ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বাংলাদেশ এবং শামসুর রাহমান

মারুফ রায়হান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:০৪, ১৬ আগস্ট ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলাদেশ এবং শামসুর রাহমান

অলংকরণ : অপূর্ব খন্দকার

মারুফ রায়হান : মৃত্যুখচিত বিহ্বল এক মাসের নাম আগস্ট। বাংলা কবিতার দুই প্রধান পুরুষ রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল এ মাসেই চলে যান। বিদায় নিয়েছেন কবি শামসুর রাহমানও। আর বাঙালির জন্যে স্বতন্ত্র স্বাধীন আবাসভূমির যিনি স্থপতি, বাংলাদেশের সেই অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের প্রস্থানও এই মাসে। তার বিদায় এতটাই ট্র্যাজিক যে সে কথা স্মরণে আনলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। একদিকে শোক পাথরের মতো বুকের ওপর চেপে বসে; অপরদিকে ক্ষোভে ক্রোধে ফেটে পড়তে ইচ্ছে হয়। যা-ই হোক, মৃত্যুদিবসকে সামনে রেখে ব্যক্তিত্বের স্মরণ স্বাভাবিক এক আনুষ্ঠানিকতা। এই সুবাদে নতুন প্রজন্মের কাছে প্রয়াত ব্যক্তির এক ধরনের নবজন্মলাভ ঘটে; অপরদিকে তাঁকে পুনর্মূল্যায়ন ও পুনর্বিবেচনার একটি সুযোগও মেলে। কালের ক্যানভাসে রেখে ব্যক্তির সৃষ্টি বা অর্জনকে নতুন করে বুঝে নেয়ার এই সংগত সংস্কৃতিতে এক ধরনের মেলবন্ধনের সুবর্ণ সুযোগও তৈরি হয়।

 

কবি শামসুর রাহমানের রচনার সংখ্যা এত বিপুল যে কোনো একটি দিক নিয়ে কথা বলতে গেলেও যথেষ্ট সময় ও পরিসরের প্রয়োজন। গবেষণাপত্রে লেখা পড়া আর কম্পিউটারের পর্দায় রচনাপাঠের ভেতর বৈশিষ্ট্য ও চারিত্র্য বিচারেই রয়েছে দুস্তর ব্যবধান। এখানে বিন্দুর ভেতর সিন্ধু তুলে ধরার এক অসম্ভব কসরৎ করা লাগে।
কবিতায় শামসুর রাহমানের সামগ্রিক অর্জনের কথা সংক্ষেপে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে যে, তিনি এই অঞ্চলে প্রভাব সৃষ্টিকারী প্রাচীনত্বগন্ধী রিক্ত কাব্যভাষাকে হটিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সুমার্জিত, আধুনিক, মুখের ভাষার কাছাকাছি নাগরিক কবিতার ভাষা। এই তাৎপর্যপূর্ণ কাজে তাঁর আগেও দু’তিনজন কবি বাংলাদেশে সক্রিয় হয়েছিলেন, তবে সফল পদরেখা প্রোথিত করেন তিনিই প্রথম। পরবর্তীকালে অনুগামী পান অনেক, অনুসারী সুপ্রচুর। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ স্পষ্টতই বদলে দেয় বাংলা কবিতাবিশ্বকে। ভাষা, চেতনা, বোধ, আবেগ, বৈশিষ্ট্য- সর্ববিচারে বাংলা কবিতার ঘটে পালাবদল। এখানে যে পাঁচটি উপাদানের কথা বলা হলো তার প্রতিটির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের জন্যে প্রয়োজন পৃথক পাঁচটি প্রবন্ধ-পরিসরের। আধুনিকতা, নান্দনিকতা, বিশ্বনাগরিকতা, মননশীলতা এবং বাস্তব ও কল্পনার সাংগীতিক সমন্বয়- প্রতিটি ক্ষেত্রে কবি শামসুর রাহমানের অবদান এক কথায় অসাধারণ।

 

তবে পরবর্তীকালে আমরা বিশাল শব্দভাণ্ডার গড়ে তোলা নতুন এক শামসুর রাহমানকে আবিষ্কার করি। এই শামসুর রাহমানের বর্ণনামূলক বাকভঙ্গি এমনই অবিকল্প হয়ে উঠেছিল যে তা স্বচ্ছন্দভাবে কবিতায় ধারণে সক্ষম ছিল বাংলার আধুনিক মানুষের যে কোনো বিষয় বা বক্তব্য। কবিতা যেন হয়ে উঠেছিল দিনানুদৈনিক ঘটনা, অনুভূতি কিংবা অনুষঙ্গের সহযাত্রী। ‘হরতাল’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘দুঃস্বপ্নে একদিন’- কবিতার শিরোনামই বলে দেয় এর ভেতরকার বক্তব্য। সেই যে শামসুর রাহমানের কবিতায় স্বদেশের মুখচ্ছবি ফুটে ওঠার শুরু, তাতে আর ছেদ পড়েনি। বরং বিকশিত হয়েছে সর্ববিধ ও সর্বোচ্চ রূপ নিয়ে। স্বদেশের প্রতিটি বড়ো কম্পনে, ক্রন্দনে; অর্জনে, বিসর্জনে, আঁধারে ও আলোকছটায় সৃজিত ও স্পন্দিত হয়েছে তাঁর শব্দেরা। দেশ, দেশের মানুষ, চলমান সময়, কবিসত্তা- সব বেজে উঠেছে এক তানে, একাকার হয়ে গেছে সব। এভাবেই তো পাওয়া একাত্তরে ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’; পঁচাত্তরের প্রেক্ষাপটে ‘ইলেকট্রার গান’; পুনরায় জলপাই রঙে দেশ ঢেকে গেলে ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’, ‘দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে’, ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ এবং এরশাদের স্বৈরশাসনকালে ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’, ‘একজন শহীদের মা বলছেন’, ‘গর্জে ওঠো স্বাধীনতা’, ২০০০-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ‘সুধাংশু যাবে না’সহ অনেক কবিতা।

 

প্রকৃত কবিসত্তা গজদন্তমিনারবাসী হয়ে থাকতে পারেন না; তাঁকে নেমে আসতেই নিজ মাটিতে নিজ বাসভূমে। শামসুর রাহমানের পঞ্চম কাব্য ‘নিজ বাসভূমে’-র কবিতাগুলোয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর স্বদেশ পরিক্রমা। নির্জনতার কবি যেন চলে এসেছেন জনস্রোতের মাঝখানে। ওই কাব্যের চারটে কবিতার নাম বলি, তাতেই বোঝা যাবে কবিতার বিষয় ও কবিমানস: ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনি বর্ণমালা’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘হরতাল’, ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’। ইতিহাসের পালাবদল, স্বদেশ পরিস্থিতির রূপান্তর সব প্রত্যক্ষ করছেন কবির চোখেই, তবে তাতে আছে স্বপ্ন ও প্রগতিশীলতা, প্রতিশ্রুতি ও নান্দনিকতা।
 

 

৬৯, ৭১, ৭৫, ৮২, ৯০- কালের একেকটি অমোচনীয় ফলক। ৬৯ এর পেছনে আছে গোটা ষাটের দশক- বাঙালির একতাবদ্ধ প্রতিবাদ। স্বদেশ নিষ্পেষণের ভেতর থেকে ফুঁসে উঠছে, প্রতিরোধ গড়ে তুলছে তার সন্তানেরা। রক্তগঙ্গা বয়ে যাচ্ছে নিজের সম্মান ঊর্ধে তুলে ধরার লড়াইয়ে। অবশেষে এ দেশের মাটি থেকে বিজাতীয় শত্রুরা বিতাড়িত হয়েছে। কিন্তু রেখে গেছে ধ্বংসের বীজ। ঘরের শত্রু বিভীষণ। এই দেশ তাদের হাতে আবার ছিন্নভিন্ন। কালে কালে বদলে গেছে স্বৈরাচার। সেই স্বৈরাচারের চূড়ান্ত পতনের লক্ষ্যে কবিকে লেখার টেবিলের বাইরেও এসে সংগ্রামে যুক্ত হতে হয়েছে। নূর হোসেনকে প্রত্যক্ষ করেছেন কবি, যার বুকেপিঠে লেখা ছিল গণতন্ত্রের পক্ষে স্লোগান।

 

কবি বলছেন- বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়। আমরা যদি কবির কবিতাসমগ্রের পাতা খুলে বসি তাহলে দেখব স্বদেশের প্রতিটি গভীর স্পন্দনই সেখানে শাব্দিক ব্যঞ্জনায় মূর্ত। কালেকালে নতুন সংকট এসে সামনে দাঁড়িয়েছে দেশমাতৃকার। সেসব সংকটে যখন মানুষ মুষড়ে পড়ে, তখন দেশপ্রেমিক রাজনীতিকের মতো কবিকেও দেখাতে হয় উদ্ধারের পথ, দিতে হয় সিদ্ধান্ত।

 

‘দুঃসময়ের মুখোমুখি’ থাকা এ অনিবার্য নিয়তি হয়ে ওঠে বাংলাদেশে। তবু ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’। ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ একথা বলেই কবি থেমে থাকতে পারেন না। অনেকটা একাত্তরের ধরণেই আবার বাঙালি একতাবদ্ধ হয়ে সুসময় রচনার সংগ্রামে নামে। নব্বুইয়ে হটে যায় স্বৈরশাসক। হেসে ওঠে বাংলাদেশ। কিন্তু নবপর্যায়ে আবার রাষ্ট্রের চাকাকে যেন পেছনের দিকে নিয়ে যেতে চায় মূঢ় শাসকগোষ্ঠী। বাংলাদেশের হৃদয় পুনরায় পীড়নের শিকারে পরিণত হয়। একাত্তরের হায়েনা হেসে ওঠে আবার নব্বুইয়ের পরে; এই দেশের মাটি থেকে উত্থিত মানুষ ধর্মপরিচয়ের কারণেই ফের নির্যাতনের বলি হয়। তাকে কি দেশান্তরী হতে হবে? না। বাংলাদেশের হৃদয়কে যিনি নিজ সত্তায় লালন করেন সেই কবিকে লিখতেই হয় :

লুণ্ঠিত মন্দির, আর অগ্নিদগ্ধ বাস্তুভিটা থেকে
একটি বিবাগী স্বর সুধাংশুকে ছুঁলো
‘আখেরে কি তুমি চলে যাবে?’ বেলা শেষে
সুধাংশু ভস্মের মাঝে খুঁজে
বেড়ায় দলিল, ভাঙা চুড়ি, সিঁদুরের স্তব্ধ কৌটা,
স্মৃতির বিক্ষিপ্ত পুঁতিমালা।
...
আকাশের নীলিমা এখনো
হয়নি ফেরারি, শুদ্ধাচারী গাছপালা
আজও সবুজের
পতাকা ওড়ায়, ভরা নদী
কোমর বাঁকায় তন্বী বেদিনীর মতো।
এ পবিত্র মাটি ছেড়ে কখনো কোথাও
পরাজিত সৈনিকের মতো
সুধাংশু যাবে না।
 

 

ব্যক্তির প্রয়াণের পর আমরা ব্যক্তিত্বকে পূর্ণতায় বুঝে নিতে চাই। কবি-ভাবমূর্তির সঙ্গে সে-অবয়ব সংযুক্ত হয়ে ব্যক্তিকে বিরাট ব্যাপ্তি দেয়। দেশের প্রধান কবির সম্মান আমরা দিয়েছি শামসুর রাহমানকে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে, আরো স্পষ্ট করে বললে পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে-সেনাশাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে, সেই বাংলাদেশে জাতির বিবেকের কণ্ঠস্বর আমরা শুনেছি শামসুর রাহমানের কবিতায়। দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনকে অনুসরণ করেছে তাঁর পঙ্ক্তিমালা, যুগিয়েছে শক্তি ও প্রেরণা। মৌলবাদ ও স্বৈরাচারের সমান্তরাল উত্থানে বিপন্ন বিপর্যস্ত বাংলাদেশে আন্দোলনে সংগ্রামে শামসুর রাহমান গর্জে ওঠা শব্দে ও শারীরিক উপস্থিতির মাধ্যমে এমন একটি পর্যায়ে নিজেকে উত্তীর্ণ করতে সক্ষম হোন, যেখানে পৌঁছতে পারেন শতাব্দীতে একজন কি দু’জন। তাঁর উজ্জ্বল অংশগ্রহণ- নান্দনিক কবিতায় ও তীক্ষ্ম প্রতিবাদে নিবিষ্ট পাঠক ছাড়াও ব্যাপক গণমানুষের হৃদয় স্পর্শ করে। তিনি হয়ে ওঠেন আইকন।

[email protected]




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ আগস্ট ২০১৪/শান্ত/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়