ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

উপকূলের পথে

শেষ যাত্রায় তীরে স্বজনের কান্না!

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৮, ৩০ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শেষ যাত্রায় তীরে স্বজনের কান্না!

রফিকুল ইসলাম মন্টু: মেঘনার তীরে স্বজনের বুকফাটা আহাজারি। উত্তাল ঢেউয়ের শব্দের সঙ্গে কান্নার শব্দ একাকার। উনুনে শেষ হাড়ি উঠানোর আয়োজন আগের রাতেই শেষ হয়ে গেছে। পরের দিন দুপুরে আর চুলো জ্বালাতে হয়নি সাথীকে। ঘর থেকে মালামাল সরানোর আয়োজন সেই ভোর থেকে। শহীদুল মাঝির মেয়ে সাথী বেগম ঢালচর থেকে চলে গেছেন স্বামী ও সন্তানসহ। আর এই নিয়ে তীরে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। দূরে শেষ যাত্রার ট্রলার দ্রুত এগিয়ে চলে কচ্ছপিয়া ঘাটের দিকে। বাবা শহিদুল নিস্তব্ধ বসে রইলেন নদীর পানে তাকিয়ে। সাথীর মা খাদিজা বেগম, দাদি রোশনা বেগম, বোন তাছলিমা বেগম, প্রতিবেশী নাজমা-আমেনার গগনবিদারী কান্নায় সেদিনের মেঘনাপাড়ের আকাশ ছিল ভারি।

ভোলার চরফ্যাসনের ক্ষয়ে যাওয়া দ্বীপ ইউনিয়ন ঢালচর থেকে এভাবেই চলে গেল আরও একটি পরিবার। ছোটবেলা থেকে বাবা-মায়ের কাছে বড় হওয়া সাথীর বিয়ে হয়েছিল এখানেই। স্বামী আকতার মাঝি। এরা দীর্ঘদিন ধরে থাকতো ঢালচরের ২নং ওয়ার্ডের সরকারি কলোনীতে; যেটি ‘মালেক মাঝির কলোনী’ নামেই পরিচিত। ভাঙন ক্রমেই কলোনীর দিকে এগিয়ে আসায় বাড়ি বদলের এই সিদ্ধান্ত। আর নয় এখানে, দ্বীপ ছেড়ে চলে গেল চরফ্যাসনের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণ আইচায়। তপ্ত রোদে সকাল থেকে নদী কিনারে ঘুরছি। ছবি তুলছি, মানুষের সঙ্গে কথা বলছি। দীর্ঘক্ষণ এক স্থানে দাঁড়িয়ে ছবি তোলায়, কথা বলায় কিছু মানুষ আবার বিরক্ত। অনেকে আবার এগিয়ে এসে প্রশ্ন করেন, কোথা থেকে এসেছি? কী কাজ? ইত্যাদি। হঠাৎ ট্রলারে মালামাল ওঠার দৃশ্যে আমার দৃষ্টি আটকে যায়। সাথীর স্বামী আকতার আর ভাই ফরহাদ ট্রলারে মালামাল বোঝাই করছে। সাথীর মা খাদিজা মালামাল এনে দিচ্ছে তাদের হাতে। সাথী চলে গেলেন ঢালচর থেকে; থেকে গেলেন তার বাবা-মাসহ অন্য স্বজনেরা। ভর দুপুরে ট্রলারে উঠছিল ঘরের সব মালামাল। মোড়ানো ভাঙা টিন, সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল, প্লাস্টিকের ২টি চেয়ার, জগ, হাড়ি-পাতিল, বালিশ সব উঠলো ট্রলারে। বাদ থাকলো না ঘরের আঙিনায় করা বোম্বাই মরিচের চারাগুলোও।
 


তীরে জমানো ঘরের সব মালামাল। আমি নোটবুকে তালিকা নেই। লাকড়ি কাঠ, দুটো দাও, ৩টি হাঁস, ২টি মুরগি, ২টি পাতিল, ২টি গামলা, ১টি জগ, ১১টি মুরগির বাচ্চা, ৪টি বালিশ, ঘরের দরজা, চৌকির তকতা, ১টি কাঠের চেয়ার, ১টি প্লাস্টিকের স্যুটকেস, ২টি ড্রাম, ১টি টেবিল, একটি চৌকি, একটি ঝাড়ু, ঘরের ২টি জানালা, ২টি চালা, ৮ বস্তায় বিভিন্ন মালামাল, ১টি হাতপাখা, ১টি সিলভার কলসি, একটি শিলপাটা, কাপড়ের ২টি ব্যাগ, আরও অনেক কিছু। একে একে সব উঠছে ট্রলারে। সাথীর দাদি রোশনা বেগম সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত। কলোনীর ছেড়ে যাওয়া ঘর থেকে একটা একটা মালামাল এনে জড়ো করছেন নদীতীরে ট্রলার ঘাটে। তার প্রিয় নাতনী সাথী; যাকে কোলেপিঠে করে বড় করতে দাদির ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি; সেই নাতনী কোলজুড়ে এসেছে একটি ফুটফুটে ছেলে সন্তান। সবসহ দ্বীপ ছেড়ে চলে যাওয়ায় নানীর বুক ফেটে যাচ্ছিল। নদীতীরে দাঁড়িয়ে আছি, দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্যটি দেখার জন্য। মালামাল উঠানো যতই শেষের দিকে যাচ্ছিল, ততই আহাজারি বাড়ছিল স্বজনদের। নদীতে ভাটা পড়ে গেলে ওপারে মালামাল তুলতে সমস্যা হবে; তাইতো ট্রলারের নোঙর ছাড়তে হলো আকতার হোসেনের। মালামাল সব ওঠানোর পর ট্রলারে ওঠে সাথী। এ সময় মা আর নানীর বুকফাটা আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে বাতাস। মা খাদিজা যখন নাতিকে তুলে দিচ্ছিলেন সাথীর হাতে, তখন কান্না আরও বেড়ে যায় কয়েকগুন। দাদি রোশনী বেগমের কান্না কিছুতেই থামছিল না। ট্রলার ছাড়ার পর আরেকটু নদীর কিনারে এগিয়ে কাঁদতে থাকেন তিনি। ট্রলার চলছে মেঘনার বুক চিরে; পেছনে সুদূর জলরাশির দিকে তাকিয়ে আছেন স্বজনেরা। আমি নারিকেল গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যের ছবি তুলি, ভিডিও করি।

ট্রলারটি চলে যাওয়ার পর কথা হলো শহিদুল মাঝির সাথে। ঢালচরের পশ্চিমের কলোনীতে থাকেন তিনি। প্রায় ৪০ বছর আগে এখানে এসেছেন। ৩ ছেলে আর ২ মেয়ের বাবা শহিদুল মেয়েকে বিদায় জানানোর পর কথা বলতে পারছিলেন না। শুধু এটুকুই বললেন, ‘আমরা এভাবেই বেঁচে আছি। আমাদের জীবন ভাসমান। আজ এখানে, কাল সেখানে। মেয়ে এই চরেই ছিল; যখন মন চাইত মেয়েকে-নাতিকে দেখে যেতাম। এখন আর তা পারবো না।’ কাঁদছে থাকেন শহিদুল। একই দিনে খানিক দূরে আরেকটি ট্রলারে করে চলে গেল। যার নামে কলোনীর নাম; সেই মালেক মাঝির ছেলেদের ঘরের সব মালামাল উঠলো ওই ট্রলারে। মালেক মাঝি কিংবা তার ছেলেরা কেউই থাকতে পারবেন না এখানে। এবারের বর্ষায় মালেক মাঝির কলোনী নদীতে হারানোর শংকা সকলের। ছেলেদের মালামাল তুলে দিতে ঘাটে এসেছিলেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত মালেক মাঝি, তার স্ত্রী আমেনা বেগম এবং তাদের ছেলেবউ নাজমা ও আমেনা। ছেলেদের চলে যাওয়ার সঙ্গে সাথী বেগম ও আকতার মাঝির চলে যাওয়াতেও তাদের মনে কষ্ট কম নয়। কারণ তারা একই সঙ্গে অনেক বছর ধরে একই কলোনীতে ছিলেন।
 


মালেক মাঝির স্ত্রী আমেনা বেগমের পথ ধরে কলোনীর দিকে যাই। পুকুরের পাড়ে খানিক উঁচু ভিটিতে টিনশেড কলোনী। একে তো ভাঙন এগিয়ে এসেছে; অন্যদিকে বহু পুরানো এ কলোনীতে এখন আর থাকার পরিবেশ নেই। জোয়ারের পানি উঠে যায় কলোনীর আশপাশের নিচু জমিতে। তখন এবাড়ি থেকে ওবাড়ি যাওয়ার আর সুযোগ থাকে না। বাঁধ কিংবা রাস্তাঘাট কিছুই না থাকায় জোয়ারের পানিতে ভাসে বাড়িঘর। কলোনীর ঘরগুলো দেখি উঁকি দিয়ে। ভাঙা বেড়া, টিনের চালায় বড় বড় ফুটো। বর্ষার আগে এই ফুটো মোরামতের চেষ্টা করেও কোন লাভ হয় না। কিছুক্ষণ আগে চলে যাওয়া সাথী বেগমের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখি পাশের ঘর থেকে কয়েকটি মুরগি খালি ঘরটিতে খাবারের খোঁজ করছে। নদীর পাড়ে ট্রলারে যেসব মালামাল উঠতে দেখলাম, সেগুলো সব এই ঘরেই ছিল। মাটির মেঝেতে পাতা ছিল চৌকি, চেয়ার-টেবিল। ছোট শিশু খেলা করতো যে মেঝেতে, সেটা শূন্য পড়ে আছে। সূর্যবাতির আলোকে এঘর আলোকিত হতো; কিন্তু এখন আর বাতি জ্বলবে না।

সাথীর শূন্য ঘরের সামনে থেকে আমি গাছতলায় কথা বলি মালেক মাঝির স্ত্রী আমেনা বেগমের সাথে। টুমচরে তাদের অনেক জমি ছিল। ঢালচরে তারা এসেছেন অনেক বছর আগে। মালেক মাঝির জমিতে এই কলোনী নির্মিত হয়েছে বলে কলোনীর নাম দেয়া হয়েছে ‘মালেক মাঝির কলোনী’, জানালেন আমেনা। তার নয় ছেলেমেয়ের মধ্যে ৬জন ছেলে। এরা সবাই মিলে দক্ষিণ আইচায় মানিকা বাজারের পাশে কিছু জমি কিনেছে। সেই জমিতে প্রথমে তারা বাবা-মায়ের জন্য ঘর তুলবেন; পরে নিজেদের ঘর তুলবেন। আমেনা বেগমের অনেক স্মৃতি এই ঢালচরে। নিজের হাতে লাগানো অনেক গাছপালা, সাজানো গোছানো ঘর; সব ফেলে তাকে চলে যেতে হবে। একথাগুলো বলতে বলতে কয়েকবার চোখ মুছলেন আমেনা।
 


নিজের বাড়ি বদলের কষ্টের কথা মনে করে মেয়ে আকলিমা অশান্তির কথা মনে ওঠে তার। দক্ষিণ আইচার সালাহউদ্দিন নামে এক যুবকের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার ছোট মেয়ে আকলিমার। ৫ বছর আগে বিয়ে হয়। বিয়ের সময় যৌতুক হিসাবে জামাইকে দিয়েছিলেন এক লাখ টাকা। ব্যবসা করতে পরে দিয়েছেন আরও এক লাখ টাকা। সালাহউদ্দিনের আরও ৫০ হাজার টাকার দাবি। সেই দাবিতে আকলিমার ওপর নির্যাতন চালায়। সালিশি বৈঠক হয়েছে কয়েকবার। কোন ফয়সালা হয়নি। আমেনা ভাষায়, ‘তইছার (নির্যাতনের) জ্বালায় মাইয়া আমার ঢাকা চলে গেছে।’ আমেনার কথা শুনে ভাবি, মানুষের কষ্টের কোন শেষ নেই। এক নদী ভাঙনের কষ্টের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও কত কষ্ট। এইসব বাঁধা ডিঙিয়ে এগোয় উপকূলের মানুষেরা। চেষ্টা করে মাথা তুলে বাঁচার।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়