ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ঈদ অনুষ্ঠানমালা ও বিজ্ঞাপন যন্ত্রণা

আমিনুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৪৩, ৫ আগস্ট ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঈদ অনুষ্ঠানমালা ও বিজ্ঞাপন যন্ত্রণা

আমিনুল ইসলাম

আমিনুল ইসলাম : এক মাসের সিয়াম সাধনা শেষে আসে খুশির ঈদ। আর এই ঈদকে সামনে রেখে ব্যবসায়ীরা হাজার কোটি টাকার ব্যবসার পরিকল্পনা নিয়ে থাকে। তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপনসহ নানান বিজ্ঞাপন দিয়ে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও রমরমা ব্যবসা করে থাকে। আর সেটা করতে গিয়ে দর্শকদের এক প্রকার যন্ত্রণা দিয়ে থাকে চ্যানেলগুলো।

তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না দর্শকরাই হচ্ছে টিভি চ্যানেলের প্রাণ। তাদের যন্ত্রণা দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। অন্যদিকে এ কথাও মনে রাখতে হবে বিজ্ঞাপনই একটি চ্যানেলকে বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু দুইয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতার অভাব প্রকটভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে দেশীয় চ্যানেলগুলো থেকে। ঝুঁকে পড়ছে ভিনদেশি চ্যানেলের দিকে।

দর্শকরা সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞাপন যন্ত্রণার শিকার হয়ে থাকে দুই ঈদে। ঈদের বেশ আগে থেকেই চ্যানেলগুলো তাদের ‘ঈদ অনুষ্ঠানমালার’ বিজ্ঞাপন ঘটা করে প্রচার করতে থাকে। সাত দিনব্যাপী ঈদ আয়জনের নামে তারা বিজ্ঞাপনের পসরা সাজিয়ে বসে। দারুণ দারুণ সব অনুষ্ঠানের নামে তারা মূলত বিজ্ঞাপন দেওয়ার ফাঁদ পেতে থাকে।

ঈদের অনুষ্ঠান দেখতে বসে বিজ্ঞাপন যন্ত্রণার শিকার হয়নি এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া ভার। গেল এক দশক ধরে ঈদ অনুষ্ঠানমালার নামে মূলত চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপন প্রচার করে যাচ্ছে। যেমন, একটি অনুষ্ঠান সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বিজ্ঞাপন প্রচারের তোড়ে সেটা শুরু হয় ৮ থেকে ১০ মিনিট দেরিতে। এরপর ৫ মিনিট অনুষ্ঠান দেখানোর পর ১০-১৫ মিনিটে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এমন চিত্র বাংলাদেশের প্রায় সবগুলো চ্যানেলে দেখা যায়।

কিন্তু বিজ্ঞাপন প্রচারের আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী এক ঘণ্টার একটি অনুষ্ঠানে বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় সর্বোচ্চ ১২ থেকে ১৪ মিনিট। কিন্তু আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এক ঘণ্টার একটি অনুষ্ঠানে বিজ্ঞাপন প্রচার করে থাকে ৩০ মিনিটেরও বেশি। ঈদের সময় এক ঘণ্টার একটি অনুষ্ঠানের বিপরীতে বিভিন্ন সময়ে চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপন প্রচার করে থাকে ১২০ মিনিটের মতো। যা দর্শকদের ধৈর্য্য সীমার বাইরে। এটা এক ধরনের মানসিক নির্যাতনের শামিল।

আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে হয়। কিন্তু আমাদের চ্যানেলগুলো ঈদের সময় বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে অনুষ্ঠান দেখায়। বিজ্ঞাপন যন্ত্রণার শিকার হয়ে খুব কম দর্শকই একটি অনুষ্ঠান পুরোপুরি দেখতে পারেন। অনেক সময় বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার করতে গিয়ে অনুষ্ঠান কাটছাট করা হয়। ফলে যে দর্শক বিজ্ঞাপন যন্ত্রণা সহ্য করে শেষ পর্যন্ত অনুষ্ঠানটি দেখতে মনস্থির করেন, তিনি হন বঞ্চিত। কারণ, মাঝ থেকে একটি অনুষ্ঠান কাটছাট করার ফলে আগাগোড়া কিছুই বুঝে উঠতে পারেন না দর্শকরা। ফলে দেশীয় অনুষ্ঠানের প্রতি একটি বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হয়।

গেল কয়েক ঈদকে কেন্দ্র করে ছয় পর্বের ধারাবাহিক নাটকের নামে বিজ্ঞাপন প্রচারের নতুন একটি ফাঁদ তৈরি করেছে চ্যানেলগুলো। শুধু ধারণকৃত অনুষ্ঠানই নয়, সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানেও বিজ্ঞাপনের পসরা সাজিয়ে বসে তারা। যেমন, লাইভ অনুষ্ঠানে উপস্থাপক বললেন, ‘দর্শক কোথাও যাবেন না। ফিরছি ছোট্ট একটি বিজ্ঞাপন বিরতির পর।’ একটি লাইভ অনুষ্ঠানে তার সেই ছোট্ট বিজ্ঞাপন বিরতি শেষ হতে সময়ে লেগে যায় ১২ থেকে ১৫ মিনিট।

২০০৯ সালে প্রথম আলো কর্তৃক পরিচালিত একটি জরিপে দেখা যায়, ঈদের প্রথম তিন দিনে বাংলাদেশের প্রথম সারির ১২টি চ্যানেলে ২৪ হাজার ২৮০টি বিজ্ঞাপন প্রচার করা হয়েছে। ১২টি চ্যানেলের মোট সম্প্রচার ছিল ৮৪১ দশমিক ৩৭ ঘণ্টা। এর মধ্যে ১৭৬ দশমিক ১৪ ঘণ্টা ব্যয় হয়েছে শুধু বিজ্ঞাপন প্রচারে। বাকি ৬৬৫ দশমিক ২৩ ঘণ্টা প্রচারিত হয়েছে অনুষ্ঠান, সংবাদ ও প্রোমো। শতকরা হিসেবে ঈদের তিন দিনের মোট সময়ের প্রায় ২১ শতাংশ সময় চ্যানেলগুলো বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে। বর্তমানে যা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।

বলা হয়ে থাকে দিন দিন বিজ্ঞাপনের রেট কমে যাওয়ার কারণে চ্যানেলগুলোকে এমন বিজ্ঞাপনের পসরা সাজিয়ে বসতে হয়। কিন্তু চ্যানেলগুলোর মাসিক আয়ের দিকে নজর দিলে দেখা যায় বাংলাদেশে যেমন মাসে আট কোটি টাকা আয়ের চ্যানেল রয়েছে, তেমনি রয়েছে মাসে মাত্র ২০ লাখ টাকা আয়ের চ্যানেলও। যারা বেশি আয় করে তারা কম বিজ্ঞাপন দিয়ে বেশি অনুষ্ঠান দেখালে সমস্যা কোথায়? অথবা অনুষ্ঠানমালা ও বিজ্ঞাপন প্রচারের মধ্যে একটি ভারসম্য নিয়ে এলে সমস্যা কীসে?

আসলে সমস্যা হচ্ছে চ্যানেলগুলোর অতি লাভের মানসিকতা। কিন্তু তারা হয়তো এটা ভেবে দেখছে না, বিজ্ঞাপন যন্ত্রণা দেওয়ার মাধ্যমে তারা দর্শক হারাচ্ছে।  দেশি চ্যানেল রেখে ভিনদেশি চ্যানেলগুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ছে দর্শকরা। আর ভিনদেশি সংস্কৃতির অনুষ্ঠানাদি দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলছে আমাদের জীবন-যাপন ও সমাজ-সংস্কৃতির ওপর। বদলে দিচ্ছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতি। তৈরি হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়। পচন ধরতে শুরু করেছে তরুণ সমাজের মস্তিষ্কে। সমাজ কাঠামো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। অতি লোভের আশায় আমাদের দেশীয় চ্যানেলগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও সংস্কৃতিকে ঠেলে দিচ্ছে অনিশ্চিয়তার দিকে।

আজ সমাজে নৈতিক অবক্ষয় প্রকট আকার ধারণ করেছে। সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ মারাত্মকভাবে লোপ পেতে বসেছে। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের অভাবে এবং নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে সমাজে অপরাধ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। এসবের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে আমাদের সরকারি ও বেসরকারি ২৫টি চ্যানেল। কিন্তু চ্যানেলগুলো সে ভূমিকা কতটুকু পালন করছে?

লেখক : ক্রীড়া সাংবাদিক।

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ আগস্ট ২০১৪/আমিনুল/রাসেল পারভেজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়