ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

সাপের সাতকাহন

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ৬ আগস্ট ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাপের সাতকাহন

সুন্দরবনের কাল কেউটে

তাপস রায় : সাপ গোবেচারা টাইপের প্রাণী-এই কথাটি অনেক পাঠক মানতে চাইবেন না। কারণ আমাদের কল্পনারাজ্যে সাপ মানেই বিষধর, হিমশীতল ভীতিকর এক প্রাণীবিশেষ। অথচ জেনে অবাক হতে হয়, সাপের গুটিকয় প্রজাতি ছাড়া অধিকাংশ সাপ বিষহীন। শুধু তাই নয়, বিশেষজ্ঞরা একে নিরীহ প্রাণীরও সার্টিফিকেট দিয়েছেন। তাই বলে সাপ দেখলেই ধরতে যাবেন না যেন। কারণ এই সার্টিফিকেটের কথা আমরা জানি, সাপ কিন্তু জানে না!

আপনাকে আরেকটু জানিয়ে রাখি, এই উপমহাদেশে যে সাপগুলো দেখা যায় এদের ৭৬ শতাংশই বিষহীন। বাকি ২৪ শতাংশ যে ভীষণ বিষধর তাও বলা যাবে না। এর অধিকাংশই তুলনামূলক কম বিষধর। সে তুলনায় সাপের প্রতি আমাদের বিদ্বেষের পরিমাণ অনেক বেশি।

আপনি যদি গ্রামের বাসিন্দা হয়ে থাকেন তাহলে দেখবেন অথবা শুনে থাকবেন সেখানে খাল-বিল বা ডোবা থেকে পানি নেমে গেলে অনেকে দল বেঁধে উল্লাসে সেই কাদায় নেমে পড়েন। উদ্দেশ্য কাদায় হাত ডুবিয়ে মাছ ধরা। এভাবে মাছ ধরতে গিয়ে হাতে সাপও কিন্তু উঠে আসে। ভাগ্যিস সেই সাপগুলো মোটেই বিষধর হয় না। কিন্তু তাতে কী! ওই ঢোরা সাপ দেখেই অনেকের ভয়ে আত্মা শুকিয়ে যায়। সাপ আসলে এমনই প্রাণী। নাম শুনলেই মনে কেমন ভয় জাগে। অনেকে আবার সাপ দেখে অস্বস্তিতে ভোগেন। সাপের মধ্যে তারা সুন্দর কিছু খুঁজে পান না। অথচ আপনাকে যদি প্রশ্ন করি এখন পর্যন্ত বাংলা চলচ্চিত্রে মানুষের পর কোন প্রাণীটিকে দর্শক সবচেয়ে বেশি দেখেছে? তাহলে এর উত্তর হবে-সাপ। আহা! সাপ নিয়ে কত চলচ্চিত্রই না হয়েছে আমাদের দেশে। কিন্তু সেই তুলনায় সাপ কিন্তু খুব কমই মানুষের সহানুভূতি পেয়েছে। মানছি যে, সাপের কামড়ে বছরে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু এটাও ভাবতে হবে যে, এর তুলনায় অনেক বেশি সাপ মানুষের হাতে প্রাণ হারায় শুধুমাত্র কিছু ভুল ধারণার কারণে।

সাপ নিয়ে এই ভুল ধারণাগুলো হয়েছে বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি এবং সে অনুযায়ী নির্মিত চলচ্চিত্র থেকে। যা শুধু অবৈজ্ঞানিকই নয়, অযৌক্তিক এবং ভিত্তিহীন বটে! এই যেমন অনেকে বলেন, সাপ নাকি গুপ্তধন পাহাড়া দেয়। সাপের মাথায় মণিও থাকে। অথচ এ কথা সঠিক নয়। পুরনো, বদ্ধ, অন্ধকার জায়গায় সাপ এমনিতেই থাকতে পারে। তার অর্থ এই নয় যে, সাপ সেখানে গুপ্তধন পাহাড়া দিচ্ছে।

সাপ মাংসাশী প্রাণী। কিছু সাপ দুধ খায় বটে, কিন্তু কলা কোনো সাপ খায় না। একইভাবে বলা যায়, সব সাপ ডিম পাড়ে না। অ্যানাকোন্ডা, চন্দ্রবোড়া বাচ্চা দেয়। অর্থাৎ এমন একটি কথা প্রচলিত রয়েছে যে, সাপের ডিম নষ্ট করলে বা সাপকে শত্রু বানালে সুযোগ বুঝে সে প্রতিশোধ নেবে- এটা ভুল। শত্রুকে চিনে রাখার ক্ষমতা সাপের নেই। তাই পরবর্তীতে সাপের প্রতিহিংসার শিকার হওয়ার প্রশ্নই আসে না।

সাপের সম্মোহনী শক্তি নেই। মাছের মতো সাপের চোখের পর্দাও নেই। তাই বলে ভাববেন না, সাপ বেহায়া প্রাণী। মানুষের সাড়া পেলে সে সেখান থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে যেতে চায়। অনেক সময় তা সম্ভব হয় না, সাপ এবং মানুষ মুখোমুখি হয়ে যাওয়ার কারণে। প্রাথমিক অবস্থায় তখন কিন্তু দুই পক্ষই খুব ভয় পেয়ে যায়। বাঁচার জন্যই তখন পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে। তাছাড়া অন্ধকারে চলতে গিয়ে সাপের শরীরে পা দেয়ায় অনেকে আক্রান্ত হন।

আগে ধারণা ছিল সাপ সম্পূর্ণ বধির। কারণ তাদের না আছে কানের ফুটো, না আছে শ্রবণশক্তি। কিন্তু গবেষকরা এখন বলছেন, ফুসফুসের মাধ্যমে ওরা বায়ুবাহিত কিছু কিছু শব্দ গ্রহণ করতে পারে। জীবজন্তু বা মানুষের পায়ের শব্দে যে সামান্য ভূকম্পন হয় তাও ওরা শুনতে পারে। আপনি হয়তো এখন বলবেন, সাপুড়ের বাঁশির তালে তালে সাপ যে নাচে এটা কীভাবে সম্ভব? আসলে সাপ বাঁশির সুর শুনে নাচে না। সাপ সাপুড়ের অঙ্গভঙ্গি এবং বাঁশির দুলুনির অনুকরণে নাচে।

দু’মুখো সাপ নিয়েও আমাদের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। ধারণাটি এমন শক্তিশালী যে, বিশ্বাসঘাতকদেরও আমরা ‘দু’মুখো সাপ’ বলি। অথচ আমরা অনেকেই জানি না, দুমুখো সাপ বলতে কিছু নেই। আমরা যে সাপকে দু’মুখো বলি সেই সাপের মাথা একটিই। সমস্যাটা হয় এ জন্য যে, এ ধরনের সাপের মাথা এবং লেজ প্রায় একই রকমের। ফলে কোনটি মাথা আর কোনটি লেজ তা সহজে শনাক্ত করা যায় না। তাছাড়া পিছু হটার সময় এ সাপ পিছন ফেরে না, ব্যাক-গিয়ারে পিছিয়ে যায়। এই পিছিয়ে যাওয়া দেখেই অনেকে ধরে নেন, ওটা দু’মুখো সাপ।

এবার বিষধর সাপের কথা জেনে নেয়া যাক। অনেকে ইনল্যান্ড তাইপানকে পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ হিসেবে মনে করলেও পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত সাপ হল বেলচেরি। এটি তাইপানের চেয়ে প্রায় শতগুণ বেশি বিষাক্ত। সমুদ্রে বসবাসকারী এ সাপটি প্রায় ১ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। মজার ব্যাপার সাপটি একবার শ্বাস নিয়ে প্রায়  ৮ ঘণ্টা পানির নিচে ঘুরে বেড়াতে পারে। তবে

পৃথিবীর সবচেয়ে বিষাক্ত এ সাপটি খুবই ভদ্র স্বভাবের। এটি খুব বেশি বিরক্ত না হলে সাধারণত কামড় দেয় না। আর একবার কামড় দিলে মাত্র ১০ মিনিটে মৃত্যু অনিবার্য। শুধু এটুকু মনে রাখুন, মাত্র কয়েক মিলিগ্রাম বেলচেরির বিষ ১ হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট।

এতো গেল সমুদ্রের বিষাক্ত সাপের কথা। স্থলের বিষাক্ত সাপদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে তাইপান। এই সাপ অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে বেশি দেখা যায়। এর অনেকগুলো প্রজাতি রয়েছে। এ সাপগুলো ১.৮-৩.৭ মিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ধারণা করা হলেও এরা খুব সহজেই বশ মানে। তবে এই সাপ কোন কারণে বিরক্ত হলে শিকার জায়গা থেকে নড়ার আগেই প্রচণ্ড বেগে কয়েক বার ছোবল হানতে পারে। একবার এক ইনল্যান্ড তাইপানের ক্ষেত্রে এক ছোবলে সবচেয়ে বেশি প্রায় ১১০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত বিষ নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। আর এই পরিমাণ বিষ একশ’ লোকের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট।

আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে যে সাপটির বিষধর হিসেবে পরিচিতি রয়েছে সেটি হলো ক্রেইট।
বাংলায় এরাই কাল কেউটে। এরা দিনে কুণ্ডলি পাকিয়ে থাকে এবং রাতে শিকার করে। এরা যে কোন সাধারণ কোবরা থেকে প্রায় ১৫গুণ বেশি বিষাক্ত। মানুষের স্লিপিং ব্যাগ, বুট বা তাবুর নিচে লুকানো এই সাপের একটি বড় অভ্যাস। একে অভ্যাস না বলে বদভ্যাস বলাই ভালো। কাল কেউটের পরেই রয়েছে কোবরা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ অগাস্ট ২০১৪/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়