ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ওস্তাদ আলাউদ্দিনের পরিবারে সাধকের ছড়াছড়ি

জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ওস্তাদ আলাউদ্দিনের পরিবারে সাধকের ছড়াছড়ি

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, কন্যা রওশন আরা অন্নপূর্ণা দেবী ও পুত্র আলী আকবর খাঁ

জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল : উপমহাদেশের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বাংলাদেশের গর্ব। অথচ আজ এই কিংবদন্তি সংগীত সাধকের জন্মস্থান ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আজ কোনো আয়োজন নেই।

কালজয়ী এই সঙ্গীত সাধকের পুরো পরিবারই সংগীতে আলোর ফুলঝুরি ছড়িয়েছেন।পুত্র আলী আকবর খাঁ সরোদে কিংবদন্তি তুল্য। কন্যা রওশন আরা অন্নপূর্ণা দেবী সুরবাহারের বিখ্যাত শিল্পী, মেয়ের জামাতা প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ বিখ্যাত সেতার শিল্পী পন্ডিত রবি শংকর।এ ছাড়াও সরোদ শিল্পী শ্যামল গাঙ্গুলি, পান্না লাল ঘোষ, ফুলঝুরি খাঁন, ইসরাফিল খাঁ, নিখিল বন্দোপাধ্যায় এবং সরোদ শিল্পী ভ্রাতুষ্পুত্র বাহাদুর হোসেন খাঁ, খাদেম হোসেন খাঁ ও আবেদ হোসেন খাঁ প্রমুখ আলাউদ্দিনের স্নেহধন্য হয়ে সুরের ভুবনে দীপ্তিমান।

আলাউদ্দিন খাঁর পিতা সবদর হোসেন খাঁ-ও ছিলেন সেতার শিল্পী। তিনি ছিলেন আগরতলা রাজদরবারের সভা বাদক ওস্তাদ কাশেম আলী খাঁ’র শিষ্য। আলাউদ্দিনের কনিষ্ঠ ভাই বিশিষ্ট যন্ত্র সঙ্গীত শিল্পী ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ। তিঁনি ছেলেন সুরবাহার বিশেষজ্ঞ। তিঁনি ১৯৫৩ সালে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে শান্তি নিকেতনে বিশ্বভারতীর যন্ত্র সঙ্গীত বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগদান করেন। পরে কুমিল্লায় যন্ত্রসঙ্গীত কলেজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাগ সঙ্গীতের প্রসার ঘটান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাদ্যযন্ত্রের উপর গবেষণার জন্য চালু করেন ‘সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন মিউজিক্যাল কলেজ’ (বর্তমানে যা সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন)। সুরবাহার, সরোদ যন্ত্রের আধুনিকায়ন এবং মনোহারা, মন্দ্রনাথ বাদ্যযন্ত্রের উদ্ভাবন তার উল্লেখযোগ্য অবদান।

আয়েত আলী খাঁ ১৯৬০ সালে ‘গভর্ণর পদকে’ ভূষিত হন। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার কতৃক ‘তম-ঘা-ই-ইমতিয়াজ’ উপাধি; ১৯৬৬ সালে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘প্রাইড-অব-পারফরমেন্স’লাভ করেন।  এছাড়া বাংলাদেশেও একুশে ও স্বাধীনতা পদক লাভ করেন তিনি। বিশিষ্ট সরোদ শিল্পী আফজালুর রহমান তারই কৃতি ছাত্র এবং তার ছেলে বাহাদুর হোসেন খাঁ সরোদে খ্যাতি অর্জন করেন। অপর ছেলে মোবারক হোসেন খান, শেখ সাদী খান, নাদি শাহাদাৎ হোসেন খান বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় খেতাব একুশে পদক লাভ করেন। মোবারক হোসেন খান স্বাধীনতা পদকও লাভ করেন।

বড় ভাই সাধক ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁ ছিলেন ‘মলয়া’ গানের স্রষ্টা বিশিষ্ট ব্রহ্মসাধক কবি মহর্ষি মনমোহন দত্তের একমাত্র যোগ্য সমঝদার। আফতাব উদ্দিন খাঁ হেন বাদ্যযন্ত্র নেই যা তিনি বাজাতে পারতেন না। তৎকালীন সময়ে অবিভক্ত বাংলায় তার মতো বংশীবাদক আর কেউ ছিলনা। তিনি একসাথে তিনটি বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন। আগরতলার মহারাজ বীর বিক্রম মানিক্য রায়বাহাদুর ও ভবানীপুরের মহারাজা জগনীন্দ্র নাথকে বাদ্যযন্ত্রের সুরে বিস্মিত করেন। স্বরগ্রহ, মেঘডম্বুর দু’টি বাদ্যযন্ত্র ছিল তার অন্যতম আবিষ্কার।

শুধু ভারতেই নয় জন্মভূমি বাংলাদেশের শিবপুরেও কিছু বিপন্নপ্রায় স্থাপত্য ও মা-বাবার সমাধি খাঁ পরিবারের স্মৃতি বহন করছে। যেগুলো অযত্ন অবহেলায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আলী আকবর খাঁ ১৯৮৯ সালে তৎকালীন সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাবীবুল্লাহ খানের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসে ঢাকাসহ কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় সংবর্ধিত হন। পরে তিনি জন্মভূমি নবীনগরের শিবপুরে পিতা আলাউদ্দিন খাঁর নিজ হাতে গড়া মসজিদটির জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে প্রশাসনের হাতে তৎকালীন সময়ে ৮০ হাজার টাকা দিয়ে এর সংস্কারের জন্য অনুরোধ করে যান। দীর্ঘ এতো সময় পর ব্যাক্তি উদ্যোগে সামান্য সংস্কার করা হয়।

এদিকে ২০১৫ সালে একদল উচ্ছৃঙ্খল যুবকের দেওয়া আগুনে পুড়ে ছাই হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে অবস্থিত সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গণ ও আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতি বিজড়িত অনেক বাদ্যযন্ত্র।

কুমিল্লা শহর জুড়েও জড়িয়ে আছে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও তার ভাই ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর অনেক স্মৃতি। কুমিল্লায় আলাউদ্দিন খাঁর শেষ ঐতিহাসিক কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিলো টাউন হল মিলনায়তনে। সেখানে আলাউদ্দিন খাঁকে স্মরণ করার মতো কোন উদ্যোগ নেয়নি কেউ। এমনকি নজরুল ইনস্টিটিউট কেন্দ্রের সামনের রাস্তাটি সুরসম্রাটের নামে এবং কান্দির পাড় থেকে টমছম ব্রিজের রাস্তাটির নাম আয়েত আলী খাঁর নামে, টমছম ব্রিজ কবরস্থানে আয়েত আলী খাঁর সমাধি হলেও হালে এর কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া কঠিন। চলতি বছর (২০১৮) আলাউদ্দিন খাঁর নাতি আশিষ খাঁ শিবপুরে তার পূর্বপুরুষের পরিত্যক্ত ভিটেমাটি দেখে মনে একবুক কষ্ট নিয়ে ফিরে যান।




রাইজিংবিডি/কুমিল্লা/৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮/জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়