ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ভিনদেশি বন্ধু

যুদ্ধদিনের অকুতোভয় বন্ধু সাইমন ড্রিং

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫২, ৬ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যুদ্ধদিনের অকুতোভয় বন্ধু সাইমন ড্রিং

ইয়াসিন হাসান : ১৯৭১ সাল। দেশ স্বাধীন করতে আমাদের দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতে হয়েছে। পাকিস্তানিদের বর্বরোচিত হামলা, নিপীড়ন, দুর্দশা কাটিয়ে লাল-সবুজের জয় হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান ৯৩ হাজার সৈন্যসহ আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের মধ্য দিয়ে পরিসমাপ্তি ঘটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের। বাংলাদেশি না হয়েও এদেশের নিপীড়িত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এসেছিলেন যারা, মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নভাবে রেখেছেন অবদান, এমনকি অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রণাঙ্গণে লড়াই করেছেন, সেইসব ভিনদেশি বন্ধুদের নিয়ে বিজয়ের এই মাসে রাইজিংবিডি’র বিশেষ আয়োজন।

‘সাইমন ড্রিং বহু বাংলাদেশির কাছে হিরো। তিনি একমাত্র সাংবাদিক যিনি ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের ভয়াবহতা এবং নৃশংসতা শুরু থেকেই কভার করেছিলেন। এ কারণে বাংলাদেশ থেকে তাকে সম্মানসূচক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছিল। ভারতে মার্ক টালি যেমন, সাইমন ড্রিং আমাদের কাছে ছিলেন সেরকমই একজন।’ ২০০২ সালের ২ অক্টোবর ইংল্যান্ডের ডেইলি টেলিগ্রাফকে বলেছিলেন ক্রিকেট সংগঠক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সাবের হোসেন চৌধুরী।

ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং ছিলেন অকুতোভয় এবং মেধাবী সাংবাদিক। গুণী এ সাংবাদিক বিশ্বের সকল বড় বড় প্রতিষ্ঠান বিবিসি, রয়টার্স, টেলিগ্রাফ, ওয়াশিংটন পোস্টে কাজ করেছেন। সাফল্যর স্বীকৃতি হিসেবে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন।  এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্টার অব দ্য ইয়ার-১৯৭১।

সাইমন ড্রিং আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কী করেছিলেন? তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর জঘন্য ও নৃশংসতার বিবরণ তুলে ধরেন বিশ্ব দরবারে। তিনি বিশ্বকে জানান কীভাবে পাকিস্তানি সৈন্যরা এদেশের নিরীহ মানুষের উপর অত্যাচার, অবিচার করছে এবং নির্বিচারে গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছে। ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ ঢাকা আসেন সাইমন ড্রিং। তবে ১৯৬৮ সালে তার ঢাকায় আসার একটি খবরও রয়েছে। তিনি সে সময় কেন এসেছিলেন তা অজানা। দ্বিতীয় দফায় ঢাকায় আসার পরদিনই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার সুযোগ হয় তার। মঞ্চের খুব কাছে দাঁড়িয়ে পুরো ভাষণ শুনেছিলেন সাইমন।

এরপর ঢাকায় বিভিন্ন কাজ করছিলেন। এভাবেই পাড় হয়ে যায় দুই সপ্তাহ। এসে যায় ২৫ মার্চ। তিনি জানতে পারেন পশ্চিম পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খান কোনো সমঝোতা ছাড়াই ঢাকা ত্যাগ করছেন।  পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে সাইমন ধারণা করেন ঢাকায় ভয়ংকর কিছু হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে বিদেশি সকল সাংবাদিকদের একসঙ্গে করে রাখা হয় ইন্টারকন্টিনেন্টালে। তাদের গার্ড দেয় পাকিস্তানের মিলিটারি বাহিনী। তার সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। এরই মধ্যে উপস্থিত সকল সাংবাদিক জানতে পারেন ঢাকায় গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছে পাকিস্তানের সৈন্যরা। রাতেই পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের মেজর সালেক সিদ্দিকী নিরাপত্তার অজুহাতে সকল বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা ত্যাগের নির্দেশ দেয়। কিন্তু নিজ ইচ্ছায় বাংলাদেশে থেকে যান সাইমন। কীভাবে? হোটেলে বাঙালি কর্মচারীর সঙ্গে সখ্য গড়ে হোটেলেই লুকিয়ে পড়েন সাইমন। ৩২ ঘণ্টা সময় কাটান হোটেলের লবি, ছাদ, বার এবং কিচেনে। বাঙালি হোটেল বয়ের সাহায্যে হোটেল ছেড়ে বের হয়ে প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে (আগে নাম ছিল ইকবাল হক) যান সাইমন। সেখানে গিয়ে বিভীষিকাময় অধ্যায়ের মুখোমুখি হন তিনি। ছাত্রদের মৃতদেহ পুড়ছিল, অনেক মৃতদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। চারুকলা গিয়ে জানতে পারেন সেখানেও হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে। আশপাশের এলাকাগুলো ঘুরে চিত্র এবং তথ্য জোগাড় করতে থাকেন সাইমন। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে গিয়ে দেখেন পাকিস্তানি সেনারা পতাকা উড়িয়ে রেখেছে এবং শত শত মৃহদেহ ট্রাকে তুলে নিচ্ছে।

একদিন পর ব্রিটিশ হাই কমিশনের সহায়তায় ঢাকা ছাড়েন সাইমন। কিন্তু তাকে এয়ারপোর্টে নাজেহাল করা হয়। উলঙ্গ করে চেক করা হয় সাথে কী নিয়ে যাচ্ছেন! তার ক্যামেরা নিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি। পায়ের মোজায় কাগজ লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু ধরা পড়ে যান। এরপর তার পায়ুপথে লাঠি ঢুকিয়ে পরীক্ষা করা হয়। প্রথমে তাকে পাকিস্তানের করাচিতে পাঠানোর চিন্তা করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন, পাকিস্তান গেলে তিনি প্রতিবেদন তৈরি করতে পারবেন না। তাই ব্যাংকক চলে যাওয়া স্থির করেন। ব্যাংকক থেকে ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রতিবেদন পাঠান ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’শিরোনামে। ৩০ মার্চ তা প্রকাশিত হয়। এটাই ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত বহির্বিশ্বে প্রচারিত প্রথম সংবাদ। এই খবরটি ছাপা হবার পর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিদেশীদের টনক নড়ে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনমত সৃষ্টিতে এ প্রতিবেদনটি বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে সাড়া জাগিয়েছিল।

প্রতিবেদনে তিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, ‘আল্লাহর নামে আর অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত ও সন্ত্রস্ত এক নগর। পাকিস্তানি সৈন্যদের ঠান্ডা মাথায় টানা ২৪ ঘণ্টা গোলাবর্ষণের পর এ নগরে অবশিষ্ট আর কিছু নেই।’

তার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের একটি চিত্র সবার সামনে উঠে আসে এবং এরপরই পাকিস্তানকে চাপ দিতে শুরু করে আন্তর্জাতিক মহল। সায়মন ড্রিং বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু। তার সাহসী ভূমিকায় পুরো বাংলাদেশ আজও তার কাছে কৃতজ্ঞ। স্বাধীনতার পর কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন সাইমন। পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগের মেজর সালেক সিদ্দিকী তার সঙ্গে আবার দেখা করেন। তিনি জানতে চান, ২৫ মার্চ রাতে যদি তাকে পেত তাহলে কী করা হতো? সালেক সিদ্দিকী জানান, ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হতো। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি ঢাকা ফিরে আসার পর তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সেদিন তার জন্মদিন হওয়ায় বঙ্গবন্ধু কেক কেটে জন্মদিন উদযাপনের ব্যবস্থা করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখায় ইংল্যান্ডের এই সাংবাদিককে বাংলাদেশ সরকার পরবর্তী সময়ে সম্মাননা দেয়। সেই সম্মানে সম্মানিত হয়ে তিনি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করেন দেশের প্রথম বেসরকারী টেলিভিশন ‘একুশে’।

তথ্যসূত্র : দ্য টেলিগ্রাফ




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়