ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কোরবানি ঈদ : গোড়ার কথা

অধ্যক্ষ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ: || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫৪, ২৩ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কোরবানি ঈদ : গোড়ার কথা

অধ্যক্ষ মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ: কোরবানির আরবি শব্দ আযহাতুনের বহুবচন আযহা। অর্থাৎ উৎসর্গ বা আল্লাহর নামে উৎসর্গিত জন্তু। (আরবি-বাংলা অভিধান, ইফাবা)। এছাড়া শরিয়তের পরিভাষায় আরবি শব্দ ‘কুরবান’ দ্বারা ওই জন্তুকে বুঝানো হয় যাকে আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে যবেহ করা হয় (তাফসিরে, মাআরিফুল কুরআন, সংক্ষিপ্ত-পৃ: ৩২৪)। এ থেকেই বলা হয়, ঈদুল আযহা বা উৎসর্গের ঈদ, কোরবানির ঈদ।

কোরবানি বা আল্লাহর নামে কোনো কিছু উৎসর্গ করার ইতিহাস সুদীর্ঘ। শুরুটা হয়েছিল হযরত আদম (আ.) এর পুত্র হাবিল-কাবিলে মাধ্যমে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, হযরত আদমের (আ.) দুই ছেলে ছিল- হাবিল ও কাবিল। হযরত আদম (আ.) এর স্ত্রী হাওয়ার (আ.) প্রত্যেকবার এক জোড়া সন্তান হতো, একটি ছেলে অপরটি মেয়ে। একই পিতার ঔরসজাত সন্তানদের মধ্যে বর্তমানে বিবাহ হারাম বা অবৈধ। তবে তখন এটি ছিল জায়েজ বা বৈধ। কাবিলের জমজ বোনটি ছিল সুশ্রী। জমজ হওয়ার কারণে তাকে বিয়ে করার নিয়ম না থাকলেও সে জিদ ধরল যে, সে তার জমজ বোনকেই বিয়ে করবে। অপরদিকে তাকে বিয়ে করার বৈধ হকদার হাবিল। সেও তার প্রাপ্য ছাড়তে মোটেই রাজি নয়। এই দ্বন্দ্বের  মিমাংসা হযরত আদম (আ.) করলেন এভাবে- তারা প্রত্যেকে আল্লাহর সান্নিধ্যে কিছু কোরবানি করবে। যার কোরবানি কবুল হবে তার কথা মেনে নেয়া হবে। কথা মতো হাবিল একটি দুম্বা ও কাবিল কিছু শস্য, গম ইত্যাদি কোরবানির জন্য পেশ করল। সে যুগে কোরবানি কবুল হওয়ার আলামত ছিল, আকাশ থেকে আগুন নেমে কবুলকৃত পশু বা বস্তু খেয়ে ফেলত। মহান আল্লাহর কুদরতি নিয়ম অনুযায়ী আগুন এসে হাবিলের দুম্বাটি খেল, কাবিলের কুরবানির বস্তু রয়ে গেল। কাবিল এই ঘটনা কোনোভাবে মেনে নিতে পারল না। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে সে হত্যা করল ভাই হাবিলকে। (তাফসিরে, মাআরিফুল কুরআন, সংক্ষিপ্ত-পৃ: ৩২৪, ইবনে কাসীর ২/৪৮)। যাহোক, এ হলো প্রথম কোরবানির কথা। তবে আমরা যে রীতি ও বিধান অনুযায়ী কোরবানি করি তার পিছনে কিন্তু রয়েছে অন্য এক হৃদয় বিদারক ঘটনা।

নবী হযরত ইব্রাহীম (আ.) ছিলেন নিঃসন্তান। একবার তিনি আবেগভরা কণ্ঠে মহান সৃষ্টিকর্তার নিকট দোয়া করলেন, পরওয়ারদেগার, আমাকে সৎ পুত্র দান করুন। অতঃপর মাহান আল্লাহ তাঁকে এক সহনশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলেন। (সূরা আস সফ্‌ফাত: ১০০-১০১)। ইব্রাহীম (আ.) বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রী হাজেরার ঘরে পেলেন ফুটফুটে সন্তান হযরত ইসমাঈলকে (আ.)।  মহান আল্লাহর নির্দেশে স্ত্রী হাজেরা ও তাঁর দুই বছরের সন্তান ইসমাঈলকে রেখে এলেন বর্তমান পবিত্র মক্কা নগরীর কাবা গৃহের কাছে একটি গাছ তলায়। আজকের মক্কা তৎকালে ছিল জন-মানবহীন নির্জন মরুভুমি। যতদূর দৃষ্টি যেত কেবলই ধু-ধু মরুভূমি। (ফতহুল বারী )। বিদায়ের বেলায় হাজেরা অশ্রুসজল ঝাপসা চোখে আল্লাহর নবীর কাছ থেকে কেবল এতোটুকু জেনে নিয়েছিলেন যে, জনমানবহীন এই প্রান্তরে তাদের থাকতে হবে ‘মহান আল্লাহর নির্দেশে’। সকল মুছিবতে এটাই তাদের মূল ভরসা।  রাত-দিনের পরিবর্তনে এ ঊসর মরুর ধূসর বুকে ঘটে গেলো অনেক ঘটনা। ইসমাঈল (আ.) এর বয়স এখন সাত বছর। মাঝে মধ্যে সুদূর ফিলিস্তিন থেকে এসে পিতা ইব্রাহীম দেখে যান স্ত্রী-পুত্রদের। কলিজার টুকরা, বার্ধক্যের মাণিক ইসমাঈল এখন বাবার হাত ধরে দৌড়াদৌড়ি করে।

শুরু হলো নবী জীবনে ইব্রাহীম (আ.) এর নতুন পরীক্ষা। মহান আল্লাহ তাঁর বন্ধু ইব্রাহীমকে (আ.)  স্বপ্নে দেখলেন, তোমার প্রিয় বস্তুকে আমার জন্য কোরবানি করতে হবে। একবার নয়, তিন রাতেই এমন স্বপ্ন দেখানো হলো (কুরতুবী)। ইব্রাহীম (আ.) এর বুঝতে বাকী রইল না- যা কোরবানি করতে বলা হচ্ছে তা আর কিছুই নয়, বৃদ্ধ বয়সে ঘরকে আলোকিত করা কলিজার টুকরা ইসমাঈল। কলিজায় রক্তক্ষরণ হতে লাগল। কিন্তু কিছুই করার নেই। আল্লাহর বিধানের সামনে নশ্বর পৃথিবীর সব কিছুই তুচ্ছ। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, যা হুকুম তাই বাস্তবায়িত হবে। পরম স্নেহের লালনকারিনী মাকে কিছুই না জানিয়ে পুত্র ইসমাঈলকে সাথে নিয়ে চললেন ইব্রাহীন (আ.)। উদ্দেশ্য মহান আল্লাহর নির্দেশ পালন করা। অভিশপ্ত ইবলিস পথিমধ্যে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করল নানাভাবে। ইব্রাহীম (আ.) পৌঁছে গেলেন যবেহ করার যথাযথ স্থানে। আল্লাহর বিধান পালনে কারো মতামতের প্রয়োজন নেই। তারপরও সবকিছুতে পরামর্শ করে নেওয়া ভালো। মানসিকভাবে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে ইব্রাহীম (আ.) পুত্রকে খুলে বললেন সব কিছু। যেমন পিতা তেমন পুত্র। সাত বছর বয়সী ইসমাঈল বিচলিত হলেন না এতটুকুও। বিনয়ের সাথে পিতাকে সাফ জানিয়ে দিলেন: ‘হে আমার সম্মানিত পিতা! আপনাকে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে নির্দ্বিধায় তা সেরে ফেলুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীল হিসেবে পাবেন’ (সূরা আস সফফাত: ১০২) ।

ইসমাঈল (আ.) পিতাকে পরামর্শ দিলেন,  আপনি যখন আমাকে যবেহ করতে যাবেন তখন হয়তো আপনার হৃদয়ে আমার জন্য মায়া সৃষ্টি হতে পারে। এর ফলে আল্লাহর নির্দেশ পালনে দেরি হতে পারে। তাই আমাকে শোয়ানোর পর আপনি আপনার চোখ দুটি কাপড় দিয়ে বেঁধে নিবেন। পুত্রের পরামর্শে সব প্রস্তুতি তখন শেষ। বিসমিল্লাহ বলে ইব্রাহীম (আ.) ছুরিও চালিয়ে দিলেন। ওই মুহূর্তে আকাশ বাতাস যেন কেঁপে উঠলো। বন্ধুর জন্য আরেক বন্ধুর এ কেমন পরীক্ষা! মহান আল্লাহও যেন ফেরেস্তাদের গর্ব করে বললেন,  দেখ! যে মানুষকে সৃষ্টির ব্যাপারে তোমরা প্রশ্ন করেছিলে সেই মানব সন্তান আজ এক মহাপরীক্ষায় কীভাবে বিজয়ের মালা ছিনিয়ে নিয়ে গেল!

ফেরেস্তাদের নেতা জিব্রাঈলকে আল্লাহ বললেন, যাও, আমার বন্ধু  ইব্রাহীমের ছুরির নিচে শক্ত ধাতব পাত রেখে দাও, যেন কোনোভাবেই ইসমাঈলের গলায় কোনো আঘাত না লাগে। এদিকে স্নেহ-ভালোবাসার বন্যাবেগকে ছাপিয়ে হযরত ইব্রাহীম (আ.) শরীরের পূর্ণ শক্তি দিয়ে ছুরি চালাতে লাগলেন। নাহ! ছুরি কোনো কাজ করছে না! ইব্রাহীম (আ.) ছুরির উপর বেশ চটেও গেলেন। জীবনের অন্তিম মুহূর্তে ছুরির নিচে শুয়ে ইসমাঈলও দিয়ে চলছেন নানা পরামর্শ। আব্বু এভাবে না, এভাবে ছুরি চালান ইত্যাদি। আল্লাহর নির্দেশ পালনে পিতা-পুত্রের চলছে নিবিড় প্রচেষ্টা। ইতোমধ্যেই আওয়াজ এলো: ‘হে ইব্রাহীম তুমি স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছো’ (সূরা আস সফফাত: ১০৫-৬)। আমার (আল্লাহর) আদেশ পালনে যা যা করার তুমি তার সবই করেছো, কোনো ত্রুটি করোনি। আমার সন্তুষ্টির জন্য নিজ সন্তানের গলায় ছুরি চালাতে কুণ্ঠাবোধ করোনি, জীবনের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটিকে কোরবানি করতে বিচলিত হওনি মোটেই। তুমি চিরবিজয়ী, তুমি সফলকাম। তোমার পরীক্ষা পূর্ণ হয়েছে। ছুরি উঠাও, ইসমাঈলকে ছেড়ে দাও।

ইসমাঈলকে ছেড়ে দিলেন ইব্রাহীম (আ.)। নিজের চোখ থেকে কাপড় খুলে নিলেন। বুকে জড়িয়ে ধরলেন প্রিয় পুত্রকে।

অতপর ইব্রাহীমকে (আ.) একটি জান্নাতি ভেড়া দেয়া হলো কোরবানি করার জন্য। পিতা-পুত্র মিলে কোরবানি করলেন সেই জান্নাতি ভেড়া। হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাঈলের (আ.) এই ঘটনা আল্লাহর কাছে এতটাই পছন্দনীয় হয়েছিল যে, কোরবানির এই বিধানকে তিনি কেয়ামত পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহর জন্য বলবৎ রেখে দিলেন। যদি সেদিন হযরত ইসমাঈল (আ.) সত্যি সত্যি যবেহ হয়ে যেতেন আর যদি বিধান থাকত প্রত্যেককে তার জীবনের সর্বাধিক প্রিয় সন্তানকে কোরবানি করতে হবে তাহলে ব্যপারটা কত কঠিন হতো চিন্তার বিষয়। আল্লাহ তা’আলা যাদের স্বচ্ছলতা দিয়েছেন, তাদের উচিৎ কার্পণ্য না করে আল্লাহর দেয়া সম্পদ দিয়ে উত্তম পশুটি ক্রয় করে শরীয়তের বিধান মোতাবেক কোরবানি করা। তাহলে হযরত ইব্রাহীম (আ.) নিজ সন্তানকে ছুরির নিচে শুইয়ে যে মহাপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন, আমরা সমান্য অর্থের কোরবানি করেও সে মর্যাদা পেয়ে যেতে পারি। তবে এ সবই হতে হবে একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। কাউকে দেখানো কিংবা যশ-খ্যাতির জন্য নয়। আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে ঘোষণা করেছেন : ‘কোরবানির পশুকে তোমাদের জন্য আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য মঙ্গল রয়েছে। অতএব, সারিবদ্ধ থাকা অবস্থায় তোমরা তাদের উপর ( তাদেরকে যবেহ করার সময়) আল্লাহর নাম উচ্চারণ কর। তারা যখন (যবেহ এরপর) কাত হয়ে পড়ে যায় তখন তোমরা তাদের গোশত খাও, স্বচ্ছল পরিতুষ্ট এবং গরিবদেরকেও খাওয়াও। এভাবেই আমি এসব পশুকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো।(জেনে রেখ) কোরবানিকৃত এসব পশুর গোশত ও রক্ত (কিছুই) আল্লাহর কাছে পৌঁছাবে না, বরং তাঁর কাছে পৌঁছাবে তোমাদের তাকওয়া’।(সূরা হজ : ৩৬-৩৭)

লেখক : গবেষক, নগরবিদ ও রাজনীতিবিদ



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ আগস্ট ২০১৮/শাহেদ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়