ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

চট্টগ্রামে দুর্গাপূজা || অজয় দাশগুপ্ত

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০০, ৮ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চট্টগ্রামে দুর্গাপূজা || অজয় দাশগুপ্ত

চট্টগ্রামের দুর্গাপূজা দেশের অন্য এলাকার চাইতে অধিক জমজমাট। এর মূল কারণ বাণিজ্যনির্ভর এই শহরের আর্থিক স্বচ্ছলতা। জন্ম থেকে দেখেছি কি জাঁকজমক আর উৎসবমুখর এই শারদ উৎসব! আমাদের ছেলেবেলায় চাটগাঁর বড় বড় পূজা হতো অবাঙালি হিন্দু বাড়িতে। ব্যবসা ও বন্দর এই শহরে নানা দেশের মানুষকে টেনে এনেছে। ভারতীয় মাড়োয়ারী খাতুন গঞ্জের প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী কানাই লাল মাড়োয়ারীর পূজা ছিলো দেখার মত। লোক লোকারণ্য সেই পূজায় ঢুকতে হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। রাতভর মানুষের ভিড়ে এই পূজা ছিলো আনন্দের উৎস। মনে পড়ে পূজা আসা মানেই নগরীর জেগে ওঠা। পাড়ায় পাড়ায় ব্যানার, বোর্ড আর দেয়াল লিখনে চট্টগ্রামের পূজা আসতো শরতের হিম হাওয়ায়।

সেই হিম হিম আবেশ বা আবহাওয়া কোনটাই এখন আর নেই। তখন এখনকার মতো দোকানপাট বা শপিং মল ছিলো না। বাড়ি বাড়ি ঘুরে কাপড় বিক্রি করা সেইসব ফেরিওয়ালাদের এখন মনে হয় স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। কাঁধে নিয়ে আসা বিশাল কাপড়ের ভাণ্ডার খুলে ধরতো তারা। কি নিপুণ হাত! অতো বড় বড় শাড়ি ভাঁজ খুলে অনায়াসে দেখিয়ে দিতেন। আবার গুটিয়ে নিতেন ভাঁজসহ। তারা ছিলেন আমাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। সার্ট প্যান্টের কাপড়ও বিক্রি করতেন। আমরা অধীর আগ্রহে ধৈর্য ধরে থাকতাম কখন তারা আসবেন। কোন কাপড় দিয়ে সার্ট হবে, আর কোন দর্জি বানিয়ে দেবেন-এসবই ছিলো  আবেগের বিষয়।

তখনকার দিনে  সর্বজনীন পূজা ছিলো হাতে গোণা। অল্পকিছু এলাকায় হতো। বাকী সব মন্দির মঠে। সদরঘাট কালীবাড়ি রাজরাজেশ্বরী কালী বাড়ির প্রতিমা ছিলো দৃষ্টিনন্দন আর বিশাল। তাদের সাথে পেরে উঠতো না কেউ। তাদের পটুয়া মৃৎশিল্পীদের নির্মিত প্রতিমার সাথে টেক্কা দিতে পারতো না কেউ। অনেক কাল পর রাধেশ্যাম পাল নামের এক মৃৎশিল্পী তাদের ভার লাঘব করেন।এসব বহিরাঙ্গিক কথা। মূলত পূজা আসতো মানুষের মনে। সত্যি বলছি, এখনকার মতো বাণিজ্যিক পূজা ছিলো না তখন। পরে এমন হলো- সব এলাকায়, সব গলিতে একটি করে পূজা চালু হয়ে গেলো। একদিক থেকে এটি যেমন আনন্দের, আরেকদিকে এর ভেতর ছিলো এলাকাগত প্রতিযোগিতা। আমাদের নন্দনকানন গোলাপ সিংহ লেইনে পূজা হতো না বলে আমরা তরুণেরা মিলে ঠিক করেছিলাম আমরাই করবো পূজার আয়োজন। একুশ, বাইশ বছরের তরুণদের এই ইচ্ছা পূরণ হয়েছিল আর্থিক স্বচ্ছল চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের কল্যাণে।

চট্টগ্রামের পূজায় রাজনীতি এলো পঁচাত্তরের পর। তখন দেশের রাজনীতির দুটো ধারার প্রভাব পড়লো পূজাতেও। যেদিকে প্রয়াত মেয়র মহিউদ্দীনের লোকজন সেদিকের পূজায় আওয়ামী আওয়ামী ভাব। যেদিকে আবদুল্লাহ আল নোমানের লোকজন সেদিকে বিএনপি বিএনপি গন্ধ। বলাবাহুল্য এসব বিভাজনে দুর্গা বা মানুষের কিছুই এসে গেলো না। তারা সব মণ্ডপে সব আয়োজনে উৎসবের আমেজ নিয়ে হাজির। গোল বাধলো যখন দেশের রাজনৈতিক আকাশে দুর্যোগ হয়ে উঠলো সাম্প্রদায়িকতা। আমি একথা হলফ করে বলতে পারি- চাটগাঁ শহরে  স্বাধীনতার পরপর পরিকল্পিতভাবে মূর্তি ভাঙার পর আর কেউ তেমন করার সাহস পায়নি। মাঝে মাঝে উত্তেজনার ঢেউ বয়ে যেতো বৈকি। কিন্তু এমন এলাকাও চট্টগ্রামে আছে যেখানে দাঙ্গাবাজদের টাকা-পয়সা দিয়েও ঢোকানো যাবে না। সেখানকার হিন্দু-মুসলমান মিলেই ঠেকিয়ে দেবে অসুর আক্রমন।

এখানকার পূজার আরেক বড় দিক আতিথেয়তা। আপনি দেওয়ানজী পুকুর পাড়ে যাবেন আর প্রসাদ ছাড়া ফিরে আসবেন এমন হতে পারে না। আপনি জেএম সেন হলে যাবেন আর একটা পূজা দেখবেন এমনও হবে না। এই জেএম সেন নিজেই বিখ্যাত মানুষ। তাঁর নামের এই হলটির মাঠেই নীরবে আছেন সূর্য সেন। তাঁর মূর্তিটি কাল মহাকাল দেখে চলেছে নীরবে। ড. অনুপম সেনের নেতৃত্বে পূজা হয়েছে এখানে। যেবার মূর্তি না গড়ে প্রতিবাদী পূজা হবার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল, সে-বছর আমরাও সেখানে ছিলাম প্রতিবাদের জন্য।দুর্গার ভেতর দিয়ে শক্তি ও শৌর্য ফিরিয়ে আনার সেই দিনগুলো ভোলার নয়। চট্টগ্রামের কৈবল্যধাম চট্টেশ্বরী কালী মন্দির এমন সব প্রতিষ্ঠানগুলোয় যে সাত্ত্বিক পূজা তার তুলনা নাই। এই শহরের রামকৃষ্ণ মিশনে অষ্টমীর কুমারী পূজা সংস্কৃতির এক অনুপম অনুষঙ্গ।

আর বিসর্জন? সেও এক মহা আনন্দ আর বেদনার সম্মিলন। কর্ণফুলীর তীর থেকে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় প্রতিমা বিসর্জন আপনি না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না। বিকেল থকে দলে দলে মানুষের ভিড় আর ট্রাকে গাড়িতে আসা প্রতিমায় জনজীবন অচল হয়ে পড়ে। দূর দূরান্তের প্রতিমা বিসর্জনের আবহে আকাশ বাতাস ভারী  হয়ে ওঠে শহরের। এ যাত্রা পরের বছরের আগমনী আর আনন্দের উৎসমুখ। যা চলে আসছে কালের পর কাল।  যার সাথে আর কিছুর তুলনা চলে না। আনন্দ উৎসব আর বিসর্জনের এক অদ্ভুত সমন্বয়ে জেগে ওঠা চট্টগ্রাম সারাবছর ধৈর্য ধরে থাকে আশ্বিন ও শরত আসবে বলে।

সাম্প্রদায়িক সংহতি মিলনের এক মহামিলন মেলা দুর্গাপূজা। যা চট্টগ্রামে তার আপন মহিমায় আপন গৌরবে নিজের মত করে পালিত হয়ে আসছে। আর সব শহর বা জেলার চাইতে সংখ্যায় অধিক মানে বাড়ন্ত নিজের স্বতন্ত্র ভাষা ও খাবারের কারণে তার বৈশিষ্ট্য ঠিক তার মতো। সিঁদুরে রাঙানো নারী, ধুতি পাঞ্জাবি পরা বাবু, বাচ্চাদের উজ্জ্বল পোশাকে ভরে ওঠা এই পূজার আনন্দ একেবারেই অন্যরকম। এর রেশ, এর আনন্দ চলে আসছে, চলতে থাকবে। বুঝুন আর না বুঝুন, দেখবেন হাসিমাখা মুখে কেউ না কেউ আপনাকে ডাকছে: ইন্দি আইয়ুন। আঁরার পূজাত আইস্‌সন প্রসাদ ন ল ইয়েরে কেনে যাইবেন ওয়া। আঁরার দেবী গোস্বা ন অ ইবো না? এই আতিথেয়তা, এই আবেদন, এই আহবান আমাদের শহর ও পূজাকে অনন্তকাল ধরে রাখবে। এটাই সত্য। 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়