ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

তেজগাঁও-কুর্মিটোলায় পঞ্চাশ টনেরও বেশি বোমা নিক্ষেপ

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৫ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তেজগাঁও-কুর্মিটোলায় পঞ্চাশ টনেরও বেশি বোমা নিক্ষেপ

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে মিত্রবাহিনীর ট্যাঙ্ক

শাহ মতিন টিপু : ১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর । চারদিকেই তখন বিজয়ের রণধ্বনি।  মিত্রবাহিনীর দখলে ঢাকার আকাশ । তেজগাঁও ও কুর্মিটোলায় পঞ্চাশ টনেরও বেশি বোমা ফেলা হয়েছিল মাত্র ১২ ঘন্টায়।
অন্যদিকে নিঃশেষ পাকবাহিনীর সব জঙ্গী বিমান । দেশের বিভিন্ন অঞ্চল দখলমুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার দিকে আসতে থাকেন।

একদিকে সম্মুখযুদ্ধের উন্মাদনা অপরদিকে কূটনৈতিক যুদ্ধ- দুটি দিকেই বাংলাদেশ জয়ের ধারায়, হারতে থাকে পাকিস্তান। আসলে আজকের দিনে লড়াইটা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের । পাকিস্তানের সামরিক জান্তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করে। পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পেশ করে। এ প্রস্তাবের পাশাপাশি ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহারসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরও কিছু প্রস্তাব উপস্থাপন করে।

নিরাপত্তা পরিষদের ১৪ সদস্যের মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ড এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে, তবে ১০টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে মত দেয়। ব্রিটেন ও ফ্রান্স ভোটদানে বিরত থাকে। এমনই পরিস্থিতিতে প্রস্তাবটি যাতে পাস হতে না পারে সেজন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তাবের বিপক্ষে ভেটো প্রদান করায় প্রস্তাবের মৃত্যু ঘটে। পাকিস্তানের শেষ প্রত্যাশার সলতে টুকুও দপ করে নিভে যায়।

বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চোখে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে যুদ্ধরত বাংলাদেশ। কামান-গোলাসহ মারণাস্ত্রের সামনে যার যা কিছু ছিল তাই নিয়ে বাংলার মুক্তিসেনাদের সম্মুখযুদ্ধ দেখে বিস্মিত হয়ে যায় গোটা পৃথিবী। বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্ব হারাতে থাকে পাকিস্তান। জাতিসংঘে উত্থাপিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবও নাকচ হয়ে যায়।

ডিসেম্বরের শুরু থেকেই বাঙালীর সম্মুখযুদ্ধে একের পর এক পরাজয়ে পায়ের তলা থেকে মাটিও সরে যেতে থাকে পাক হানাদারদের। তার ওপর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর শাণিত আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা। ইয়াহিয়া বুঝতে পারেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। পাকিস্তান পরাজয়ের বিষয়টি বুঝতে পেরে নতুন কূটকৌশলে লিপ্ত হন।

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভারতীয় হামলা প্রতিরোধে প্রতিরক্ষা তহবিলে মুক্তহস্তে সবাইকে দান করার আহ্বান জানান। পাকিস্তানী সেনাপ্রধান অবসরপ্রাপ্ত ৫৫ বছরের কম বয়সী মেজর পর্যন্ত সব সৈনিককে নিকটস্থ রিক্রুটিং অফিসে হাজির হওয়ার জন্য আবার নির্দেশ দেন। বাঙালীর জন্মভূমি আদায়ের লড়াইকে আড়াল করতে পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়েছে বলে বেতারে ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান।

কিন্তু কোন কৌশলেই বাঙালীকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। মাতৃভূমিকে হানাদারমুক্ত করতে তারা মরণপণ লড়াই চালিয়ে যান। একদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাণপণ লড়াই, অন্যদিকে মিত্রবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণ। প্রাণ বাঁচাতে পাক হানাদাররা বীর বাঙালীর কাছে আত্মসমর্পণের পথ খুঁজতে থাকে।

মিত্রবাহিনীর যুদ্ধেরও তৃতীয় দিন আজ। ভারতীয় বিমানবাহিনীর লাগাতার আক্রমণে দিশেহারা পাকিবাহিনী। তেজগাঁও ও কুর্মিটোলায় পঞ্চাশ টনেরও বেশি বোমা ফেলে। রানওয়েতে ২০ ফুট চওড়া গর্তের সৃষ্টি হয়।

ভারতের বিমানবাহিনীর হিসাব মতে, ১২ ঘণ্টায় ২৩২ বারে তেজগাঁও এবং কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটিতে ৫০ টনের মত বোমা ফেলা হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর কনভয়ের ওপরও বিমান আক্রমণ চলে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর ৯০টি গাড়ি ধ্বংস হয়। এ ছাড়াও পাকিস্তানি বাহিনীর সৈন্য বোঝাই কয়েকটা লঞ্চ এবং স্টিমার ধ্বংস হয়। বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনীর যৌথকমান্ডের সফল আক্রমণে পাকিস্তানি নৌবহরের গর্ব সাবমেরিন 'গাজী'  ধ্বংস হয়। সাবমেরিনটি যুক্তরাষ্ট্র হতে পাকিস্তান ধার হিসাবে পেয়েছিল।

জামালপুর ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার, ঝিনাইদহ, সান্তাহার, ময়মনসিংহ ইয়ার্ড মিত্রবাহিনীর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি দখল করে নেয় মিত্রবাহিনী। বাংলার উন্মুক্ত আকাশে মিত্রবাহিনীর বিমান অবাধে বিচরণ করে। জামালপুরে বিমান হামলায় কয়েকশ’ পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়।

মিত্রবাহিনী বাংলাদেশের চারদিক থেকে বিজয় দেখে এগিয়ে যায়। ভারতের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলিত হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়ার দক্ষিণ এবং পশ্চিমাংশ দিয়ে অবরোধ করে। পাকিস্তানি বাহিনী অবশেষে আত্মসমর্পণ করে। ফলে আখাউড়া সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়।

মিত্রবাহিনীর বিজয় দেখে জেনারেল নিয়াজী পাকিবাহিনীকে পেছনের দিকে সরে আসার নির্দেশ দেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দ্রুত চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়।

মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়াতে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী জাতির উদ্দেশে বেতারে ভাষণ প্রদান করেন। এদিকে 'পূর্ব পাকিস্তান'-এর পুতুল শাসক গভর্নর ডা. মালিক দেশবাসীর কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। তিনি বলেন, ‘দেশ আক্রান্ত’।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ ডিসেম্বর ২০১৭/ টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়