প্রতিদিনের ঋতু
সাবেরা তাবাসসুম || রাইজিংবিডি.কম
সাবেরা তাবাসসুম : লোকে বলে, গৃহিণী জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে ঘরের নেতা বনে যাওয়া। মানে যেকোনো উপায়ে রাজনীতির পয়লা পাঠের জায়গাটায় ক্ষমতার একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখা। লোক-যারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কেন্দ্র থেকে তাবড় তাবড় পাস দিয়ে বেরোয়, লোক-যারা তেমন কোনো কিছু পাস না দিয়েই জীবন ঘষতে ঘষতে নুন-ভাতের জন্যে লড়াই করে মরে, কম-বেশি সবাই এর কাছাকাছি ভাবে। আর তাই, খাবার, পোশাক, সেবাকেন্দ্র, রূপসদন, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট আর বড় জোর একটু-আধটু পরকিয়ার বাইরে এদের আর কোনো জগতের অস্তিত্ব সম্পর্কে কেউ ভাবতে সচেষ্ট নয় কিংবা ভাবনার কিছু আছে সেটাও বোধ করে না। ওইসব পূর্ব নির্ধারিত ভেবে নেয়াটা যে পুরোপুরি খারিজ যোগ্য, মোটেও তা নয়। বরং তত্ত্ব আর চর্চার জায়গায় প্রয়োজনানুসারে রঙ পালটে আঁটোসাঁটো ভাব এনে লোকেরা একে সরিয়ে তাকে বসিয়ে বেশ করে খাচ্ছে। তা খাক। মেজরিটি বলে কথা। শ্রেণিগত দিক থেকে আমি সুবিধাবাদী। তবে অনুভূতিজাত ভাবনার দিক থেকে প্রান্তিকজনের দিকে আপনা আপনি মন চলে যায়। বিষয়টা আগাগোড়া প্রশ্নবিদ্ধ, সন্দেহ নেই। তবু যেটাই হোক, ভাবছি, দিনশেষে এই গৃহিণী পেশাটা (এই রে, রে রে বলে তেড়ে এলো সবাই কট্টর নারীবাদী তকমা নিয়ে, অবশ্য তা নিয়ে খুব বিচলিত নই বোধহয়) নিয়ে আরো কোনো দিক থেকে ভাববার কিছু আছে কি? লোকের ঠাট্টার দৃষ্টি, বন্ধুদের পরিচয় করানোয় আমতা আমতা ভাব এসব নিয়ে এতদিনে মজা পেতে শুরু করেছি। মনে হলো, কোনো এক কোণায় জড়োসরো কিছুকে প্রতিদিনের আমার কাছে টেনে আনা যায় কি? ভেবে দেখলাম, বিজ্ঞাপনের ভাষায় চলা মধ্যবিত্তের সংসারে একজন গৃহিণীর আরো অনেককিছুই করার থাকে যা মোটা কথায় অলাভজনক। এই অলাভজনক কাজের খোঁজে নামলাম আমি। এই সিদ্ধান্তে যেদিন পৌঁছলাম সেদিনটা আমার জন্যে বিশেষ। সেদিন আমার হাতে ছিল কবিতা আর চোখের সামনে ছিল ঋতু। আরো বিশেষ করে বললে, মনে রবীন্দ্রনাথ, পাশে ঋতুপর্ণ ঘোষ।
২.
‘জীবন আমার চলছে যেমন তেমনি ভাবে
সহজ কঠিন দ্বন্দ্বে ছন্দে চলে যাবে’
এত সহজ করে এই সময়ে সংসার তো নয়ই, কোনো কিছুই চলে না। অনেকের কাছে এগুলো বাতিল যোগ্য ন্যাকামো। অনেকের কান অব্দি এই কথাগুলো কখনো পৌঁছায় না। আমাদের অন্তর্জগত ঠাসা থাকে অন্তঃসারশূন্য চকমকিতে। তবু যেসব প্রান্তিকজন রবীন্দ্রনাথের দেখা পান, যারা ঋতুপর্ণের রবীন্দ্রনাথের দেখা পান তাদের ঘরের কোণে জগতের সত্য আলোর কিরণ একটুখানি হলেও ঠিকরে এসে পড়ে। এই মন্ত্রে বেশ চলে যায় দিন। তবে মজার ব্যাপার কী, খোদ জীবনই এমন সব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করে যে নতুন পঙক্তির খোঁজে নামতেই হয় পথে। রোজকার নুন-তেলের সহজ হিসাবের বাইরে কীসের হাতছানি গার্হস্থ্যজীবনের থেকে পথভোলা আমিটাকে সামনে হাজির করে! শরীরের অসুখ ছাপিয়ে মনের অসুখ আমার ম্লানমুখে চোখ রাখে! আমি যেন ঋতুপর্ণর ছবিতে শোনা কবিতাখানি আবারো শুনতে পাই-
পূর্ণ হয়েছে বিচ্ছেদ যবে ভাবিনু মনে
একা একা কোথা চলিতেছিলেম নিষ্কারণে।
শ্রাবণের মেঘ কালো হয়ে নামে বনের শিরে,
খর বিদ্যুৎ রাতের বক্ষ দিতেছে চিরে,
দূর হতে শুনি বারুণীনদীর তরল রব-
মন শুধু বলে, অসম্ভব এ অসম্ভব।।
রবীন্দ্রনাথ যে পূজো করার, ঝেড়ে মুছে গুছিয়ে তুলে রাখার জিনিস না, এ যে নিত্যদিনের সঙ্গী সেটা ঋতুপর্ণ ঘোষ সুন্দর করে তার দর্শকদের বুঝিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। অন্তত সেটা ঋতুর রবীন্দ্রনাথের কাহিনীর আশ্রয়ে নির্মিত ছবি এবং নানাজনের সাথে সাক্ষাৎকার, আলাপ থেকে আমার মনে হয়েছে। তাতে কী এমন হলো? আমি তো বোদ্ধা নই, সমালোচক তো নইই। হওয়ার দরকার নেই। আমি কেবল আবেগসর্বস্ব দর্শক হয়েই খুশি। তবু আমার এই মনে হওয়াটা আমার কাছে বেশ লাগে। মনে হয় রবীন্দ্রনাথকে উপলব্ধি করবার নতুন একটা পথ পাওয়া গেল। বেঁচে থাকার খানিকটা রসদ হাতে এলো। তারপর অবসর মত ঋতুকে একবার শুকরিয়া বলে নিই।
৩.
একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে
আনন্দবসন্ত সমাগমে।
আজকের দিনটায় এই গানটি আমি গেয়ে উঠতেই পারি। খটখটে ভাদ্রের দিনে ঋতুপর্ণের আবির্ভাব এই জগতে। তবু তার চলে যাওয়াতেই যেন আজকের দিনটার মাহাত্ম অনুভব করি আমি। ভাগ্যিস এসেছিলেন ঋতু। তা না হলে বিনোদিনীর বাসনা-সঙ্গীত শুনতে আরো কত বছর কেটে যেত আমার-
মাধব মিলন তরে
আমার রাধা বাসর সজ্জা করে।
কিংবা
জীবন রে
ও জীবন ছাড়িয়া যাস নে মোরে
তুই জীবন ছাড়িয়া গেলে আদর করবে কে জীবন রে!
চিত্রাঙ্গদার এমন চমৎকার ইন্টারপ্রিটেশন দেখতাম কী করে-দ্য ক্রাউনিং উইশ-
নূতন প্রাণ দাও, প্রাণসখা
আজি এ সুপ্রভাতে
অসীমের দিকে এই সীমিত প্রাণ নিয়ে কী করে হাত বাড়ানোর আকাক্সক্ষা জাগত, কী করে দুঃখ ভুলবার মন্ত্র মনে নিতাম যদি না নৌকাডুবি ছবিটিতে হেমনলিনী গেয়ে উঠত-
তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই-
কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই।
পংক্তির পর পংক্তি সাজিয়ে কোনো লাভ নেই যদি না সারবস্তুটুকু হৃদয়ঙ্গম করা যায়। আমাদের সেই এক দশা। মেজরিটির কথা বলছি। তবু মনে সাধ যায় ওই প্রান্তিকজনদের একজন হতে। জেনেছি ব্যক্তিজীবনে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন চরম প্রান্তিকজন। তাঁর ভেতর সেই শক্তি ছিল যা দিয়ে তিনি কাটিয়ে উঠতে পারতেন বিষাদ-বিড়ম্বনা-তাচ্ছিল্য-শোক। সূর্যবন্দনায় তিনি আলোকিত করেছেন আমাদের জীবন। ঋতুপর্ণও তেমনি এক প্রান্তিকজন। সংকটে হাত বাড়িয়ে দেন রবীন্দ্রনাথের দিকে, যার সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক, মান-অভিমান জড়িয়ে রাখা সম্পর্ক। রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতিকে নির্মাণের ক্ষেত্রেও সেই ছাপ পষ্ট বুঝিয়েছেন ঋতুপর্ণ।
ঋতুপর্ণ ঘোষ কেবল তো দর্শকদের নন, পাঠকদেরও। আমাদের ফার্স্টপার্সন ঋতুপর্ণ ঘোষ। তার আগে পেয়েছি বিজ্ঞাপনের সংলাপ লিখিয়ে, সম্পাদকীয়র লেখক হিসেবে। কবি হিসেবে গীতিকার হিসেবেও পেয়েছি তাকে। গীতিকার ঋতু ব্রজবুলি ভাষায় লিখলেন-
বহু মনোরথ সাজুঁ অভিসারে প্যয়হলু সুনীল বেস
কাজর নয়ানে সলাজ বয়ানে কুসুমে সাজানু কেস
সখী হাম মোহন অভিসারে যাউ
বলো হাম এতক সুখ কাঁহা পাউ
আশ্চর্য লাগে বটে! তবে শিক্ষাটা ছোটবেলাতে ভানুসিংহের পদাবলী থেকে পাওয়া বলেই ঋতু এত সাবলীল এ ভাষায়।
কবি ঋতুপর্ণ লিখলেন জগৎ জোর্তিময়ের কবিতা-
দিগন্তজুড়ে কালোর পর্দা ঢাকা
আলো দেখা যাবে একটুকু ফাঁক হলে,
মাথার ওপরে রাত্রির শামিয়ানা
চাঁদ নিবুনিবু, ধিকি ধিকি তারা জ্বলে।
তারার আলোয় ঘুমোয় বেগুনি আভা
আকাশ ছাড়িয়ে নিকষ নেমেছে মাঠে
কোন আলো বেশি আঁধারের কাছাকাছি!
সেই কথা ভেবে একজনা পথ হাঁটে।
..জীবনের কাছে তিল তিল করে পাওয়া
আস্ত একটা বছর ফেলনা নয়,
সবে মিলে যদি আগলে রাখতে পারি
সব কালো মুখে অমনি আলোকময়-
নব আনন্দে জগৎ জোর্তিময়।।
তার নির্মিত ছবি, লেখা, সাক্ষাৎকারগুলোর মধ্য দিয়ে ঋতুপর্ণ নব আনন্দে জগৎ জোর্তিময়ের কথাই বলে যেতে চেয়েছেন দিনশেষে। সবে মিলে আগলে রাখা, কালো মুখ আলো করে দেয়ার ইচ্ছেটা কাজ করেছে প্রবলভাবে। চিত্রকর পিতামাতার সন্তান ঋতুপর্ণ নিজেকে তৈরি করেছেন, কাজ করতে করতে শিখেছেন, শেখার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন, প্রচলিত মতবাদগুলোর দিকে, আপাত দৃষ্টে স্বাভাবিক মনে হওয়া বৈষম্যগুলোর দিকে তীব্র প্রশ্ন তুলেছেন কিন্তু সেই তীব্রতায় রেখেছেন নান্দনিক রাবীন্দ্রিক পেলবতা। আমাদের পক্ষে সেই পেলবতা ধারণ করা সম্ভব নয় কারণ এটা জীবনচর্চারও ব্যাপার, যেটা ঋতুপর্ণর ছিল। আমাদের ডাল-ভাত নুন-তেলের জীবনে ওই প্রশ্ন করতে পারার জায়গাটুকুই বরং যথেষ্ট হয়ে থাক। রোজকার জীবনে ওই প্রশ্নগুলোই ধাবিত করবে আমার আর কোনো আমির সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দিতে। তাই রবীন্দ্রনাথ আমার নিত্য দিনের, ঋতুও আমার নিত্যদিনের। হয়তো আমরা ঋতুর চোখে রবীন্দ্রনাথের পাঠ নিতে পারি। জন্মদিনের শুভকামনা জানাতে পারি কিংবা কোনো সুদূরের ইঙ্গিত পেয়ে যেতে পারি সংসারের প্রান্ত-জানালায় বসে-
একা বসে সংসারের প্রান্ত জানালায়
দিগন্তের নীলিমায় চোখে পড়ে অনন্তের ভাষা।
আলো আসে ছায়ায় জড়িত
শিরীষের গাছ হতে শ্যামলের স্নিগ্ধ সখ্য বহি।
বাজে মনে-নহে দূর, নহে বহু দূর।
পথরেখা লীন হল অস্তগিরি শিখর-আড়ালে,
স্তব্ধ আমি দিনান্তের পান্থশালা দ্বারে,
দূরে দীপ্তি দেয় ক্ষণে ক্ষণে
শেষ তীর্থ-মন্দিরের চূড়া।
সেথা সিংহদ্বারে বাজে দিন-অবসানের রাগিণী
যার মূর্ছনায় মেশা এ জন্মের যা-কিছু সুন্দর,
স্পর্শ যা করেছে প্রাণ দীর্ঘ যাত্রাপথে
পূর্ণতার ইঙ্গিত জানায়ে।
বাজে মনে-নহে দূর, নহে বহুদূর।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ আগস্ট ২০১৮/সাইফ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন