ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ফিরোজ আশরাফ: জনপ্রিয় একজন, নিভৃত একজন

কবি স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৩, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফিরোজ আশরাফ: জনপ্রিয় একজন, নিভৃত একজন

স্বরলিপি: ফিরোজ আশরাফ নব্বইয়ের দশকের জনপ্রিয় লেখক-ঔপন্যাসিক-অনুবাদক। তার পাঠকপ্রিয়তা এমন উচ্চতায় পৌঁছেছিলো যে, ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত গ্রন্থমেলায় তার নামে একক বুকস্টল দিতে হয়েছিল। নাম ছিল-‘ফিরোজ আশরাফ একক বই স্টল’। ওই সময় কী লিখতেন পাঠকপ্রিয় এই লেখক?

তার লেখার মূল উপজীব্য ছিল বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মানুষের মানবিক সম্পর্ক। প্রেম সম্পর্কে ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতার কথা জানতে চাইলে লেখক বলেন, প্রেমের সূত্র ধরেই লেখলেখিতে আসা। উচ্ছল তারুণ্যের জীবন যখন ব্যাকরণের বাইরে চলে, তখন ঘটনা পরিক্রমায় এক মেয়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। কিন্তু তাকে প্রপোজ করার সাহস তার ছিলো না। তিনি জানতে পারলেন সেই মেয়ে বই পড়তে ভালোবাসে। তিনি ভাবলেন, যে বই ভালোবাসে, সে লেখককেও ভালোবাসবে। এই প্রেরণা থেকেই তিনি লেখালেখিতে ঝুঁকে পড়েন। এরপর ফিরোজ আশরাফকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ভালোবাসার মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য কলম হাতে তুলে নিলেন তিনি। গল্প লিখতে গিয়ে লিখে ফেললেন উপন্যাস। লেখালেখির সেই শুরু। প্রথম উপন্যাসের নাম: ‘বেদনার নীল আকাশ’।

লেখা শেষ হওয়ার পর প্রকাশ করার পালা। এক বন্ধুর সঙ্গে পাণ্ডুলিপি নিয়ে তিনি চলে গেলেন বাংলাবাজার। শিরীন পাবলিকেশন্স-এর প্রকাশক তার পাণ্ডুলিপি গ্রহণ করেছিলেন। শর্ত ছিল- পড়ে যদি ভালোলাগে তাহলে তিনি ছেপে প্রকাশ করবেন। ফিরোজ আশরাফ এরপর শুধু যোগাযোগের ঠিকানা রেখে সেদিন চলে এসেছিলেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগে পড়েন। থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলে। প্রকাশক একদিন সেই হলে হাজির হলেন। তখন সকালের আলো ছড়াচ্ছিল, হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ফিরোজ আশরাফ। প্রকাশকের উপস্থিতি তাকে সেদিন ভীষণ অবাক করে দিয়েছিল। এরপর বই প্রকাশ হলো। কিন্তু ভালোবাসার প্রকাশ আর হলো না। কেননা ততদিনে মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। ফিরোজ আশরাফ সাময়িক হতাশ হলেও সাহিত্য ভালোবেসে ফেললেন। যদিও গল্প, উপন্যাসে বারবার ফিরে এসেছে তার ভালোবাসার প্রিয় মানুষ, তার ছায়া হয়ে, অনুপ্রেরণা হয়ে। প্রিয় সেই মুখ জীবনের সঙ্গে না থেকেও থেকেছেন তার প্রতিটি অক্ষরে, অবলীলায়।

বইটি পরবর্তীতে দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়। ফিরোজ আশরাফ জয় করে নেন অগণিত পাঠকের ভালোবাসা। প্রকাশকদের কেউ কেউ অগ্রীম রয়ালিটি নিয়ে হাজির হন ফিরোজ আশরাফের কাছে। গ্রন্থমেলার গণ্ডিতে নয়, তার বই প্রকাশ হতে থাকে তখন বছরজুড়ে। লেখা শুরু করার পর, লেখার টেবিলে তিনি যেন হয়ে উঠলেন নিয়মিত একজন। প্রতিদিন কমপক্ষে এক হাজার শব্দ লেখার ইচ্ছা পোষণ করতেন আর সেভাবেই লিখতেন। সেসময়ের কথা জানতে চাইতেই তিনি নিজেকে তুলনা করলেন একজন কারিগরের সঙ্গে। বললেন, ভাস্কর্য গড়তে হলে তার গড়ন কেমন হবে, কি রং দিয়ে সাজানো হবে তা ঠিক করবেন কারিগর নিজে। একজন লেখকও তার ব্যতিক্রম নন। লেখক অভিজ্ঞতা লিখবেন, পর্যবেক্ষণ লিখবেন। নিজের সাহিত্য দর্শন জানাতে গিয়ে ফিরোজ আশরাফ বললেন, যেটা বাস্তবতা সেটাকে বাস্তবতার মতো করে তুলে ধরা, যেটা সত্যি সেটাকে সত্যির মতো করে বলতে চওয়া। এর বাইরে গিয়ে তেমন কিছু চিন্তা করিনি’। সামাজিক বাস্তবতা, অর্থনৈতিক বাস্তবতা, পারিপার্শ্বিকতা, পারস্পরিক সম্পর্ক-রসায়ন, টানাপোড়েন; এসব থেকে ছেঁকে লেখার বিষয় নির্ধারণ করেন তিনি। আর এভাবেই কলমের সঙ্গে গড়ে ওঠে তার সখ্য।

কারণটা বলছি। তার আগে বলে নেই- ফিরোজ আশরাফের অনুবাদের বই পড়েননি, অন্ততপক্ষে নাম শোনেননি এমন পাঠক পাওয়া কঠিন। ফিরোজ আশরাফ-এর অনুবাদের বই ‘আশি দিনে বিশ্ব ভ্রমণ’ পৌঁছে গিয়েছে অসংখ্য পাঠকের টেবিলে। এই অনুবাদক মনে করেন অনুবাদ বিষয়টি মূল লেখার থেকেও কঠিন। কারণ হিসেবে যুক্তি দেখালেন- আমি যখন মৌলিক লেখা লিখি তখন আমি আমার মতো করে লিখি। সে বিষয়ে কারও কিছু বলার নেই। কিন্তু অনুবাদ করতে গিয়ে অন্য আরেকজন লেখকের লেখা বঙ্গানুবাদ করলেই হচ্ছে না। লেখক কি বোঝাতে চেয়েছেন, প্রথমত সেই বিষয় খুঁজে বের করতে হবে। প্রত্যেকটা ভাষায় নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে। অনুবাদ করতে গিয়ে আমার ভাষার যে সীমাবদ্ধতা সেটা মাথায় রেখে উপস্থাপন করতে হয়। অনুবাদকর্মকে তিনি কঠিন মনে করলেও, এর সঙ্গে তার সম্পর্ক নিবিড়।


বিদেশি আলোচিত বইগুলো পাঠ্যতালিকায় রাখতে পছন্দ করেন ফিরোজ আশরাফ। পড়তে পড়তেই এক সময় চিন্তা করলেন ভালোলাগার বইটি নিজের ভাষায় উপস্থাপন করবেন। আর অনুবাদ করতে গিয়ে মনে করলেন-বই আমাদের দেশের মানুষের কাছে সহজপাঠ্য হিসেবে তুলে ধরবেন। শিশুতোষ বই অনুবাদ প্রসঙ্গে ফিরোজ আশরাফ মনে করেন- শিশুদের নিজস্ব শব্দভাণ্ডার আছে। মূল বইয়ের লেখক কি বলতে চেয়েছেন সেটা ঠিকঠাক মতো শিশুদের ভাষায় রূপান্তর করতে হয়। কীভাবে লিখলে শিশুদের জন্য উপভোগ্য আর গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে অনুবাদ করার সময় এসব বিষয়কে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন।

ফিরোজ আশরাফের বইয়ের বিজ্ঞাপনের ভার নিয়েছেন স্বয়ং পাঠক। একজন আরেকজনের কাছে বইটি পৌঁছে দিয়েছেন। ফিরোজ আশরাফের বই কখনো কখনো হয়ে উঠেছে প্রেম প্রস্তাবের প্রতীক। এমন গল্পও শোনালেন তিনি। লেখা তাকে অসীম ভালোবাসার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলে তার নামে এতো চিঠি আসতো যে, তিনি পড়ে শেষ করতে পারতেন না। চিঠি লেখকদের অধিকাংশ ছিলো নারী। নারী হৃদয়ের আবেগজড়িত সেই সব অক্ষরমালা ফিরোজ আশরাফের অনেক লেখার রসদ জুগিয়েছে-স্বীকার করলেন তিনি। কৃতজ্ঞতা জানাতেও ভুললেন না। এও বললেন যে ‘আমি যে খুব বই পড়ে লিখতে এসেছি, নট দ্যাট’। লেখাটা তার কাছে মালাগাঁথার মতোও। গ্যাপ দিয়ে-দীর্ঘ সময় নিয়ে লেখতে হবে এমনটা তিনি মনে করেন না।

ফিরোজ আশরাফ ভক্ত পাঠিকাকে বিয়ে করে ঘর বেঁধেছেন। সংসারে-চাকরিতে হয়েছেন নিয়মিত একজন। অন্যদিকে লেখার সঙ্গে কমেছে সখ্য, বেড়েছে দূরত্ব। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘লেখক হওয়ার জন্য লিখতে আসিনি। তবে একটা সময় ছিলো, লেখা থেকে যে রয়ালিটি পেতাম তাই দিয়ে চলতাম। একটা কথা না বললেই নয়, এখানে সব প্রকাশক এক রকম না। তারা স্বচ্ছ আচরণ করেন না। একজন প্রকাশক অস্বচ্ছ আচরণ করতে শুরু করলে লেখকের খুব বেশি কিছু করার থাকে না। আমি দেখেছি, আমার বই রি-প্রিন্ট করা হয়েছে কিন্তু আমাকে বলা হয়নি। আমি অতটা কমার্শিয়াল আচরণও কারো সঙ্গে তেমনটা করতে পারিনি। অনেক ভালো প্রকাশকও পেয়েছি যারা বাসায় এসে রয়ালিটি দিয়ে গেছেন। তারপরও মনে হলো, লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নেয়া সম্ভব নয়।’

বর্তমানে তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ইউনিট হেড এবং হিউম্যান রিসোর্স হিসেবে কর্মরত। দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে সাজানো সংসার। কেবল লেখার টেবিলেই তিনি এখন অনিয়মিত। একথা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘বসলেই লেখা হয় কিন্তু লিখতে বসা নিয়মিত হয় না। কয়েকটা লেখা আমার হাফডান হয়ে আছে। আমি অল্প সময় দিলেই শেষ হয়ে যাবে। আমেরিকা নিয়ে একটা ভ্রমণ কাহিনি লিখছি। ‘ভিয়েতনামের মেয়ে’ নামে একটা উপন্যাস অর্ধেক শেষ হয়েছে। মাঝে মাঝে ভাবি- লেখাতে নিয়মিত সময় দেবো কিন্তু হয় না।’ তারপর জানতে চাওয়া- জনপ্রিয়তা, তারপর একদিন হুট করে হারিয়ে যাওয়া- কেন হয় এমন? ফিরোজ আশরাফ বলেন, ‘আমার চোখের সামনেই এমন দেখেছি। তারা লেখাটা সিরিয়াসলি নেননি বলেই হয়তো এমন হয়েছে। জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে হলে ধারাবাহিকতা জরুরি।’

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়