ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শোক ও বিশ্বাসের পদযাত্রা

গাজী মুনছুর আজিজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শোক ও বিশ্বাসের পদযাত্রা

দেশের বিভিন্ন স্থানে আশুরা উপলক্ষে তাজিয়া মিছিল বের হয়। তবে মানিকগঞ্জের গড়পাড়া এমাম বাড়ির মিছিলটি অন্যতম বৃহৎ মিছিল হিসেবে পরিচিত। শতবর্ষের প্রাচীন এমাম বাড়িতে আশুরা উপলক্ষে থাকে নানা আয়োজন। লিখেছেন-গাজী মুনছুর আজিজ

শোকের মিছিল কিংবা মহরমের মিছিল। ‘তাজিয়া মিছিল’ও বলে। আশুরার দিন শোকের এ মিছিল বের হয় মানিকগঞ্জের গড়পাড়ার এমাম বাড়ি থেকে। শিয়া মতাদর্শী মুসলিমরা মিছিলটি বের করেন। এ মিছিল দেখার জন্য দীর্ঘক্ষণ রাস্তার দুইপাশে দাঁড়িয়ে থাকেন অসংখ্য বৃদ্ধ-যুবা, শিশু-কিশোর। বয়সের ভারে যাদের দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি নেই তারাও বসে থাকেন চেয়ার-বেঞ্চিতে। তারা বিশ্বাস করেন এ মিছিল দেখার মধ্যে পূণ্য আছে। যখন মিছিল এলো, মনে হলো সে মিছিল দেখে তাদের চোখ শান্ত হয়েছে, তৃপ্ত হয়েছে তাদের আত্মা। এ মিছিল দেখতে গত আশুরার দিন হাজির হই গড়পাড়ায়। ইতিহাস সাক্ষী দেয় ৬৬১ খ্রিস্টাব্দের ১০ মহরম শোকের দিন। এদিন ইরাকের অদূরে ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে ইয়াযীদ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ হয় হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র ইমাম হোসাইনের (র.) সঙ্গে। যুদ্ধে নির্মমভাবে সীমারের হাতে শহীদ হন ইমাম হোসাইন (র.)। সেই দিনটিকে স্মরণ করেই শিয়া মতাদর্শী মুসলিমরা আশুরার দিন শোক মিছিল বের করেন।

মিছিল বের হয় দুপুরের পরে। মিছিলে অংশ নিতে সকাল থেকে বিভিন্ন স্থান থেকে ছোট-বড় দলে এমাম ভক্তরা আসতে থাকেন। আর মিছিল উপলক্ষে এমাম বাড়ি প্রাঙ্গণজুড়ে লোকজ মেলা বসে। মেলায় মিষ্টিসহ দেশি খাবার, খেলনা সামগ্রী, তৈজসপত্রসহ নিত্য পণ্যের সমারহ ঘটে। পাশাপাশি এমাম বাড়িতে ভক্তদের জন্য খাবার রান্নার আয়োজন চলে। খাবার আয়োজনের ব্যবস্থা করেন ভক্তরাই। ভক্তরা নিয়ে আসেন হাঁস-মুরগি-ছাগল, কেউ আনেন সবজি, কেউ দেন নগদ টাকা। মূলত মনের বাসনা পূরণের জন্যই ভক্তদের এ দান। এছাড়া ভক্তরা নিয়ে আসেন মিষ্টিসহ বিভিন্ন তবারক। এমাম বাড়ির সেবক সে তবারক বিতরণ করেন দর্শনার্থী-ভক্তদের মাঝে। মিছিল উপলক্ষে বাড়ির প্রাঙ্গণ সাজানো হয় কালো, লাল, সবুজসহ বিভিন্ন রঙের কাপড়ের নিশানা দিয়ে। বাঁশের আগায় লম্বা লম্বা এসব নিশানা উড়তে থাকে। এছাড়া যেসব ভক্তরা মিছিলে অংশ নিতে আসেন, তাদের হাতেও নিশানা থাকে। আর গায়ে থাকে কালো রঙের পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জামা। মাথায় কিংবা মাজায় বাঁধা থাকে লাল রঙের উত্তরীয়। কেউ কেউ অন্য পোশাকও পরেন। ভক্তদের মধ্যে বৃদ্ধ-যুবা, শিশু-কিশোর সবাই আছেন।
 


এমাম বাড়ি থেকে মূল মিছিল বের হওয়ার আগে অংশগ্রহণকারীরা দলে দলে জড়ো হন মাঠে। তারাও আসেন মিছিল করে। মিছিলের সময় অনেকের হাতেই থাকে লাঠি, কাঠ বা টিনের তলোয়ার এবং নিশানা। মিছিলের সবার সামনে একজন থাকেন বড় নিশানা হাতে। আরেকজন ঢোল পেটান। আর সবার মুখেই থাকে ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ বুলি। কেউ কেউ এ বুলি বলতে বলতে বেহুঁশ হয়ে পড়েন। তখন মিছিলের অন্যরা তাকে সামলে রাখেন। মাঠের ঠিক মাঝখানটায় লম্বা একটি বাঁশের আগায় বড় নিশানা উড়তে থাকে। বিভিন্ন স্থান থেকে যারা মিছিল নিয়ে আসেন তারা এ মাঠেই জড়ো হন। মাঠের চারপাশে তারা ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ বলতে বলতে ঘুরতে থাকেন। এভাবেই গড়পাড়া এমাম বাড়ি প্রাঙ্গণ ভরে যায় ভক্তদের ভিড়ে। তারপরই শুরু হয় মূল শোক মিছিল।

মিছিলের শুরুতে লাম্বা কালো নিশানা হাতে থাকেন একজন। তারপর আছে ব্যান্ড পার্টি। তারা বাজনা বাজান। এরপর আছে ঢোলক। একটি ভ্যানে বড় একটি ঢোল থাকে। সেটি বাজান একজন। তারপর রয়েছে দুটি সুসজ্জিত ঘোড়া। মিছিলের মাঝ বরাবর আছে ইমাম হোসাইনের (রা.) সমাধির প্রতিকৃতি। এ প্রতিকৃতি বহন করেন কয়েকজন ভক্ত। এছাড়া মিছিলে অংশ নেয়া সবার হাতেই থাকে নিশানা, লাটি, কাঠ বা টিনের তলোয়ার। মিছিলের সামনে কয়েকজন লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে ও তলোয়ার চালাতে চালাতে অগ্রসর হন। মিছিলে অংশগ্রহণকারী সবাই থাকেন খালি পায়ে। তবে অন্য তাজিয়া মিছিলগুলোতে যেমন চাকু দিয়ে নিজের পিঠে বা বুকে আঘাত করে ভক্তরা রক্তাক্ত হন, এ মিছিলে তেমনটি দেখিনি।গড়পাড়া থেকে যাত্রা করে মিছিল অগ্রসর হয় মানিকগঞ্জ শহরের দিকে। ঠিক কতো লোক মিছিলে অংশ নিয়েছেন তার সঠিক সংখ্যা না থাকলেও মিছিলটি লাম্বায় দেড় থেকে দুই কিলোমিটার হবে। আর এ দীর্ঘ মিছিলটি দেখার জন্যই রাস্তার দুইপাশে দীর্ঘসময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকে নানা বয়সী নারী-পুরুষ। এর মধ্যে আছেন সনাতন ধর্মীসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষও। সনাতনধর্মী অনেক নারীকে দেখেছি মিছিলের ঘোড়ার পায়ে টাকা রেখে প্রণাম করছেন। কল্পনা সাহা বলেন, পূণ্যবান একজনকে স্মরণ করেই এ শোক মিছিল। সেজন্য মিছিলটিও পূণ্যের। তাই এ মিছিল দেখতে আসা এবং মনের বাসনা পূরণের জন্য টাকা দান করে প্রণাম করা। যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মিছিল দেখছেন, তারাও মিছিল দেখে যেনো পূণ্যের তৃপ্তি পেলেন। স্থানীয় বাসিন্দা আবদুল গফফার (৫০) বলেন, কারবালায় ইমাম হোসাইনের (র.) মৃত্যু আমাদের সবার জন্যই শোকের। এ মিছিল দেখে আমিও সেই শোকের সঙ্গী হতে পেরেছি বলে মনে করি। গড়পাড়া এমাম বাড়ি দরবার শরীফের পীর ও পাকপাঞ্জাতন অনুসারী পরিষদের সভাপতি শাহ্ মোখলেছুর রহমান বলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানের এমাম বাড়ি থেকে মহরমের মিছিল বের হয়। তবে শতবর্ষের প্রাচীন গড়পাড়া এমাম বাড়ির মিছিলটি অন্যতম বৃহৎ। প্রতিবছর এ মিছিলে প্রায় অর্ধলক্ষ এমাম ভক্তের সমাগম ঘটে। আশুরা উপলক্ষে পহেলা মহরম থেকেই ফাতেহাপাঠ, মিলাদ মাহফিল, নেয়াজ, মার্সিয়া, মাতমসহ নানা আয়োজন থাকে। আর ১০ মহরম বের করা হয় শোক মিছিল।
 


রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ থেকে মিছিলে অংশ নেয়া তজু বেপারী বলেন, পহেলা মহরম থেকেই বিভিন্ন স্থান থেকে ভক্তরা আসেন এমাম বাড়িতে। তখন তাদের মাঝে দল ভাগ করে দলনেতা ঠিক করে দেয়া হয়। সেই দলনেতাই আশুরার শোক মিছিলে তার দলের অন্য সদস্যদের নিয়ে আসেন। এবার ৩৬টি দল অংশ নিয়েছে। এসব দল ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, টাঙ্গাইলসহ মানিকগঞ্জের আশপাশের অঞ্চল থেকে এসেছিলেন।

মিছিলে অংশ নেয়া মাদারীপুরের একটি দলের দলনেতা হোসেন আলম বলেন, ইমাম হোসাইন (র.) শহীদ হওয়াতে আমরা ব্যথিত। তার আত্মার মাগফেরাত কামনায় আমাদের এ আয়োজন। সন্ধ্যার ঠিক আগে মানিকগঞ্জ শহর ঘুরে মিছিল শেষ হয় সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ মাঠে গিয়ে। তারপর সেখানে অনুষ্ঠিত হয় আশুরার তাৎপর্য নিয়ে শোকসভা।

ছবি : লেখক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়