ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

পাহাড়ি ঝরনায় নেই নূপুরের ছন্দ

বিজয় ধর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ১৮ আগস্ট ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাহাড়ি ঝরনায় নেই নূপুরের ছন্দ

শুকিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের ছড়া ঝরনা

বিজয় ধর, রাঙ্গামাটি : রাঙ্গামাটি শহর থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার দূরের গ্রাম মগবান। এই গ্রামেরই জুমচাষী পহেল চাকমা। তিনি জানালেন, জুমের ধান, নানান সবজি, ঝিড়ি থেকে ধরা বিভিন্ন পদের ছোট মাছ, কাঁকড়া, কচ্ছপ-এগুলোই ছিল তাদের এক সময় প্রিয় খাবার। আর এ অঞ্চলের মানুষের খাবার পানির একমাত্র উৎস ছিল ছড়া এবং ঝর্ণা। ছড়ার সেই বয়ে চলা চঞ্চল দিন বহু আগেই ফুরিয়েছে। নেমে আসা ঝর্ণার জলে নূপুরের শব্দ এখন আর শোনা যায় না। কারণ অঞ্চলে আর আগের মতো  ছড়াও নেই, ঝর্ণাও নেই। ফলে শধু এলাকার মানুষই নন, পশুপাখিও পানির অভাবে কষ্ট পাচ্ছে। শুধু তাই নয়, ঝিরি দিয়ে দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় পণ্য পরিবহন করেন আদিবাসীরা। এখন সেটাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।

 

পাহাড়ি এলাকায় ছড়াগুলো কেন্দ্র করেই এক সময় গড়ে উঠেছিল ছোট ছোট আদিবাসী পাড়া। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী পাড়াগুলোর নামও ঝিড়ি, ঝর্ণা কিংবা ছড়াকেন্দ্রিক। যেমন-চোংড়াছড়ি, বড়ইছড়ি, কুতুকছড়ি, গিলাছড়ি, বগাছড়ি, ঠাকুছড়া ইত্যাদি। অতীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জীবন আর পাহাড় জুড়ে থাকা শত শত পাহাড়ি ছোট-বড় ঝর্ণা, ছড়া, ঝিড়িগুলো ছিল একে অপরের পরিপূরক। এখন সময় বদলেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উঞ্চতা বৃদ্ধি, অব্যাহত বৃক্ষ নিধনের প্রভাবে ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে সেগুলো। প্রকৃতির বদলে যাওয়ার এই প্রভাব অনেক বেশি দৃশ্যমান পাহাড়ের আদিবাসী জীবন জীবিকায় লক্ষ্য করা যায়।

 

রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে ঘাগড়া আর্মি ক্যাম্পের সামনে, কাপ্তাই যাওয়ার পথে দেবতাছড়া, সাপছড়ি ছড়া, বান্দরবান থেকে রুমা যাওয়ার পথে প্রায় ২৯টি ছোট-বড় ছড়া ও ঝর্ণা, রুমা উপজেলায় লুংঝিড়ি, খাগড়াছড়ি জেলায় ঠাকুর ছড়া, আলুটিলাসহ পার্বত্য এলাকায় এমন অনেক ছড়া পাওয়া যাবে যা বর্তমানে মৃত। আবার রাঙামাটি থেকে মহালছড়ি যাওয়ার পথে বগাছড়ি, কুতুকছড়ি, মানিকছড়ি, মহালছড়ি উপজেলায় চোংড়াছড়ি, সিন্দুকছড়ি, মাইচছড়ি ও মুবাছড়ি ছড়া, রুমা উপজেলায় রুমা খাল, রোয়াংছড়ি উপজেলার দুলুঝিড়ি, মানিকছড়ি উপজেলায় মানিকছড়ি ছড়া এবং রামগড় উপজেলায় সোনাইছড়ি ছড়াও শুকিয়ে যাচ্ছে। কেবলমাত্র ছোট ছোট ছড়া, ঝর্ণাই নয়, ধীরে ধীরে শুকিয়ে আসছে পার্বত্যঞ্চলের বিখ্যাত সুভলং ঝর্ণা, আলুটিলা ঝর্ণা, মানিকছড়ি ঝর্ণা, রিজুক ঝর্ণাও। একসময় সুভলং যাওয়ার পথে যে অজস্র ছোট-বড় ঝর্ণা দেখা যেত তা এখন কেবলই স্মৃতি। পাশাপাশি খাগড়াছড়ি জেলায় চেংগী নদী, মাইনী নদী, বান্দরবান জেলায় মাতামুহুরী, সাংগু নদী ও সুয়ালক নদীতে আশঙ্কাজনকভাবে পানির প্রবাহ কমে গেছে ।

 

আদিবা

তিনি আরো বলেন, এইসব ছড়া, ঝর্ণা বাঁচাতে হলে বন রক্ষার জন্য আদিবাসীদের সামাজিক মালিকানা প্রথার স্বীকৃতি, পার্বত্য ভূমি লিজ দেয়া বন্ধ করা, বনায়নের নামে একক প্রজাতির বৃক্ষ রোপণ রোধ, পার্বত্য ভূমির জন্য ক্ষতিকর এমন বৃক্ষ রোপণ থেকে বিরত রাখার লক্ষ্যে ক্ষতিকর বৃক্ষসমূহের তালিকা প্রণয়ন ও জনসাধারণকে সেগুলো জানাতে হবে। পাশাপাশি, ছড়া ও ঝর্ণাগুলো সংরক্ষণের লক্ষ্যে স্থানীয় আদিবাসীদের উপর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বভার দেয়া, অবাধে কাঠ, বাঁশসহ সকল প্রাকৃতিক সম্পদ পাচার রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এর বাইরে এ বিষয়গুলো পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভূক্ত করা এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা, ছড়া-ঝর্ণা সংরক্ষণ নিয়ে সরকার এবং বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক প্রকল্প গ্রহণ এবং এই বিষয়ে ব্যাপক গবেষণা ও প্রকাশনার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

 

পাহাড়ে ছড়া ঝর্ণা কমে যাওয়ায় আদিবাসীদের খাদ্যাভ্যাসও বদলে গেছে বলে মন্তব্য করেন আদিবাসী বিষয়ক গবেষক শাওন ফরিদ। তিনি বলেন, বিগত দুই দশকে অবাধে বৃক্ষ নিধন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে শুকিয়ে বিলীন হয়ে গেছে পার্বত্য জনপদের অজস্র ছড়া ঝর্ণা। স্বভাবতই এর উপর নির্ভরশীল আদিবাসী জীবন এবং পাহাড়ের জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি এ প্রসঙ্গে গবেষকদের পরামর্শের ভিত্তিতে দ্রুত কার্যকর পদেক্ষপ নেয়ার জন্য সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

 

পার্বত্য চট্টগ্রামভিত্তিক পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজের নির্বাহী পরিচালক ফজলে এলাহী এ প্রসঙ্গে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি বন উজাড়, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, জুম চাষ, তামাক চাষ, আনারস, রাবার, সেগুন বাগান বেড়ে যাওয়ার কারণে পাহাড়ের পানির প্রাকৃতিক উৎসসমূহ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাই পাহাড়ের ছড়া ঝর্ণাগুলো ধ্বংস  হয়ে যাচ্ছে। এ থেকে মুক্তির পথ এখনো খোলা আছে। তবে এখনই এ জন্য সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। জলবায়ু তহবিলের নামে যে অবাধ লুটপাট চলছে তা বন্ধ করে এইসব গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যবহার করতে হবে।

 

পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে এমন অনেক দুর্গম জায়গা এখনো আছে, যেখানে ন্যূনতম সরকারি সুযোগ সুবিধা পৌঁছায় না। সেই এলাকায় নিরাপদ খাবার পানি বা খাদ্য সাহায্যের কল্পনা করা বেশ কঠিন। তাই পাহাড়ের প্রান্তিক মানুষের জীবন এবং জীবিকার স্বার্থেই এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরসবুজ বন ও জীববৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এইসব ছড়া-ঝিড়ি-ঝরনা বাঁচিয়ে রাখা জরুরি।

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ অাগস্ট ২০১৪/তাপস রায়

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়