ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৫ বছর পূর্ণ

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ৬ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৫ বছর পূর্ণ

শাহ মতিন টিপু : বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৫ বর্ষপূর্তি আজ। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর উগ্রহিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যার এই ঐতিহাসিক স্থাপনাকে ধূলিসাৎ করে দেয়।

ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের কণ্টকিত ইতিহাসে বাবরি মসজিদে হামলা একটি ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’৷ গুটি কয়েক হিন্দু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দিনটিকে সূর্য দিবস বলে আখ্যায়িত করলেও বেশিরভাগ ভারতীয় দিনটিকে ‘কালো দিন’ বলে উল্লেখ করেন৷ অনেকেই বলেন, এই ঘটনায় দেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি একেবারে ভূলুন্ঠিত হয়েছিল৷

বাবরি মসজিদের গায়ে উৎকীর্ণ লিপি সূত্র মতে, ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা জহিরুদ্দীন মোহাম্মদ বাবরের নির্দেশে মীর বাকী ১৫২৮-২৯ সালে এটি নির্মাণ করেছিলেন। এই মসজিদ উত্তর প্রদেশের বৃহত্তম মসজিদগুলোর একটি হিসেবে গণ্য হতো।

বাবরি মসজিদ নিয়ে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত এবং মামলা-মোকদ্দমার সূচনা হয়েছে এটি নির্মাণ করার কয়েক শ’ বছর পর। জানা যায়, ১৮৫৩ সালে একদল হিন্দু ‘সাধু’ সর্বপ্রথম বাবরি মসজিদ চত্বর দখল করে এর ওপর মালিকানা দাবি করেছিলেন। ফলে পরের দুই বছর এ নিয়ে মাঝে মধ্যে সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এ অবস্থায় প্রশাসন এখানে মন্দির নির্মাণের অনুমতি যেমন দেয়নি, তেমনি এটাকে প্রার্থনার জন্য ব্যবহার করতে দিতে চায়নি।

১৮৫৫ সালে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষের পর মসজিদের সীমানা দেয়াল তোলা হয় যাতে বিবাদ এড়ানো যায়। এরপর মুসলমানরা দেয়ালের ভেতরে নামাজ পড়তেন এবং হিন্দুরা বাইরে একটি উঁচু চত্বরে পূজা করতেন। ১৮৮৩ সালে এই চত্বরে মন্দির নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হলে মুসলমানরা প্রতিবাদ জানান এবং প্রশাসন মন্দির নির্মাণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। তখন জনৈক হিন্দু পুরোহিত দেওয়ানি মামলা করেন। একজন হিন্দু বিচারকই পুরোহিতের মামলা খারিজ করে দেন। এর বিরুদ্ধে পরপর দুইবার আপিল করা হলে সেটাও খারিজ হয়ে যায়।

এরপর প্রায় অর্ধশতাব্দী কেটে যায়। ১৯৩৪ সালে অযোধ্যায় দাঙ্গা বাধলে দাঙ্গাকারীরা মসজিদের দেয়ালগুলো এবং একটি গম্বুজের ক্ষতি করে। সরকার তা পুনর্নির্মাণ করে দেয়। ১৯৩৬ সালে আইন মোতাবেক বাবরি মসজিদ ও সংলগ্ন গোরস্থান ওয়াকফ সম্পত্তি হিসেবে রেজিস্ট্রি করা হয়।

ভারত স্বাধীন হওয়ার পরই বাবরি মসজিদ ইস্যু চরম আকার ধারণ করে। ১৯৪৯ সালে ‘অখিল ভারতীয় রামায়ণ মহাসভা’ মসজিদের ঠিক বাইরেই ৯ দিন ধরে অবিরাম রামচরিতমানস পাঠের আয়োজন করে। এই কর্মসূচি শেষ হওয়ার সাথে সাথে রাতের বেলায় ৫০-৬০ জন মসজিদে ঢুকে রাম ও সীতার মূর্তি সেখানে স্থাপন করে। পরদিন মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়, ‘বাবরি মসজিদের ভেতরে অলৌকিকভাবে মূর্তির আবির্ভাব ঘটেছে।’ এটা দর্শন করে পুণ্য সঞ্চয়ের জন্য ভক্তদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। ফলে হাজার হাজার হিন্দু নর-নারী সেখানে আসতে শুরু করেন। এ অবস্থায় সরকার মসজিদটিকে ‘বিতর্কিত এলাকা’ ঘোষণা করে গেটে তালা লাগিয়ে দেয়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরু ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল  উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দবল্লভ পন্থ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বাবরি মসজিদ থেকে মূর্তি সরিয়ে দেওয়ার জন্য; কিন্তু ফয়জাবাদের হিন্দু জেলা প্রশাসক ‘জনতার প্রতিশোধের ভয়ে’ এ আদেশ পালন করেননি। সেখানে রাম-সীতার পূজার অনুমতির জন্য মামলা করা হয়। ১৯৫৯ সালে এই মসজিদের দখলিস্বত্ব পাওয়ার জন্য হিন্দুদের একটি ধর্মীয় সংগঠন মামলা করে। পরে সুন্নি মুসলমানদের ওয়াক্ফ বোর্ড মসজিদ থেকে মূর্তি সরিয়ে জায়গাটার মালিকানা তাদের দেওয়ার জন্য মামলা করে।

১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ‘মন্দির ধ্বংস করে বাবরি মসজিদ নির্মাণ’ করার প্রচারণা চালায় দেশব্যাপী। এ জন্য রথযাত্রার আয়োজন করা হয়। ১৯৮৬ সালে মসজিদটিতে পূজার অনুমতি চেয়ে আবার মামলা করা হলে কংগ্রেসের রাজীব গান্ধী সরকার জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে মসজিদ গেটের তালা খোলার নির্দেশ দেয়। এর আগে থেকেই একজন পুরোহিত বছরে একবার সেখানে পূজা করতেন। এবার সব হিন্দু প্রবেশের অধিকার পাওয়ায় মসজিদটি অনেকটা মন্দিরের রূপ ধারণ করে। এ দিকে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সেখানে শিলান্যাস বা ‘প্রস্তর স্থাপন’ অনুষ্ঠানের অনুমতি পেয়ে যায়।

১৯৯২ সালে বিজেপির শীর্ষ নেতা এল কে আদভানির নেতৃত্বে ১০ হাজার কিলোমিটার রথযাত্রা করা হয় বাবরি মসজিদের জায়গায় মন্দির স্থাপনের লক্ষ্যে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য। ৬ ডিসেম্বর কয়েক হাজার সাম্প্রদায়িক লোক পূজা এবং ‘করসেবা’র নামে বাবরি মসজিদ প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। একপর্যায়ে তারা মসজিদটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। ভারত সরকারের গঠিত ‘লিবেরহান কমিশন’ তদন্ত করে এল কে আদভানি, অটল বিহারি বাজপেয়ী ও কল্যাণ সিং (মুখ্যমন্ত্রী)সহ ৬৮ জনকে দায়ী করেছে বাবরি মসজিদ ধ্বংসযজ্ঞের জন্য।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৫ তম বর্ষপূর্তির লগ্নে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়, ‘বাবরি মসজিদের  ইমারত ধ্বংসকার্যের ছবিই এখন ভারতীয় রাজনীতির একটি বহুল প্রচারিত পোস্টার। গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে ছবিটি ফিরে ফিরে তুলে ধরা হয়। গুঁড়িয়ে দেওয়া মসজিদের জায়গাটি ফাঁকা এখনও আছে, ওই রাম জন্মভূমিতে রামলালার মন্দির করতে হবে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের প্রধান মোহন ভাগবত বলে দিয়েছেন যে, সামনের বছরের মধ্যেই মন্দির উঠে যাবে।’

‘২০১৮-র ডিসেম্বরের মধ্যেই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কাজ রাম মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটনেই উদ্‌যাপিত হবে, মোহন ভাগবত এ হেন আশ্বাস দিয়েছেন।’

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৫ তম বর্ষপূর্তির এই দিনটিতে আজ অযোধ্যায় ব্যাপক নিরাপত্তার ব্যবস্থা হয়েছে। বামপন্থী দলগুলো দিনটিকে ‘কালো দিবস’ হিসেবে পালন করছে। অন্যদিকে, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ‘শৌর্য দিবস’ হিসেবে পালনের ডাক দিয়েছে। অযোধ্যা শহরে নিরাপত্তা বাহিনীকে সতর্ক রাখা হয়েছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ ডিসেম্বর ২০১৭/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়