ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

অটিজম মোকাবিলায় পথ দেখাচ্ছে বাংলাদেশ || মিনার মনসুর

মিনার মনসুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:১৫, ২ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অটিজম মোকাবিলায় পথ দেখাচ্ছে বাংলাদেশ || মিনার মনসুর

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল

মিনার মনসুর : অটিজম শব্দটি উচ্চারিত হলেই অনিবার্যভাবে আর একটি নাম সামনে চলে আসে। সেটি হলো সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। তাঁর একটি বিশেষ পরিচয় হলো, তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা। তবে সেই পরিচয়কেও ছাপিয়ে উঠেছে তাঁর স্বনির্মিত অনন্য এক ভাবমূর্তি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষায়, তিনি হলেন অটিজম সচেতনতায় দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন। বিগত বছরের ১ এপ্রিল তাঁকে এ সম্মাননা দেওয়া হয়। এর যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সংস্থাটির দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার প্রধান ডা. পুনম ক্ষেত্রপাল বলেন, পুতুল তাঁর নিজ দেশ বাংলাদেশে স্বাস্থ্য এজেন্ডায় অটিজম ইস্যুকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে যে প্রচেষ্টা চালিয়েছেন তা অভূতপূর্ব। একই সঙ্গে অটিজম বিষয়ে বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক মনোযোগ আকর্ষণ করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। অটিজম মোকাবিলায় জনসচেতনতা তৈরি এবং কমিউনিটিকে সংযুক্ত করে কর্মসূচি গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

এ প্রসঙ্গে ড. ক্ষেত্রপাল বলেন, সায়মা ওয়াজেদের প্রচেষ্টায় এই অঞ্চলের ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অটিজম নিয়ে বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। দশটি মেডিক্যাল কলেজে শিশুদের অটিজমজনিত সমস্যা শনাক্ত করার জন্যে বিশেষ ইউনিট চালু করা হয়েছে। অটিজম নিয়ে এই অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন হিসেবে সম্মান জানিয়েছে।

কয়েক দশক আগেও অটিস্টিক শিশুদের প্রতি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের উদাসীনতা কোন পর্যায়ে ছিল তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই জানেন। তারা শুধু যে মর্মান্তিকভাবে অবহেলিত হয়েছে তাই নয়, পরিবার ও সমাজের চরম নেতিবাচক মানসিকতারও শিকার হতে হয়েছে নাজুক এ শিশুগুলোকে। দীর্ঘদিন ধরে অটিস্টিক শিশুদের পরিবার ও সমাজের বোঝা বলে ভাবা হয়েছে। ফলে এইসব শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যথাযথ পরিবেশ, সুযোগ-সুবিধা এবং ব্যবস্থাপনা বলতে কিছুই ছিল না। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সর্ব ক্ষেত্রেই এ কথা প্রযোজ্য।

অন্যদিকে, উন্নত দেশগুলোর বাস্তবতা খানিকটা ভিন্ন হলেও সামগ্রিকভাবে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের পরিস্থিতিও ছিল তথৈবচ। সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের দরদি হৃদয়ের ছোঁয়ায় শুধু যে বাংলাদেশের চিত্র বদলে গেছে তাই নয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও অটিজম বিষয়ে সৃষ্টি হয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ সচেতনতা। এটা যে নিছক কথার কথা মাত্র নয়, তাঁর কর্ম ও অর্জনের দিকে নজর দিলেই তা বোঝা যাবে। তাঁর উদ্যোগেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ‘অটিজম আক্রান্ত শিশু ও তাদের পরিবারের জন্য স্বাস্থ্যসেবা এবং আর্থ-সামাজিক সহায়তা বৃদ্ধি’ শীর্ষক প্রস্তাব গৃহীত হয়। অটিজম বিষয়ে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষ অবদানের জন্য ২০১৪ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাঁকে ‘এক্সিলেন্স ইন পাবলিক হেলথ অ্যাওয়ার্ড’-এ ভূষিত করে। সম্প্রতি তিনি ইউনেস্কোর ‘ইউনেস্কো-আমির জাবের আল-আহমদ আল-সাবাহ পুরস্কার’-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক জুরি বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।

দক্ষিণ এশীয় অটিজম নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার অন্যতম কারিগরও ছিলেন তিনি। তাঁর উদ্যোগেই ২০১১ সালে ঢাকায় প্রথমবারের মতো অটিজমবিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ উপলক্ষে ২০১৬ সালে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ‘অটিজম মোকাবিলা: এসডিজির আলোকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কৌশল’ শীর্ষক সম্মেলনে তিনি মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। জাতিসংঘে যৌথভাবে এই সম্মেলনের আয়োজক ছিল বাংলাদেশ, ভারত, কাতার, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র মিশন এবং বেসরকারি সংস্থা অটিজম স্পিকস। উচ্চ পর্যায়ের এ আলোচনায় বাংলাদেশের কর্মকৌশলের পাশাপাশি তাঁর বক্তব্যও বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। অতএব, ডা. পুনম ক্ষেত্রপালের এ প্রত্যাশা খুবই যৌক্তিক যে, আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পুতুল এই অঞ্চলে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অটিজমের বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে আরো গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবেন, যা ইতোমধ্যেই আঞ্চলিক সীমানা ছাড়িয়ে গেছে।

উল্লেখ্য যে, সায়মা ওয়াজেদ বর্তমানে অটিজমবিষয়ক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। গত এক দশকে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি অর্জন করেছে তা অভাবনীয়ই বলা চলে। রীতিমত বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে। যুগপৎ ভরসা ও আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেয়েছেন অটিস্টিক শিশুর বাবা-মা ও অভিভাবকগণ। কারণ খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই দাঁড়িয়েছেন তাদের পাশে। শুধু কথা নয়, কাজেও তার প্রমাণ দিয়ে চলেছেন তিনি। তার তাৎপর্যপূর্ণ একটি উদাহরণ হলো, গত কয়েক বছর যাবৎ প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি ঈদ শুভেচ্ছা কার্ড তৈরি হচ্ছে অটিস্টিক শিশুদের আঁকা ছবি দিয়ে। প্রধানমন্ত্রী অকপটে স্বীকার করেছেন যে পুতুলই তাঁকে পথ দেখিয়েছেন। মানসিকতার এই যে পরিবর্তন এটাই সম্ভবত সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। তবে অটিস্টিকদের জন্যে সরকারের গৃহীত নীতি ও পদক্ষেপগুলোর তাৎপর্যও কোনো অংশে কম নয়।

প্রসঙ্গত, বলা প্রয়োজন যে অটিস্টিক শিশু শনাক্তকরণ, সেবা প্রদান এবং তাদের মা-বাবা বা পরিচর্যাকারীদের সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ প্রদানের লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের উদ্যোগেই ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এ ‘সিনাক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমানে এটিকে ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোলজি অ্যান্ড অটিজম-এ রূপান্তরিত করা হয়েছে। খোলা হয়েছে ‘ইন্সটিটিউট ফর নিউরো ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম ইন চিল্ড্রেন’ (ইপনা) নামে একটি ইনস্টিটিউটও। সরকারি হাসপাতালগুলোতে শিশু বিকাশ কেন্দ্র এবং দেশের সব জেলায় প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্রে একটি করে অটিজম কর্নার খোলা হয়েছে। পিছিয়ে নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও। সেখানে ‘এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি’ বিভাগ এবং অটিস্টিকদের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট চালু করা হয়েছে। কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী, শিক্ষক, প্রশিক্ষক, চিকিৎসক, সেবাদানকারী ও অটিস্টিক শিশুর মা-বাবার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। পাশাপাশি নেওয়া হয়েছে অটিস্টিকদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজনের উদ্যোগসহ তাদের সৃষ্টিশীল মনের বিকাশের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও। অটিজম আক্রান্তদের কর্মসংস্থানেরও চিন্তাভাবনা চলছে। এদের অনেকে চাকরি করছেন এবং স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করছেন। অটিজমে আক্রান্তরা এখন আর সমাজের বোঝা নয়।

তবে আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। কারণ দেশে যে হারে অটিজমে আক্রান্তের হার বাড়ছে সে হারে বাড়ছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ তাদের সহায়ক সুবিধাদি। বাংলাদেশের মতো সীমিত সম্পদের একটি দেশের পক্ষে রাতারাতি সেটা সম্ভবও নয়।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুয়ায়ী, দেশে অটিস্টিক শিশুর সংখ্যা আনুমানিক দেড় লাখ। সর্বশেষ আদমশুমারির তথ্যমতে, দেশে ৯ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ প্রতিবন্ধী। আন্তর্জাতিকভাবে কোনো দেশের মোট প্রতিবন্ধীর ১ শতাংশকে অটিজমের শিকার বলে ধরে নেওয়া হয়। এদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক জরিপে বলা হয়েছে, ঢাকা শহরে অটিস্টিক শিশুর হার ৩ শতাংশ আর ঢাকার বাইরে দশমিক ৭ শতাংশ। অটিজম নিয়ে জাতিসংঘের সর্বশেষ গবেষণা জরিপে বলা হয়, প্রতি ৬২ জনের একজন অটিজম সম্পর্কিত রোগে আক্রান্ত অর্থাৎ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১ শতাংশ অটিজম জীবন নিয়ে বেড়ে উঠছে। উদ্বেগের বিষয় হলো এর সিংহভাগই শিশু।

অটিজম আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা সুজান রীটের মতে, বিশ্বে ৭ কোটি মানুষ অটিজমে ভুগছে। ড. ক্ষেত্রপাল মনে করেন, অটিজম ধারাবাহিকভাবেই জনস্বাস্থ্যের জন্যে একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ চ্যালেঞ্জ আরো গুরুতর।

সফলভাবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হলে প্রথমেই জানা দরকার অটিজম কী? অটিজম এমন একটি মানসিক ব্যাধি যেখানে একজন ব্যক্তির অন্যান্য মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ এবং নিজেকে সম্পর্কযুক্ত করার ক্ষমতা সীমিত হয়ে যায়। অটিজমের সঠিক কারণ কী তা বিজ্ঞানীরা এখনো জানেন না। তবে যেহেতু এটি পরিবারের মধ্যে সঞ্চালিত হয়, তাই মনে করা হয় যে এক্ষেত্রে জিন সম্ভবত একটি ভূমিকা পালন করে। যেহেতু বাচ্চারা খুব সামাজিক হয়, তাই তারা কীভাবে সবার সঙ্গে মিশছে তা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অটিজমের লক্ষণ শনাক্ত করা সম্ভব। এক বছর বয়সেই তাদের মধ্যে কিছু লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন অটিজম আক্রান্ত শিশু মায়ের ডাকে সাড়া দেয় না, নাম ধরে ডাকলেও সাড়া মেলে না এবং কারো চোখের দিকে তাকায় না। দুই বছর বয়সের মধ্যে অটিজমের প্রভাব আরো তীব্র হয়ে ওঠে। অন্যান্য শিশু যেখানে তাদের প্রথম শব্দ গঠন এবং কিছু চাওয়া হলে তার প্রতি নির্দেশ করে, অটিজমে আক্রান্ত একটি শিশু সেখানে সব কিছুর প্রতি নিরাসক্ত থেকে যায়।

অটিজম একটি নিউরোলজিকাল বা স্নায়বিক সমস্যা যাতে মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ফলে কথা বলতে বা বুঝতে, নতুন জিনিস শিখতে এবং সমাজে চলতে ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হয় রোগী। অটিজমের উপসর্গ নানারকম হতে পারে। একই সঙ্গে এই রোগের প্রভাব ব্যক্তিবিশেষে আলাদা আলাদা হয়ে থাকে। কোনো শিশু হয়ত সামান্য সাহায্য পেলেই স্বাধীনভাবে সব কিছু করতে পারে, আবার কেউ হয়তো সম্পূর্ণরূপে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়। আগে এক একটি রোগের (অটিস্টিক ডিস্অর্ডার, পার্ভেসিভ ডেভেলপমেন্টাল ডিস্অর্ডার, এনওএস, অ্যাসপার্জার’স সিন্ড্রোম) আলাদা আলাদাভাবে চিকিৎসা হতো। কিন্তু এখন সব কিছুকেই অটিজম স্পেকট্রাম ডিস্অর্ডার (ASD) হিসেবে ধরা হয়।

বাচ্চার তিন বছর বয়সের মধ্যে অটিজমের উপসর্গ স্পষ্ট হয়ে যায়। ক্ষেত্র বিশেষে সেই উপসর্গ কম কিংবা বেশি হতে পারে এবং এক একজন শিশুর এক এক রকমের উপসর্গ হতে পারে। কোনো কোনো শিশুর ক্ষেত্রে অটিজমের পাশাপাশি বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা, মোটর নার্ভে সমস্যা, অন্ধত্ব বা বধিরতা এবং অতিরিক্ত চঞ্চলতাও দেখা যেতে পারে। সমস্যা দেখা দিতে পারে কথা বলতে গিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পেডিয়াট্রিক নিউরোডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম (ইপনা)-এর উপপ্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল কাদেরের মতে, অটিস্টিক শিশুর বিকাশ তিনটি ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়। প্রথমত, সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে বাধা। অর্থাৎ অন্য কোনো ব্যক্তির প্রতি আগ্রহ না থাকা, কে কী করছে তা নিয়ে কৌতূহল না থাকা, অন্যের আচরণ বুঝতে না পারা। দ্বিতীয়ত, যোগাযোগ স্থাপনে বাধা। অর্থাৎ কথা বলতে না শেখা, কথা বলতে পারলেও অন্যের সঙ্গে আলাপচারিতা করতে সমর্থ না হওয়া। তৃতীয়ত, পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ করা, একই কাজ বারবার করা।

অটিজম একটি দীর্ঘস্থায়ী অসুখ এবং এটি কখনো সারে না। কিন্তু সঠিক থেরাপির সাহায্যে শিশু সুন্দর জীবন কাটাতে সক্ষম হয়ে উঠতে পারে। যেহেতু ১৮ মাস বা তার চেয়ে কম বয়সেও এই রোগ ধরা পড়তে পারে, তাই তাড়াতাড়ি এর চিকিৎসা শুরু করা গেলে আশাতীত ফল পাওয়া সম্ভব। বাবা-মাকে এ ব্যাপারে শুরু থেকে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। এর অংশ হিসেবে সংশ্লিষ্ট শিশু চিকিৎসকের সঙ্গে এই ব্যাপারে নিয়মিত যোগাযোগ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা অব্যাহত রাখতে হবে। অটিজম শনাক্ত করার জন্যে বেশকিছু পদ্ধতি রয়েছে। তার মধ্যে নিউরোলজিকাল টেস্ট; অটিজম ডায়াগনস্টিক ইন্টারভিউ রিভাইজ্ড (ADI-R); অটিজম ডায়াগনস্টিক অব্জারভেশন শিডিউল (ADOS); চাইল্ডহুড অটিজম রেটিং স্কেল (CARS); গিলিয়াম অটিজম রেটিং স্কেল এবং পার্ভেসিভ ডেভেলাপমেন্টাল ডিস্অর্ডার স্ক্রিনিং টেস্ট প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অটিজম চিকিৎসার উদ্দেশ্যই হলো শিশুকে স্কুলে যেতে, সামাজিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে, স্বাধীনভাবে চলতে, ঠিকমত কথা বলতে সাহায্য করা। সঠিক এবং নিয়মিত চিকিৎসায় তা সম্ভব। চিকিৎসা এবং থেরাপিরও স্বীকৃত কিছু পদ্ধতি রয়েছে যার কার্যকারিতা অনেকাংশে ফলপ্রসূ বলে প্রমাণিত হয়েছে। যেমন অ্যাপ্লায়েড বিহেভিয়ার অ্যানালিসিস (ABA); ডিসক্রিট ট্রায়াল ট্রেনিং (DTT); আর্লি ইন্টেনসিভ বিহেভিওরাল ইন্টারভেনশন (EIB); পিভোটাল রেসপন্স ট্রেনিং (PRT); ভার্বাল বিহেভিওর ইন্টারভেনশন (VBI) এবং ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড এডুকেশন অব অটিস্টিক অ্যান্ড রিলেটেড কমিউনিকেশন হ্যান্ডিক্যাপড চিলড্রেন মেথড (TEACCH) ইত্যাদি। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন থেরাপি। যেমন অকুপেশনাল থেরাপি, সেন্সরি মাইগ্রেশন থেরাপি, স্পিচ থেরাপি, মিউজিক থেরাপি প্রভৃতি।

এটা অনস্বীকার্য যে বাবা-মা বা অভিভাবিকদের পক্ষে অটিজম আক্রান্ত শিশুর যত্ন নেওয়া খুব সহজ কাজ নয়। শিশুর উন্নতিকল্পে তাদের অনেক সময় দিতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে চাকরিও ছেড়ে দিতে হয় কর্মজীবী মায়েদের। সর্বোপরি, বাড়তি অর্থ জোগানোর চ্যালেঞ্জ তো আছেই। তবে মমত্ব দিয়ে সব বাধাই জয় করা যায়। পাশাপাশি রোগ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যায়। অটিজম সম্পর্কে যত বেশি করে সম্ভব জানতে হবে। অন্যান্য অটিজম রোগীর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে নিয়মিত। সন্তান বা প্রিয়জন যেই হোক তাকে নিয়ে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ এটা প্রমাণিত যে অটিজম রোগীদের নিজস্ব গুণ ও প্রতিভা থাকে। থাকে বিশেষ কিছু গুণাবলি ও ক্ষমতা। প্রতি ১০ জনে একজন অটিস্টিক শিশু অনন্য প্রতিভার অধিকারী হয়ে থাকে। যথাযথ পরিচর্যা পেলে তারা কিন্তু তাক লাগানো সাফল্য দেখাতে পারে নানা ক্ষেত্রে। বিশেষ করে খুব সহজেই কঠিন বিষয় বুঝতে পারে তারা। এমনকি পছন্দের বিষয়ে সেরা হয়ে ওঠার নজিরও রয়েছে তাদের মধ্যে।

ইপনার প্রকল্প পরিচালক ডা. শাহীন আখতারের মতে, বেশির ভাগ অটিস্টিক শিশু অত্যন্ত সম্ভাবনাময় হয়। প্রতি দশজন অটিস্টিক শিশুর মধ্যে একজন ছবি আঁকায়, গানে, গণিতে বা কম্পিউটারে খুবই দক্ষ হয়ে থাকে। অটিস্টিক শিশুকে সামাজিক করতে হবে। ওদের নিজের জগৎ থেকে বাইরে আনতে হবে। এজন্য তাকে ব্যবহারিক শিক্ষা দিতে হবে।

আশার কথা হলো আমাদের সামর্থ্য সীমিত হলেও একাধিক কারণে আমরা ভাগ্যবান। প্রথমত, আমরা সায়মা ওয়াজেদের মতো একজন বলিষ্ঠ ও দায়বদ্ধ মানুষ পেয়েছি, যিনি শুধু যে সমস্যাটিকে ভালোভাবে বোঝেন তাই নয়, এক্ষেত্রে বৈশ্বিকভাবে নেতৃত্বও দিয়ে চলেছেন সফলভাবে। সর্বোপরি, পেয়েছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মতো একজনকে, যিনি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন যে অটিস্টিক শিশু-কিশোরদের সম্ভাবনাগুলোকে চিহ্নিত করে সঠিক পরিচর্যা, শিক্ষা ও স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তোলা হলে তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বোঝা না হয়ে অপার সম্ভাবনা বয়ে আনবে। এ বিশ্বাস থেকেই তিনি প্রতিবন্ধী এবং অটিজম আক্রান্ত লোকজনকে সমাজের মূলধারায় অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের সুযোগ করে দেওয়ার লক্ষ্যে কার্যকর নীতি গ্রহণের জন্য উদাত্ত আহ্বানও জানিয়েছেন বিশ্বের সকল দেশের প্রতি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলতে চাই: ‘আসুন, আমরা এদের বহুমুখি প্রতিভাকে স্বীকৃতি প্রদানে সংকল্পবদ্ধ হই, যাদের এই অসামঞ্জস্যের কোনো চিকিৎসা নেই তাদের মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের সুযোগ করে দিই, যাতে করে তারা সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত হতে পারে।’

লেখক :  কবি ও প্রাবন্ধিক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ এপ্রিল ২০১৮/ইভা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়