ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস: বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যস্থল

ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার এবং আব্দুল্লাহ আল নাঈম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৮, ১৮ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস: বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্যস্থল

অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার এবং আব্দুল্লাহ আল নাঈম : ‘ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল ফর মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস (ICOMOS)’ ১৯৮২ সালে তিউনিশিয়ায় একটি আলোচনা সভায় ১৮ এপ্রিলকে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর মনুমেন্টস অ্যান্ড সাইটস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৩ সালে দিনটি ‘বিশ্ব ঐতিহ্য দিবস’ হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পায়। ২০০৯ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ৩টি স্থানকে বিশ্ব ঐতিহ্যস্থল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। ঐতিহ্যস্থলগুলো হচ্ছে- নওগাঁর পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার (আদি নাম সোমপুর মহাবিহার), বাগেরহাটের মসজিদ শহর এবং সুন্দরবন।

এই তিনটির মধ্যে পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার (১৯৮৫) ও বাগেরহাট মসজিদ শহর (১৯৮৫) বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যভুক্ত প্রত্নস্থল। অপরদিকে প্রাকৃতিক স্থান হিসেবে বিশ্বে প্রাকৃতিক ঐতিহ্যস্থলভুক্ত হয়েছে সুন্দরবন (১৯৯৭)। এটি পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। এছাড়াও বিশ্বের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জায়গা পেয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং শীতলপাটি। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণকেও ইউনেস্কো আওতাভুক্ত করেছে ২০১৭ সালে ‘মেমরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে।

১৬-২৫ জুন ২০১৪ সালে কাতারের রাজধানী দোহায় অনুষ্ঠিত বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৩৮তম বৈঠকে নতুন করে ২৬টি স্থানকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত করে যেখানে বাংলাদেশের আরো ৫টি স্থানকে বিশ্ব ঐতিহ্যস্থলে সাংস্কৃতিক শাখায় সম্ভাব্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এগুলো হলো বগুড়ার মহাস্থানগড়, কুমিল্লার লালমাই ময়নামতি গ্রুপ অব মনুমেন্ট,  ঢাকার লালবাগ কেল্লা, নওগাঁর হলুদ বিহার ও জগদ্দল বিহার। কেন এই সব ঐতিহ্য এতো গুরুত্বপূর্ণ? প্রথমত বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতিসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। বাংলাদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য একটি দেশের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা অনুধাবন করা মুশকিল। এই সব ঐতিহ্যকে জানার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিবছর অনেক পর্যটক বাংলাদেশে আসছে। যা একটি দেশের পরিচিতি এবং অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বিশ্বের দরবারে।

সোমপুর মহাবিহার : সোমপুর মহাবিহার সম্রাট ধর্মপাল দ্বারা নির্মিত হয়েছিল আজ থেকে প্রায় এক হাজার দুইশ বছর আগে। আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো দেশ বিদেশ থেকে শিক্ষক শিক্ষার্থীরা এখানে বৌদ্ধ ধর্ম ও দর্শন ছাড়াও চিকিৎসা বিজ্ঞান, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা, কৃষি প্রযুক্তি, গণিত ইত্যাদি চর্চা করতে আসতেন এসব বৌদ্ধবিহারে। স্থানীয় লোকজনের কাছে ৮০ ফুট উঁচু ঢিবি পাহাড়ের ন্যায় মনে হতো, তাই পরবর্তীতে তাদের কাছে এটির আধুনিক নাম হয় পাহাড়পুর। এখানে নির্মিত ছিল বর্গাকার চারটি বাহুতে ১৭৭টি ভিক্ষুকোঠা এবং মাঝখানে ছিল একটি অসাধারণ মন্দির। এই মন্দির তলপত্তনে ৬৩টি প্রস্তর মূর্তি দ্বারা সুশোভিত ছিল। এদের মধ্যে ৬২টি হিন্দু ধর্মাবলম্বীর এবং একটি মূর্তি বৌদ্ধদের। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, একটি জৈন বিহারের ওপর পাল আমলের বৌদ্ধবিহারটি নির্মিত হয়েছিল পঞ্চম শতকে।

বাগেরহাট মসজিদ শহর : ঐতিহাসিক মসজিদের শহর বাগেরহাট ১৯৮৫ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ইউনেস্কো এ শহরটিকে তালিকাভুক্ত করে ‘স্থাপত্য কর্মের একটি অসাধারণ নিদর্শন হিসেবে’, যা মানব ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বর্নণা করে। এদের মধ্যে ষাট গম্বুজ মসজিদ অন্যতম। এছাড়াও খান জাহানের সমাধী, সিংরা মসজিদ, নয় গম্বুজ মসজিদ ইত্যাদি। সুলতানাদের একজন প্রশাসকের সমাধি থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, শহরটি ১৫ শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়। শহরটির পরিকল্পনায় ইসলামিক স্থাপত্যরীতির প্রভাব আছে। এই শহরে ৩৬০টি মসজিদ ছিল যার অধিকাংশের নকশা সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী এবং স্বতন্ত্র। এছাড়াও অসংখ্য সরকারি ভবন, গোরস্থান, সেতু, সড়ক এবং জলধারের উপস্থিতি ছিল।

সুন্দরবন : বৃহত্তর সুন্দরবনের বাংলাদেশে ও ভারতীয় অংশ একই নিরবিছন্ন ভূমিরূপের অংশ হলেও ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের সূচিতে ভিন্ন ভিন্ন নামে তালিকাভুক্ত হয়েছে যথাক্রমে সুন্দরবন ও সুন্দরবন জাতীয় উদ্যান নামে। সুন্দরবন পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের একটি যা, প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র ও বিভিন্ন ধরনের প্রাণীর আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। পৃথিবীখ্যাত বিরল রয়েল বেঙ্গল টাইগার এই বনের প্রধান আকর্ষণ। ২০০৪ সালে ইউএনডিপি, বাংলাদেশ ও ভারতের বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় বাঘের পদচিহ্নের ওপর নির্ভর করে বাংলাদেশের বন বিভাগের একটি জরিপ পরিচালিত হয়।ওই জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৪৪০টি বলে উল্লেখ করে। পরবর্তী সময়ে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশ ও ভারতের সহায়তায় ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৫ সালের মার্চ পর্যন্ত ক্যাপচার ক্যামেরার মাধ্যমে জানা যায় সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে ৬ হাজার ১৭ বর্গ কিলোমিটারে বাঘ আছে মাত্র ১০৬টি যা ১০ বছর আগের জরিপের চার ভাগের এক ভাগেরও কম।

বর্তমানে সুন্দরবনের আশেপাশের নদীগুলোতে কয়লা ও তেলবাহী জাহাজ চলাচল নদীর পানি দূষণের অন্যতম কারণ। ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার তেল নিয়ে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ও.টি. সাউদার্ন স্টার-৭ ডুবে যায়। সুন্দরবনের ২০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তেল, যা পরবর্তীতে জীব বৈচিত্র্যের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। সম্প্রতি ১৫ এপ্রিল ২০১৮, মোংলা বন্দরের হাবারিয়া এলাকায় এমভি বিলাস নামক একটি কয়লাবাহী লাইটার জাহাজ ডুবে যায়। প্রস্তাবিত রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রও ভবিষ্যতে সুন্দরবনের জন্য হুমকি হতে পারে। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত কাঁচা মাল যেমন- কয়লা নদী দিয়ে বহন করতে হবে। এছাড়াও বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিভিন্ন তেজস্ক্রিয় বর্জ্যও বা গরম পানি নদীর পানির সঙ্গে মিশে নদীর বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বর্তমানে সুন্দরবনের আশপাশে ২৪টি লাল শ্রেণীর দূষণকারী শিল্প কারখানাকে সবুজ শ্রেণীতে তালিকাবদ্ধ করেছে সরকার। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সব শিল্পকারখানা সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

দিন দিন সুন্দরবনের প্রাণী সম্পদ কমে আসছে, কমে আসছে বনের পরিমাণ। একজন মা যেমন তার সন্তানকে সকল ঝড় ঝাপটা, বিপদ আপদে গভীর মমতায় আগলে রাখে, ঠিক তেমনি সুন্দরবনও আগলে রাখে বাংলাদেশকে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য অক্সিজেনের সিংহভাগই আসে সুন্দরবন থেকে। তাই মানবকল্যাণের স্বার্থে সুন্দরবনকে বাঁচিয়ে রাখা অতীব জরুরি। বাংলাদেশের জন্ম লগ্ন থেকেই সুন্দরবন বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করে আসছে। সুন্দরবন বাংলাদেশের ঐতিহ্য এবং বাংলাদেশকে বিশ্ব বাজারে পরিচিতিও দিয়েছে। কিন্তু আমরা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র রক্ষা করতে পারছি না। আমরা নিজ হাতেই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংস করছি যেমন- নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন থেকে শুরু করে বাঘ নিধন এবং হরিণ শিকার করে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছি আইন অমান্য করে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন ২০১২ এর ৩৬ ধারায় বাঘ শিকার ও হত্যাকারীর জামিন অযোগ্য বিবেচনা করে ৭ বছর ও সর্বনিম্ম ২ বছরের কারাদণ্ডের বিধান আছে বাংলাদেশে। এছাড়াও আছে এক থেকে দশ লাখ টাকার জরিমানার বিধান। বন বিভাগের কর্মকর্তাদের আরো কঠোর ব্যবস্থাপনা এবং জনসচেতনতাই পারে এই সমস্যার সমাধান করতে।

বি.দ্র. : লেখকদ্বয় স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষকতা এবং গবেষণায় সংযুক্ত




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়