ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

ভ্রান্তিবিলাস: এর কারণ ও প্রতিকার

মোঃ আমিরুল ইসলাম প্রামাণিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৮, ২০ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভ্রান্তিবিলাস: এর কারণ ও প্রতিকার

মোঃ আমিরুল ইসলাম প্রামাণিক : মানবদেহে অসুস্থতার সূচনা হয় মন থেকে। আবার অসুস্থতা থেকে সুস্থতার সূচনাও হয় মন থেকে। তাই মনের অস্বাভাবিক আচার-আচরণগুলো খেয়াল, বিভ্রান্তি, উদ্ভট চিন্তা, অবাস্তব দর্শন এভাবে দেখলে চলে না। আমাদের মন অনেক কথা বলে। জনপ্রিয় একটি গান থেকে তার অনেকটা ধারণা পাওয়া যায়। নিতান্তই মনে করিয়ে দেয়ার জন্য গানের কথাগুলো এখানে তুলে ধরছি: কে বলে পাগল, সে যেনো কোথায়, রয়েছে কতই দূরে, মন কেন এতো কথা বলে?

গানের কথাগুলোর সাথে মনের অনেক কথার মিল আছে। আমরাই একমাত্র জীব যাঁরা জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি অনেক কথা বলি। কোনটা বুঝে বলি, কোনটা আবার না বুঝে বলি। কোনটা ইচ্ছায় বলি, কোনটা অনিচ্ছায় বলি। মনের সাথে আমরা যত কথা বলি তার এক-তৃতীয়াংশও প্রকাশ করি না। অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ মনেই থেকে যায়। নানা প্রয়োজনে মনের সাথে আমরা মনের বোঝাপড়া করি। এবং তার ভিত্তিতে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। নিজে অনেক কিছুর সমাধান করে ফেলি। আমরা নিজে যেসব সিদ্ধান্ত নিই তার মধ্যে একটি হচ্ছে ‘হ্যাঁ’, অন্যটি ‘না’। যেসব ক্ষেত্রে আমরা হ্যাঁ অথবা না সিদ্ধান্ত নিতে পারি সেগুলো ভালো দিক। কিন্তু কিছু বিষয় আছে যেসব বিষয়ে মনের কাছ থেকে কোন সিদ্ধান্ত পাওয়া যায় না, সেটি খারাপ দিক। এই খারাপ দিকগুলো অবহেলা না করে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ এবং বিষয়টি গুরুতর ও দীর্ঘস্থায়ী হলে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। আজকের আলোচনা মূলত এ প্রসঙ্গে।

আমরা জানি যে, মানুষের মধ্যে দু’ধরনের ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি বিরাজমান। বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালাতে যেমন ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক সংযোগের প্রয়োজন, তেমনি মনের সাথে মনের বোঝাপড়ার জন্যও অনুরূপ ধরনের ব্যক্তিত্ব প্রয়োজন। ফলে এক কাজের সাথে আরেক কাজের মিল থাকে। সুপরিকল্পিতভাবে জীবনের উন্নততর লক্ষ্য পূরণের দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু এমন যদি না থাকে তাহলে মনে গণ্ডগোল বেধে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেকে ইচ্ছা করেও এমন সব আচরণ করেন যা অনিচ্ছাকৃত বলে মনে হয়। যেসব ক্ষেত্রে আজগুবি এবং উদ্ভট নানা খেয়াল, বিভ্রান্তি এবং অবাস্তব দর্শনের ঘটনা ঘটে তাকেই ভ্রান্তিবিলাস বলা হয়। অন্য কথায় বলা হয় হ্যালুসিনেশন। এই ভ্রান্তিবিলাসের স্বরূপ কী হতে পারে এবং এর সম্ভাব্য কারণ কী হতে পারে সে সম্পর্কে নীচে খানিক ধারণা দেয়া হলো:

এমন কিছু মানুষ আছেন যাঁরা বাড়িতে থেকেও মনে করেন বাড়ি থেকে অনেক দূরে আছেন। তাই তিনি মনের খেয়ালে বারবার বাড়িতে যাওয়ার কথা বলেন বা যেতে চান অথবা ঘুমের মধ্যে বাড়ি যাওয়ার কথা বলেন। কেউ কেউ উপযুক্ত পরিবেশে থেকেও মনে করেন অপরিচিত পরিবেশে আছেন। কেউ আবার মনে করেন অন্য কোন মানুষ তাঁর পাশে শুয়ে আছেন। এপাশ-ওপাশ ঘুরে দেখেন সত্যি সত্যিই কেউ আছেন কিনা। মনে মনে অনেক ভাবেন তাঁর বিছানা যেন ডুবে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে বিছানা বিছানার মতই থাকে। কেউ আবার মনে করেন বিছানাটা অত্যন্ত কঠিন বা শক্ত। অথবা ঘর চাপা পড়ে নিষ্পেষিত হচ্ছেন। সময় ও স্থান সম্বন্ধে ভুল ধারণা করেন। সময় খুব আস্তে, না হয় তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছে মনে করেন। ঘুম থেকে জেগে ঘরের চেয়ার-টেবিলগুলিকে মানুষ ভেবে ভুল করেন। মনে করেন যে, পাশের ঘরে অনেক মানুষ একসাথে শলা-পরামর্শ করছেন ইত্যাদি।

এমন অনেককে পাওয়া যাবে যাঁরা মনে করেন যে, কেউ যেন তাঁকে তিরস্কার বা তাঁর সমালোচনা করছেন। কেউ কেউ মনে করেন যে, কেউ একজন তাঁকে মেরে ফেলবেন বা হত্যা করবেন। কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবেন। হোড়-গোড় ভেঙ্গে ফেলবেন। শত্রুদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছেন। কেউ তাঁকে বিষপ্রয়োগ করবেন। হালকা ভূতের মত বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছেন। যেন কেউ তাকে অনুসরণ করছেন। যেন গর্ভবতী (মেয়েদের ক্ষেত্রে) হয়েছেন অথবা তলপেটে জীবন্ত কিছু আছে ইত্যাদি। কেউ কেউ আবার মনে করেন যে, তাঁর দু’টি দেহ আছে। তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ফাঁপা। পৃথিবী যেন ঘন মেঘে আবৃত, জগতটা যেন কালো ও কপটতাপূর্ণ। তাঁর চেয়ারের নীচ থেকে ইঁদুর দৌঁড়াচ্ছে এবং তাতে তিনি ভয় পাচ্ছেন। তাঁর দেহ কাঁচ বা কাঠের তৈরি। দুই প্রকার ইচ্ছাশক্তি দ্বারা তিনি পরিচালিত হচ্ছেন। দেহ যেন তাঁর আত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন। যেন অমানসিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত। জিনিসপত্রের আকার-আয়তন বাস্তব অপেক্ষা যেন ছোট, মাথা খালি খালি বোধ হওয়া, মনে করেন কোন নারকীয় শক্তি মস্তিষ্ককে অভিভূত করে রেখেছে ও মস্তিষ্কের কাজে বাধা সৃষ্টি করছে ইত্যাদি।

অন্যদিকে, এমন অনেকেই আছেন যাঁরা মনে করেন যে, তাঁর পরকাল নষ্ট হয়ে গেল, শপথ করেন, মুক্তিলাভে আশাশূন্য অবস্থা। মনে হয় কোন পাপের কাজ করেছেন বা করছেন। কারো উপর বিশ্বাস থাকে না অথবা কাউকে কাউকে অতিরিক্ত বিশ্বাস করেন। মনে হয় সরল সোজা কিন্তু অল্পতে রেগে যান। কাজ করার প্রবল ইচ্ছা কিন্তু কোন কাজ গুছিয়ে এবং একবারে শেষ করে উঠেন না। একই কথা বারবার বলেন অথবা কিছু আজগুবি বলেন যা অন্যরা শুনলে মনে করবেন সব সত্যি। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস থাকে না। কখনো মৃত্যুর ভয় মোটেও থাকে না আবার কখনো মৃত্যুর ভয়ে অন্যকে জড়িয়ে ধরেন। আস্তে আস্তে কথা বলেন, মুখে আঙুল দিয়ে শীষ দেন, চুপ থাকতে বলেন। দরজা, জানালা বা আসবাবপত্র ভাংচুর করেন। খাওয়ার কথা বললে ঐ সময় না খেয়ে রাতের আঁধারে উঠে খাবার খান, কেউ যদি দেখে ফেলেন তবে রেগে যান, অতিরিক্ত দানশীল হন ইত্যাদি।

উপরের এক বা একাধিক অথবা একগুচ্ছ ত্রুটিপূর্ণ আচরণ মানুষ যে নিজের ইচ্ছায় করেন তা নয়, নিতান্ত বাধ্য হয়েই এসব করেন অথবা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঐসব হয়ে যায়। এগুলিকে খেয়াল, উদ্ভট চিন্তা, অবাস্তব দর্শন কিংবা ভ্রান্তিবিলাস নামে অভিহিত করা সমীচীন নয়। এসব সমস্যা প্রিয়জন হারানো, মানসিক আঘাত, শৈশবে প্রাপ্ত আঘাতাদি, দৈনন্দিন জীবনের জটিলতা, বিষণ্নতা, জিনঘটিত সমস্যাসহ আরো সব উত্তেজক অথবা পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিচারে উদ্ভুত হয়।

এক গবেষণা থেকে জানা গেছে যে, বিশ্বব্যাপী বিষণ্নতায় প্রায় ৩০০ মিলিয়ন, ডিমেনশিয়ায় ৩৫ মিলিয়ন এবং সিজ্রোফ্রেনিয়ায় প্রায় ২১ মিলিয়ন মানুষ ব্যাধিরূপ মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা আসলে অনেক বেশি। অনেকের মধ্যে উপরের অনেকটা অথবা আংশিক মিল পাওয়া যায়। এসব ত্রুটি-বিচ্যুতি অনেক কারণেই হতে পারে। তবে মস্তিষ্ক, স্নায়ুমন্ডলী এবং রক্ত দূষণের কারণেও এসব ধরনের অনেক সমস্যা দেখা দেয়। এগুলি এক ধরনের মানসিক গোলযোগ বিশেষ। যা নিজ ব্যক্তিত্বের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলেই যে খুব দুশ্চিন্তা করতে হবে তা নয়, তবে কাল বিলম্ব না করে তার প্রতিকারের পথ খুঁজতে হবে। প্রতিকারের প্রাথমিক পদক্ষেপ স্বরূপ যথোপযুক্ত চিকিৎসক বিশেষ করে স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ নতুবা মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত হবে। এছাড়াও, অন্যান্য সহজবোধ্য উপায় খুঁজে বের করা উচিত হবে। যাবতীয় উপায় খুঁজে বের করে এর সমাধান দেয়া সম্ভব হলে অনেকাংশে মনের এসব অস্বাভাবিক অবস্থা দূর করে অনেকটা ত্রুটিবিহীন সুখে জীবনধারণ করা সম্ভব হবে।

লেখক: চাকরিজীবী এবং হোমিওপ্যাথিকের ছাত্র, ২য় বর্ষ



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়