ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

থাইল্যান্ড ত্যাগের হিড়িক কম্বোডীয়দের

তৈয়বুর রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৩৫, ১৭ জুন ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
থাইল্যান্ড ত্যাগের হিড়িক কম্বোডীয়দের

থাইল্যান্ড ত্যাগ করে নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে কম্বোডীয়রা -ব্যাংকক পোস্ট

তৈয়বুর রহমান : থাইল্যান্ডে কর্মরত দেড় লাখেরও বেশী কম্বোডীয় নিজ দেশে পালিয়ে গেছেন। সামরিক জান্তার দমন অভিযানের ভয়ে তারা থাইল্যান্ড ছাড়তে বাধ্য হন। এতে থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মধ্যে সম্পর্ক আরো তিক্ত হয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে দুই দেশের অর্থনীতিও।

থাই শিল্প-কারখানা মূলত কম্বোডীয় শ্রমিকদের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। আবার কম্বোডীয় অর্থনীতি উপকৃত হয় শ্রমিকদের পাঠানো অর্থে, অর্থাৎ রেমিট্যান্সে।

থাই অর্থনীতি ভর করে আছে মূলত ত্রিশ লাখ বিদেশি শ্রমিকের উপর। তারা থাইল্যান্ডে গেছেন প্রতিবেশি মায়নমার, কম্বোডিয়া ও লাওস থেকে। তারা কাজ করে থাকেন কল-কারখানা ও নির্মাণাধীন প্রকল্পে। এছাড়া ধনবান, মধ্যবিত্ত থাই ও অন্যান্য দেশ থেকে আসা লোকজনের বাসা-বাড়িতেও কাজ করে থাকেন কেউ কেউ। বাকিরা করে থাকেন ভৃত্যের কাজ।

বিভিন্ন খবরে বলা হচ্ছে, থাই ব্যবসায়ীদের মধ্যেও আতঙ্ক ভর করেছে। থাইল্যান্ড ছেড়ে কম্বোডীয়দের চলে যাওয়া যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লোকজনের অভাব দেখা দেবে। বিশেষ করে, সামরিক জান্তার দমন অভিযানের আতঙ্ক মায়ানমার থেকে আসা শ্রমিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ায় থাইল্যান্ড বড় ধরনের বেকায়দায় পড়বে। থাই অর্থনীতির একেবারে চাকা মন্থর হয়ে যেতে পারে। প্রসঙ্গত, থাইল্যান্ডে মায়ানমার থেকে আসা শ্রমিকের সংখ্যা অনেক বেশি।

কম্বোডীয় শ্রমিকদের সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার সময় সেখানে দেখা দিয়েছে গোলযোগপূর্ণ পরিস্থিতির। যেমনটা বললেন অরন্যপ্রাথেট সীমান্ত চেকপয়েন্টের কাস্টমস প্রধান আনেক মানুসনিরবন। তিনি বলেন, ‘এখানকার পরিস্থিতি রীতিমতো গোলযোগপূর্ণ।’ সেই সঙ্গে যোগ করেন, ‘অতিরিক্ত ডিপারচার লেনও আমাদের খুলতে হয়েছে। কেননা সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার জন্য ট্রাক ও বাসের লম্বা লাইন প্রায় চার কিলোমিটার পর্যন্ত দীর্ঘ হয়েছে।’

কম্বোডীয় শ্রমিকদের ব্যাপক হারে চলে যাওয়ার কারণ হয়তো সামরিক জান্তার ঘোষণার প্রতি তাদের বিশ্বাস না থাকা। এছাড়া টেলিভিশনে খবর প্রচারের উপর সেন্সর আরোপ করেছে জান্তা। অভ্যূত্থানের সমালোচনাও সহ্য করছেন না তারা, নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে। জেনারেলরা ক্ষমতা দখল করেন গত মাসে। অথচ এর আগে কয়েক মাস ধরে তারা অভ্যূত্থানের পরিকল্পনা করছে বলে প্রচারিত খবর অস্বীকার করে আসছিল।

থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, সামরিক বাহিনীর দমন অভিযানের কথা ঠিক নয়, পুরোপুরি মিথ্যা। একে গুজব বলেও অভিহিত করা হয় বিবৃতিতে।

ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের মুখপাত্র জোয়ে লরে জানান, এতো ব্যাপক হারে কম্বোডীয়দের চলে যাওয়ার পেছনে গুজব ছাড়া আর কিছুই নেই। তার সংস্থা থাইল্যান্ড ত্যাগকারী কম্বোডীয়দের সাহায্য করছে।
জোয়ে লরে বলেন, ‘এখানে অবশ্যই তথ্যের ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া কম্বোডীয়রা আসলে বিশ্বাস করছে তাদের নিজেদের কমিউনিটির কাছ থেকে যা শুনছে, তাই।’

সোমবার কম্বোডিয়ার এক কর্মকর্তা জানান, এ পর্যন্ত ১লাখ ৬০ হাজার কম্বোডীয় দেশে ফিরেছে। কম্বোডিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কোয় কুয়ং জানান, বিভিন্ন চেক পয়েন্ট দিয়ে শ্রমিকরা ফিরছে। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহে শুধুমাত্র অরন্যপ্রাথেট চেকপয়েন্ট দিয়ে সীমান্ত পাড়ি দেন ১ লাখ ৪২ হাজার জন।

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবেই বিরোধপূর্ণ। কিন্তু দুই দেশের নাগরিকরা বলতে গেলে অবাধে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে থাকেন। যে সব কম্বোডীয় থাইল্যান্ড ত্যাগ করার অপেক্ষায় রয়েছেন, তারা বলছেন, কম্বোডীয় কমিউনিটির মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করছে। কেউ কেউ বলছেন, এতো জরুরি ভিত্তিতে থাইল্যান্ড ত্যাগের কারণ তারা নিজেরাই জানেন না।

কম্বোডিয়ার মানবাধিকার গ্রুপগুলোর অভিযোগ, থাই কর্তৃপক্ষ কম্বোডীয়দের নির্যাতন এবং তাদের স্বদেশে ফিরতে বাধ্য করছে। ধারণা করা হচ্ছে থাইল্যান্ডে দুই লাখেরও বেশী কম্বোডীয় কাজ করছে থাইল্যান্ডে এবং এদের বেশীরভাগই অবৈধ। তবে থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেক ওয়ানামেথি অভিযোগ নাকচ করে দিয়ে বলেন, কম্বোডীয়রা স্বেচ্ছায় ফিরে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের সীমান্ত পর্যন্ত পরিবহন সহায়তা দেয়া হচ্ছে।

তবে একটু ভিন্ন কথা বলেছেন ব্যাংকক থেকে ফেরা চেম চেদা (২০) নামের এক শ্রমিক। সোমবার পইপেট থেকে তিনি ফোনে বলেন, ব্যাংককের শহরতলী সামুত প্রাকার্নে একটি কোম্পানিতে তিনি নির্মান শ্রমিক হিসেবে অবৈধভাবে কাজ করছিলেন। সেখানে মাসে তিনি পেতেন ৯ হাজার বাথ (তিনশ ডলার)।

গত শুক্রবার থাই সামরিক পুলিশ তার কর্মস্থলে এসে কোম্পানির ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলার পর ওই ব্যবস্থাপক জানান, সেনা নির্দেশে অবৈধভাবে কর্মরত কম্বোডীয় শ্রমিকদের দেশে ফিরে যেতে হবে। চেম আরও বলেন, প্রথমে বিষয়টিতে তিনি গুরুত্ব দেননি। কিন্তু থাই সেনারা যখন সরাসরি আমাকে একই কথা বলল তখন আমি ভয় পেলাম। এরপর আমি বিনা বাক্য ব্যয়ে থাই সেনাদের সঙ্গে রেল স্টেশনে গেলাম। এসময় সেনারা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেনি। চেম জানান, সেখান থেকে তাকে সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়।

অরন্যপ্রাথেট চেকপয়েন্টে সীমান্ত পাড়ি দেয়ার জন্য অপেক্ষমান বাস বোঝাই কম্বোডীয়দের একজন ২২ বছর বয়সী না কুয়ান। তিনি বললেন, ‘আমি জানি না, আমি কেন দেশে ফিরছি। আমার বাবা-মা, ভাই, বোন সবাই আমাকে কম্বোডিয়া ফিরে যেতে বলেছে।’

উয়ে কাওউই নামে এক হকার ও খ-কালীন নির্মাণ শ্রমিক থাইল্যান্ডে বসবাস করছেন ১৫ বছর ধরে। তিনি জানালেন, থাই সামরিক বাহিনীর লোকজন কম্বোডীয়দের হত্যা করছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়েছে। তাই সবাই দেশের পথ ধরেছেন।

আমি থাইল্যান্ডে এর আগে কখনোই এতটা ভয় পায়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে এখানে থাকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমি নিজেও এখানে থাকার ঝুঁকি নেবো না। আমরা সবাই সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ভয়ে ভীত।’

গত কয়েক সপ্তাহে সামরিক সরকার কিছুটা জাতীয়তাবাদী সুরে কথা বলেছে। অভূত্থানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের সমালোচনা করেছে তীব্র ভাষায়। নরওয়ের টেলিকম কোম্পানি টেলিনরের শেয়ারহোল্ডিং কাঠামো খতিয়ে দেখার ঘোষণা দিয়ে বলেছে, এতে কোনো আইন অমান্য করা হয়েছে কি না, তা দেখা হবে। এর আগে কোম্পানি প্রকাশ করে দেয় যে, জান্তা সরকার সাময়িকভাবে কোম্পানিকে ফেসবুক ব্লক করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, জান্তার লক্ষ্য অবৈধ তৎপরতা বন্ধ করা। এর মধ্যে জুয়া, মাদক দ্রব্য ও অবৈধ শ্রমিক রয়েছে। অবৈধ শ্রমিকদের বিদায় করে দেয়া হবে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পর্যায়ক্রমে তা করা হবে। তবে অবশ্যই বিদেশি শ্রমিকদের উপর নির্ভরশীল কল-কারখানার ক্ষতি করে নয়।

সামরিক সরকারের মুখপাত্র পাটামাপর্ন রাতানাদিলক না ফুকেত কম্বোডীয়দের ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এখন ফসল ঘরে তোলার সময় হয়েছে।

তিনি দাবি করেন, দমন অভিযানের গুজব শুনে কল-কারখানার মালিকরা তাদের অভিবাসী শ্রমিকদের সাময়িকভাবে দেশে চলে যেতে বলেছেন। তাই এমনটা ঘটে থাকতে পারে।

‘আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে চাই যে, অভিবাসী শ্রমিকদের উপর দমন অভিযান চালানোর কোনো নির্দেশ দেয়া হয়নি’- বললেন ফুকেট।

তথ্যসূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস, ফক্স নিউজ

রাইজিংবিডি/১৭জুন ২০১৪/তৈয়বুর/সন্তোষ/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ