ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন কত দূর

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০৭, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন কত দূর

অলোক আচার্য : পোল্যান্ডের কাটোভিৎসে অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন। এই শহরেই রয়েছে ইউরোপিয় ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় কয়লা কোম্পানি। আজ আমরা সবাই জানি, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এই কয়লা কোম্পানিগুলোর দায় রয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস বলেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার পরিমাণ কমাতে ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি করা হয়েছিল। কিন্তু এ চুক্তি বাস্তবায়নে ব্যর্থতা হবে আত্মঘাতী। সম্মেলনে দেয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেছেন। তিনি এর সাথে যোগ করেন পোল্যান্ডের এ সম্মেলন ব্যর্থ হলে তা সবুজ অর্থনীতির অপেক্ষায় থাকা মানুষের কাছে একটি বিপর্যয়মূলক বার্তা পাঠাবে। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকাতে প্যারিস সম্মেলনে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা কমানোর যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়নে দেশগুলোর পরিকল্পনা বিষয়ে এ সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা আলোচনা করেছেন। প্যারিস চুক্তিতে শিল্প বিপ্লবের পূর্ববর্তী সময়ে যা ছিল তার চেয়ে দুই ডিগ্রী সেলসিয়াসের বেশি না বাড়তে দেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কনফারেন্স অফ দ্য পার্টি বা কপ নামে পরিচিত জাতিসংঘের এই বার্ষিক আয়োজনের ২৪ তম আয়োজন ছিল এটি। এর আগে গত অক্টোবরে জাতিসংঘের সংস্থা ’ইন্টারগভার্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ’ বা আইপিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির লক্ষমাত্রা দেড় ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এই লক্ষ পূরণ করতে চাইলে ২০৩০ সালের মধ্যে গ্রীন হাউজ গ্যাস নির্গমন ৪৫ শতাংশ কমাতে হবে বলে বিশ্বের প্রায় ৯০০ বিজ্ঞানী যৌথবিবৃতি ঐ প্রতিবেদনে রয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর প্রতিটি দেশই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ভেতর বাংলাদেশ রয়েছে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের চতুর্থ ন্যাশনাল ক্লাইমেট অ্যাসেসমেন্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র শত শত কোটি ডলার খরচ করলেও লাগামহীন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশটির মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে হুমকির মুখে পড়বে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঐতিহাসিক হারে কার্বন নিঃসরণ অব্যাহত থাকলে চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ কয়েকটি অর্থনৈতিক খাতে বার্ষিক ক্ষতির পরিমাণ শত শত কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে। এই ক্ষতির পরিমাণ বহু রাজ্যের জিডিপির চেয়েও বেশি। ক্ষতির প্রকারে পার্থক্য থাকলেও বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোও রয়েছে চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাবের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্প্রতি গবেষকরা জানিয়েছেন। তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার নারীদের গর্ভের সন্তান মারা যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কারণ হিসেবে বলছেন, মাটিতে বাড়ছে লবণাক্ততার পরিমাণ। ফসল নষ্ট হচ্ছে, মরে যাচ্ছে মিঠা পানির মাছ, কমে যাচ্ছে বিশুদ্ধ খাবার পানি। সেই লবণাক্ত পানি পানের কারণেই বাড়ছে রোগ আর গর্ভের সন্তানের মৃত্যু ঝুঁকি। দুই সপ্তাহ ব্যাপী এই সম্মেলনের এবারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্যারিসে স্বাক্ষরিত চুক্তি বাস্তবায়নে একটি নীতিমালা তৈরি করা। কিভাবে প্যারিস চুক্তিটি দেশগুলো বাস্তবায়ন করবে তা নির্ধারণ করার জন্যই এই রুলবুক বা নীতিমালা করাটা অত্যাবশ্যক বলে মনে করছেন অংশগ্রহণকারী প্রতিনিধিরা।

পরিবেশবিদরা বলছেন আবহাওয়ার চরিত্র দীর্ঘ অনেক বছর যাবৎ বদলাচ্ছে। ষড় ঋতুর এই দেশে এখন ছয়টি ঋতু আলাদা করা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। রীতিমত নাম গুণে বের করতে হয় কিন্তু দেখা মেলে না। কারণ যখন যে আবহাওয়া থাকার কথা তখন তা থাকছে না। শীতের সময়ে খুব অল্প সময় শীত অনুভূত হয়। যখন গরম আসার কথা তখন শীত থাকে। অতিবৃষ্টি অনাবৃষ্টি তো আমাদের লেগেই আছে। প্রকৃতি তার চরিত্র পাল্টাচ্ছে। আমরাও প্রকৃতির খেয়ালের সাথে নিজেদের প্রস্তুত করে নিচ্ছি। কিন্তু ক্ষতি পোষাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশ্বের ৪০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণকারী দেশ হলো চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। আমরা মূলত এরকম বড় বড় শিল্পোন্নত দেশের কার্বন উৎপাদনের ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার। তার সাথে রয়েছে নিজেদের ভারসাম্যহীনতা। সব মিলিয়ে অবস্থা যে ভজঘট সেটা বোঝা যায়। আমরা পরিস্থিতির স্বীকার। কিন্তু তাই বলে বসে থাকার উপায় নেই। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী আমাদের কাজ এগিয়ে নিতে হবে। যদি এটা মনে করি যে, এই ভূমিকা সরকার একা করবে তাহলে এটা ভুল চিন্তা। নিজেদের উদ্যোগেও কাজ শুরু করতে হবে। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশগুলো আশাবাদী ছিল যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় উন্নত দেশগুলোকে আমরা পাশে পাবো। যদিও এই জলবায়ু পরিবর্তনে আমাদের দেশের দায় তুলনামূলকভাবে কম কিন্তু ফল ভোগ করছি আমরাই বেশি। বিশ্বের ১৮০টি দেশের সমর্থনে করা প্যারিস জলবায়ু চুক্তির বাংলাদেশের মত জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্থ দেশগুলোকে আর্থিকভাবে সহায়তা করা। যে অর্থ ঝুঁকি মোকাবেলায় কাজ করতে পারে। তবে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চুক্তির প্রতি নেতিবাচক মনোভাবের কারণে এই জলবায়ু চুক্তি ঝুঁকির মুখে পরেছে বলে পত্রপত্রিকায় এসেছে। কিন্তু আমরা এই চুক্তির বাস্তবায়ন চাই।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশগুলোর একটি। প্রতিবছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রাণহানি ঘটার পাশাপাশি বাস্তুচুত্য হচ্ছে অগণিত মানুষ। সেসব মানুষ শহরমুখী হওয়ার কারণে চাপ বাড়ছে শহরের উপর। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, কালবৈশাখি, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডোসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নির্দিষ্ট করে বললে, গত ১০ অক্টোবরে হারিকেন ‘মাইকেল’ যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য ফ্লোরিডায় আঘাত হানে। সেপ্টেম্বর মাসের ২৮ তারিখে ইন্দোনেশিয়ায় ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। কয়েকদিন আগেই ভারতের তামিলনাডু উপকূলে ঘূর্নিঝড় ‘গাজা’র আঘাতে ২৫ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। পরিবেশ নিয়ে গবেষণা বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করে আসছে। পরিবেশের পরিবর্তিত প্রভাব নিয়ে চলছে নানা ধরণের সাবধানবাণী। আমাদের জলবায়ুর ক্রমাগত পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে বোঝানোর চেষ্টা চলছে। যখন শীত আসার কথা তখন না এসে শীত আসছে দেরীতে। আবার যখন বৃষ্টি হওয়ার দরকার তখন না হয়ে অসময়ে প্রচুর বৃষ্টি হলো। অনেকদিন থেকেই শোনা যাচ্ছে পৃথিবীর আবহাওয়া বিরূপ হতে শুরু করেছে। বদলে যাচ্ছে জলবায়ু। জলবায়ু পরিবর্তনের লক্ষণগুলো ক্রমেই প্রকৃতিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পরিবেশ বিপর্যয়জনিত কারণে সবচেয়ে দুর্ভোগে যে দেশ পরবে তার মধ্যে প্রথম সারিতেই বাংলাদেশের নাম রয়েছে। আমাদের দেশ নিয়ে চিন্তা তো আমাদেরই হবে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির যে প্রবণতা তার জন্য সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়ার মত হুমকী বহন করছে। ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় ঘটাতে পারে। তাছাড়া এর জন্য আমাদের মত নিচু দেশগুলির একটা বিরাট অংশ সাগরের পানিতে হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কার বিষয়ে বিজ্ঞানীদের হুশিয়ারী রয়েছে। লবণাক্ততার বিরূপ প্রভাব পড়বে ফসল উৎপাদনে। যা খাদ্য ব্যবস্থার জন্যও ভযাবহ ফলাফল বহন করতে পারে।

পরিবেশের বিরূপ অবস্থার সাথে লড়াই করার মত পর্যাপ্ত সামর্থ আমরা এখনো অর্জন করতে পারিনি। বিগত বছরগুলোতে আইলা বা সিডর বা নার্গিসের মত প্রলয়ঙ্করী প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতির দিকে তাকালে সহজেই আমরা তা অনুমান করতে পারি। আজও সেসময়কার ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। সেই সংগ্রামের রেশ থামতে না থামতেই আবারো নতুন কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের উৎপত্তি হচ্ছে। নিত্যনতুন নাম আর ভয়ঙ্কর চেহারা নিয়ে আমাদের সাজানো গোছানো সংসারকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে যাচ্ছে। যখনই সংকট সামনে এসেছে তখনই আমরা এ নিয়ে মাথা ঘামিয়েছি। তারপর ধীরে ধীরে সেই বিষয়টা আমরা ভুলতে থাকি। শুধু সেইসব মানুষের মনে দাগ থেকে যায় যারা এর শিকার হয়েছে। বহু বছর তারা এর ক্ষতচিহ্ন বহন করে। তারপর যখন সবকিছু তারা কাটিয়ে উঠে দাঁড়ায়, তখন হঠাৎ আবারো কোন নতুন দুর্যোগের কবলে পরে। জার্মান ওয়াচ তাদের গবেষণায় বলছে বাংলাদেশে প্রতিবছর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ৮২৪১ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। সিডর, খাইমুর, নার্গিস, আইলার মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলাতে আমাদের হিমশিম খেতে হয়েছে। সেসব ক্ষয়ক্ষতি কাটাতে বছরের পর বছর সময় লেগে যাচ্ছে। এর ভেতরেই নতুন নতুন দুর্যোগ হানা দিচ্ছে। গত বছর বজ্রপাতেই মারা গিয়েছিল ১৪২ জন। যার সংখ্যা দুই দিনেই ছিল ৮২ জন। এরকমটা অতীতে দেখা যায়নি। তাই বজ্রপাতও নতুন দুর্যোগ রূপে আবির্ভূত হয়েছে। এবছর চৈত্রের শুরু থেকেই বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা শুরু হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিভিন্ন সময় প্রচুর মানুষ মারা গেছে। ১৯৭০ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় ১০ লাখ লোক মারা গিয়েছিল। আর পার্শ্ব ক্ষয়ক্ষতি তো ছিল আরও ভয়ঙ্কর। ১৯৯১ সালের ঝড়ে প্রায় দেড় লাখ লোক নিহত হয়েছিল। তাছাড়া ১৯৮৮, ১৯৯৮ সালের বন্যাতেও যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আর কয়েক বছর ধরে সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম ভূমিকম্প। যা মোকাবেলা করার শক্তি আমাদের একেবারেই অপর্যাপ্ত। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পৃথিবী প্রাণীকুলের বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পরছে। টিকে থাকা রীতিমত হুমকিতে পরিণত হচ্ছে। জলবায়ু স্বাভাবিক মাত্রায় ফিরিয়ে আনতে ২৪ তম জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের রুল তৈরি করলে তা হবে পৃথিবীতে টিকে থাকা প্রাণীকুলের জন্য মঙ্গলজনক।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়