ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

জহরলালের দুঃখ পিছু ছাড়ে না

ছাইফুল ইসলাম মাছুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ১৪ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জহরলালের দুঃখ পিছু ছাড়ে না

ছাইফুল ইসলাম মাছুম: জীবন সে তো এক অবিরাম লড়াই। সেই লড়াইয়ের কিছু ঘটনা অনেক সময় পুরো জীবনটাই পাল্টে দেয়। অনেকে হারিয়ে যায় চিরতরে। আবার অনেকে অদম্য মনোবল নিয়ে টিকে থাকে। চেষ্টা করে ঘুরে দাঁড়ানোর। তেমনি এক সংগ্রামী মানুষ জহরলাল।

জহরলাল দাশের (৩৪) বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার চরঈশ্বর লতিফ হাজী গ্রামে। বাবা ধীরেন্দ্র কুমার দাশ ও মা পারুল বালা দাশ। পরিবারের ছয় ভাই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। জহরলালের জীবন অন্য দশজন মানুষের মতো স্বাভাবিক ছিল। দুই চোখে ছিল রঙিন স্বপ্ন। দারিদ্র্যের কারণে তৃতীয় শ্রেণীর পর আর পড়া হয়নি। বাবার অভাবের সংসারে হাল ধরার চেষ্টা করেন। শুরু করেন দিন মজুরের কাজ। 

কৈশোর তারুণ্য পেরিয়ে যখন যৌবন তখন জহরলাল জীবিকার তাগিদে চট্টগ্রাম শহরে পাড়ি জমান। বেশ কয়েক বছর যাত্রীবাহী গাড়ির সহকারীর কাজ করেন। ইচ্ছে ছিল গাড়ির চালক হবেন। সংসারের অভাব তখন ঘুঁচবে। বোনের বিয়ে দেবেন। ভাইগুলোকে মানুষ করবেন। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। ২০০৮ সালে জাতীয় পরিচয়পত্রের ছবি তোলার জন্য হাতিয়া যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন তিনি। জরুরিভিত্তিতে ভর্তি করানো হয় চট্টগ্রাম মেডিকেলে। শেষ সম্বল হিসেবে ছোট্ট এক টুকরো জমি ছিল, সেটুকুও বিক্রি করা হয় জহরলালের চিকিৎসার খরচ মেটাতে। তবুও রক্ষা পায়নি জহরলালের বাম পা। পুরোটাই কেটে ফেলতে হয়। জহরলাল জানান, দুর্ঘটনার এক সাপ্তাহ পর জ্ঞান ফিরলে দেখি, আমার বাম পা নেই। অন্য পাটিও তেমন সচল নয়।

হাসপাতালের বেডে কাটাতে হয়েছে দীর্ঘ দুই মাস। পুরনো কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাননি তিনি। রঙিন দিনগুলো হঠাৎ করেই যেন সাদাকালো হয়ে যায় তার। পা-বিহীন বেকার যুবক জহরলাল ভাবলেন, জীবন তো থেমে থাকবে না, জীবনের প্রয়োজনে কিছু একটা করতেই হবে। অথচ কোনো পুঁজিও নেই। ২০০৯ সালে একজনের কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার নিয়ে চায়ের টং দোকান দেন। বিস্কুট, কলা, চকলেট আর চা। টেনেটুনে চলছিল দোকান। তখনও তিনি অবিবাহিত। বিয়ের কথা বললে অনেকেই তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলত- ল্যাংড়া মানুষের আবার বিয়ের শখ!

কোনো মেয়ে পক্ষই রাজি হচ্ছিল না। তখন জহরলালকে বিয়ে করতে রাজি হন পাশের গ্রামের শিপরা রানী দাস। ২০১০ সালে বিয়ে করেন তিনি। তারপর থেকেই স্ত্রী শিপরা হয়ে ওঠেন জহরলালের হাতের লাঠি, মনের সাহস। ২০১২ সালে জন্ম নেয় তাদের প্রথম সন্তান হরে কৃষ্ণ দাস। কৃত্রিম পা দিয়ে পুনরায় হাঁটার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। জহরলালের সেই স্বপ্নপূরণে এগিয়ে আসে হাতিয়া দ্বীপের কিছু সমাজকর্মী। তাদের প্রচেষ্টায় সংগ্রহ করা হয় অর্থ। ঢাকাতে শুরু হয় আবার চিকিৎসা, তৈরি করা হয় কৃত্রিম পা। কিন্তু বিধি বাম। কোমরের হাড়ের একটি অংশ না থাকায় কৃত্রিম পা সংযোজন করা সম্ভব হয়নি তার। ভাগ্যের বিপর্যয়ে আবারও হতাশ হন জহরলাল।

টং দোকানেই মন বসান তিনি। দোকানে বেচাবিক্রিও বেশ হচ্ছিল। দোকানের আয়ে চলছিল সংসার। আবার দুর্ঘটনা। ২০১৬ সালে এক রাতে দোকানে চুরি হয়। লুট হয় নগদ ৩০ হাজার টাকাসহ দোকানের মালামাল। জহরলাল হার মানেন না। আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেন। এবার বাধ্য হয়ে শূন্য হাতেই শুরু করেন নবযাত্রা। স্থানীয় এনজিও থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে আবার শুরু করেন দোকান। কিন্তু জহরলালের দুঃখ পিছু ছাড়ে না। ২০১৭ সালের এপ্রিলে মালবাহী ভ্যান গাড়ির চাকার নিচে পড়ে একমাত্র সন্তান হরে কৃষ্ণ দাশের দুই পা ভেঙে যায়। সে হাসপাতালে এখনও চিকিৎসাধীন।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ অক্টোবর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়