ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

যুক্তরাষ্ট্রের শাট ডাউন ও বিভেদের দেয়াল

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪৮, ১৬ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যুক্তরাষ্ট্রের শাট ডাউন ও বিভেদের দেয়াল

অলোক আচার্য: ক্ষমতার মসনদে বসার পর থেকেই ট্রাম্প বিশ্বে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন। তার ক্ষমতা গ্রহণের পরেই অভিযোগ ওঠে মার্কিন মুলুকের নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের বিষয়ে। ট্রাম্প অবশ্য এ কথা বরাবরই অস্বীকার করে এসেছেন। যদিও রাশিয়ার সঙ্গে প্রথম দিককার সেই সুসম্পর্ক এখন নেই। গণমাধ্যমের সঙ্গেও তার সম্পর্ক সুখের নয়। সাংবাদিকদের সঙ্গে তাকে বহুবার বিতর্কে জড়াতে দেখা গেছে।

তবে এ কথা ঠিক, মার্কিন মুলুকের নির্বাচন নিয়ে এতো সমালোচনা এর আগে সম্ভবত আর কোনো নির্বাচনে হয়নি। জলবায়ু ফান্ডে অর্থায়ন, অভিবাসী ইস্যু প্রভৃতি বিষয় নিয়ে একের পর এক সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন তিনি। নারী কেলেঙ্কারী নিয়েও গত বছর বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম খবর তার বিরুদ্ধে প্রকাশিত হয়েছে। তার কারণে বা সিদ্ধান্তে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেয়া বা দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে এটা স্পষ্ট যে, সহকর্মীরাও তাকে নিয়ে দোলাচলে থাকেন। সেখানেও একটি অস্থিরতার বলয় তৈরি হয়েছে।

বিশ্ব পরাশক্তির সঙ্গে ট্রাম্পের কখনো সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে, আবার পরমুহূর্তেই দেখা গেছে তিনি সমালোচনায় বিদ্ধ হচ্ছেন। গত বছরের পুরোটা সময় চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য যুদ্ধ লেগে ছিল। শুল্ক এবং পাল্টা শুল্ক আরোপের ভেতর দিয়েই গেছে বছরটা। এতে কোনো পক্ষেরই মঙ্গল হয়নি। বরং বিশ্বের এই বড় দুই পরাশক্তির বাণিজ্য যুদ্ধে পরোক্ষভাবে অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি হয়েছে। তবে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে ট্রাম্প ইতিবাচকভাবেই অগ্রসর হয়েছেন। প্রথম দিকে যেভাবে উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়েছে তাতে বহুবার যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত দুই দেশ সাময়িক শান্ত হয়েছে। দুই দেশের জন্যই এটি বড় একটি কূটনৈতিক অগ্রগতি। মার্কিন লেখক সাংবাদিক মাউকেল উলফ ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে ‘ফায়ার অ্যান্ড ফিউরিয়াস’ নামে একটি বই লিখেছেন। বইটি ইতিমধ্যেই বিস্ফোরক তকমা পেয়েছে।

অঘটনঘটনপটিয়সী ট্রাম্প এরপরও শান্ত হননি। অবশেষে মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল তৈরি নিয়ে তার সঙ্গে ডেমোক্র্যাটদের দ্বন্দ্ব এবং তার ফলশ্রুতিতে অতীতের রেকর্ড ধরে সেখানে শাট ডাউন অবস্থা চলছে। শাট ডাউন হলো মার্কিন সরকারের কিছু কাজ বন্ধ হওয়া। এতে বিনা বেতনে সরকারি চাকুরিজীবিদের কাজ করতে বাধ্য করা হয়। স্বাভাবিকভাবেই এজন্য অনেক প্রতিষ্ঠানে নেতিবাচক প্রভাব পরবে। এর আগেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শাট ডাউনের মুখোমুখি হয়েছিল। তবে তা এতদিন ধরে নয়। মার্কিন ইতিহাসে শাট ডাউন অবস্থা শুরু হয় ১৯৭৬ সালে। এরপর বিভিন্ন সময় সে দেশে শাট ডাউন বা সরকারের আংশিক অচালবস্থার সৃষ্টি হয়। সবচেয়ে দীর্ঘ সময় শাট ডাউন হয়েছিল প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সময়ে (২১ দিন)। তবে সেই রেকর্ড এবার ভেঙে গেছে। শাট ডাউনের ফলে প্রথম দিকে জণগণের ক্ষোভের আঁচ না পেলেও ধীরে ধীরে দীর্ঘ উত্তাপ ছড়িয়ে পরছে। কারণ ট্রাম্প এবং ডেমোক্র্যাটদের মুখোমুখি অবস্থানের কারণে সৃষ্ট এ অচলাবস্থায় সে দেশের আট লাখের বেশি কর্মী বেতন পাচ্ছেন না। এসব কর্মী ইতিমধ্যেই বেতনের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন। বেতন না দিয়ে চাকরি করতে বাধ্য করার ঘটনাকে অমানবিক উল্লেখ করে সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে আমেরিকান ফেডারেশন অব গভর্নমেন্ট এম্পলয়িজ।

অভ্যন্তরীণ আয়কর বিভাগ তাদের বেতন বন্ধ করে দিয়েছে। বেতন বঞ্চিতরা দেশটির কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। কিন্তু এসব বিক্ষোভে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তে কোনো প্রভাব পরবে বলে মনে হয় না। বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, এই শাট ডাউনের ফলে অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা জানুয়ারিতে ৫ লাখ মার্কিনী কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হবেন। ফলে বেকারত্বের হার ৪ ভাগে দাঁড়াবে। সেই সাথে কমে আসতে পারে প্রবৃদ্ধির হারও।

মোট কথা দীর্ঘতম এই অচলাবস্থার কারণে দেশটি বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তর সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। এমনকি সেবা খাতগুলোও এই শাট ডাউনের কবল থেকে মুক্ত নয়। এই সমস্যার সমাধান কোন পথে রয়েছে তা নিয়ে সাধারণ মার্কিনীদের মাথা ব্যথা থাকলেও কর্তৃপক্ষের নেই। কারণ ট্রাম্পের সাথে ডেমোক্র্যাটদের সম্পর্ক মোটেই ভালো নয়। কারণ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতিমধ্যেই নিজের অনড় অবস্থান জানিয়ে দিয়ে এই অচলাবস্থা মাসের পর মাস এমনকি বছর পর্যন্ত চালিয়ে যাবার হুমকি দিয়েছেন। যদি সত্যিই এই অচলাবস্থা আরও দীর্ঘায়িত হয় তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাছাড়া সীমান্তে দেয়াল নিমার্ণের বিষয়ে একমত না-হওয়া এই সমস্যাকে দীর্ঘায়িত করবে। ডেমোক্র্যাটরা মনে করছেন, দেয়াল নির্মাণের চেয়ে আরো অনেক জরুরি বিষয় রয়েছে। একদিকে তার নির্বাচনী প্রতিজ্ঞা অন্যদিকে বিরোধীদের শক্ত মনোভাব শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সময়ই বলে দেবে। তিনি তার সিদ্ধান্তে এতটাই অটল যে জরুরি অবস্থা জারি করে মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ চালিয়ে যাওয়ারও হুমকি দিয়েছেন। মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ করা ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনী অঙ্গীকার। তিনি এই দেয়াল নির্মাণের খরচ বাবদ অর্থ মেক্সিকোর কাছে দাবি করেছিলেন। কিন্তু মেক্সিকো সে দাবি প্রত্যাখান করেছে। এ থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত থেকে সহসাই পিছু হটছেন না। ডেমোক্র্যোটরাও সহজে ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত মেনে অর্থ ছাড় করাবেন বলেও মনে হয় না।

সম্প্রতি রিপাবলিকান দলের সাবেক প্রেসিডেন্টপ্রার্থী মিট রমনির সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। রমনি তাকে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনের যোগ্য নন বলে মন্তব্য করেছেন। অপরদিকে ট্রাম্প বলেছেন, ভোটে তিনিই জিতে এসেছেন, রমনি নন। এরকম ঘরে-বাইরে ট্রাম্প সমালোচনার শিকার হচ্ছেন। তবে প্রথম থেকেই সব সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, এই অচলাবস্থা যদি দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে তাহলে মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ করতে গিয়ে নিজ দেশেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মানুষের মনের মধ্যে তার বিরুদ্ধে দেয়াল তুলে দেবেন কিনা? এই দেয়াল শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হয় কিনা তাই এখন দেখার বিষয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়