ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ছোটগল্প : থাকে শুধু অন্ধকার

সাব্বির জাদিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৩, ৩ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটগল্প : থাকে শুধু অন্ধকার

রাখির ফিরে আসাটা বিস্ময়কর। রাজন তার নিজ পছন্দে বিয়ে করা স্বামী। বিয়ের আগে তারা চার বছর প্রেম করেছে। তারপর বিয়ে করেছে পরিবারের অমতে। পরিবার বলতে বাবা। রাখির মা নেই। মনে মনে বাবা রাখির জন্য একটা পাত্র ভেবে রেখেছিলেন। সেটা যদি বাবা আগে থাকতে বলতেন, রাখি হয়তো জড়াতো না রাজনের সাথে। যতদিনে জানল সে, অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সেখান থেকে ফেরত আসার কোনো সুযোগ রাখির ছিল না। সম্পর্ক তো শুধু একটা মায়া মায়া খেলা নয়। এক ধরণের চুক্তি। একসাথে থাকার কথা দেয়া-নেয়া। দায়িত্ববোধ। যেখানে জড়িয়ে থাকে দুটো মানুষের জীবন, সমান গুরুত্ব নিয়ে। বাবার পছন্দের ছেলেকে রাখি বিয়ে করতে পারেনি। বাবা কষ্ট পেয়েছেন। কষ্ট পেয়েছে রাখিও। তবু বিয়ের আট মাসের মাথায় সেই রাজনকে ডিভোর্স দিয়ে থমথমে মুখে বাবার কাছে ফিরে আসাটা খোদ ইকবাল সাহেবেরও বিশ্বাস হচ্ছে না। কোথায় যেন কিছু একটা ঘটেছে।


বাবার কাছে রাখি কিছুই বলছে না। আজ পনের দিন হয়ে গেল। এখনো সে প্রথম দিনটার  মতো বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে আছে। কখনো হেঁচকি তুলে কাঁদছে। যেটুকু খেলে কোনোভাবে বেঁচে থাকা যায়, চড়ুই পাখির দানার মতো সেটুকুই সে খাচ্ছে। এই এতকাল পর ইকবাল সাহেব স্ত্রীর অভাব তীব্রভাবে অনুভব করতে লাগলেন। রাখির মা বেঁচে থাকলে এই সঙ্কটে তিনি পড়তেন না। যে কোনো সঙ্কট মোকাবেলা করার মতো মানসিক জোর ফাতেমার ছিল। যেটা ইকবাল সাহেবের নেই। দাম্পত্যের প্রথম দিকে, তখনো রাখি আসেনি, ইকবাল সাহেবের চাকরি চলে গিয়েছিল। তার নিচের পোস্টের হারুন, ইকবাল সাহেব যার পদন্নোতির জন্য ছিল বাধা, সে ফাঁসিয়ে দিয়েছিল ইকবাল সাহেবকে, দুর্নীতির কেসে। ইকবাল সাহেবের তখন বয়স কম। মফস্বল ছেড়ে ঢাকায় এসেছেন নতুন। গায়ে গ্রাম্য গন্ধ। জানাশোনা মানুষের বৃত্ত তৈরি হয়নি। অসহায় তিনি মিথ্যা কেসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে পারেননি। ঘামতে ঘামতে ফিরে এসেছিলেন বাসায়। স্ত্রীকেও কিছু বলেননি। বলার সাহস পাননি। আগে যেমন যেতেন, প্রতিদিন সকালে তাড়াহুড়ো করে খেয়ে অফিসের পোশাক পরে বেরিয়ে যান। সারাদিন হেঁটে হেঁটে মানুষ দেখেন। বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপন পড়েন। কখনো বসে থাকেন পার্কের নির্জন বেঞ্চে। একটু দূরে, কোনো গাছের আড়ালে হয়ত শারীরিক শিল্পকলার চর্চা চলে। ইকবাল সাহেব দেখেন ভাবলেশহীন। সেই শিল্পকলা তার ভেতর কোনো কোলাহল তুলতে পারে না। এভাবে পালিয়ে পালিয়ে কদিনইবা টেকা যায়। পুরুষের চোখ হয়ত ফাঁকি দেয়া যায়। কিন্তু নারীর? নারীর চোখ, সে তো শুধুই চোখ নয়, দক্ষ আলোকচিত্রীর সতর্ক ক্যামেরা। যা বাইরের অবয়ব তো বটেই, মনোজগতের তোলপাড়ও তুলে আনে নিপুণ বিশ্বস্ততায়। ফলে দুদিন যেতে না যেতেই বদলে যাওয়া স্বামীর অছন্দিত চলাফেরায় হোঁচট খায় ফাতেমার চোখ। ইকবাল সাহেব প্রথমে কিছু স্বীকারই করেন না। কিন্তু জেরাটা যদি হয় নাছোড়বান্দা সাংবাদিকের মতো, স্বীকার না করে উপায় থাকে না। ফাতেমা একটুও ঘাবড়ান না। যোগ্য সঙ্গীর মতো কোমরে আঁচল গুঁজে তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন স্বামীর পাশে। যতদিন আরেকটা চাকরির ব্যবস্থা না হচ্ছে, বাসার পাশের এক শিশুবিদ্যালয়ে পড়ানোর দায়িত্ব নেন। সেই মানুষটা যদি আজ থাকত কাছে, রাখির জীবনের এই নতুন সঙ্কটে ইকবাল সাহেব নির্ভার থাকতে পারতেন।


কুড়ি দিন পার হয়ে যায়, স্বামী ছেড়ে আসার কোনো বৃত্তান্ত বাবাকে বলে না রাখি। ইকবাল সাহেব বোঝেন মেয়েটা অপরাধবোধে ভুগছে। শত হোক নিজের পছন্দের ছেলেকে ছেড়ে আসা। আজ যদি সে বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করত আর কোনো কারণে তাকে ত্যাগের প্রয়োজন দেখা দিত, তবে নির্দ্বিধায় সে ছেড়ে আসতে পারত। ইকবাল সাহেব সময় দেন মেয়েকে। বড় একটা ধাক্কা গেছে। সেরে উঠতে সময় লাগবে। আর গোপনে গোপনে যোগাযোগের চেষ্টা করেন রাজনের সাথে। কিন্তু তল পান না রাজনের। পঁচিশ দিনের মাথায় মুখ খোলে রাখি। রাজনকে ছেড়ে আসার কারণ তার রাগ। অল্পতেই মাথা গরম হয়ে যায় রাজনের। অথচ বিয়ের আগে এই আচরণ তার চোখেই পড়েনি। লাগামহীন রাগের কারণে পথেঘাটে প্রায়ই লজ্জার মুখে পড়তে হয়। হয়তো শাড়ি কিনতে দোকানে গেছে দুজন। দোকানি শাড়ির দাম হাঁকিয়েছে পঁয়ত্রিশশ টাকা। দরদামের পর সেই শাড়ির দাম যখন নেমে আসে চোদ্দশর নিচে, রাজন কোথায় খুশি হবে, তা না দোকানির লেজে পাড়া দিয়ে সে ঝগড়া শুরু করে। কী ব্যাপার ভাই, দেশটারে কি মগের মুল্লুক পাইছেন? এক হাজার টাকার শাড়ির দাম চান চার হাজার টাকা! আমি বলে না হয় ঠকলাম না। আরেকজনের কাছ থেকে তো ঠিকই এক শাড়িতে দুই হাজার টাকা লাভ করতেন। এইটা ক্যামন ব্যবসা আপনের!

এই কথায় দোকানির আঁতে ঘা লাগে। দোকানিও রেগে যায় রাজনের মতোই। তবে তার প্রকাশভঙ্গি নিয়ন্ত্রিত-- ভাইজান, এইটা আমাদের ব্যবসা। আপনার পোষালে নেবেন, না পোষালে নেবেন না।

প্রতিউত্তরে রাজন আরো রেগে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে রাখি টেনে ধরে তার লাগাম- আহা! বাদ দাও তো! ভাই, শাড়িটা প্যাকেট করেন।

এতক্ষণ রাজনের যে রাগ দাঁড়িয়ে ছিল দোকানির উপর, এবার সেই রাগ গড়িয়ে পড়ে রাখির উপর- কেন, বাদ দেব কেন! দোকানদার কিছু হয় তোমার যে বাদ দেব!

হা হয়ে যায় রাখি- কী বলছ কিছু টের পাচ্ছ তুমি!

টের পাব না কেন! মদ খেয়ে মাতাল হয়ে দোকানে এসেছি নাকি যে কী বলছি টের পাব না!

রাখি আর দাঁড়ায় না। রাগে ক্ষোভে দোকান থেকে বেরিয়ে সে হনহন করে হাঁটা দেয় বাসার দিকে। আর কী আশ্চর্য, মান ভাঙানো দূরে থাক, রাজন তার গতিরোধ পর্যন্ত করে না। এভাবে প্রায়ই পছন্দের জিনিসটা পড়ে থাকে দোকানে, আর তারা দুজন, স্বামী-স্ত্রী, ঝগড়া করে মরে রাস্তায় এবং বাসায়। আর এমন ঘটনার ভেন্যু যে দোকান, সজ্ঞানে সেখানে আর যাওয়া হয় না কোনোদিন। এভাবে রাখির শপিং-এর জায়গাটা ধীরে ধীরে ছোট থেকে ছোট হতে থাকে। সাথে ছোট হয় সে নিজেও, লোকের ভিড়ে।


একদিন রাজনকে ডক্তার দেখাতে বলে রাখি। মাথার ডাক্তার। তুমি যা করছ আজকাল, মাথার ডাক্তার দেখানো উচিত তোমার। সেদিন ওভার ব্রিজের সিঁড়িতে ফকিরটা খারাপ কিছু তো বলেনি। তুমি দুই টাকা দিয়েছ, ফকিরটা বলেছে, দুই ট্যাহায় কিছুই হয় না ছার। অমনি একটা ফকিরের সাথে তর্ক করতে হবে তোমার! তোমার প্রেস্টিজ নাই! গরম তেলে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ার প্রতিক্রিয়া হয়। টেস্ট ক্রিকেটে স্পিন বলে পরপর দুটো উইকেট পড়ে গেলে ফিল্ডাররা যেভাবে ঘিরে ধরে ব্যাটসম্যানকে, এক রাজন যেন একাধিক রাজন হয়ে চেপে ধরে রাখিকে। চোখ লাল করে সে বলে, কী বললে তুমি! আবার বল তো! আমি পাগল, না! আমাকে মাথার ডাক্তার দেখাতে হবে! শোন রাখি, তোমার যদি মনে হয় একটা পাগলের সাথে বাস করা তোমার সম্ভব না তবে চলে যাও।

রাখির বিরক্তি লেগে যায়। ঘেন্নাও। সে বলে কি আর লোকটা বোঝে কি! এই মানুষকে সে কী দেখে ভালোবেসেছিল! এতকিছুর পর তার সাথে বসবাস অসম্ভব। সব শুনে বাবা আদরের হাত রাখেন মেয়ের মাথায়। বলেন, মন খারাপ করিসনে, মা। যা হবার তা হয়েছে। দেখেশুনে খুব নরোম-সরোম একটা ছেলের সাথে তোর বিয়ে দেব আবার।


দ্বিতীয় স্বামীর বেশে নরোম-সরোম যে ছেলেটা রাখির জীবনে আসে, তার নাম হাসান। হাসানের কোমল ব্যবহারে রাখি একেবারে মুগ্ধ হয়ে যায়। সংসারের যাবতীয় কাজে রাখির যা সিদ্ধান্ত, তা-ই হাসানের সিদ্ধান্ত। রাখির কোনো কাজেই হাসানের দ্বিধা নেই, আপত্তি নেই। এমনকি সঙ্গমের সুখ- সেখানেও রাখির একচ্ছত্র আধিপত্য। প্রয়োজনের রাতে সে হাসানকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলে। আবার অপ্রয়োজনের রাতে তাকে সরিয়ে রাখে একপাশে। হাসান যেন তার পোষা ঘোড়া। ইচ্ছামতো সওয়ার হওয়া যায়। আস্তাবলে বেঁধেও রাখা যায়। এমন অনুগত ঘোড়া পেয়ে রাখি সুখী। সুখের আধিক্যে সে বাবাকে ফোন করে জানায়- এমন একটা ছেলেরই আমার দরকার ছিল। তোমাকে থ্যাংকস, বাবা।

এক বিকেলে সিঁড়ির মুখে দেখা হয় পাশের ফ্ল্যাটের ভাবির সাথে। ভাবি সেজেগুজে কোথায় যেন বেরুচ্ছে। হাই হ্যালোর পর চেহারায় বিস্ময়ের রং এনে ভাবি বলে, তোমার জামাইটা যেন ক্যামন। পুরুষ মানুষ এতো ভ্যাদা হলে চলে!

রাখির ভুরু কুঁচকে যায়- কী হইছে ভাবি?

তেমন কিছু না। সেদিন রিকশা করে ফিরছিলাম বাজার থেকে। গেটের মুখে নামব। ওই সময় তোমার জামাই বেরোচ্ছিল বাসা থেকে। গেট দিয়ে বেরোতেই রিকশার মুখোমুখি। গতি ছিল রিকশার। থামাতে থামাতে সামনের চাকা ছুঁয়ে গেল তার প্যান্টে। হেই রিকশাওয়ালাকে কিছু না বলে হাত দিয়ে প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে নেমে পড়ল রাস্তায়। জানো, রিকশাওলারই দোষ। বাসার গেটের মুখে সে অত জোরে চালাবে কেন! তিতলির আব্বু হলে থাপ্পড়ে ওই ব্যাটার কান লাল করে দিতো। পরে আমিই একটু বকলাম। অথচ তোমার পুরুষটা কিচ্ছু বলল না। এই যুগে এমন ব্যাটাছেলে তো দেখা যায় না!

রাখি জোর করে হাসি এনে বলে, আসলে ভাবি, হইছে কি, ও অমনই। রাগ টাগ নাই।

রাগ ছাড়া পুরুষ মানুষ, সে আবার ক্যামন পুরুষ মানুষ! ভাবি বেরিয়ে যায় স্যন্ডেলে শব্দ তুলে। কিন্তু তার কথাগুলো ঢুকে যায় রাখির মনে। তারপর থেকে সে খেয়াল করতে থাকে কোথায় কোথায় হাসানের রেগে ওঠা উচিত অথচ রাগে না। দুজন শপিংমলে যায় একবার। রাখির শাড়ি আর হাসানের শার্ট প্যান্টের কাপড় কিনতে। তারা অনেকক্ষণ ধরে বসে আছে। দোকানি অন্য কাস্টমার নিয়ে ব্যস্ত। হাসান মৃদু স্বরে দোকানির দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু সেই চেষ্টা এতটাই ম্রিয়মান, প্রায় গা-ঘেঁষে বসা রাখিও টের পেত না যদি না সে স্বামীর উপর নজর রাখত। দোকানি যথারীতি তাদের পাত্তা দেয় না। এমনকি তাদের পরে আসা কাস্টমাররাও যখন দোকানির সাথে দরদাম শুরু করে দেয় আর তারা বসে থাকে বিরস মুখে, তখন এক ঝটকায় হাসানের হাত ধরে বেরিয়ে আসে রাখি, দোকান ছেড়ে। বিব্রত হাসান সামলে নিয়ে বলে, এটা কী করলে রাখি! ওদের না বলেই চলে আসাটা কি ঠিক হল!


রাখি সেদিকে যায় না। রাজনের রাগ যেন ভর করেছে তার উপর। চিবিয়ে চিবিয়ে সে বলে, তুমি কেমন পুরুষ এ্যাঁ! আমাদের পরে এসে সবার কেনাকাটা হয়ে যায় আর তুমি ম্যান্দা মাইরে থাকো!

হাসান একটুও মাথা গরম না করে বউকে পরিস্থিতি বোঝানোর চেষ্টা করে- ওদের হয়ত তাড়া আছে তাই অমন তাড়াহুড়ো করছে। আমাদের তো তাড়া নেই। একটু দেরি হলে কী সমস্যা! বাসায় গিয়ে সেই বসেই থাকতে হবে। আর দেখছিলেই তো, দোকানে কত ভিড়। তারা কয়দিক সামলাবে!

থাক, আর অজুহাত দ্যাখায়ো না। মানুষ ঠ্যাঙানোর মুরোদ নেই তোমার, তা বলবা না। খালি অজুহাত।

আরেকবার ফুটপাত ধরে হাঁটছিল দুজন। পাশের চায়ের দোকান থেকে এক ছেলে শিস দিলো রাখিকে। রাখি দাঁড়িয়ে পড়ে ছেলেটাকে দেখে নিলো। তারপর তাকালো হাসানের দিকে। তার ইচ্ছা হাসান ছেলেটার গালে একটা থাপ্পড় দিক। থাপ্পড় না হোক অন্তত একটা ধমক দিক। কিন্তু হাসান সেসবের কিছুই করে না। সে বউয়ের হাত ধরে তাড়াতাড়ি জায়গাটা পেরিয়ে আসে। রাখি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, কিছু বললে না যে!

কী বলব?

বারে! বখাটেরা তোমার বউকে টিজ করবে আর তুমি কিছু বলবে না!

টিজ করল কই! একটা শিসই তো বাজিয়েছে। ও কিছু না।


ফেসবুকে এক ছেলের সাথে পরিচয় হয়েছে রাখির। বয়সে রাখির ছোট। মাত্র টেনে পড়ে। ইনবক্সে আপু আপু করে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। রাখির ছোট ভাই নেই। ছেলেটার মনে যা-ই থাক, তার এই আপু আপু করাটা রাখির ভালো লাগে। সেও প্রশ্রয় দেয় ছেলেটাকে। মোবাইল নাম্বার নিয়ে এক রাতে রাখিকে ফোন করে সেই ক্লাশ টেন। ওরা মাত্রই শুয়েছে। সাংসারিক দু’ চারটা ছেঁড়া ছেঁড়া কাথার পর ঘুমিয়ে যাবে। তখন ফোন। রাখি অভ্যাসবশত মশারি থেকে বেরিয়ে বারান্দায় যায় কথা বলতে। বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে সাত মিনিট তেরো সেকেন্ড কথা বলে ছেলেটার সাথে। ফিরে এসে মশারিতে ঢুকে দেখে হাসান তখনও জেগে। গেম খেলছে মোবাইলে। রাখির কেমন অস্বস্তি হয়। হাসান নিশ্চয় এই ফোনকল নিয়ে সাত-পাঁচ অনেক কিছু ভাবছে। কিন্তু এই নিয়ে একটা কথাও সে বলবে না। হাসানের স্বভাব রাখির জানা। রাখির জীবনের কোনো অধ্যায়ই সে ঘেঁটে দেখে না। তবে এই মুহূর্তে রাখি কামনা করছে, হাসান যেন তাকে ঘাঁটে। ফোনকল নিয়ে প্রশ্ন করে। তাহলে খটকা দূর হবে হাসানের। কিন্তু হাসান বরাবরের মতোই ভাবলেশহীন। তার এই ভাবলেশহীনতা রাখির অস্বস্তিকে আরো ঘন করে তোলে। সে তখন নিজ থেকে বলতে উদ্যোগী হয়। তাতে হাসানের মনের সন্দেহের মেঘ যদি কাটে। সে বলে, রিফাত নামের একটা ছেলে ফোন করে....। রাখির বাক্য শেষ হয় না। তার আগেই তাকে থামিয়ে দেয় হাসান- কে ফোন করেছিল আমি শুনতে চাইনি রাখি।


মশারির ভেতর রিফাত নামটা উচ্চারিত হওয়ার পর এই যে থেমে যাওয়া- এতে রাখি যে শঙ্কাটা করছিল তা আরো পোক্ত হয়ে যায়। এরচেয়ে বরং চুপ থাকাই ভালো ছিল। রাগে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে ওঠে তার। এই রাগ তার স্বামীর উপর না নিজের উপর বুঝতে পারে না। ক্রদ্ধ সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করতে করতে সে পাশ ফিরে শোয়। এর একটু পরেই ভেসে আসে হাসানের নাকের গর্জন। লোকটার এই নির্বিকারত্ব, ঘুমিয়ে পড়া, অসহ্য লাগে রাখির। এমন একটা রসহীন, রাগহীন মানুষের সাথে এক মশারিতে শোয়া- কেমন ঘেন্না ঘেন্না লাগে। তাড়াতাড়ি মশারি ছেড়ে বেরিয়ে সে বারান্দায় যায়। গ্রিলের ওপাশে রাতের ঢাকা জড়াজড়ি করে শোয়া, হাসানের মতোই উদাসীন। অনেক রাত পর্যন্ত গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে রাখি। রাজনের কথা মনে পড়ে। একটুখানি ঝগড়ার জন্য সে কাতর হয়ে ওঠে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ অক্টোবর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়