ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

জল-জঙ্গলের কালাবগি

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:২৬, ১৬ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জল-জঙ্গলের কালাবগি

রফিকুল ইসলাম মন্টু: জল-জঙ্গলের সব রূপকথা হার মানায় ‘কালাবগি’। এখানে জল-জঙ্গলের সঙ্গে একাকার হয়ে বাস করে মানুষ। জলবায়ু পরিবর্তন এখানকার মানুষের জীবনধারা পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। বাসিন্দারা সেই ঘূর্ণিঝড় আইলার প্রলয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ার পর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। নিজের বসতভিটা হারানোর পর ঠাঁই হয়েছে বাঁধের ধারের জমিতে। সেখানেও ঘর বানানোর মতো আর মাটি অবশিষ্ট নেই। ফলে জোয়ারের পানির সমান উঁচু খুঁটির ওপর মাচা পেতে বানানো হয়েছে ঘর।

ওপাড়ে জঙ্গল, মাঝখানে শিবসা নদী আর এপাড়ে সারিবদ্ধ ঝুলন্ত বাড়ি। এভাবেই জেগে আছে জল-জঙ্গলের কালাবগি। এক একটি ঘর দাঁড়িয়ে আছে নড়বড়ে খুঁটির ওপরে। মোটামুটি মাঝারি ঝড়ে এসব ঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়। দুর্যোগপ্রবণ এই দেশে সারাবছর ঝুঁকিতে থাকে কালাবগিবাসী। প্রধান জীবিকা মাছ ধরা কিংবা সুন্দরবনে কাজে যাওয়া অথবা বর্ষাকালে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যাওয়ার জন্য ঝুলন্ত পাড়ার প্রত্যেক বাড়িতে রয়েছে নৌকা। ভাঙা, এলোমেলো সেখানকার ঘরগেরস্থলি।



খুলনার দাকোপ উপজেলার সুতারখালি ইউনিয়নের পশ্চিমে শিবসা নদীর তীরে ‘গেট’ বলে একটি স্থান রয়েছে। একটি বড় স্লুইজ গেট আছে বলে লোকমুখে প্রচলিত হয়ে এলাকাটির নাম ‘কালাবগি গেট’। মূলত এখান থেকেই কালাবগি শুরু। এখান থেকে যত দক্ষিণ-পূর্বে এগুতে থাকি, তত ঝুলন্ত বাড়ির সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রথমে ছড়ানো ছিটানো ঝুলন্ত ঘর চোখে পড়ে। এরপর সারিবদ্ধ ঝুলন্ত ঘর। সামনে এগোলে আরও দীর্ঘ সারি। নদীর তীরে ঝুলন্ত ঘরের সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘরত হলেও ঠিক ভেতর অংশেই আবার ভিন্ন চিত্র চোখে পড়ে। বাঁধের ভেতরে অবস্থাপন্ন মানুষ জমিতে ধানের আবাদ করছে। তবে ঘূর্ণিঝড় আইলার ধাক্কা এখনও অনেকেই সামলে উঠতে পারেনি। যুগ যুগ ধরে জল-জঙ্গলে কালাবগির মানুষের জীবিকা নির্বাহ হলেও অনেক আগেই তাতে ভাটা পড়েছে। ঘূর্ণিঝড় আইলায় সব কেড়ে নেয়ার পর প্রতিনিয়ত এখানকার মানুষের সংকট বেড়েই চলেছে। প্রধানত কাজের সংস্থান হারিয়েছে, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জীবন-জীবিকার নানা বিষয়। শেষ বসতভিটা হারানোর পর আবাসনের ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে তীব্র সংকট। খাবার পানির সংকট এ এলাকায় আগেও ছিল। কিন্তু আইলা সেই সংকট আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়ে গেছে। উপেজলা সদর দাকোপ, চালনা, এমনকি খুলনা থেকে এখানকার মানুষ খাবার পানি সংগ্রহ করে।

দৈনন্দিন খাবার সংগ্রহের সঙ্গে সুপেয় পানি সংগ্রহ যেন এ এলাকায় রীতিমত যুদ্ধ। মিঠা পানির যে উৎসগুলো ছিল, ঘূর্ণিঝড় আইলা তা কেড়ে নিয়েছে। নদীতে আসা তীব্র লবণ পানি ঢুকেছে পুকুর-ডোবা-খালে। ফলে এলাকায় পানি সংগ্রহের উৎস একেবারে কমে গেছে। যা আছে, তাতে আবার সকলের প্রবেশাধিকার নেই। ঝুলন্ত পাড়ার কাঁচা রাস্তায় হাঁটার সময় চোখে পড়ে অসংখ্য প্লাস্টিকের ড্রাম। এগুলোতে এই পাড়ার মানুষ দূর থেকে আনা পানি সংরক্ষণ করে রাখে। সাধ্যমত অনেকে ধরে রাখে বৃষ্টির পানি। সেগুলোও সংরক্ষিত হয় এই ড্রামে। ড্রাম থেকে আবার পানি চুরি হয়ে যাওয়ার ভয় আছে। সে কারণে ড্রামের মুখ শক্ত করে আটকে, পলিথিন দিয়ে বেঁধে মাটি দিয়ে ঢেকে রাখা হয়।



পানির কষ্ট নিয়ে যখন কথা হচ্ছিল, তখন ঝুলন্ত পাড়ার জালাল মীরের স্ত্রী সকিরন বিবি (৪৫) বলছিলেন, অনেক কষ্ট করে তিনবেলা ভাত হয়তো পেট ভরে খেতে পারি। কিন্তু প্রায়োজনমত পানি পান করতে পারি। অন্যান্য কাজেও পানি ব্যবহার করতে হয় মেপে। বর্ষাকালে পানির কষ্ট কম থাকে। কারণ, তখন বৃষ্টির পানি পাই। তখন পানি ব্যবহার করি এবং সংরক্ষণ করে রাখি। তবে ধরে রাখা বৃষ্টির পানি শেষ হয়ে গেলে শুকনো মৌসুমে খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। সকিরনের কথায় সায় দিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জায়েদা খাতুন বলেন, আমরা যে কীভাবে পানিকষ্টে বেঁচে আছি, সরকারকে একটু লিখে জানান। বাসিন্দারা আরো জানালেন, লবণাক্ত এলাকা বলে এখানে খাবার পানির সংকট তীব্র। আইলার পরে নদীর পানিতেও লবণাক্ততা বেড়েছে বলে আমরা অনুভব করি। এলাকায় নলকূপ বসলেও তা থেকে লবণ পানি ওঠে। ১৬০-১৬৫ ফুট পাইপ বসিয়েও দেখা গেছে নলকূপ থেকে লবণ পানিই ওঠে। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে নদীর পানি মিষ্টি থাকে। তখন পুকুরের পানিও মিষ্টি থাকে। এরপর থেকে লবণাক্ততা বাড়তে থাকে। দূর থেকে এক কলসি পানি নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছিলেন তারাবানু। ক্যামেরাওয়ালা লোক দেখে সাংবাদিক বুঝতে পেরে বলতে থাকেন- পানির জন্য আমরা কী কষ্ট করি। খাবার পানিসহ নিত্যপ্রয়োজনের পানি সংগ্রহ করতেই আমাদের অনেক সময় এবং অর্থ চলে যায়।

ঝুলন্ত পাড়ার কয়েকটি স্থানে পানির পাকা ফিল্টার চোখে পড়লেও সেগুলো অকেজো। পানির সংকট নিরসনে বিভিন্ন সময় হয়তো এগুলো দেয়া হয়েছিল বেসরকারি উদ্যোগে। ইটবালুর এ ফিল্টারে পানি ধরে রাখা যাচ্ছে না। প্লাস্টিকের ড্রাম পানি সংরক্ষণের টেকসই মাধ্যম বলে মনে করেন এলাকার মানুষ। কিন্তু সব পরিবারের পক্ষে এই ড্রাম পর্যাপ্ত পরিমাণে সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। এনজিও থেকে কিছু ড্রাম দেয়া হলেও তার সংখ্যা হাতে গোনা। পানি সংকট নিয়ে আলাপকালে এলাকার ইউপি সদস্য মোনতাজ সানা বলেন, এখানে নলকূপ বসিয়ে কিংবা ফিল্টার দিয়ে পানির অভাব পূরণ করা সম্ভব নয়। এখানকার প্রতিটি পরিবারে দেড় হাজার লিটারের একটি করে ট্যাঙ্কি দিলে তারা সারাবছরের পানি ধরে রাখতে পারবে।



কালাবগির বাসিন্দারা নদীভাঙনে ক্ষতবিক্ষত। ভাঙনের কারণে ঘর বদল করতে করতে তাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকেছে। এখন আর কোথাও যাওয়ার স্থান নেই। কালাবগির শেষ সীমানা থেকে নলিয়ান পর্যন্ত ভাঙনের তীব্রতা একই রকম। ঘূর্ণিঝড় আইলায় এ এলাকার বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। এরপর নতুন বাঁধ হয়, ব্লক ফেলে বাঁধ সংরক্ষণ করা হয়। কিন্তু ভাঙন রোধে কোন উদ্যোগ না নেওয়ায় সে বাঁধ টিকেনি। এবার সুতারখালী ইউনিয়নে নতুন করে বাঁধ হচ্ছে। কিন্তু ভাঙন রোধ না হলে সে বাঁধও টিকবে কিনা সন্দেহ এলাকাবাসীর। যদিও কালাবগির অন্তত ৫০০ পরিবার সে বাঁধের বাইরেই থাকছে।  ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দাদের একজন মোনায়েম সরদার। জানালেন, এখানে নিজের জমিতেই তার বাড়ি ছিল। নিজের বাড়িতে থাকতেন, অন্যের জমিতে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। কিন্তু ১০ কাঠা জমির ওপর নিজের সেই বাড়িটি নদীর ভাঙনে চলে গেছে। ভিটে হারানোর সঙ্গে তার জীবিকায় দেখা দিয়েছে সমস্যা। আগে নদীতে মাছের পোনা ধরার সুযোগ ছিল, সুন্দরবনে বিভিন্ন কাজে যাওয়া যেত। এখন সেসব কাজ সংকুচিত হয়ে এসেছে। মোনায়েম সরদারের কথায় ঘূর্ণিঝড় আইলা এখানকার মানুষের জীবন জীবিকা এলোমেলো করে দিয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার আগের কালাবগির সঙ্গে এখনকার কালাবগির মিল নেই। বহু জনপদ হারিয়েছে নদীতে। বেড়িবাঁধ চলে গেছে। সাইক্লোন শেলটার, স্কুল, রাস্তাঘাটসহ বহু স্থাপনা হারিয়ে গেছে। মানুষ কাজ হারিয়েছে। আর কাজ হারানোর কারণে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংকট বেড়েছে। স্কুল পড়ুয়া অনেক ছেলেমেয়েরা আর্থিক সংকটের কারণে কাজে নামতে বাধ্য হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এলাকার উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও তা টেকসই হয়নি। এলাকার উল্লেখিত সমস্যা প্রসঙ্গে ইউপি সদস্য মোনতাজ সানা বলেন, নদীর ভাঙনের কারণে এখানে বারবার বাড়ি বদল করতে হয়। এর পাশাপাশি নদীতে পোনা ধরা নিষিদ্ধ। ফলে মানুষের হাতে কাজ নেই। অনেককেই ধারদেনা করতে চলতে হয়। বহু পরিবারের পুরুষ এখন কাজের সন্ধানে বাইরে চলে গেছে। এখানকার মানুষ আইলার পর থেকে খুবই সংকটে দিনযাপন করছে। সমস্যা সমাধানে এলাকায় রাস্তাঘাট করতে হবে। ব্লক ফেলে নদীর ভাঙন রোধ করতে হবে। তাহলে সংকট অনেকটা কাটবে।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়