ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

রম্য গল্প

গরু বিদায় || সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ২৬ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গরু বিদায় || সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

অকৃতদার মন্টু মামা তার জীবনের অকৃত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কর্মটির অর্থাৎ বিবাহের দ্বার রুদ্ধ করার আগে আমাদের শেষ চেষ্টায় সম্মতি জানিয়েছিলেন। সে বছর কুড়ি আগে, তখন তিনি মধ্য চল্লিশে। আমাদের দেখা পাত্রী মধ্য তিরিশে। যোগাযোগ ভালো, যোগ-বিয়োগটাও ভালো। কিন্তু মামা বললেন, ‘নাহ্, হবে না।’

‘কেন, কী সমস্যা? পাত্রী তো নমস্যা।’ কিন্তু মামা অনড়। আমাদের গুণগান শুনে বললেন, ‘সমস্যাটা ওইখানেই। তোমরা তো পাত্রী দেখছ না, গরু দেখছ। ছিঃ এই নারী জাতির জন্য অপমান।’ অবশ্য আসল কারণটি মামা সংগোপনে বলেছিলেন, ‘সংসার ধর্ম আমার জন্য নয়। সংসারে পুরুষরা সং, নারীরাই সার। তারা নাকে দড়ি ধরে ঘুরায় পুরুষদের। ঘানির গরুর মতো।

আবারো গরু! এবার মামার বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত পুরুষ জাতির সম্মান রক্ষার নিমিত্তে।

মামার মনস্তত্ব বরাবরই জটিল, জটপাকানো। তার ব্যাখ্যায় না গিয়েও দুটো জিনিস পরিষ্কার হলো আমাদের কাছে : এক. তার জন্য কনে দেখা অভিযানে ইতি টানতে হবে এবং দুই. গরু দেখা ভারি মন্দ জিনিস। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে সেই গরু দেখা কর্মই হাতে নিলেন মামা, মন্দ জেনেও। বকরি ঈদ তার সঙ্গে উদযাপনের আমন্ত্রণ জানালেন আমাদের এবং ঘোষণা দিলেন তিনি পশু কোরবানি দেবেন। আমি বললাম, ‘তুমি বকরি না গরু, মামা?’

মামা হুংকার তুলে বললেন, ‘আমি কোনোটাই না, আমি কিছু ছাগলের মামা।’ তারপর ভাগ্নেবাহিনীকে নিয়ে মার্চ করে রওনা দিলেন শেখঘাটের গরুহাটা উদ্দেশে, গরু কেনার অভিলাষে।

বিরাট গরুর হাট। বিরাট গরুগুলি চোরাচালানিরা ভারত থেকে এনেছে বর্ডার দিয়ে, বাকিগুলো শহরের আশপাশ থেকে অর্ডার দিয়ে। নৌকা ও ট্রাক সহযোগে। গরুর নৌযাত্রা খুব কষ্টকর দৃশ্য। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর গরুগণ পানি পানের জন্য গ্রীবা নামায়, কিন্তু পানি থাকে নাগালের বাইরে। সে তুলনায় তাদের ট্রাক যাত্রা অনেক বেশি সহনীয়। দার্শনিকও, যেহেতু গরুগণ ঊর্ধ্বপানে তাকিয়ে থাকে অধিক সময়। প্রচুর গরু, প্রচুর গরুবর্জ্য। সেগুলো সামলে হাঁটছি। একটা কোমল গো-মলময় গন্ধ বাতাসে। আর প্রচুর হাম্বাধ্বনি। আমরা একটার পর একটা গরু দেখছি, কিন্তু মামার পছন্দ হচ্ছে না। স্বাস্থ্য পছন্দ হলে রং পছন্দ হয় না। রঙে সমস্যা না থাকলে দাঁতে ত্রুটি খুঁজে পান। এক উন্নত শ্রেণীর গরু পছন্দ হলো কিন্তু লেজটা পছন্দ হলো না মামার। বিক্রেতা রাগ করে বলল, ‘নিজের লেঙ্গুর কাটিয়া লাগাই দিওন।’ শেষ মেষ এক গরুর দাম জিজ্ঞেস করলে বিক্রেতা বলল, ‘সাত।’ মামা বললেন, ‘চার।’ বিক্রেতা বলল, ‘আস্তে, গরুয়ে হুনলে হাসব’। কিন্তু গরু হাসল না। সে বরং কাঁদল। তার চোখে জল। জলময় চোখে প্রবল এক আর্তি নিয়ে তাকাল সে মামার দিকে। ছয়ে রফা করে মামা গরুর মালিকানা অর্থাৎ গলার সঙ্গে লাগানো রশিটা গ্রহণ করলেন। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। গরুটাও। তবে ভিন্ন ভিন্ন কারণে। আমরা গরুটা কেনার জন্য পাঁচ ঘণ্টা নষ্ট করেছি। আর গরুটা বিক্রীত হওয়ার জন্য পাঁচ মাস অপেক্ষা করেছে। নিষ্ঠুর মালিক, সারা গায়ে ছ্যাঁকা দিয়ে নাম্বার টাম্বার লিখেছে। খেতে দেয়নি, শেষ দিনটা ছাড়া।

মামা বললেন, ‘চল।’ কিন্তু গরু হাঁটতে রাজি নয়। বনেদি ভাবধারার গরু, ট্রাক চায়। কিন্তু মামা অপচয় করেন না। হেঁটেই যাবেন, লেট হলেও। অগত্যা গরুকে রাজি হতে হলো। মামার বাসা কুমারপাড়ায়। তার কুমারত্বের সুবাদে পাড়ার নাম হয়েছে ‘চিরকুমার পাড়া’। গরুর জন্য এমন কিছু দূরত্ব নয়, কিন্তু গরু প্রথম থেকেই গররাজি। গরগর করতে করতে রওনা হলো। দৃশ্যটা বেশ মধুর : মামা টেনে নিয়ে যাচ্ছেন গরুকে। গরু টেনে রাখতে চাইছে মামাকে। আমরা উৎসাহ দিচ্ছি গরুকে- না, টেনে রাখতে না, পা চালাতে। মামা ইতিমধ্যে গরুর একটা নাম দিয়েছেন, সুনেত্রা। আয়ত, বিশাল এবং গভীর দুই নেত্র, খুবই প্রকাশপ্রবণ। মামার অপত্য স্নেহ জাগ্রত হয়েছে গরুকে কেন্দ্র করে। লক্ষ্মী মেয়ে, একটু পা চালা। কিন্তু লক্ষ্মী মেয়ের অনিচ্ছাভাব দূর হয় না। তাতে মামা বেত দিয়ে একবার তার পিঠে মৃদু আঘাত করলেন। আর তাতেই তার আঁতে ঘা লাগল। ভদ্র নম্র গরু রেগে গিয়ে মামার পেটে গুঁতো মারল। মামার মধ্যপ্রদেশ আবার বেশ সমৃদ্ধ। কাজেই গুঁতোটা তেমন প্রভাব রাখল না। কিন্তু ক্রুদ্ধ হয়ে চপেটাঘাত করলেন সুনেত্রাকে। আর সুনেত্রা হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে বিশাল অভিমানী দুই চোখ মেলে তাকাল মামার দিকে। মামা যেন খুব লজ্জিত হলেন। প্রচুর দুঃখিতও হলেন। গলা জড়িয়ে ধরে নিলেন সুনেত্রাকে, ‘আই অ্যাম সরি, মাই বেবি।’ কিন্তু বেবি মামার এই আচরণে পরিতৃপ্ত হলো না। মাথা দিয়ে বরং একটা গুতো মারল মামাকে, এবার পশ্চাৎদেশে। মামা কুপোকাৎ হলেন, পড়লেন গিয়ে নালায়। সেই নালায় ক্ষীণ ধারায় কিছু তরল পদার্থ প্রবাহিত হচ্ছিল। তবে তা পানি ছিল না। ছিল... যাক গে। মামাকে পতিত অবস্থা থেকে উদ্ধার করাটাই প্রথম কর্তব্য। কিন্তু মামার হাত থেকে সুনেত্রার দড়ি ফসকে গেলে সে দৌড় লাগাল। তাকে আর পাওয়া গেল না। তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য! সারা গায়ে ইয়ে মাখা মামা। পেছনে আমরা, আমাদের পেছনে টোকাই, লোকাল লোকজন, চানাচুরওয়ালা, ট্রাফিক পুলিশ। হৈ চৈ পড়ে গেল পাড়াময়। অলিগলি, পুকুর, বনসূলী, বসতবাটি, উঠোন, রান্নাঘর, দোকান, নর্দমাÑ সব খোঁজা হলো। কোনো জায়গা বাদ পড়ল না। কিন্তু সুনেত্রা নেই। যেন আকাশ থেকে কেউ এসে তুলে নিয়ে গেছে তাকে।

সুনেত্রাকে হারিয়ে মামা প্রথমে রাগ করলেন। বললেন ‘গরুটাকে নিজের হাতে জবাই করব।’ পরে মন খারাপ করলেন। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। রাতে ঘুমোতে পারলেন না। স্বপ্নে দেখলেন সুনেত্রা ফিরেছে। কিন্তু জেগে উঠে রবীন্দ্রনাথের রাইচরণের মতো হাহাকার করলেন, নেই, কোথাও নেই।

ছোট শহর। জানাজানি হতে দেরি হলো না। ভোর থেকে সর্বদলীয় সমবেদনা জানানো শুরু হলো। পুলিশ বলল, সুনেত্রাকে তারা খুঁজে বের করবেই। যুগভেরির সংবাদদাতা জিজ্ঞেস করলেন, ‘সুনেত্রাকে হারিয়ে এ মুহূর্তে আপনার কী অনুভূতি?’

গেল সারাদিন। পরের দিন ঈদ। ভোরবেলা কসাই এসে উপস্থিত। ভুল করে কসাইয়ের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করা হয়নি। সে হারানো বৃত্তান্ত শুনে বলল, ‘স্যরি আমার ফুল পেমেন্ট দিতে হবে।’ এতে মামার কষ্ট বাড়ল। তবে আমাদের একটু স্বস্তিই লাগছিল। জবাই করা, মাংস বিলি করা-  এসব কঠিন কাজ। কিন্তু সকলকে অবাক করে হঠাৎ সুনেত্রা এসে হাজির! তাকে টেনে এনেছে এক লোক, হতদরিদ্র ধরনের। ঈদের দিনেও ছেঁড়া কাপড়-চোপড়। লোকটার গা ঘেঁষে সুনেত্রা দাঁড়াল, লোকটা হাত বুলাতে থাকল সুনেত্রার গায়ে।

লোকটা : গতকাল আপনার গরুটা লুকিয়ে রেখেছিলাম।

মামা : খুবই অন্যায় কাজ করেছেন ... তা খেতে দিয়েছেন?

লোকটা : জি, খড় বিচালি, ঘাস। নর্মাল খাবার, যা খেলে ম্যাডকাউ ডিজিজ হয় না।

মামা : পানিটানি?

লোকটা : যথেষ্ট

মামা : ঠিক আছে, তা কী করেন?

লোকটা : স্টেশন ক্লাবের দারোয়ান ছিলাম, আর্লি রিটায়ার করেছি। দরিদ্র।

মামা : জমিজমা আছে?

লোকটা : না, একটা ঘর ছিল খাদিমনগরে। ঘরের সঙ্গে বাঁধা ছিল একটা গাই। মইজুদ্দিনের ছেলেরা দুটোই পুড়িয়ে দিল।

মামা সুনেত্রার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। সুনেত্রার চোখ জলময়। আগের রাগ নেই। কোমল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মামার দিকে। মামা তার গায়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।

লোকটা মামাকে বলল, ‘ওকে দেখে আমার আঞ্জুমানের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল স্যার। অপরাধ নেবেন না।’

আঞ্জুমান তার সেই প্রয়াত গাই। মামা উত্তেজিত হয়ে গেলেন হঠাৎ, বললেন, ‘যান, একে নিয়ে যান। গো। আর আসবেন না। ডোন্ট কাম ব্যাক।’

মামার বকা খেয়ে লোকটা সুনেত্রাকে নিয়ে রওনা দিল। কিন্তু যাবার আগে সুনেত্রা এক হেভি লুক দিল মামাকে। অবিশ্বাস্য নেত্রপাত! যেন শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে। তার চোখে পানি।

মামার চোখেও।

 

অলঙ্করণ: সামুরাই মারুফ




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ আগস্ট ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়