ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

শহীদ শামসুজ্জোহা ও জাতীয় শিক্ষক দিবস

ড. আমিরুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৩, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শহীদ শামসুজ্জোহা ও জাতীয় শিক্ষক দিবস

ড. আমিরুল ইসলাম: উচ্চতর শিক্ষা সম্পর্কে রবীন্দ্র-ভাবনা হচ্ছে ‘মনুষ্যত্বের সম্পূর্ণ উম্মোচন, ব্যক্তির সকল শুভ সম্ভাবনার স্ফুরণ, ব্যক্তির সাথে সমাজের যোগ, শিক্ষিত অশিক্ষিতের বৈষম্যের বিমোচন, আত্মিক ও ব্যবহারিকের সমন্বয়, জ্ঞান, বোধ, কল্পনা ও সৌন্দর্যচেতনার কর্ষণ ও বিকাশ, কর্মে জ্ঞানের নিয়োগের দ্বারা জীবনের সম্পন্নতা ও সমৃদ্ধি অর্জন, সৃজনশীলতার সাহায্যে মনুষ্যের পরিচর্যা ও প্রসার।’

স্পষ্টতই রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চিন্তার কেন্দ্র ছিল জীবনলগ্ন, সমাজলগ্ন এবং বিশ্বলগ্ন, যুক্তি কল্পনা ও প্রায়োগিক শক্তিতে দক্ষতাপূর্ণ বিকশিত এবং বিবর্তিত মানুষ... যার দানে ও গ্রহণে থাকবে আনন্দ। তিনি অন্যভাবে বলেছেন, যেখানে অধ্যাপকগণ জ্ঞানের চর্চায় স্বয়ং প্রবৃত্ত, সেখানেই ছাত্রগণ বিদ্যাকে প্রত্যক্ষ দেখতে পায়। এমনই একজন আলোকিত অধ্যাপক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ড. সৈয়দ মুহম্মদ শামসুজ্জোহা। ড. জ্জোহা নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। ডাক নাম মন্টু। ১৯৩৪ সালের ১ মে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলায় জন্ম। পিতার নাম মুহম্মদ আব্দুর রশিদ। পরিবারের তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। শামসুজ্জোহার প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন পশ্চিমবঙ্গে। বাঁকুড়া জেলা স্কুলে তিনি ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অনুষ্ঠিত ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় তিনি বাঁকুড়া জেলা স্কুল থেকে ১৯৪৮ সালে প্রথম বিভাগে এবং বাঁকুড়া ক্রিশ্চিয়ান কলেজ থেকে ১৯৫০ সালে প্রথম বিভাগসহ উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে শামসুজ্জোহা পরিবারের সাথে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে তিনি সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের কারণে তার ওপরে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। ভাষা আন্দোলনের পর তিনি মামার বাড়ি, বর্তমান নাটোর জেলার গুরুদাসপুর থানার চাঁচকৈড় নাজিম উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রবিউল করিমের বাসায় অবস্থান করেন। সেখান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং কারারুদ্ধ করা হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৫৩ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিসহ স্নাতক এবং ১৯৫৪ সালে প্রথম শ্রেণিসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৫ সালের শেষের দিকে শামসুজ্জোহা পাকিস্তান অর্ডিন্যান্স কারখানায় সহযোগী কারখানা পরিচালক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর তিনি যুক্তরাজ্যে গমন করেন এবং সাউথ ওয়েলস রয়্যাল অর্ডিন্যান্স কারখানায় বিস্ফোরক দ্রব্যের উপর প্রশিক্ষণ লাভ করেন। ১৯৫৯ সালে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের ওয়াহ ক্যান্টনমেন্টে সহকারী পরিচালক পদে যোগদান করেন। ১৯৬১ সালে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে  যোগদান করেন এবং একই বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের লেকচারার পদে যোগদান করেন। অধ্যাপনাকালে বৃত্তি নিয়ে তিনি লন্ডন ইম্পেরিয়াল কলেজে চলে যান। সেখান থেকে পিএইচডি ও ডিআইসি ডিগ্রি লাভ করে তিনি ১৯৬৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যাবর্তন করে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং ১৯৬৬ সালে সহযোগী অধ্যাপক (রিডার) পদে উন্নীত হন। পরবর্তী বছর ১৯৬৫ সালে তিনি এসএম হলের আবাসিক শিক্ষক এবং ১৯৬৬ থেকে ৬৭ সাল পর্যন্ত প্রাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর পর ১৯৬৮ সালের ১৫ এপ্রিল তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

স্বৈরাচার আয়ুব খানের সামরিক শাসনকালে ১৯৬৬-এর ৬ দফা ও ১১ দফা দাবি এবং তৎকালীন অবিসম্বাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ দুর্বার গণ-আন্দোলন গড়ে তোলেন। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি মিছিল করা অবস্থায় পুলিশের গুলিতে ছাত্র ইউনিয়নের নেতা আসাদুজ্জামান আসাদ শহীদ হন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সেনানিবাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হয়। এই দুটি হত্যাকাণ্ডে আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে ওঠে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় সরকার সামরিক বাহিনীর শরণাপন্ন হয় এবং সান্ধ্য আইন জারি করে। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করে। আন্দোলনকারী ছাত্ররা মিছিল বের করলে অনেক ছাত্রের জীবননাশের আশঙ্কা থাকায় প্রক্টর শামসুজ্জোহা নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন সেনাসদস্যদের। বলা হয়ে থাকে তিনি ছাত্রদের শান্ত করার চেষ্টা করেন এবং আশ্বস্ত করেন যে, যদি একটি গুলিও বর্ষিত হয়, তা ছাত্রদের গায়ে লাগার পূর্বে তার গায়ে লাগবে। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কে অবস্থান নিতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়।

বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীর ভেঙে রাস্তাসংলগ্ন খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে দেয়। ক্যাপ্টেন হাদী নামক একজন সামরিক কর্মকর্তা পিস্তল উঁচিয়ে ছাত্রদের দিকে তাক করে। ড. জ্জোহা তখন সেখানে ছুটে যান। তৎকালীন সহকারী প্রক্টর এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর আবদুল খালেকের মুখে শোনা যায়, সেনা কর্মকর্তা জিজ্ঞেস করেছিলেন তার পরিচয়। তিনি বলেছিলেন ‘রিডার’। তারা শুনেছিলেন ‘লিডার’। তিনি সেনাসদস্যদের শান্ত হতে আহ্বান করেন। কিন্তু সেনাসদস্যরা তার কথা উপেক্ষা করে উপর্যুপরি বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাকে রাস্তার নিচে খাদে ফেলে দেয়। রক্তাক্ত অবস্থায় সেনাবাহিনীর গাড়িতে করে তাকে নিয়ে পুরাতন পৌরভবনসংলগ্ন স্থানে কয়েক ঘণ্টা বিনা চিকিৎসায় রাখা হলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। যথাসময়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হলে এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু এড়ানো যেত। ড. জ্জোহার মৃতুতে সারা দেশ ফুঁসে ওঠে। পতন হয় সামরিক শাসক আয়ুব খানের। প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. জ্জোহার আত্মত্যাগের মধ্যে দিয়ে একতাবদ্ধ হয় বাঙালি জাতি। ৭০-এর নির্বাচনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে এই আত্মত্যাগ। জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে পাকিস্তানের রাজনীতিতে একক বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয় আওয়ামী লীগ। রচিত হয় স্বাধীনতার স্বপ্নসৌধ। প্রতি বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্জোহা দিবস উদযাপিত হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মহান শিক্ষকের আত্মত্যাগের মহিমাকে সম্মান জানাতে সরকারের প্রতি আবেদন, ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় শিক্ষক দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে বাংলাদেশের এই প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবীর আত্মত্যাগের যথাযথ মূল্যায়ন করা হোক।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়