ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

বাংলাদেশে চাষের জন্য বাউ ড্রাগন উদ্ভাবন

আরিফুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৭, ১৮ আগস্ট ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলাদেশে চাষের জন্য বাউ ড্রাগন উদ্ভাবন

বাকৃবি জার্মপ্লাজম সেন্টারে উদ্ভাবিত বিভিন্ন প্রজাতির বাউ ড্রাগন ফল

আরিফুল ইসলাম, বাকৃবি : ফলটির উৎপত্তিস্থল সেন্ট্রাল আমেরিকা। মানুষ জানে ভিয়েতনামের ফল হিসেবে। কারণ, ভিয়েতনামে সর্বাধিক বাণিজ্যিক হিসাবে ফলটির চাষ হয়। ফলটির নাম ‘ড্রাগন’। বাংলাদেশেও ফলটি নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। বাকৃবি জার্মপ্লাজম সেন্টারে ইতিমধ্যেই গবেষকরা বিভিন্ন প্রজাতির বাউ ড্রাগন উদ্ভাবন করেছেন।

সেন্ট্রাল আমেরিকাতে ‘ড্রাগন’ ফলের প্রবর্তন হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে মালয়েশিয়াতে প্রবর্তন করা হয় বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। বর্তমানে মেক্সিকো, সেন্ট্রাল ও দক্ষিণ আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, দক্ষিণ চীন, ইসরাইল, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বাংলাদেশেও চাষ করা হচ্ছে ড্রাগনের।

বাংলাদেশে এ পর্যন্ত অনেকগুলো বিদেশি ফল প্রর্বতন করা হয়েছে। তার মধ্যে এ্যাভোকেডো, ম্যাঙ্গোঁস্টিন, স্ট্রবেরি, কিউই, রাম্বুটান, লংগান, ল্যাংসাট, ব্রেড ফ্রুট, জাবাটিকাবা, শান্তল, পিচফল ফ্রুট এবং ডুরিয়ান অন্যতম। এদের মধ্যে কিউই ও ডুরিয়ান ছাড়া প্রায় সব ফলই এদেশে কমবেশি হচ্ছে এবং আশানুরূপ ফলন পাওয়া যাচ্ছে। যা দেখে অনেকে এসব ফলের বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করার চিন্তা-ভাবনা করছেন।

এর মধ্যে ড্রাগন ফলের চাষ সম্ভাবনাময়। গবেষকরা মনে করেছেন অচিরেই এ ফলটি এ দেশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে চাষ করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশে এ ফল ২০০৭ সালে প্রথম প্রবর্তন করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ¡বিদ্যালয়ের (বাকৃবি) বাউ জার্মপ্লাজম সেন্টারের পরিচালক প্রফেসর ড. এম. এ রহিম। তিনি এ ফলের জাত থাইল্যান্ড, ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে নিয়ে আসেন। বর্তমানে এ ফলটি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বংশ বিস্তার করা হচ্ছে।

সবধরনের ডায়েটের জন্য এ ফলটি উপযুক্ত। এ ফল শরীরের জন ফাইবার সরবরাহ করে যা পেটের পীড়া এবং লিভার এর জন্য উত্তম। খাবারের পর ডেজার্ট হিসাবে পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এ ফল খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। এ ফলটি প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, মিনারেল এবং উচ্চ ফাইবার যুক্ত।

জুস তৈরিতেও ফলটি অত্যন্ত উপযোগী। প্রতি ১০০ গ্রাম ফলে ফাইবার ০.৯ গ্রাম, ফ্যাট ০.৬১গ্রাম, এ্যাশ ০.৬৮ গ্রাম, ক্যারোটিন ০.০১২ গ্রাম, পানি ৮৩.০ গ্রাম, ফসফরাস ৩৬.১ মি.গ্রাম, অ্যাসকরবিক এসিড ৯.০মি.গ্রাম, প্রোটিন ০.২২৯ গ্রাম, রিবোফ্লাবিন ০.০৪৫ মি.গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৮.৮ গ্রাম, নায়াসিন ০.৪৩০ মি.গ্রাম ও আয়রন ০.৬৫ মি.গ্রাম থাকে।

খাদ্যমানের প্রাচুর্যের জন্য উৎপাদনকারী দেশগুলোতে খাবারের সাথে এ ফল না থাকলে যেন তাদের খাওয়া অপূর্ণ থেকে যায়। ড্রাগন ফল দেখতে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর।

এমন কথা প্রচলিত আছে যে, একটি তাজা ফল খেয়ে মানব শরীরকে সতেজ ও সুস্থ রাখা যায়। ডায়াবেটিক রোগীরা এ ফল খেয়ে সহজেই ডায়াবেটিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। ফ্রেশ ফ্রুটের চেয়ে শুষ্ক ফ্রুট অনেক ভালো। এ ফল সালাদের সাথেও ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

ড্রাগন ফল ক্যাকটাস গোত্রের একটি ফল। গাছ দেখে সবাই একে চির সবুজ ক্যাকটাস বলেই মনে করেন। এশিয়ার মানুষের কাছে এ ফল অনেক জনপ্রিয়, হালকা মিষ্টি-মিষ্টি। এ ফলকে ড্রাগন ফল ছাড়াও পিটাইয়া, টিহায়া ইত্যাদিও নামে ডাকা হয়।

ড্র্রাগন ফল গাছ শুধুমাত্র রাতে ফুল দেয়। ফুল লম্বাটে সাদা ও হলুদ, অনেকটা ‘নাইটকুইন’ ফুলের মত। এ কারণে ড্রাগন ফুলকে ‘রাতের রাণী’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। ড্রাগন ফলের গাছ লতানো ইউফোরবিয়া গোত্রের ক্যাকটাসের মত কিন্তু এর কোন পাতা নেই। ফুল স¡পরাগায়িত; তবে বিভিন্ন মাছি, মৌমাছি ও পোকা-মাকড় এর পরাগায়ন ত্বরান্বিত করে এবং কৃত্রিম পরাগায়নও করা যেতে পারে।

এ ফলটির জন্য শুষ্ক ট্রপিক্যাল জলবায়ু প্রয়োজন। মধ্যম বৃষ্টিপাত এ ফলের জন্য ভালো। অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতে ফুল ঝরে পরে এবং ফলের পঁচন দেখা দেয়। প্রায় সব ধরনের মাটিতেই ড্রাগন ফল চাষ করা যায়। তবে পানি জমে না এমন উঁচু জমিতে এ ফলটি চাষ করা ভালো। উচ্চ জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ বেলে-দোঁয়াশ মাটিই এ ফল চাষের জন্য উত্তম। ড্রাগন ফল প্রচুর আলো পছন্দ করে।

বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সফলভাবে চাষ করার জন্য বাউ ড্রাগন ফল -১ (সাদা), বাউ ড্রাগন ফল -২ (লাল)
নির্বাচন করা যেতে পারে। এছাড়া হলুদ ড্রাগন ফল, কালচে লাল ড্রাগন ফল চাষ করা যেতে পারে।

জমি ভালভাবে চাষ করে গাছ থেকে গাছের দুরত্ব ৩মি. এবং সারি থেকে সারির দূরত্ব ৩মি. দিয়ে হেক্সাগোনাল পদ্ধতি ব্যবহার করে এ গাছ লাগানো উত্তম। তবে অবস্থাভেদে দূরত্ব কম বা বেশি দেওয়া যেতে পারে।

ড্রাগন ফলের চারা রোপনের জন্য ২০-৩০ দিন আগে প্রতি গর্তে ৪০ কেজি পঁচা গোবর, ৫০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০০ গ্রাম করে টিএসপি ও এমপি এবং ১০ গ্রাম করে জিমসাম, বোরাক্স ও জিঙ্ক সালফেট দিয়ে, গর্তের মাটি উপরে-নীচে ভালোভাবে মিশিয়ে রেখে দিতে হবে। সার দেওয়ার ২০-৩০দিন পর গাছ লাগানো যাবে। এরপর প্রতিবছরে প্রতি গাছের জন্য ৪০ কেজি পঁচা গোবর ঠিক রেখে ইউরিয়া ৫০ গ্রাম, টিএসপি ও এমটি ১০০ গ্রাম এবং জিমসাম, বোরাক্স ও জিঙ্ক সালফেট ১০ গ্রাম করে বৃদ্ধিহারে প্রয়োগ করতে হবে।

ক্যাকটাস গোত্রের গাছ বিধায় বছরের যে কোন সময়ই লাগানো যায় তবে এপ্রিল-সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে লাগানো ভাল। কাটিংকৃত কলম প্রতি গর্তে ৪-৫টি করে লাগানো হয়। এ গাছ ১.৫-২.৫ মিটার লম্বা হয়। এজন্য এ গাছকে উপরের দিকে ধরে রাখার জন্য সিমেন্টে অথবা বাঁশের খুঁটির সাথে উপরের দিকে তুলে দেওয়া হয়। গাছের দুইপাশে দুটি খুঁটি পুতে মোটা তারের উপরে মাচাঁ তৈরি করে দিলে ভাল হয়।

এ ফলের বংশ বিস্তার অত্যন্ত সহজ। বীজ দিয়েও বংশ বিস্তার করা যেতে পারে। এতে ফল ধরতে একটু বেশি সময় লাগে। তবে হুবহু মাতৃ বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে না। সেজন্য কাটিং এর মাধ্যমে বংশ বিস্তার করাই উত্তম। কাটিং এর সফলতার হার প্রায় শতভাগ এবং ফলও তাড়াতাড়ি ধরে। কাটিং থেকে উৎপাদিত একটি গাছে ফল ধরতে সময় লাগে ১২-১৮ মাস।

সাধরণত ১-১.৫ ফুট বয়স্ক এবং শক্ত শাখা কেটে  হালকা ছায়াতে বেলে-দোঁআশ মাটিতে গোড়ার দিকের কাটা অংশ পুতে সহজেই চারা উৎপাদন করা যায়। ২০ থেকে ৩০ দিন পরে কাটিং এর গোড়া থেকে শিকর বেরিয়ে এলে মাঠে লাগানোর উপযুক্ত হবে। ১২-১৮ মাস বয়সের একটি গাছে ৫-২০টি ফল পাওয়া যায় কিন্তু পূর্ণ বয়স্ক একটি গাছে ২৫-১০০টি পর্যন্ত ফল পাওয়া যায় । হেক্টর প্রতি  ফলন প্রায় ২০-২৫ টন।

 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ আগস্ট ২০১৪/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়