ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ইয়াসির আরাফাত : স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১১ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইয়াসির আরাফাত :  স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক

শাহ মতিন টিপু: ইয়াসির আরাফাত। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক। পুরো নাম মুহাম্মদ আবদেল রহমান আবদেল রউফ আরাফাত আল-কুদওয়া আল-হুসাইনি। কিন্তু ইয়াসির আরাফাত নামেই তিনি বিশ্বব্যাপী পরিচিত।

ফিলিস্তিনি মুক্তি সংগ্রামের এই মহানায়কের ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ফিলিস্তিনিদের দখল করা ভূমিতে গড়ে তোলা রাষ্ট্র ইহুদিবাদী ইসরায়েলের দখলদারিত্ব থেকে মাতৃভূমি ফিলিস্তিনকে মুক্ত করতে আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন তিনি।

ফিলিস্তিন মুক্তি সংগ্রামের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ত্যাগী নেতা ছিলেন ইয়াসির আরাফাত। পিতৃভূমি দখলদারমুক্ত করতে তিলে তিলে নিঃশেষ করেছেন নিজেকে। শৈশব, কৈশোর, যৌবন সবকিছু তিনি উৎসর্গ করেছিলেন মাতৃভূমির স্বাধিকারের জন্য।

ছোটবেলা থেকেই আরাফাত অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন একদম স্বাধীনচেতা। পরাধীনতার গ্লানি তাকে দারুণভাবে পীড়া দেয়। তাই তরুণ বয়সেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ফিলিস্তিনিদের গ্লানিকর ও জীবন তাকে দারুণভাবে আহত করে। মাতৃভূমি হারানো এবং পবিত্র ভূমিতে ইহুদিদের পদচারণা মর্মানুভূতিতে খুব নাড়া দেয়।

১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ইহুদি কর্তৃক ফিলিস্তিন ভুখন্ড দখল এবং হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের বর্বরচিত্র স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন। সে বিভীষিকার চিত্র ছিল খুবই করুণ ও অবর্ণনীয়। ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি ফিলিস্তিনি জাতীয়বাদী আন্দোলনের মুক্তির সংগঠন ফাতাহ গঠন করেন। ১৯৬৪ সালে ফাতাহ প্যালেস্টাইনিয়ান লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও) নামকরণ করা হয়। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি পিএলওর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

ইসরাইলের বিরুদ্ধে অধিকাংশ লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন ইয়াসির আরাফাত। ১৯৬৭-৬৮ আরব-ইসরাইল যুদ্ধে তিনি সম্মুখ সারিতে ছিলেন।

ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ঘোষণার পর আরাফাত পশ্চিমা বিশ্বসহ সারা দুনিয়া চষে বেড়িয়েছেন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য। তিনি একটি দেশের প্রধান না হওয়া সত্ত্বেও সব দেশেই রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা পেয়েছেন। তিনি সর্বত্র তুলে ধরেছেন ফিলিস্তিনি জাতির ওপর ইসরাইলিদের নির্যাতনের করুণ চিত্র। স্বাধীনতা সংগ্রামে মন-প্রাণ উজাড় করে দেওয়ায় আরাফাত তার নিজের দিকে তাকানোর সময় পাননি সুদীর্ঘ ৬০টি বছর। ১৯৯০ সালে তিনি বিয়ে করেন ২৮ বছর বয়সী সুহা তাবিলকে। জাহওয়াহ নামে এক কন্যা সন্তান রয়েছে তাদের।

দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ অনুষ্ঠানে ইয়াসির আরাফাত যোগদান করেন। সেখানে জোহান্সবার্গের বড় মসজিদে এক ভাষণে আরাফাত বলেন, আল কুদসই (জেরুজালেম) হচ্ছে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের রাজধানী। মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা হিসেবে ইয়াসির আরাফাত ১৯৯৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।

২০০১ সালের ডিসেম্বর থেকে পশ্চিমতীরের রামাল্লায় তিনি স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ইসরাইল ২০০২ সাল থেকে রামাল্লায় একটি গৃহে আরাফাতকে অবরুদ্ধ করে রাখে। ইসরাইলিদের ওপর বোমা হামলাকারী জঙ্গিদের ধরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ না দিলে তাকে সেখান থেকে বের হতে দেওয়া হবে না বলে ইসরাইলি সরকার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে। এ সময়ে তিনি ঠিকমতো চিকিৎসা নিতে পারেননি। স্ত্রী-কন্যাও কাছে ছিল না। দীর্ঘ চার বছর অন্তরীণ জীবনে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন।

বলা হয়, ২০০৪ সালে দিনের পর দিন অবরুদ্ধ রেখে তাকে সায়ানাইডের চেয়েও ১০ লাখ গুণ বেশি ভয়ঙ্কর বিষ পলোনিয়াম ২১০ প্রয়োগ করে মোসাদ। এ কারণে ২০০৪ সালের ১১ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

পরদিন মিসরের রাজধানী কায়রোতে জানাজা শেষে তার মরদেহ জন্মভূমি ফিলিস্তিনের রামাল্লায় আনা হয়। পিএলও সদর দপ্তর প্রাঙ্গণে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে ফের জানাজা শেষে তার লাশ দাফন করা হয়।

ফিলিস্তিনের মহান মুক্তি সংগ্রামীর জন্ম ১৯২৯ সালের ২৪ আগস্ট মিসরের কায়রোতে। আরাফাত ছিলেন একটি ফিলিস্তিনি সুন্নি মুসলিম পরিবারের সন্তান। তার বাবা আবদেল রউফ আল-কুদওয়া আল-হুসাইনি গাজার এবং মা জোয়া আবুল সাউদ জেরুজালেমের অধিবাসী ছিলেন।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই ইয়াসির আরাফাত বাংলাদেশের জনগণের মহান বন্ধুর মর্যাদায় অভিসিক্ত হয়ে আসছেন।

বাংলাদেশের মহান বন্ধু আরাফাত ১৯৭৪ সালে লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে আরাফাতকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্ভাষণ জানান। পরে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ পরম বন্ধুর মর্যাদায় আরাফাতের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখেন। এ ছাড়া '৯১ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা নিজ নিজ সরকারের মেয়াদে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ইয়াসির আরাফাতের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখেন।

জীবদ্দশায় ইয়াসির আরাফাত অনেকবার রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় আসেন। এ ছাড়া ফিলিস্তিনের জন্য সমর্থন আদায়ে বিশ্ব ভ্রমণকালে অসংখ্যবার ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যাত্রাবিরতি করেন।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ২৫ বছরপূর্তি উপলক্ষে ১৯৯৭ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ আমন্ত্রণে ইয়াসির আরাফাত ঢাকায় আসেন।

 

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ নভেম্বর ২০১৮/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়