ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

উপকূলের পথে

চর রমণীমোহন, দুর্যোগ-তাড়িত মানুষের ঠাঁই

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১১, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চর রমণীমোহন, দুর্যোগ-তাড়িত মানুষের ঠাঁই

রফিকুল ইসলাম মন্টু, লক্ষ্মীপুরের চর রমণীমোহন ঘুরে: দুপুর গড়িয়ে বিকেল; কারও ঘরেই নেই রান্নার আয়োজন। সকলেই ব্যস্ত কাজে। নারী-শিশুদের কেউ গরু-মহিষের খাবার সংগ্রহে ব্যস্ত। আবার কারও ব্যস্ততা রান্নার জন্য জ্বালানি কুড়োতে। কারও সময় কেটে যাচ্ছে অলস। আর পুরুষেরা সকলেই রোজগারের খোঁজে বাইরে। কেউ জাল-নৌকা নিয়ে নদীতে; কেউবা নদী পেরিয়ে শহরে।

এ চিত্র চোখে পড়লো চর রমণীমোহনে। লক্ষ্মীপুরের কালকিনি ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী মৎস্যকেন্দ্র মতিরহাট পেরিয়ে নদীর ওপারে এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপে ছড়ানোর ছিটানো বাড়িঘরে প্রায় শ’খানেক পরিবার বসবাস করছে। কোন পরিবার লক্ষ্মীপুরের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে ভিটে হারিয়ে এখানে এসেছে, আবার কেউবা একইভাবে সর্বস্ব হারিয়ে এসেছে মেঘনার ওপারের ভাঙন কবলিত গ্রাম থেকে। দ্বীপের প্রায় সবগুলো পরিবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার।

দ্বীপের বাসিন্দাদের সাথে আলাপে জানা গেল, নদী ভাঙন, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে পরিবারগুলো অন্তত ৫-৬ বার বাড়ি বদল করে অবশেষে এখানে এসে ঠাঁই নিয়েছে। বসবাসের উপযোগিতা না থাকা সত্বেও মানুষগুলো নিরুপায় হয়ে এখানে এসে বসতি গড়েছে। বর্ষায় গোটা দ্বীপ ডুবে থাকে ৭-৮ ফুট পানির নিচে। পরিবারগুলো তখন ঘরের উপরে মাচা পেতে বাস করে। আর এক ঘর থেকে আরেক ঘরে; কিংবা হাটবাজারের জন্য শহরে যেতে যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম নৌকা।

মেঘনার বুকে জেগে ওঠা এই দ্বীপে রয়েছে দু’টো অংশ। একটি চর রমণীমোহন নামে পরিচিত; অপরটি চর সামসুদ্দিন নামে। দক্ষিণ দিকে মেঘনার ভাঙনপ্রবণ এলাকায় চর সামসুদ্দিনের অনেকটা এরই মধ্যে নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। এই অংশে একটি আবাসান করা হয়েছিল। সেটি এখন নেই। আবাসনের কিছু পরিবার নিরুপায় হয়ে মাটি আঁকড়ে দ্বীপেই আছে; কেউ কেউ আবার চলে গেছে অন্যত্র। চর সামসুদ্দিনের কিছু অংশ আর চর রমণীমোহন মিলে শ’খানেক পরিবার এখন অত্যন্ত মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।

 


মৎস্যকেন্দ্র মতিরহাট থেকে অনিয়মিত খেয়া পারাপার চর রমণীমোহনে। ভর দুপুরে এক সন্তান কোলে মতিরহাট ঘাটে খেয়ার অপেক্ষায় লাইলি বেগম। বয়স ৩০ পেরোয়নি এখনও। কোলের শিশুটির বয়স ৩-৪ বছর। কিন্তু ৭ বছর বয়সী বড় ছেলে সুমন ক’দিন আগেই অকালে প্রাণ হারিয়েছে। পুকুরের কাছে তরকারি সংগ্রহ করতে গিয়ে পানিতে ডুবেই তার মৃত্যু ঘটে। লাইলি বেগমের সঙ্গে খেয়া পার হতে হতে আলাপ হলো চরের সার্বিক অবস্থা নিয়ে। বললেন, মানুষগুলো অত্যন্ত কষ্টকর জীবন কাটাচ্ছে। অন্য কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই বলে এরা এখানেই পড়ে আছে।

চরে রমণীমোহন খেয়াঘাটে নেমে লাইলি বেগম তর্জনী উঁচিয়ে দেখিয়ে দিলেন দ্বীপের মাঝখানে টিনের ঘরের পাশে ছোট ভাঙা ঘরটাই তার। স্বামী আলাউদ্দিন জন্ম থেকেই প্রতিবন্ধি। কোন কাজ করতে পারেন না। বাইরের কাজ লাইলিকেই গোছাতে হয়। ছেলেটি মাকে সাহায্য করছিল; কিন্তু সেও নেই। লাইলি এখন একেবারেই অসহায়। লক্ষ্মীপুরেই তাদের মূল বাড়ি ছিল। বেশ কয়েক স্থানে বসতি বদল করে অবশেষে এই চরে এসে ঠাঁই নিয়েছেন।

দ্বীপের আরেক বাসিন্দা বিবি সুলতানা (২৫)। স্বামী মো. হানিফ। নদীতে মাছ ধরেন। মূল বাড়ি ছিল লক্ষ্মীপুরের কমলনগরের পাটারীহাটের কৃষ্ণপুরায়। কয়েকবার নদীর ভাঙনের শিকার হয়ে অবশেষে এখানে এসেছেন। এখানে চরের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করে কোনমতে জীবিকা নির্বাহ করেন। শিশুরা গরু-মহিষ লালন পালনের কাজে মালিকের কাছ থেকে কিছু মজুরি পায়।

বিবি সুলতানার ঘরে সদস্য সংখ্যা ৫জন। স্বামী এবং তিন ছেলেমেয়ে। বড় ছেলের বয়স ৯ হলেও স্কুলের পাঠানোর সুযোগ হয়নি। জীবিকা নির্বাহের জন্য সে এখনই কাজে যোগ দিয়েছে। এভাবেই চলছে সংসার। ঘরে গিয়ে দেখা যায় ছোট্ট ঘরের এককোণে হাড়িপাতিল, একপাশে কাঁথাবালিশ। পাশের বারান্দায় গরু রাখার জায়গা। ঘরের উপরে কাঠঘড়ির মাচা পাতা রয়েছে। প্রচন্ড শীতেও ঘরের মাটিতেই বিছানা পেতে রাত কাটিয়ে দেন মানুষগুলো। উঠোনে খড়ের গাঁদার দিকে আঙুল তুলে সুলতানা জানালেন, বেশি শীতে বিছানার নিতে খড় বিছিয়ে নেন। আর বর্ষায় যখন জোয়ারের পানিতে ঘর তলিয়ে যায়, তখন মাচার উপরে ওঠেন।

 


আরেকজন ইয়ানুর বেগম (৩৫)। স্বামী কামাল হোসেন নদীতে মাছ ধরেন। ভোলার ইলিশার চর আনন্দ থেকে প্রায় ১০ বছর আগে এখানে এসেছেন। সেখানাকার বাড়িঘর মেঘনায় ভেঙে গেছে। চর আনন্দতে এক সময় ব্যাপক গোলযোগ হতো। এ কারণে বহু পরিবার অন্যত্র চলে যায়। কামাল হোসেনের এই পরিবারটিও চলে আসতে বাধ্য হয়। ইয়ানুর জানান, অন্যকোন স্থানে যাওয়ার সুযোগ না থাকায় এই পরিবারগুলো এখানে পড়ে আছে। আমরা কেমন আছি, তা জানতে হলে বর্ষাকালে আসতে হবে। ছিন্নমূল মানুষদের জন্য সরকারের কাছে অনেক কিছু আছে। আমরা তো কিছুই পাইনি। শুকনোর কয়েকটা মাস একটু ভালো থাকলেও বর্ষায় আমাদের দুর্ভোগ মারাত্মক আকার ধারণ করে।

গোটা দ্বীপ ঘুরে দেখা গেল, ছড়ানো ছিটানো বাড়িঘর। চরের সমতল জমিতে মাটি দিয়ে ৫-৬ ফুট উঁচু ভিটে তৈরি করে বানানো হয়েছে ঘরগুলো। কোন ঘরে টিনের চালা, আবার কোন ঘরে খড়ের ছাউনি। অধিকাংশ ঘরে পাতার বেড়া। ছোট ছোট নড়বড়ে ঘরগুলোর একই মেজেতে পরিবারের সকলে গাদাগাদি করে বসবাস করে। কালকিনি ইউনিয়নের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. মেহেদী হাসান লিটন বলেন, বাইরে জমি কেনার সামর্থ্য নেই, এমন পরিবারগুলোই আসলে এখানে পড়ে আছেন। এদের জীবনযাপন অত্যন্ত মানবেতর। চর সামসুদ্দিনে একটি আবাসন থাকলেও সেটি নদীগর্ভে হারিয়ে গেছে। আমরা ভাঙন প্রতিরোধের জন্য দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন করেছিলাম। কিন্তু এ বিষয়ে কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।   

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়