ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ইলিশ সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নে করণীয়

মো. আবুল বাশার মো. মুনজুরুল হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১০, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইলিশ সংরক্ষণ ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়নে করণীয়

মো. আবুল বাশার ও মো. মুনজুরুল হাসান : ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ, যা এ দেশের অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও প্রাণিজ আমিষ সরবরাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

বাংলাদেশের মোট মৎস্যসম্পদের মধ্যে একক প্রজাতি হিসেবে ইলিশের অবস্থান সর্ববৃহৎ ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের মধ্যে প্রায় ১২ ভাগই ইলিশ। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এর অবদান প্রায় ১ ভাগ।

দেশের ১৪৫ উপজেলার ১ হাজার ৫০০ ইউনিয়নের ৪ লাখ ৫০ হাজার জেলে ইলিশ মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। এর মধ্যে ৩২ ভাগ সর্বক্ষণিকভাবে এবং ৬৮ ভাগ খণ্ডকালীনভাবে এ পেশায় নিযুক্ত। ইলিশ আহরণ ছাড়াও বিপণন, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানি, জাল-নৌকা তৈরি ইত্যাদি কাজে প্রায় ২০-২৫ লাখ লোক জড়িত।

গবেষণা ও অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের প্রায় ৬০ ভাগই ইলিশ ধরা পড়ে বাংলাদেশে। মিয়ানমারে ২০ ভাগ, ভারতে ১৫ ভাগ এবং অন্যান্য দেশে ৫ ভাগ।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই ইলিশ সম্পদের ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এর ধারাবাহিকতায় ইলিশের প্রজননক্ষেত্র ও জাটকার অভয়াশ্রম সুনির্দিষ্টকরণ অন্যতম। ইলিশের চারটি প্রধান প্রজননক্ষেত্র হচ্ছে- উত্তর-পূর্বে মায়ানী পয়েন্ট, মীরেরসরাই এলাকা, উত্তর-পশ্চিমে পশ্চিম সৈয়দ আউলিয়া পয়েন্ট, তজুমুদ্দিন এলাকা, দক্ষিণ-পূর্বে গন্ডামারা পয়েন্ট, বাঁশখালী এলাকা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে লতা চাপালী পয়েন্ট, কলাপাড়া এলাকা। সুনির্দিষ্ট পাঁচটি জাটকা অভয়াশ্রম হচ্ছে-নিম্ন মেঘনা নদী, শাহবাজপুর চ্যানেল, তেঁতুলিয়া নদী, নিম্ন পদ্মা নদী ও আন্ধারমানিক নদী। এছাড়া মেঘনার শাখা নদীতে বরিশালের হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ অঞ্চলে নতুন করে আরো একটি অভয়াশ্রম প্রস্তাবিত আছে, যা বাস্তবায়িত হলে ষষ্ঠ অভয়াশ্রম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।

একসময় দেশের প্রায় সকল প্রধান নদ-নদী, মোহনা ও বঙ্গোপসাগরে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ পাওয়া যেত। কিন্তু ইলিশ মাছ আহরণ ও সংরক্ষণে কোনো ব্যবস্থাপনা না থাকায় ইলিশের প্রজনন মৌসুমে অবাধে প্রজননক্ষম ইলিশ আহরণ ও জাটকার বিচরণক্ষেত্রে নির্বিচারে জাটকা নিধনের ফলে ইলিশ মাছের প্রাপ্যতা হ্রাস পেতে থাকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ইনস্টিটটিউটের নদীকেন্দ্রের ১৯ বছরের গবেষণালব্ধ ফলাফলকে সমন্বিত করে ২০০১ সালে হিলশা ফিশারি ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান চূডান্ত কারা হয়। ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণ ও বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রণীত পরিকল্পনা মৎস্য অধিদপ্তরসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে। যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ইলিশের প্রজননক্ষেত্রের সুরক্ষা প্রদান ও জাটকার বিচরণক্ষেত্রে অবাধে জাটকা নিধন বন্ধ করা। এর ফলে জাটকা অভয়াশ্রমে দুই মাস জাটকা ধরা নিষিদ্ধ এবং প্রজননক্ষেত্রগুলোতে প্রধান প্রজনন মৌসুমে ২২ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এতে একদিকে যেমন জাটকা নিধন প্রতিরোধ সম্ভব হচ্ছে, অপরদিকে প্রজননক্ষেত্রগুলোতে নির্বিঘ্নে ও নিরাপদে প্রজননক্ষম ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পাচ্ছে।

উল্লেখ্য, প্রধান প্রজনন মৌসুমে প্রজননক্ষেত্রসমূহে আগের নিষেধাজ্ঞা ১৫ দিন থেকে বৃদ্ধি করে ২২ দিন করা হয়েছে। মূলত আশ্বিনের প্রথম উদিত চাঁদের বড় পূর্ণিমার পূর্বের চার দিন, পূর্ণিমার দিন ও পূর্ণিমার পরের ১৭ দিন হিসাব করা হয়। যা অত্র ইনস্টিটিউটের নদীকেন্দ্র চাঁদপুরের গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে প্রণীত। মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে আইনগুলো বাস্তবায়নের ফলে ইলিশ উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিকতায় ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছ।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণালব্ধ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ সালে স্পেন্ট ইলিশের হার ছিল উৎসাহব্যঞ্জক (৪৬.৪৭%)। ৩৯ হাজার ২৬৮ কোটি জাটকা নতুনভাবে পূর্ণাঙ্গ ইলিশ হয়েছে। প্রতি ১০০ মিটার জালে ঘণ্টায় ধৃত জাটকার পরিমাণ ছিল ৩.২৫ কেজি। জাটকা সংরক্ষণ ও ইলিশ মাছ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইনস্টিটিউটের নদীকেন্দ্র থেকে জাটকা বিচরণ, ইলিশের প্রজনন, সর্বোচ্চ সহনশীল উৎপাদন, ইলিশের গতিবিদ্যা, নদ-নদীর বাস্তুসংস্থান, ইলিশের জীবনচক্র ও উৎপাদনশীলতার ওপর পরিবেশ ও জলবায়ুগত প্রভাববিষয়ক গবেষণা পরিচালিত করে যাচ্ছে। এছাড়া ইলিশসম্পদ উন্নয়নে লাগসই ব্যবস্থাপনা কৌশল ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনার লক্ষ্যে ইনস্টিটিউটের চাঁদপুরস্থ নদীকেন্দ্রে ইলিশ গবেষণা জোরদারকরণ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

চলমান ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকলে আগামী বছরগুলোতে ইলিশের মোট উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ৫ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত হতে পারে। বর্তমানে বাস্তবায়িত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির পাশাপাশি ভবিষ্যতে বাছাই করে বড় ইলিশ ধরার জন্য জালের ফাঁসের আকার নিয়ন্ত্রণ, উপকূল ও সমুদ্র এলাকার ইলিশ সংরক্ষণ আইন বাস্তবায়ন, মনিটরিং এবং সার্ভিলেন্স জোরদারকরণ, ইলিশ আহরণের জন্য বিভিন্ন প্রকার জাল, নৌকা ও ইলিশ উৎপাদনের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী নিরূপণ, আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক ও আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, গণসচেতনা বৃদ্ধি ও আধুনিক ইলিশ গবেষণা ইত্যাদি বিষয় কার্যকর করার জন্য বাস্তব উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। এর মাধ্যমেই এ দেশের মানুষের দৈনিক প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সরকার কর্তৃক গৃহীত রূপকল্প ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে।

লেখকদ্বয় : গবেষক, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়