ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

রম্যরচনা ॥ বই বই এবং বই

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৯, ২০ আগস্ট ২০১৪   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রম্যরচনা ॥ বই বই এবং বই

ছবি : সংগৃহীত

তাপস রায়

বরেণ্য রুশ সাহিত্যিক আলেকজেন্ডার দ্যুমা টিফলিস শহরে বেড়াতে এসেছেন। হঠাৎ করেই তার ইচ্ছে হলো শহরের সবচেয়ে বড় বইয়ের দোকানে যাবেন। সফরের মাঝপথে সময় করে তিনি ইচ্ছেপূরণের উদ্দেশ্যে বের হলেন। খবর পেয়ে দোকানের মালিক লেখককে খুশি করতে তাড়াহুড়া করে সমস্ত দোকান দ্যুমার বই দিয়ে সাজালেন। দোকানে ঢুকে সবগুলো সেলফে নিজের বই দেখে দ্যুমা ভীষণ অবাক হয়ে বললেন, আরে! এতো দেখি সবই আমার লেখা বই। অন্য লেখকের বই কোথায়?

এ কথা শুনে দোকানি বিগলিত হাসি দিয়ে বললেন, ওহ! অন্যদের সমস্ত বই বিক্রি হয়ে গেছে।

 

এ বঙ্গে বই বিক্রি সহজ কাজ নয়। প্রমথ চৌধুরী যতই বলুন, ‘বই কিনে কেউ কোনোদিন দেউলে হয় না’-সেকথা মনে রেখেছে কে? উল্টো বই লিখে বা প্রকাশ করে দেউলিয়া হয়েছেন এমন উদাহরণ অনেক আছে। এটুকু পড়ে আপনি হয়তো ভ্রু নাচিয়ে, চোখ পাকিয়ে বলবেন, তাহলে আমরা কি পড়ি না?

অবশ্যই পড়ি। তবে রাশিফল এবং ব্যাংকের চেক বই যতটা মনোযোগ দিয়ে পড়ি অন্য কিছু ততটা নয়। পাঠ্যবই তো নয়ই। আমরা শেয়ার মার্কেটে গিয়ে ধপাস করে মুখ থুবড়ে পড়তে পারি, পকেটের পয়সা খরচ করে একই সময় একাধিক প্রেমে পড়তে পারি, বেখেয়ালে চলতে গিয়ে সাঁই করে খোলা ম্যানহোলে পড়তে পারি, এমনকি চায়ের টেবিলে অবলীলায় জাতির ভবিষ্যতও পড়তে পারি। কিন্তু বই পড়াটা আমাদের সঙ্গে ঠিক যায় না! ছাত্রজীবনে পড়তে হয় তাই পড়া। মেনে নিতে হয় তাই বাধ্য হয়ে মেনে নেওয়া। মনে নেওয়ার মানুষ হাতে গোনা যায়।

 

পিকলুর কথাই ধরুন। পিচ্চির বয়স পাঁচ। পড়ে কেজি ওয়ানে। পিকলুর পড়াশোনা নিয়ে মা যতটা চিন্তিত, সে ঠিক ততটাই নিশ্চিন্ত। ‘পড়া’ শব্দটাই তার দু’চোখের বিষ। একবার গ্রাম থেকে মেজকাকা বেড়াতে এসেছেন। পিকলুকে আদর করে তিনি জানতে চাইলেন, বাবা, তুমি কী পড়?

পড়ার কথা শুনেই পিকলুর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সারাদিন শুধু পড়া, পড়া আর পড়া। কাহাতক সহ্য হয়! সে ঘাড় উল্টো দিকে ঘুড়িয়ে বলল, প্যান্ট পড়ি।

: না, বলছি কোথায় পড়?

: নাভির ওপরে।

 

প্রতিবছর বাংলা একাডেমিতে বইমেলায় যে লোক সমাগম হয় তার মাত্র আট থেকে দশ ভাগ মানুষ বই কেনে। বাকি সবাই আসেন বেড়াতে, বই দেখতে। মাছবাজারে গিয়ে মাছ টিপে দেখার মতো তারা বই দেখেন। বিজ্ঞের ভাব নিয়ে সযত্নে পাতা ওল্টান। তারপর একসময় ‘নাহ! প্রচ্ছদ ভালো হয় নাই’ বলে অন্য বই হাতে তুলে নেন। ভাবটা এমন- বই তোমার নাম কী?

প্রচ্ছদে পরিচয়।

কথাটা সেদিন এক বন্ধুকে বলতেই সে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, ঠিকই তো। যে তরকারি দেখতে ভালো না, সে তরকারি খাইতেও স্বাদ লাগে না।

বন্ধুর কথা শুনে মনে হলো এরচেয়ে বধির হওয়াই বুঝি ভালো ছিল। আমি থ হয়ে গেলাম! আমার থ ভাব কাটাতে বন্ধু পুনরায় বলতে শুরু করল, শোন বাংলা একাডেমির গেটের বাম পাশে সিঙ্গারা, পুরির দোকান। মনে পড়ে? সেখান থেকে গরম গরম খেয়ে তবেই আমরা মেলায় ঢুকতাম। ঢুকেই সোজা বইয়ের স্টল। বই নেড়েচেড়ে দেখে তারপর একাডেমির পুকুর পাড়ে সিঁড়িতে গিয়ে বসতাম। সেখানেই জমে উঠত আমাদের ম্যারাথন আড্ডা।

তাহলে বই নেড়েচেড়ে দেখার মানে কী? আমি প্রশ্ন করতেই বন্ধু পিঠে দুই চাপর মেরে বলল, ধুর বোকা! আমরা কী কেনার জন্য বই দেখতাম নাকি! আমরা বইয়ের পাতা উল্টাতাম হাত মোছার জন্য। আরে বই তো শুধু পড়ার জিনিস নয়। বই দিয়ে কত কাজ হয় তুই জানিস?

 

মনে পড়ে গেল কবি জসীমউদ্দীনের কথা। তিনি বইকে রথের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন-‘বইয়ের রথে চেপে আপনি অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যত অনায়াসে যে কোনো জায়গায় যেতে পারেন।’

আমি বহুবার সে চেষ্টা করে দেখেছি, কাজ হয়নি। কারণ ছেলেবেলা থেকেই বই পড়তে নিলেই আমার ঘুম পায়। আমার জীবনে এরপরই ঘটে বইয়ের সর্বোত্তম ব্যবহার। মাথার নিচে বই রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি। এ ক্ষেত্রে সিডনি স্মিথের কথাও স্মরণযোগ্য। তিনি বলেছেন, বই হচ্ছে ঘরের সবচেয়ে সুন্দর আসবাব। সমঝদার বাঙালি বিষয়টি বুঝতে পেরেছে বলেই আমার মনে হয়। কিন্তু ‘বই দিয়ে কত কাজ হয়’ বলে বন্ধু ঠিক কী বুঝাতে চাইছে বুঝতে পারলাম না। আমাকে বুঝাতে গিয়ে বন্ধু যে গল্পটি বলল তা এরকম :

ঘটনা অনেক আগের। ছোট্ট মিনুকে স্যার জিজ্ঞেস করলেন, রামায়ণ পড়েছ?

: হুম।

: বলো তো রামায়ণে কী আছে?

: বেলপাতা রাখা আছে।

: না। আর কী আছে?

: আর, আর, আর। মনে পড়েছে! বড়দির বয়ফ্রেন্ডের একটা ছবি আছে।

 

প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য বই সত্যি এক কাজের জিনিস। তবে বইয়ের ভেতর এখন আর প্রেমের চিঠি আদান-প্রদান হয় কিনা জানি না। ওসব দিন কবেই চুকেবুকে গেছে। এখন এসএমএস-এর যুগ। তবে রেলস্টেশনে প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য ‘১০০০ এসএমএস একটা ফাও’ এমন বই দেখেছি। আশার কথা, বাঙালির রান্নাঘরেও এখন বই ঢুকে পড়েছে। ঘরে ঘরে গিন্নিরা এখন বই দেখে রান্নার চর্চা করছেন। প্রকাশকেরা বেছে বেছে রান্নার বই প্রকাশ করছেন। শুনেছি সেগুলো নাকি ধুমছে বিক্রি হচ্ছে। এক সময় বাড়ির মেয়েরা দুপুরের খাবারের পর বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে রবীন্দ্র, নজরুল, শরৎ পড়তেন। এখন তারা এসি অন করে সোফায় বসে পায়ের ওপর পা তুলে ‘শত রকমের ভর্তা’ পড়েন।

 

বই নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলেছেন। ভিক্টর হুগো বইকে বিশ্বাসের অঙ্গ বলেছেন। আমি এর সঙ্গে শুধু ‘বউ’ শব্দটি যোগ করতে চাই। এ দুই জায়গায় বিশ্বাস না জমলে যে জগৎ টলে যাবে। তবে যে যাই বলুন, মনীষী টলস্টয় বই সম্পর্কে যা বলেছেন তার ওপর আর কথা হয় না। তিনি বলেছেন, জীবনে মাত্র তিনটি জিনিসের প্রয়োজন। জিনিস তিনটি হলো, বই, বই এবং বই।

কথাটি কার্ল মার্কস যতটা বুঝেছিলেন তার স্ত্রী ততটা বুঝতে পারেননি বলেই মনে হয়। ঘটনা খুলেই বলি, কার্ল মার্কসের মৃত্যুর পর তার স্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিতে এলেন এক সাংবাদিক। এ পশ্ন সে প্রশ্নের পর মার্কসের দাম্পত্য জীবন নিয়েও প্রশ্ন করল সে। এমনই এক প্রশ্নের জবাবে স্ত্রী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আমরা যথেষ্ট সুখী ছিলাম।

উত্তর দেওয়ার ধরন দেখেই চতুর সাংবাদিক চটপট জানতে চাইলেন, আপনারা সত্যিই কি সুখী ছিলেন?

এবার ভদ্রমহিলা আরও বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আমরা সত্যিই সুখী ছিলাম। কিন্তু কার্ল যদি ক্যাপিটাল লেখায় সময় না দিয়ে ক্যাপিটাল সংগ্রহেও কিছু সময় দিত তাহলে আরও ভালো হতো।

বইয়ের সঙ্গে সরস্বতীর সম্পর্ক আছে বলেই হয়ত লক্ষ্মীর সঙ্গে তার এতো দূরত্ব। খুব কম বই-ই পারে এই দূরত্ব ঘুচিয়ে দিতে। কারণ মানুষের বেলায় যেমন বইয়ের বেলাও তেমনি, অল্পসংখ্যকই মহান ভূমিকা পালন করে, বাকি সব হারিয়ে যায় আগমনের মধ্যে। 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ অগাস্ট ২০১৪/তাপস

 

 

 

 

 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়