ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ফ্রানৎস কাফকার চারটি অণুগল্প

ফজল হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪৩, ৪ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফ্রানৎস কাফকার চারটি অণুগল্প

[বিশ্ব সাহিত্যে যেসব কথাসাহিত্যিক অণুগল্প বা ফ্লাশ ফিকশন লিখে কিংবদন্তি হয়েছেন, তাদের মধ্যে ফ্রানৎস  কাফকা অন্যতম। তবে তিনি শুধু অণুগল্প লেখক হিসেবে অনন্য নন, ছোটগল্প এবং উপন্যাসেও তাঁর স্বকীয়তার ছাপ দেখা যায়। প্রচলিত গল্প বলার ঢং তিনি উপেক্ষা করে নিজস্ব ঢঙে অবলীলায় গল্প বলে গেছেন। তাঁর লেখায় ভাষার জৌলুস নেই, নেই কোনো সনাতন রীতি-নিয়ম, বরং তাঁর সাহিত্যকর্মে চিন্তা-চেতনায়, দর্শনে এবং কাঠামো ও আঙ্গিকে নতুনত্বের উপস্থিতি দেখা যায়। বলা হয়, তাঁর গল্প বা উপন্যাস সহজেই অনুধাবন করা যায় না। অনূদিত অণুগল্পগুলিও এসব গুণের বাইরে নয়। কাফকা অসংখ্য অণুগল্প লিখেছেন। সেখান থেকে মাত্র চারটি অণুগল্প পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো। গল্পগুলোর পটভূমি ও বিষয়বস্তু আলাদা এবং আবেদন সর্বকালীন।
‘প্রত্যাখ্যান’ গল্পটিতে লেখক স্মৃতির ঝাপি খুলে ধরেছেন। কোনো এক সময় তিনি এক অপ্সরীকে তাঁর সঙ্গী হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। লেখক অধিবক্তা হয়ে কাল্পনিক সংলাপের মাধ্যমে দু’জনের প্রতি দু’জনের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন। মেয়েটি অধিবক্তার বাহ্যিক দিকের নেতিবাচক মন্তব্য করে, অথচ অধিবক্তা মেয়েটির বাহ্যিক দিকের ভূঁয়সী প্রশংসা করে। গল্পের শেষ বাক্যে অধিবক্তার মহত্ব প্রকাশ পায়।
‘পোশাক-পরিচ্ছদ’ গল্পটিতে লেখকের চমকপ্রদ, কিন্তু প্রচণ্ড গভীর দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায়। সবাই জানি, ফ্যাশন একসময় পুরনো হয়ে যায়, নতুন পোশাকও হয় পুরাতন, কিন্তু তারপরও সবাই ফ্যাশন সচেতন, এমনকি চেহারা নিয়েও অনেকে বড়াই করেন। অন্যদিকে ‘ট্রামে’ গল্পটিতে একজন সাধারণ মানুষ দু’চোখে যা দেখে এবং যেভাবে পর্যবেক্ষণ করে, তারই স্বভাবজাত চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ‘পরিত্যাগ’ গল্পটি আয়তনে খুবই ছোট, কিন্তু বক্তব্যে অত্যন্ত ভারী। গল্পের মূল বিষয় হলো প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে কিছু নিজস্ব সময় কিংবা বিশেষ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, যখন সেই মুহূর্ত সে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চায় না।
অণুগল্প চারটি ইংরেজিতে প্রকাশিত ‘দ্য কমপ্লিট স্টোরিজ অব ফ্রানৎস কাফকা’ গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে। গল্পগুলি জার্মান ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন ভিলা ও এডুইন ম্যুইর। সেখান থেকে বাংলা তরজমা করেছেন ফজল হাসান​]


 

প্রত্যাখ্যান
অতি সুন্দরী এক মেয়ের সঙ্গে যখন আমার মোলাকাত হয়, তখন আমি বিনয়ের সুরে তাকে বলি : ‘আমার সঙ্গে আসতে হলে তোমাকে খুবই ভালো হতে হবে।’ 
মেয়েটি একটি কথাও না বলে আমার পাশ কেটে চলে যায়। আসলে সে আমাকে এ কথাটাই বলতে চেয়েছে : ‘তুমি বিখ্যাত নামের কোনো অভিজাত ব্যক্তি নও, তোমার শারীরিক আকৃতি আমেরিকার আদিবাসীদের মতো প্রশস্ত নয়, তোমার চোখের তারায় বিষণ্ণতার ছায়া এবং তোমার শরীরের চামড়া যেন বৃক্ষহীন তৃণভূমি, যার বুক চিরে চিকন ধারায় বয়ে যায় নদীর স্রোত। যদিও আমি হদিশ জানি না, তবে যেখানেই সাগরের অস্তিত্ব থাক না কেন, তুমি কখনই সাত-সাগর পাড়ি দাওনি। তাহলে কেন তোমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য আমার মতো একজন সুন্দরী মেয়েকে শিকার নির্বাচন করেছ?’
‘তুমি ভুলে গেছ যে, কোনো যন্ত্রচালিত গাড়ি তোমাকে নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে না, এমনকি অর্ধ গোলাকৃতি হয়ে রক্ষিদলের কোনো সদস্য তোমার সঙ্গে যাবে না। পেছন থেকে কেউ তোমার পোশাক আগলে ধরবে না এবং তোমার মাথায় আশীর্বাদের ফুঁ দিবে না। অন্তর্বাসের খাপের সঙ্গে তোমার উরোজ মিলে গেছে। কিন্তু তোমার উরু এবং নিতম্ব সেই সংযমটুকু দিয়েছে। তোমার পরনে ফিনফিনে রেশমি কাপড়ের চকচকে স্কার্ট, যা গত শরতের সময় আমাদের সবাইকে মোহিত করেছিল এবং তুমি হাসছিলে– যেন তুমি মৃত্যুর মতো বিপদের দিকে আহ্বান জানিয়েছিলে– তবে কখনও-কখনও ।’
‘হ্যাঁ, আমাদের দিক থেকে আমরা দু’জনেই সঠিক এবং তা-ই আমাদের সচেতন রেখেছে। আলাদা পথে বাড়ি ফিরে যাওয়াটা কী আমাদের জন্য ভালো নয়?’

পোশাক-পরিচ্ছদ
মাঝেমধ্যে আমি যখন পোশাকে একাধিক ভাঁজ, কুঁচি এবং ঝুল দেখি এবং তা সুন্দর দেহের সঙ্গে অত্যন্ত সুবিন্যস্ত এবং পরিপাটি দেখায়, আমার মনে হয় সেই সুবিন্যস্ততা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। বরং একসময় ভাঁজ পড়ে এবং সেই ভাঁজ ইস্ত্রী করলেও যায় না। এছাড়া পোশাকের ভাঁজের ফাঁকে এমন পুরু হয়ে ময়লার আস্তরণ পড়ে যা কিছুতেই পরিষ্কার করা যায় না। এমন কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি সকাল থেকে রাত অবধি বোকার মতো সেই ময়লা এবং কুঁচকে যাওয়া, অথচ মূল্যবান, পোশাক পরে থাকতে চাইবেন।
আমি দেখেছি সুশ্রী মেয়েরা দেহের সৌন্দর্য্য, ফুলে ওঠা ছোট হাড়, মসৃণ ত্বক, ঘন চুলের গোছা এবং বলাবাহুল্য, দিন-রাত পছন্দের একই পোশাক পরে থাকে, সবসময় তাদের প্রতিফলন আয়নায় একই ভঙ্গিতে দেখা যায় ।
শুধু রাতের বেলা কদাচিৎ, যখন মেয়েরা পার্টি থেকে দেরি করে ফিরে, আয়নায় তাদের পোশাক দেখে, মনে হয় সেগুলো বিধ্বস্ত এবং ময়লা হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে সেসব পোশাক অনেকেই দেখেছে এবং পুনরায় তা পরিধান করার সুযোগ খুবই কম থাকে।

ট্রামে
আমি ট্রাম ইস্টিশনের শেষ প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি এবং এই জগতে, বিশেষ করে এই শহরে এবং পরিবারের মধ্যে, আমার অস্তিত্ব ছিল কি না, তা নিয়ে তখন আমি সম্পূর্ণ সন্ধিহান ছিলাম। কোনো সঠিক পথে আমি অগ্রসর হতে পারি, সাদামাটাভাবে তা দাবি করতে পারবো না। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য কোনো অজুহাত দাঁড় করানোর মতো আমার অবস্থা নেই। এছাড়া এই চামড়ার ফিতা ধরে রাখার জন্য, এই ট্রামের ভেতর নিজেকে বহন করার জন্য, এবং যারা ট্রাম বা হাঁটার পথ দিয়ে যেতে পারে অথবা যারা চুপিসারে হেঁটে যাবে কিংবা দোকানের জানালার আয়নার বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভেতরের জিনিসপত্র দেখবে, তাদের জন্য আত্মপক্ষ সমর্থন করার কোনো সুযোগ নেই। কেউ আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে বলেনি এবং আসলে বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক।
প্ল্যাটফর্মের দিকে ট্রাম এগিয়ে আসছে এবং ট্রাম থেকে নামার জন্য একটা মেয়ে সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। হাত দিয়ে তার শরীর স্পর্শ করে দেখার মতো সে আমার কাছে স্পষ্ট। তার পরনে কালো পোশাক এবং অনেকটা স্থির হয়ে স্কার্টের কুঁচি ঝুলে আছে। শরীরের সঙ্গে আঁটসাট গায়ের জামা। জামার কলার সাদা লেস ফিতার। তার বাম হাত ট্রামের একপাশে সমান্তরালভাবে বিছানো এবং ডান হাতের ছাতার নিচের দিকটা উপর থেকে দ্বিতীয় সিঁড়িতে ঠেস দেয়া আছে। তার মুখমণ্ডল বাদামি রঙের। যদিও পাশে সামান্য, কিন্তু তার নাকের ডগা প্রশস্ত এবং বৃত্তাকার। তার মাথা ভর্তি বাদামি চুল এবং ডান গালের টোলে কয়েকটা দীর্ঘ লোম। তার কানের ফুটো সংকুচিত, কিন্তু আমি যেহেতু তার খুব কাছে আছি, তাই তার ডান কানের ভেতরের সবটুকুই দেখতে পাই ।
সেই মুহূর্তে আমি নিজেকে প্রশ্ন করি: এটা কী করে সম্ভব যে মেয়েটি নিজের ঠোঁট বন্ধ রাখে এবং কোনো ধরনের মন্তব্য করে না?

পরিত্যাগ
সময়টা ছিলো খুব সকাল। রাস্তাগুলো পরিষ্কার এবং ফাঁকা ছিলো। আমি স্টেশনের দিকে হাঁটছিলাম। এক ফাঁকে টাওয়ার ঘড়ির দিকে তাকাই এবং আমার হাতের ঘড়ির সঙ্গে সময় মিলিয়ে দেখি। আমি বুঝতে পারি, গন্তব্যে পৌঁছুতে যে সময় ভেবেছিলাম, তার থেকে ঢের দেরি হবে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে- এই অনুভূতিটা আমাকে বিচলিত করে তোলে এবং আমি সঠিক পথ গুলিয়ে ফেলি। শহরের রাস্তাঘাটের সঙ্গে আমার খুব একটা পরিচয় হয়নি।  সৌভাগ্যক্রমে আমি কাছাকাছি একজন পুলিশকে পেয়েছি। আমি তার কাছে রীতিমতো দৌড়ে যাই এবং দ্রুত নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের ফাঁকে জিজ্ঞাসা করি ।

পুলিশ হেসে বললো, ‘আমার কাছ থেকে আপনি পথের হদিশ জানতে চান?’

‘হ্যাঁ,’ আমি বললাম, ‘যখন থেকে পথ খুঁজে পাচ্ছি না ।’

‘বাদ দিন,’ বলেই সে আচমকা শরীর দুলিয়ে ঘুরে যায়, যেমন অনেকে হাসির সময় একাকী থাকতে পছন্দ করে।

 





রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়