ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বুক রিভিউ

জীবন ও কল্পনার সংকর ‘মৃত্যুর পরাগায়ন’

আমিনুল ইসলাম শান্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৭, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জীবন ও কল্পনার সংকর ‘মৃত্যুর পরাগায়ন’

|| আমিনুল ইসলাম শান্ত ||

ভাব থেকে কবিতা প্রসব করে। ভাবের বেদনা কবির মস্তিষ্কে যখন ওঠে তখন কবি যে বেদনা অনুভব করেন তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে নিচের পঙ্‌ক্তিতে:  

‘সম্পর্ক ভেঙে শামুক কিনেছো শুনলাম

তার জন্য একটু জল

একটা রাস্তাও রেখো—

শামুকতো আর মানুষ নয়

খোলসটা তার ভালো রেখো’

এ পঙ্‌ক্তিমালা  ‘মৃত্যুর পরাগায়ন’ কাব্যগ্রন্থের। কবি স্বরলিপির এ বইটির মলাট খুললেই তার শীতল বেদনা আর যত্নের আভাস পাওয়া যায়। ব্যক্তি কবিকে খোঁজার প্রয়াস আমার নয়, কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে কবির ভাবনার মসৃণ পদচিহ্ন অনুসরণ আমার লক্ষ্য।

প্রেমের শরীরের কামের লতা লাউয়ের ডগার মতো জড়িয়ে থাকে। কিন্তু ভালোবাসায় তার অস্তিত্ব থাকে না। বরং বাধাহীন সরল, পবিত্র এক অস্পর্শী আহ্বান থাকে। কোনো এক কবিকে তিনি এ আহ্বান করেছেন ‘কবির জন্য’ শিরোনামের কবিতায়। চলুন এ কবিতার ক’চরণ পাঠ করা যাক—

‘খুলে দিলাম বারো হাত শাড়ির বহর

বসো পাতালগামী সীতার আসনে

এইসব পড় ‘কবি’

সেই সেই নারীর নামে

যে তোমাকে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল।’ [পৃষ্টা নং ৯]   

৪৮ পৃষ্ঠার এ বইটির মসৃণ পাতা উল্টাতেই দেখা মেলে কবির ভাবনার ভিন্নচিত্র। ১১ নম্বর পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ ‘বোধের কফিন ভেঙেছে’ শিরোনামের কবিতাটি। শুরুতে যে কবি ভালোবাসার অব্যক্ত ভাব ব্যক্ত করেছেন— এবার কবিকে মৃত বোধের কফিন ভেঙে প্রেমের উত্তাল ঢেউয়ে ভাসতে দেখা যায়। আর এসবই কবির মস্তিষ্ক পোড়া কল্পনার বাণী।   

দুজন নারী-পুরুষের প্রেমের সম্পর্কে লেনাদেনা থাকে। কিন্তু এই পৃথিবীতে কিছু প্রেমিক-প্রেমিকা রয়েছে যাদের প্রেমে কোনো বিনিময় নেই। চোখ বন্ধ করে বলা যায়, তারা দেশপ্রেমিক। সূর্য সেন তারদেরই একজন। যে আমাদের ভূ-খণ্ডের জন্য, এখানকার মানুষের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তার মতো দেশপ্রেমিককে কোনো কোনো নারী প্রেমিকরূপে পেতে চান- তবে সব নারী তা চান না। সূর্য সেন ‘আমার পুরনো প্রেমিক’ কবিতায় কবি সূর্য সেনকে গভীরভাবে তার ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করেছেন। তাকে ভালোবাসা মানেই দেশকে ভালোবাসার প্রতীকী বহিঃপ্রকাশ। চমৎকার ঢঙে একটু কৌশলীভাবে ভালোবাসার কথা উপস্থাপন করেছেন কবি। তা যথার্থই জীবনঘনিষ্ঠ।

দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রযন্ত্রের কার্যকলাপ কবিকে ভাবিয়েছেন। তারই স্পষ্ট চিহ্ন পাওয়া যায় ‘সুরতহাল প্রতিবেদন’ শিরোনামের কবিতায়। সময়ের সঙ্গে সমাজে কিছু রীতিনীতি তৈরি হয় আবার অনেক আচার কালের গর্ভে হারিয়েও যায়। নতুনকে স্বাগত জানানো যেমন আধুনিকতার একটি অংশ, তেমনি নিজেকে সমৃদ্ধ করারও একটি মাধ্যম। তবে কবি নতুন কিছু রীতি গ্রহণ করতে নারাজ। ‘কেকবাহিত জন্মদিন’ শিরোনামের কবিতাটি তারই উদাহরণ। কবির অগ্রাহ্য করার এমন মনোভাব সময় থেকে তাকে পেছনে ফেলে দেয়- আপাত দৃষ্টিতে এমন মনে হলেও তার এই আগ্রাহ্য করার শক্তি তাকে স্বাতন্ত্র দিয়েছে।

বইটির পাতায় পাতায় ভাবনার নতুন প্লট যদিও এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেশকে ভালোবাসার কথা বলতে বলতেই প্রেমিকার প্রগাঢ় আহ্বান নিয়ে হাজির হন কবি। যেখানে প্রেমিকরূপী অদৃশ্য এক অবয়বকে খোঁজে পাবেন পাঠক। যে অবয়বকে উদ্দেশ্য করে কিছু অভিযোগ সু-কৌশলে বলে গেছেন ‘পুরুষ নয় প্রেমিককে’ শিরোনামের কবিতায়। আবার আবেগী কবি মনের কোণে প্রিয়জনের জন্য পবিত্র চুম্বনও তুলে রেখেছেন। প্রেমিকার মন অভিমানে বিক্ষোভ করলেও তাতে নিরেট ভালোবাসাই মাখা থাকে। তবে একঘর থেকে অন্যঘরে যাওয়া অর্থাৎ দেশপ্রেম থেকে মানব-মানবীর প্রেমের রাজ্যে পাঠককে হঠাৎ ফেলে দেয়া হয়েছে বইটিতে। এতে কোনো কোনো পাঠক বিরক্ত হলেও হতে পারেন আবার অনেকে আন্দোলিত হবেন তা নিশ্চিত।

জীবনঘনিষ্ঠ শব্দটি তো জীবনের বাইরের না। জীবনের নানা বাঁকে জীবন রং বদল করে। কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে কবির ভাবনায় জীবনের সেই সাত রং পরিলক্ষিত হয়। তার এ রঙের তালিকায় কালো ও নীল রং আছে। কষ্ট পেলে তার যেমন বহিঃপ্রকাশ ঘটে তেমনি কল্পনার রাজ্যে প্রজাপতির মতো পাখা মেলতেও দেখা যায় কবিকে। যাকে জীবন ও কল্পনার সংকর বললেও বোধহয় ভুল হবে না।

কবিতার ব্যাকরণ নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। কারণ আগেই বলেছি পাঠক হিসেবে ‘মৃত্যুর পরাগায়ান’ বইটিতে আমার বিচরণের অভিজ্ঞতা ও ভাবনা জানাব। তবে সব ক’টি কবিতা নিয়ে সেই অভিজ্ঞতা জানানো সম্ভব হয়নি। আমার পছন্দসই কিছু কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছি। গদ্য রীতিতে রুচিশীল শব্দ চয়নে গাঁথা হয়েছে প্রতিটি কবিতার শরীর। চর্মচক্ষে কবিতার শরীর রক্ত-মাংসের না হলেও ভাবনায় কিন্তু তারা জীবন্ত।

বইটিতে মোট ৪৮টি কবিতা মলাটবদ্ধ হয়েছে। প্রতিটি কবিতা একটি স্বতন্ত্র ভাবনার খোরাক মেটায়। ভাবনা আর শব্দের ভাঁজে ভাঁজে কখনো অপ্রাপ্তির হাহাকার কখনো আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় ঠিক-বেঠিকের পরিসংখ্যান। যা কবিতা প্রেমিকের মনের খোরাক মেটাবে কিংবা অঙ্কুরিত প্রেমকে উসকে দেবে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়