ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

লেডি অব আইল্যান্ড

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ৩০ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
লেডি অব আইল্যান্ড

রফিকুল ইসলাম মন্টু : নিজের জীবনের চেয়েও গোটা দ্বীপের মানুষের জীবন রক্ষার দায়িত্বকে বড় করে দেখেছিলেন তিনি। ওয়্যারলেস বার্তা পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন বাড়ি বাড়ি। সব নারীরা যখন নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত তখন তিনি গোটা দ্বীপ চষে বেরিয়েছেন। লক্ষ্য একটাই, সব মানুষকে বাঁচাতে হবে। নিজের ঘরে পুরুষ লোকটি বাইরে থাকলেও মনোবল হারাননি। অবশেষে তিনি জয়ী। মারাত্মক ঝুঁকির মাঝেও সকল মানুষকে বাঁচাতে পেরেছিলেন। পরের দিন দেশি-বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়- দ্বীপটি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু এই খবর পেয়ে বাইরে থেকে লোকজন এসে অবাক হন এত বড় ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে এখানকার লোকগুলো বেঁচে রয়েছে কীভাবে?

সেদিন তাক লাগানো সেই কাজটি করেছিলেন শোভা রানী। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড়ের রাতে এখানকার একটি মানুষেরও বাঁচার কথা ছিল না। কারণ, মানুষ ছিল অসচেতন। ঘর থেকে কেউ বের হতে চায়নি। শোভা রানীর সম্বল ছিল রেডক্রিসেন্টের ওয়্যারলেস আর একটি সাইক্লোন শেলটার। সঙ্গে মাত্র দশজন স্বেচ্ছাসেবক। শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাতের বার্তা পেয়ে সে বার্তা পৌঁছে দেন মানুষের কাছে। পরে সকল মানুষকে নিয়ে আসেন আশ্রয়কেন্দ্রে। রাতে প্রচণ্ড আঘাতের পর সকলের ধারণা ছিল কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপে কোনো মানুষ বেঁচে নেই। কারণ ওখানেই ঘূর্ণিঝড় আঘাত করে। এমনকি বিশেষ কাজে শহরে অবস্থানকারী শোভা রানীর স্বামী শচিরাম দাসও এমন ভাবেননি। পরের দিন ভোর থেকে দলে দলে দেশি-বিদেশি প্রতিনিধিদল এসে সব মানুষকে জীবিত পান।    

একানব্বইয়ে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়ে ‘লেডি অব আইল্যান্ড’ উপাধি পেয়েছিলেন শোভা রানী। এই শিরোনামে তার ওপর তৈরি করা প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। আর এরই সূত্র ধরে উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় সাইক্লোন শেলটার নির্মাণে বাংলাদেশ পেয়েছিল ৬০ কোটি টাকার অনুদান। কিন্তু সেই ‘লেডি অব আইল্যান্ড’ কিছুই পাননি। এখনও দ্বীপের মানুষের সেবায় নিয়োজিত তিনি। বদলায়নি ভাগ্য। শোভা রানীর বাড়ি কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলা সদরে। এই বাড়ি কিংবা সন্তানসহ সব স্বজনদের দূরে রেখে পশ্চাৎপদ দ্বীপ সোনাদিয়ার শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটিয়ে দিয়েছেন। তার কাজের সহযোগী স্বামী শচিরাম দাস। তিনিও সেখানে শিক্ষকতার চাকরি নেন। ছোট্ট খড়ের ঘরে এই দম্পতির কেটে গেল ৩২টি বছর।

একানব্বই সালের ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন শোভা রানী। সোনাদিয়া দ্বীপে রেডক্রিসেন্ট ওয়্যারলেসের দায়িত্বে ছিলেন স্বামী শচিরাম দাস। কিন্তু ওই ভয়াল রাতে বিশেষ প্রয়োজনে এলাকার বাইরে থাকায় এই দায়িত্ব পড়ে শোভা রানীর ওপর। ওয়্যারলেস অপারেট কিংবা রেডক্রিসেন্টের অন্যান্য কাজে তার প্রশিক্ষণ ছিল। সেগুলোই কাজে লাগালেন। মানুষকে বাড়ি থেকে সাইক্লোন শেলটারে নিয়ে আসাই ছিল তার লক্ষ্য। সে দিনের গল্পটা বলতে গিয়ে শোভা রানী বলেন, ছোট মেয়ে দু’টোকে খাটের সাথে বেঁধে নিজের কাপড় শক্ত করে কোমরে বেঁধে লোকজনকে শেলটারে তুলি। মানুষ ছিল অসচেতন। তাদেরকে ঘর থেকে বের করা ছিল কঠিন কাজ। তারা ঘর থেকে বের হতে চায়নি। সংকেত আর সাইরেন বাজালেও কেউ আমলে নেয়নি। শেষ মুহূর্তে হঠাৎ পানি বাড়লে সবাই বিপদে পড়ে। মাত্র ১০জন স্বেচ্ছাসেবকের সহায়তায় প্রায় সব মানুষকেই সেদিন উদ্ধার করেছিলেন শোভা রানী।

ওই ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপের প্রায় সব বাড়িঘর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও একজনও মারা যাননি। তবে পরের দিন গণমাধ্যমে খবর বের হয় সোনাদিয়া দ্বীপে কোনো মানুষ বেঁচে নেই। এই খবর পেয়ে জার্মান রেডক্রস, জাপান রেডক্রস ও বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্টের যৌথ টিম আসে সোনাদিয়া দ্বীপে। তারা দেখেন এখানকার একজন মানুষও মারা যায়নি। শোভা রানীর কাছ থেকে তারা শোনেন এখানকার লোকজনকে বাঁচানোর গল্পটা। আর এই অভিজ্ঞতার আলোকেই তৈরি হয় প্রামাণ্যচিত্র ‘লেডি অব আইল্যান্ড’। এই প্রামাণ্যচিত্র সেসময় দেশে-বিদেশে আলোচনার জন্ম দেয়। বিনিময় হয়েছে দুর্যোগ মোকাবেলার অভিজ্ঞতা। কিন্তু সেই ‘লেডি অব লাইল্যান্ডের’ ভাগ্য ফেরেনি।

চাকরির সুবাদে সোনাদিয়া এসেছিলেন শোভা রানী। বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপের শিক্ষা প্রসারে রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি একটি স্কুল গড়ার উদ্যোগ নেয় ১৯৮৭ সালে। কিন্তু শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছিল না। একটি সার্কুলার দেওয়া হয়। আগ্রহী হন তিনি। আবেদন করেন। কিন্তু চাকরি হলে একা কীভাবে এই দ্বীপে থাকবেন। সেই ভাবনা থেকে তার স্বামী শচিরাম দাসও ওই স্কুলের শিক্ষকের পদে আবেদন করেন। স্কুল পরিচালনার সুবিধার্থে দু’জনেরই চাকরি হয়। ১৯৮৮ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে শিক্ষানুরাগী এই দম্পতি এই দ্বীপে অবস্থান করছেন। দু’জন মিলে এখানকার ছেলেমেয়েদের স্কুলমূখী করার উদ্যোগ নেন। পাশাপাশি রেডক্রিসেন্টের ওয়্যারলেস অপারেটরের দায়িত্বও নেন তারা। এখানকার মানুষের স্ংস্কৃতি আর সমস্যা-সংকটের সঙ্গে মিশে যান এই শিক্ষক দম্পতি। দ্বীপের পূর্বপাড়ায় স্কুলের পাশে একখণ্ড জমিতে একটি খড়ের ঘরে তাদের বাস। শিক্ষকতার সুবাদে এলেও দ্বীপের মানুষের ‘দাদা’ আর ‘দিদি’ হয়ে ওঠেন শচিরাম দাস ও শোভা রানী। দ্বীপের মানুষের সঙ্গে নিবিড় সখ্য গড়ে ওঠে।

বিচ্ছিন্ন দ্বীপে স্কুল গড়ার গল্প শোনাতে গিয়ে শচিরাম দাস ও শোভা রাণী জানালেন তাদের বহুমূখী সংগ্রামের কথা। বলেন, মাত্র ৬০ জন ছাত্র নিয়ে শুরু হয়েছিল এই স্কুলটি। অভিভাবকেরা অসচেতন থাকায় ছেলেমেয়েদের স্কুলে আনা ছিল কঠিন কাজ। স্কুলে ভর্তি হলেও প্রথমদিকে ঝরে পড়ার হার ছিল অনেক বেশি। এখনও প্রাথমিক শেষ হওয়ার আগে অনেকে ঝরে পড়ছে। তবে হার কমেছে। দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে শচিরাম আর শোভা রানীর কণ্ঠে আক্ষেপের সুর। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে কিছুই মেলেনি। এই প্রবীণ শিক্ষক দ্বীপের এই স্কুলে মাত্র ৫০০ টাকা বেতনে চাকরি শুরু করেছিলেন। ৭০০, ৭৫০, এভাবে ২০১০ সালে এসে বেতন দাঁড়ায় ৫০০০ টাকা। কিন্তু বেতন বাড়তে না বাড়তেই চাকরির শেষ প্রান্তে চলে আসেন শচিরাম। অবসরে গিয়ে কল্যাণট্রাস্টের এক লাখ ২০ হাজার টাকার জন্যও ঘুরতে হয়েছে কয়েক বছর।  শোভা রানী বলেন, কিছু পাওয়ার আশায় আমরা এখানে আসিনি। এই বিচ্ছিন্ন দ্বীপের ছেলেমেয়েদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়ানোই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। একইসঙ্গে দুর্যোগে এখানকার মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়ার দায়িত্বটাও আমাদের ওপর পড়ে। এখানকার মানুষের ভালোবাসা নিয়ে সবার সঙ্গে মিলেমিশে আছি, এটাই বড় পাওয়া।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়