ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর অবদান || শাহরিয়ার কবির

শাহরিয়ার কবির || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১৪, ২০ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধীর অবদান || শাহরিয়ার কবির

|| শেষ পর্ব ||

৭ মে পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানিয়ে একটি সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। একই দিন নয়াদিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনার জন্য এক বৈঠকে বসেছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকার এতদসংক্রান্ত সংবাদের শিরোনাম ছিল: ‘এখনই ভারতের স্বীকৃতি বাংলাদেশের স্বার্থের অনুকূল হবে না। তবে মুক্তি আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন দেওয়া হবে- প্রধানমন্ত্রী’।

নয়াদিল্লী থেকে বিশেষ সংবাদদাতা প্রেরিত এই সংবাদে বলা হয়: ‘আজ সকালে বিরোধী নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বৈঠকে বসেছিলেন। প্রায় সকলেই বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানান। (ব্যতিক্রম: বিকানীরের মহারাজা ড. করণি সিং এবং মুসলিম লীগ নেতা মহম্মদ ইসমাইল। দুজনের বক্তব্যে অবশ্য কিছু পার্থক্য ছিল) সকলের কথা শোনার পর প্রধানমন্ত্রী যা বলেন তার মর্ম এইরকম: বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের প্রতি ভারত পূর্ণ সমর্থন জানাবে কিন্তু বাংলাদেশকে এখনই কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়া ওই দেশেরই স্বার্থের পরিপন্থী হবে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি প্রচুর সহানুভূতি থাকলেও স্বীকৃতির ব্যাপারে ভাবনা-চিন্তা চলছে। তবে তাজউদ্দিন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না এমন কথা তিনি বলেননি বা সরকার এ ব্যাপারে ঠিক কী করবেন তার কোন আভাষ দেননি। শুধু স্পষ্টভাবে তিনি বলেন যে, কোন অবস্থাতেই ভারত ভীত নয়।’

‘‘ড. করণ সিংয়ের বক্তব্য ছিল, বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন আসলে ‘বাঙালীদের বিদ্রোহ’। ভারতে এ ধরনের ব্যাপার ঘটলে সরকার কী করতেন? কাশ্মীরের কথাও ভাবা দরকার।

তখন ইন্দিরাজী তাঁকে বলেন, কাশ্মীরে যারা হাঙ্গামা বাধাতে চায় তারা জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের পিছনে বিপুল গরিষ্ঠ সমর্থন রয়েছে। বাংলাদেশে গরিষ্ঠ অভিমত পাকিস্তান দাবিয়ে রাখতে চাইছে।

মুসলিম লীগ নেতা মহম্মদ ইসমাইল যা বলেন তার মর্ম: এমন কিছু করা ঠিক হবে না যাতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ে বা কোন সঙ্কট সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে ওই ধরনের সঙ্কট দেখা দিতে পারে। তবে সরকার এ ব্যাপারে যে-কোন ব্যবস্থাই নিন না কেন তার প্রতি তাঁদের দলের সমর্থন থাকবে।

ইন্দিরাজী বলেন যে, বাংলাদেশের ব্যাপারকে কেন্দ্র করে কিছু লোক সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে চাইছে। সকলকে এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

অধিকাংশ বিরোধী নেতা বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য জোর দাবি জানান। পরিস্থিতি সম্পর্কে ইন্দিরাজীর বিশ্লেষণ তারা মেনে নেননি। তারা বলেন যে, বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব তথ্য। স্বীকৃতি দিয়ে সরকার শুধু সেই তথ্যটিকেই মেনে নেবেন আর তাতে সেখানকার আন্দোলন জোরদার হবে। ভারত এ বিষয়ে দেরি করলে ভারতেরই ক্ষতি হতে পারে। এই দাবি জানান- সি পি এম, সি পি আই, ডি এম কে, জনসংঘ, আদি কংগ্রেস, পি এস পি, এস এস পি, ফঃ-বঃ, আর এস পি। শ্রীইন্দ্রজিৎ গুপ্ত (সি পি আই) তার দলের পশ্চিমবঙ্গ কমিটির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে একটি স্মারকলিপি দেন। শ্রী এ কে গোপালন (সি পি এম) বলেন যে, পাকিস্তানকে ভয় না করে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সব রকমের সাহায্য দেওয়া হোক। শ্রী কে মনোহরণ (ডি এম কে) শ্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী (জঃ সঃ), শ্রীচিত্ত বসু (ফঃ বঃ), শ্রীত্রিদিব চৌধুরী (আর এস পি) শ্রী এন জি গোরে (পি এস পি) ও শ্রী এল এন মিশ্র (আদি কং) একই দাবি তোলেন।’’
 


বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরাও ইন্দিরা গান্ধীর ওপর ক্রমশ চাপ বৃদ্ধি করছিলেন। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছিল বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আগমন। জুলাইয়ের শেষের দিকে শরণার্থীর সংখ্যা ষাট লক্ষ অতিক্রম করে, যার শতকরা সত্তর ভাগই ছিল পশ্চিমবঙ্গে। শরণার্থীদের প্রচণ্ড চাপে তীব্র আর্থিক সংকটের পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা ও যোগাযোগ পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেন্দ্রের ওপর উপর্যুপরি চাপ দেয়া হচ্ছিল শরণার্থীদের বোঝা বিভিন্ন রাজ্যের ভেতর ভাগ করে দেয়ার জন্য। সমস্যা বাঁধাল শরণার্থীরা। তারা পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাইল না। পশ্চিমবঙ্গের অজয় মুখার্জীর মন্ত্রিসভাকে প্রধানত আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং শরণার্থীদের চাপে রাজ্যের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হওয়ায় পদত্যাগ করতে হয়। ২৫ জুন থেকে পশ্চিমবঙ্গে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হয়। কেন্দ্রের দফতরবিহীন মন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়কে পশ্চিম বঙ্গের গভর্ণরের উপদেষ্টা বানিয়ে পাঠানো হল মূলত বাংলাদেশের বিষয়ে তদারকির জন্য।

জুলাইয়ের শেষের দিকে বিশ্বের রাজনীতিতে এক নাটকীয় ঘটনা ঘটল যা ভারতের জন্য ছিল খুবই উদ্বেগজনক। পাকিস্তানের মধ্যস্থতায়, কিসিঞ্জারের দূতিয়ালিতে আমেরিকার সঙ্গে চীনের বরফ শীতল সম্পর্কের অবসান ঘটল। এই ঐতিহাসিক ঘটনায় মধ্যস্থতার সুযোগ পেয়ে পাকিস্তান দুই বৃহৎ শক্তির প্রিয়পাত্রে পরিণত হল। ভারতের ওপর আরও চাপ সৃষ্টির জন্য নতুন শক্তিতে বলীয়ান পাকিস্তানী সামরিক জান্তা ২ আগস্ট ঘোষণা করল ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে’ কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করবে তারা। ভারতের সর্বস্তরের জনসাধারণ ইয়াহিয়া সরকারের এই ন্যক্কারজনক ঘোষণার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল। দিল্লী, কলকাতা, বম্বে প্রভৃতি বড় বড় শহরে শেখ মুজিবের বিচারের উদ্যোগের প্রতিবাদ জানিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিবাদ সভা ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করেছিল। ইন্দিরা গান্ধী সুস্পষ্ট ভাষায় পাকিস্তানকে জানিয়ে দিলেন শেখ মুজিবের বিচারের আয়োজন করা হলে এর পরিণতি ভাল হবে না। তিনি এই বিচার প্রহসন বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানকে চিঠি লিখলেন। ৪ আগস্ট সংসদের সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যরা শেখ মুজিবের জীবন রক্ষার জন্য যে কোনো ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানান। বিরোধী দলের সদস্যরা এ সুযোগে আবারও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের কথা বলেন।

ঠিক যে রকম নাটকীয়ভাবে চীন মার্কিন সম্পর্ক ঘটেছিল একইভাবে ৯ আগস্ট ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। নয়াদিল্লীতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং এবং সফররত সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আঁদ্রে গ্রোমিকো বিশ বছর মেয়াদী এই মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল চুক্তিকারী দুটি দেশের কোনোটি যদি তৃতীয় কোনো রাষ্ট্র দ্বারা আক্রান্ত হয় অপর দেশ তার মিত্রের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। ভারত আক্রান্ত হলে সোভিয়েত এবং সোভিয়েত আক্রান্ত হলে ভারত তাকে সবরকম সাহায্য করবে। বিশ্ব রাজনীতির নতুন মেরুকরণ প্রবাহে, পাকিস্তান কর্তৃক বাংলাদেশে গণহত্যা চালানো এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারতের সমর্থন দানের পটভূমিতে এই চুক্তি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ যা বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনসাধারণের মনোবল যেমন বাড়িয়েছে তেমনি ভারতের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তিকেও উৎসাহিত করেছে। চুক্তির পরই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সামরিক সাহায্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পায় এবং ভারত আরও দৃঢ়ভাবে বাংলাদেশকে সাহায্যের অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।

ভারতের উগ্র বাম কিংবা দক্ষিণপন্থী দলগুলো অবশ্য ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তিকে সুনজরে দেখেনি। অতি বামরা সমালোচনা করেছে এই বলে যে, এর দ্বারা ভারত ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী’ সোভিয়েত ইউনিয়নের উপনিবেশে পরিণত হবে। দক্ষিণপন্থীরা বলেছে, এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে ভারত তার জোট নিরপেক্ষ চরিত্র জলাঞ্জলি দিয়েছে।

দেশের ভেতরে বিরোধী দলগুলোকে বুঝিয়ে স্বমতে এনে কিংবা অতিবিরোধীদের শক্ত হাতে দমন করে ইন্দিরা গান্ধী অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ক্ষেত্রে নিরাপদ হলেও পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বনকারী আমেরিকা এবং পশ্চিমা শক্তিসমূহের চাপ তাঁর জন্য ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। মুসলিম বিশ্ব এবং পশ্চিমা শক্তিবর্গকে পাকিস্তানের পর্যায়ক্রমিক অপপ্রচারের বিরুদ্ধাচারণ করা এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা তুলে ধরার ক্ষেত্রে ভারতের সরকার ও বিরোধী দলের নেতারা এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। প্রথমে দিল্লীতে অবস্থানরত রাষ্ট্রদূতদের বোঝানো, তারপর বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানের কাছে মন্ত্রী পর্যায়ের দূত পাঠানো এবং পরবর্তী পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র সহ ৮টি দেশ সফর করার মাধ্যমে ইন্দিরা গান্ধী যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য দেশগুলোকে তাঁর অবস্থান আংশিকভাবে হলেও বোঝাতে পেরেছিলেন। তবে পশ্চিমের সরকারসমূহ বোধগম্য কারণে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করলেও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের গণমাধ্যম ও সাধারণ মানুষ বাংলাদেশের পক্ষে ছিল।

নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং তার প্রশাসনকে বোঝাবার জন্য- পাকিস্তান যা করছে তা ঠিক নয়। এই সময়ে তিনি আমেরিকাসহ পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সফর করেছিলেন উপমহাদেশের পরিস্থিতি তাদের জানাবার জন্য এবং বিশেষভাবে পাকিস্তানের কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন বন্ধ করে তাঁকে মুক্তি দেয়ার বিষয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য।

৪ নভেম্বর ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে আলোচনার সময় শ্রীমতি গান্ধী যখন বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন তখন নিক্সন তা উপেক্ষা করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী পররাষ্ট্র সচিব টি এন কল এ প্রসঙ্গে আমাকে বলেছেন, ‘মিসেস গান্ধীর কথা শুনে নিক্সন বললেন, শেখ মুজিব কোথায় আমি জানি না। তিনি বেঁচে আছেন না মারা গেছেন তাও জানি না। আপনি তাড়াহুড়ো করে কিছু করবেন না। দু এক বছর অপেক্ষা করুন, দেখবেন সব ঠিক হয়ে যাবে।’

ভারতের কাঁধে তখন বাংলাদেশের এক কোটি শরণার্থীর বিশাল ভার। যে কোনো সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ লেগে যেতে পারে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেলেন, অপেক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত সময় তাদের হাতে নেই। নিক্সনের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর আনুষ্ঠানিক বৈঠক ছিল অত্যন্ত দীর্ঘ, ক্লান্তিকর এবং শীতল। রাতে নৈশভোজে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে তিনি ৩৬ হাজার মাইল ভ্রমণ করেছেন। ৩৭৫ টি মিটিং করেছেন এবং বিভিন্ন দেশে সাড়ে তিন লাখ সম্মানিত নাগরিকের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন। তিনি এখানে এসেছেন শান্তির প্রত্যাশা নিয়ে।’ (অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, সমকাল, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬)

বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনের ক্ষেত্রে ভারতের সংবাদপত্র ও অন্যান্য গণমাধ্যম যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, একইভাবে বিদেশী গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের শরণার্থীদের দুর্দশা, মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের নিদর্শনসমূহ দেখানোর ব্যবস্থাও ভারতকে করতে হয়েছিল। আমন্ত্রণ জানাতে হয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের সদস্য এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের।
 


এই সব সফল এবং কূটনৈতিক তৎপরতা যে শুধু সরকারী পর্যায়ে হয়েছিল তা নয়। বাংলাদেশের বাস্তবতা সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহের কাছে তুলে ধরার জন্য সিপিআই’র নেতৃবৃন্দকে সেসব দেশে যেতে হয়েছিল। সেপ্টেম্বরে দিল্লীতে সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন। প্রখ্যাত ফরাসী বুদ্ধিজীবী আঁদ্রে মালরো, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন, বলেছিলেন বাংলাদেশ যদি মুক্তিযুদ্ধের জন্য আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে সবার আগে তিনি ব্রিগেডে যোগ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করবেন।

মকবুল ফিদা হোসেনের মতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর ছবি এঁকে বোম্বের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য। বিকাশ ভট্টাচার্য, প্রকাশ কর্মকার, শ্যামল দত্তরায় আর গণেশ পাইনের মতো খ্যাতমান শিল্পীরা ফুটপাতে দাঁড়িয়ে মাসের পর মাস বাংলাদেশের ওপর ছবি এঁকে বিক্রি করেছেন এবং ছবি বিক্রির টাকা শরণার্থী শিবিরে পৌঁছে দিয়েছেন। শিল্পী বাঁধন দাস ছবি আঁকা ছেড়ে শরণার্থী শিবিরে গিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্র খুলেছিলেন তাঁর এক ডাক্তার বন্ধুকে নিয়ে। অন্নদাশঙ্কর রায়, মৈত্রেয়ী দেবী, দীপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, শান্তিময় রায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী,  প্রণবরঞ্জন রায়,  তরুণ সান্যাল,  নিখিল চক্রবর্তী, রমেণ মিত্র, ইলা মিত্র, গীতা মুখার্জী, স্বাধীন গুহ, সাংবাদিক দিলীপ চক্রবর্তী, দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায়, প্রণবেশ সেন, সন্তোষ কুমার ঘোষ, গোবিন্দ হালদার, অংশুমান রায়, সুচিত্রা মিত্র, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়,  ভূপেন হাজারিকা,  হিরন্ময়  কার্লেকার,  অমিতাভ চৌধুরী, সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত, মানস ঘোষ, বাসব সরকার, অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তীর মতো খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করতে গিয়ে নিজেরাই রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধায়। দিল্লীর শিল্পী নীরেন সেনগুপ্ত, ধীরাজ চৌধুরী, জগদীশ দে আর বিমল দাসগুপ্তের মতো শিল্পীরা দিল্লী, বোম্বে আর কলকাতায় প্রদর্শনী করে ছবি বিক্রির টাকা তুলে দিয়েছিলেন বাংলাদেশ তহবিলে। বোম্বের চলচ্চিত্র জগতের সাড়া জাগানো তারকা সুনীল দত্ত, নার্গিস, ওয়াহিদা রেহমান, বিশ্বজিৎ, প্রাণ, শাম্মী, লতা মঙ্গেশকর, সলিল চৌধুরী, লক্ষীকান্ত-পেয়ারেলাল ও শচীন দেব বর্মন সহ এমন কেউ ছিলেন না যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেননি। শিল্পীরা ছবি এঁকেছেন, গাইয়েরা বাংলাদেশের জন্য গান গেয়েছেন, নাটকর্মীরা নাটক করেছেন, ঋত্বিক ঘটক, হরিসাধন দাসগুপ্ত, শুকদেব আর গীতা মেহতারা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের মতো লেখক রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেছেন। হিমালয় থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত ভারতের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের ভেতর এমন ব্যক্তি খুব কমই পাওয়া যাবে যারা কোনো না কোনোভাবে তখন বাংলাদেশকে সাহায্য করেননি।

সচেতন ও খ্যাতিমানদের পাশাপাশি ভারতের সাধারণ মানুষ যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং শরণার্থীদের সাহায্য করার ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছিল পৃথিবীর দ্বিতীয় কোনো দেশে এরকম নজির নেই। এই লেখকের নিজের চোখে দেখা হাজারও ঘটনার একটি এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। বহরমপুর সীমান্তের কাছে বাংলাদেশ থেকে আসা একটি মুসলমান কৃষক পরিবার, স্বামী-স্ত্রী ও একটি শিশু আশ্রয় নিয়েছে গ্রামের এক হিন্দু কৃষক পরিবারের বাড়িতে। আশ্রয়দাতার বাড়িতে দুটি মাত্র ঘর, একটি রান্নার আর একটি শোয়ার। আশ্রয়দাতা শোয়ার ঘরটি ছেড়ে দিয়েছে আশ্রিতকে, নিজেরা থেকেছে রান্নাঘরে। দু মাস পর এই মুসলমান পরিবারটি শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় লাভ করে। দুই থেকে তিন লক্ষ শরণার্থী চেনা অচেনা সাধারণ মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল যাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকলেও হৃদয়ের বিশালতা ছিল অন্তহীন।

সাংবাদিক দিলীপ চক্রবর্তী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির বিবরণ দিতে গিয়ে একটি মর্মস্পর্শী ঘটনার উল্লেখ করেছেন তাঁর এক লেখায়-

‘চার যুগ ধরে বসবাস করা সত্ত্বেও ‘উদ্বাস্তু’ তকমাটা দেওয়াই আছে। কলকাতার উপকণ্ঠে বেশ কিছু অঞ্চল এখনও ‘উদ্বাস্তু অঞ্চল’ বলেই পরিচিত। এখানকার অধিবাসীরা সেই কবে ১৯৪৯-৫০ সালে পূর্ব বাংলা থেকে এসে স্থায়ীভাবে ঘর বেঁধেছেন। ভারতের নাগরিকত্বও পেয়েছেন। তাঁদের পুত্র-কন্যা কলকাতার জলবায়ুতেই জন্মগ্রহণ করেছে বড় হয়েছে। তবুও ‘উদ্বাস্তু’ কথাটা অঞ্চলের সঙ্গে লেপটেই আছে। কলকাতার উপকণ্ঠে দমদমে এমনি এক উদ্বাস্তু অঞ্চলে আমাদের বাড়ি। আমাদের প্রতিবেশী গোঁড়া ধর্মপ্রাণ এক ব্রাহ্মণ পরিবার। এই পরিবারে ওদের জন্ম, ১৯৭১ সালে। ওরা যমজ ভাই-বোন, এদের আমি ভালো করেই জানি। জন্মের পর পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী ওদের আত্মীয়রা যমজ ভাই-বোনের নামকরণ করলো নারায়ণ আর লক্ষ্মী। কিন্তু কী আশ্চর্য! পরিবারের কর্তা, যাকে আমি রক্ষণশীল বলেই জানতাম, সে কিন্তু ওদের নাম রাখলো ‘মুজিব’  আর ‘মুক্তি’ । মুজিবুর থেকে সংক্ষেপে মুজিব। ওরা এখন বড় হয়েছে,  এই যমজ ভাই-বোন, এখন পূর্ণ যৌবনে। ১৯৭১-এ জন্ম হলেও একাত্তরের দিনগুলি জানার কিংবা অভিজ্ঞতার কোনও সুযোগ এদের নেই। (একাত্তরের রাত-দিন, সপ্তাহ ১৮ আগস্ট ৯৫, কলকাতা)

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকাকে অনেকে অনেকভাবে বিশ্লেষণ করেন। ইতির পরিবর্তে নেতি অনুসন্ধানের চেষ্টাই আমাদের লেখক গবেষকদের একটি বড় অংশ সব সময় করেছেন। তারা ব্যাখ্যা দিতে পারবেন না, বহরমপুরের দরিদ্র কৃষক, সাধারণ মধ্যবিত্ত, খ্যাত-অখ্যাত অগণিত মানুষ কেন ৭১-এ বাংলাদেশের বিপন্ন মানুষদের সাহায্য করার জন্য এতটা ব্যাকুল হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। ২৬ মার্চ থেকে ৩০ নবেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন ২০ হাজার থেকে ৪৫ হাজার ভীত সন্ত্রস্ত অসহায় বাঙালি সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে গিয়েছিল যাদের ভেতর হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ- সব ধর্মের অনুসারীই ছিল। ত্রিপুরা রাজ্যের মোট জনসংখ্য ৭১-এ ছিল ১৩ লক্ষের মতো। সেই ত্রিপুরা বাংলাদেশের ১৪ লক্ষের বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। ত্রিপুরার মহারাণী বিভূকুমারী দেবী বলেছেন, তাদের গোটা রাজপ্রাসাদ শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছিল। অথচ পাকিস্তান সব সময় বলেছে শরণার্থীর সংখ্যা ৩০ লাখের বেশি হবে না। পাকিস্তান কী উদ্দেশ্যে প্রকৃত সত্য গোপন করেছিল সেটি জানা যাবে ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য থেকে।
 


ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জার্মান সফরকালে ১১ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখে ‘জার্মান সোসাইটি ফর ফরেন পলিসি’র দফতরের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে বলেন, শরণার্থীদের সংখ্যা সম্পর্কে আমাদের সরকারী কর্মকর্তারা বলেন ৯৭ লাখ। প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে দুই তিন লাখ বেশি হবে। শরণার্থীদের অনেকে ক্যাম্পে থাকার পরিবর্তে তাদের পরিচিত জনদের সঙ্গে রয়েছে। ক্যাম্পে যারা থাকে তাদের প্রত্যেকের রেশন কার্ড আছে। রেশন কার্ড ছাড়া কাউকে খাবার দেয়া হয় না। ফলে আমাদের বিলক্ষণ জানা আছে শরণার্থীর সংখ্যা কত। আমাদের হিসেবে তিরিশ লাখ মুসলমান শরণার্থী আছে। পাকিস্তানীরা যে হিসেব দিচ্ছে সেখানে তারা হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধদের বাদ দিয়ে গুণছে। আমরা তা করতে পারি না। আন্তর্জাতিক মহলের অভিমত যা-ই হোক আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, আমরা এই শরণার্থীদের ভারতে থাকতে দেবো না। এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত এবং আমার দেশও তাই। আমরা এক বিশাল বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছি অথচ বাইরে থেকে কোনো রকম সাহায্য পাচ্ছি না বললেই চলে। যখন আমরা জাতিসংঘকে এ বিষয়ে জানিয়েছি তারা বলেছে এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। আমরা এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারি না। ওদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি অথচ জাতিসংঘ বলছে, আমরা খুবই দুঃখিত। পাকিস্তানে যদি লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয় আমাদের কিছু করার নেই। এটা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। (বাংলাদেশ ডক্যুমেন্টস দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৯১, প্রাগুক্ত)

এক কোটি শরণার্থীর ভার বহনের জন্য ভারতকে এক বিশাল অঙ্কের অর্থ বহন করতে হয়েছিল। বিভিন্ন দেশ শরণার্থীদের জন্য ভারত ও বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে যে অর্থ সাহায্য করেছে তার পরিমাণ ভারতীয় টাকায় মাত্র ৫০ কোটি। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারতকে ব্যয় করতে হয়েছে ২৬০ কোটি টাকা। মোট ব্যয়ের হিসেব ধরা হয়েছিল ৫৫৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। (জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনকে দেয়া ভারতের পুনর্বাসন সচিব জি এস কাহ্লন-এর বিবৃতি, বাংলাদেশ ডক্যুমেন্টস, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৯৩, প্রাগুক্ত)

শরণার্থীদের জন্য ব্যয়ের হিসেব বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া গেলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সামরিক সাহায্যের পরিমাণ টাকার অঙ্কে কত ছিল এ তথ্য কেউ দিতে পারেননি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা বলেছেন আমরা যদি টাকা ফেরত চাইতাম তাহলে সাহায্যের টাকার অঙ্ক লিখে রাখতাম। ভারতীয়রা লিখে না রাখলেও বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্মের নাগরিকদের জানা দরকার শুধু শরণার্থীদের জন্য ভারত ৭১ সালে ব্যয় করেছিল টাকার বর্তমান মানে ২,৩১০ কোটি টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন লক্ষাধিক মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও অন্যান্য রসদ সরবরাহসহ সামরিক খাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৮,০০০ কোটি টাকা। টাকার অঙ্কে যা হিসেব করা যাবে না তা হচ্ছে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য ভারতের প্রায় সতের হাজার অফিসার ও জওয়ান শহীদ হয়েছেন। টাকার অঙ্কে হিসেব করা যাবে না সাধারণ মানুষের ভালবাসা ও সহমর্মিতা।

পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে নিয়োজিত সাত কোটি বাঙালির জন্য একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর ছিল এক অসামান্য আনন্দের দিন, যেদিন ভারত স্বীকৃতি দিয়েছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে। মুজিবনগর সরকারের উপর্যুপরি অনুরোধ এবং যুদ্ধরত বাঙালির তীব্র প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পার্লামেন্টের অধিবেশনে যখন ঘোষণা দিলেন তাঁর সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তখন সরকারী ও বিরোধী দলের সদস্যরা ‘জয় বালাদেশ’ বলে বিপুল হর্ষধ্বনি করে ওঠেন। আনন্দ প্রকাশের জন্য এই দিনের অধিবেশন শ্রীমতি গান্ধীর ভাষণের পর পরই মুলতবি ঘোষণা করা হয়। এর আগে ৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ভারতের উপর পাকিস্তানের আগ্রাসী হামলার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে শেষবারের মতো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের অনুরোধ জানান।

৬ ডিসেম্বর সকালে ভারতের লোকসভার অধিবেশন শুরু হওয়ার অল্পক্ষণ পরই শ্রীমতি গান্ধী  বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে নিশ্চিত যে, আমার সঙ্গে এই সভা বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁদের সহকর্মীদের অভিনন্দন জানাবেন। জনগণের সংগ্রাম, স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযোজন করেছে। আমি আনন্দের সঙ্গে আপনাদের জানাচ্ছি, বিরাজমান পরিস্থিতির আলোকে, বাংলাদেশ সরকারের উপর্যুপরি অনুরোধের প্রেক্ষিতে, সব দিক সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করে ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছে। এই মুহূর্তে আমাদের মন পড়ে রয়েছে এই নতুন রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর  রহমানের  দিকে।’

শ্রীমতি গান্ধী তাঁর ভাষণে আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেছে তাদের রাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং এমন এক সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা যেখানে ধর্মে, বর্ণে বা নারীপুরুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জোট নিরপেক্ষতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে দৃঢ়ভাবে অবিচল থাকবে এবং যে কোনো ধরনের উপনিবেশবাদ, বর্ণবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করবে। ভারতও এই সব আদর্শের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ।’
 


৬ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ৪ ডিসেম্বরের চিঠির উত্তর দিতে গিয়ে লিখেছিলেন: ‘আমার ভারত সরকারের সহকর্মীবৃন্দ এবং আমি ৪ ডিসেম্বর প্রেরিত মহামান্য রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আপনার বার্তা পেয়ে গভীরভাবে আলোড়িত হয়েছি। ...বাংলাদেশের জনগণ অত্যন্ত দুঃখ দুর্দশার ভেতর কালযাপন করছেন। আপনাদের তরুণরা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য এক আত্মোৎসর্গী যুদ্ধে নিয়োজিত রয়েছে। ভারতের জনগণও এই সব মূল্যবোধ রক্ষার জন্য লড়াই করছে। আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, আমাদের এই অনুপূরক প্রচেষ্টা এবং আত্মত্যাগ দুই দেশের জনগণের বন্ধুত্ব এবং মহৎ আদর্শের প্রতি অঙ্গীকারকে আরও দৃঢ় করবে।’

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণার আগে শ্রীমতি গান্ধী আমেরিকা এবং ইউরোপের অধিকাংশ রাষ্ট্র সফর করে তাদের মনোভাব জেনে এসেছেন। যারা বিরুদ্ধে ছিল তাদের সঙ্গে আলোচনা করে কাউকে পক্ষে এনেছেন, কিংবা পাকিস্তানকে ঢালাও সমর্থন থেকে বিরত রেখে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয়কে অনিবার্য করে তুলেছেন। বৃটিশ পত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে বিবিসি ৭১-এর ৬ ডিসেম্বর তাদের পর্যালোচনায় শ্রীমতি গান্ধীকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী মহিলা হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। ৭ ডিসেম্বর আনন্দবাজারে ইউ এন আই পরিবেশিত এক সংবাদে বলা হয়: ‘৬ ডিসেম্বর লন্ডনের মিরর-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়েছে, পূর্ব বাংলায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের এখনও যে ৭০ হাজার সৈন্য রয়েছে, তাদের খতম করাই শ্রীমতি গান্ধীর ন্যূনতম সামরিক লক্ষ্য। রাষ্ট্রপতি দেরিতে যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে এই সুন্দরী অসমসাহসী রমণী ও আজকের বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী মহিলাকে নিরস্ত করার সম্ভাবনা নেই।’

মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক সাফল্য ছিল স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের স্বীকৃতি আদায় করা। দিল্লীতে তখন বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের প্রধান ছিলেন এক সময়ের জাতীয় সংসদের স্পিকার হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। তার কাছে সেদিনের অনুভূতির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেছেন, আমার স্পষ্ট মনে আছে ১৯৭১-এর ৬ ডিসেম্বর আমি কলকাতা থেকে দিল্লী আসছিলাম। কলকাতা গিয়েছিলাম বিশেষ কারণে। দিল্লী আসার সাথে সাথে আমাকে জানানো হলো ভারত আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। আমরা তখন খুবই উল্লসিত হলাম- প্রথম দেশ আমাদের স্বীকৃতি দিল স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে। আমি বাসায় গিয়েই টেলিফোন করে মিসেস গান্ধীকে ধন্যবাদ জানালাম। তিনি অত্যন্ত আবেগপূর্ণ ভাষায় আমাকে অভিনন্দন জানালেন। এর কিছুক্ষণ পরই আমাকে ভুটানের রাষ্ট্রদূত টেলিফোন করলেন- উনি  আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। ওনাকে বললাম, আসেন। এসে উনিও বললেন- উনি একটা চিঠি দিলেন। সেই চিঠি মারফত জানতে পারলাম ভুটানও আমাদের সেই দিনই স্বীকৃতি দিয়েছে।’

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের প্রতিবাদে পাকিস্তান ৬ ডিসেম্বর ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। সেদিন ভারতের এই স্বীকৃতি ছাড়া, ভারতের সহযোগিতা ছাড়া এবং জাতিসংঘে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটো ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে প্রবল প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন ছিল সুদূর পরাহত। ৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী  ইন্দিরা  গান্ধীর অনুরোধে দিল্লীতে কয়েক ঘণ্টার জন্য যাত্রাবিরতি করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য এবং তাঁর মুক্তির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি ও জনমত গঠনের তিনি শ্রীমতি গান্ধীর প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সম্মানে আয়োজিত জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে ভারতের জনগণের উদ্দেশ্যে শ্রীমতি গান্ধী বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন স্বাধীনতার এবং তিনি তা দিয়েছেন। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম বাংলাদেশের শরণার্থীদের সসম্মানে দেশে ফেরত পাঠাবো, মুক্তিযোদ্ধাদের সবরকম সাহায্য করব এবং বাংলাদেশের অবিসংবাদী নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করে আনব। আমিও আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছি।’

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাংলাদেশ সফরের সময় বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় অনুযায়ী ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ৭২-এর ১৯ মার্চে। বঙ্গবন্ধু ভারতকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বন্ধুত্বের। সেই প্রতিশ্রুতি দীর্ঘকাল বাংলাদেশ পালন করেনি। ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বগ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য ভারত ও অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, সমরনায়ক, সরকারি কর্মকর্তা এবং বুদ্ধিজীবীদের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মান প্রদানের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন, যার সূচনা হয়েছে ২০১১-এর জুলাই-এ শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে সম্মাননা প্রদানের মাধ্যমে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে ইন্দিরা গান্ধী শুধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, লণ্ডনের ডেইলি মিররের ভাষায়  বিশ্বের  সবচেয়ে শক্তিশালী নেতায় পরিণত হয়েছিলেন, যাকে নিরস্ত করার ক্ষমতা আমেরিকারও ছিল না। ৭১-এ ইন্দিরা গান্ধীও ভারত সমার্থক শব্দে পরিণত হয়েছিল।

ইন্দিরা গান্ধীর ভারতে যারা বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে ছিলেন, তাদের ভেতর যারা এখনও বেঁচে আছেন, তারা সকলেই চান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত হয়ে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি ৭১-এর মতো বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। রক্তের অক্ষরে রচিত দুই দেশের বন্ধুত্বের বন্ধন অনন্তকাল অটুট থাকুক।

(শেষ)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়