ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

বিভিন্ন সভ্যতার সিংহবাহিনী দেবী || অদিতি ফাল্গুনী

অদিতি ফাল্গুনী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২২, ৯ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিভিন্ন সভ্যতার সিংহবাহিনী দেবী || অদিতি ফাল্গুনী

সিংহের অনুষঙ্গ শক্তি, ক্ষমতা এবং নিরাপত্তার দিকটি ইঙ্গিত করে

আজকের দিনে সাপ হাতে এবং সিংহের পিঠে চড়া কোনো নগ্ন নারীপ্রতিমাকে আমরা আর যাই হোক ‘পবিত্র’ বলি না। তবে, তাম্র যুগে প্রাচীন মিশরে প্রাক-ইস্রাইলীয় এবং কান্নানাইত যুগে এমন এক দেবী বিগ্রহের সন্ধান আজো মেলে যিনি মিশর থেকে সিরিয়া অবধি সমভাবে পূজিতা হতেন। তাঁকে ‘কাদেশ (কুদশু)’ বলে ডাকা হতো। কে এই কাদেশ বা কুদশু? অনেকেই মনে করেন, কাদেশ হলো ‘আশতারত’ বা ‘আসতোরেথ’ নাম্নী কান্নাইতের প্রধানা দেবীর আর একটি নাম। ব্যবিলনে এই আশতারত-ই ‘ইশতার’ নামে সম্বোধিত হতেন; তাঁকে ‘শুকতারা’ ও ‘সন্ধ্যাতারার দেবী’ও ডাকা হতো। এই দেবীর সাথে ছিল সিংহের অনুষঙ্গ। গোটা মধ্যপ্রাচ্যে তাঁকে ‘আশেরাহ’ বা ‘দেবী মাতা’ হিসেবেও ডাকা হতো; ডাকা হতো ‘সিংহ রমণী’ নামেও।

ইতিহাসের যে সন্ধিক্ষণে মিশর তার পশ্চিম এশীয় যুদ্ধবাজ নেতা হিকসসদের হঠিয়ে কান্নাইতদের জয় করতে গিয়েছিল, তখনি কান্নাইতদের কাছ থেকে এই দেবী বিগ্রহের উত্তরাধিকার তারা পায়। মিশরীয় এবং কান্নান- এই উভয় দেশের চিত্র বা বিগ্রহেই এই দেবীকে দেখা যায় প্রেম ও প্রজননের প্রাচীন মিশরীয় দেবী হাথরের পাখা পরিধান করতে। সিংহবাহিনী কাদেশ বা কুদশু এখানে হাথরের সৌর গোলক এবং গরুর শিংও বহন করছেন। আসলে হয়তো কাদেশ এবং হাথর একই দৈবী নারীশক্তির চারিত্র বহন করতেন। প্রাচীন পুরাণের পরিভাষায় ফুল এবং নগ্নতা ছিল প্রজনন ক্ষমতার স্বাভাবিক প্রতীক; আর সাপকে প্রজ্ঞার সাথে মেলানো হতো। এমন চিত্রকল্প থেকে এটা প্রমাণিত হয় যে, আশেরাহকে শুরুতে কান্নাইতরা এবং পরে ইস্রাইলীরা ‘দেবী মাতা’ এবং ‘জীবন বৃক্ষ’ হিসেবে বন্দনা করতো। তবে আশেরাহকে কেন ‘সিংহ রমণী’ বলা হতো?

এমন প্রশ্নের উত্তর আজ এতদিন পর খুঁজে পাওয়া কঠিন। তবে আজ থেকে প্রায় ৬ হাজার বছরেরও আগে মিনোয়ান ক্রিট থেকে পশ্চিমে এবং আনাতোলিয়া থেকে উত্তরে মেসোপটেমিয়া (সুমের, ব্যাবিলন এবং আধুনিক ইরাক) অবধি সিংহবাহিনী দেবী বিগ্রহ প্রায়ই দেখা যেত। মিশরে প্রায় চল্লিশজন দেবীর সন্ধান পাওয়া যায় যাদের সাথে সিংহ বা বিড়াল পরিবারের অন্যান্য প্রাণী পরিবেষ্টিত দেখা যেত। কান্নাইত সভ্যতার চূড়ান্ত বিকাশের সময়ে স্বয়ং দেবী আশেরাহকে দেখা যেত সিংহবাহিনী বা সিংহবেষ্টিতা রূপে যখন গোটা অঞ্চলে ইস্রাইল ছিল শাসকের আসনে।  মধ্যপ্রাচ্যের এইসব সিংহবাহিনী দেবীর সাথে প্রায়ই বৃষ পরিবেষ্টিত কোনো পুরুষ দেবতাকে দেখা যেত। দেবী আশেরাহর বর বা পুরুষ সঙ্গী যেমন ছিলেন এল বা বৃষ দেবতা- কান্নাইতদের পিতৃপ্রতিম দেবতা।

পুরাণবেত্তা যোশেফ ক্যাম্পবেল সিংহকে রবি, বৃষ, চাঁদ এবং সাপের সাথে অনুষঙ্গ যুক্ত হিসেবে প্রমাণ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যে সেই দূর অতীতে ছিল সৌর দেবী এবং চান্দ্রেয় দেবতাগণ (পরে অবশ্য পাল্টে গিয়ে চান্দ্রেয় দেবী ও সৌর দেবতাদের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়)। এই সিংহবাহিনী দেবীরা অনেকেই ছিলেন যোদ্ধা। সিংহ-মস্তক সেখমেত একবার মিশরের সৌর দেবতার শত্রুদের সাথে লড়াই করেন আবার ভারতে সিংহবাহিনী দেবী দুর্গা দৈত্য বা অসুরদের সাথে যুদ্ধ করেন। সিংহের অনুষঙ্গ অবশ্যই শক্তি, ক্ষমতা এবং নিরাপত্তার দিকটি ইঙ্গিত করে। সিংহের উপস্থিতি নিশ্চিত করে যে, তারা কোনো ব্যক্তি বা স্থানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। সিংহ ছিল রাজা ডেভিডের গোত্র ‘জুদাহ’ গোত্রের প্রতীক।  হিব্রু বাইবেলে রাজা সলোমনের সিংহাসন হাতির দাঁতে আচ্ছাদিত, সোনায় মোড়ানো এবং হাতলদ্বয় সিংহ মূর্তি ক্ষোদিত ছিল। বাইবেলের বিবরণ মতে, সলোমনের সিংহাসনে যেতে ছয়টি সিঁড়ির ধাপ পার হতে হতো এবং বারোটি সিংহ এই ছয়টি সিঁড়ির উপর দণ্ডায়মান থাকতো (১০:১৮-২০)।  সলোমনের এই সিংহাসনের বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব ছিল কি, ছিল না সেটা অন্যপ্রসঙ্গ। তবে, সিংহাসনের পাহারায় সিংহের উপস্থিতি এমন কোনো নতুন ভাবনা নয়। রাজা সলোমনের আগে ও পরে, ইতিহাসের নানা সময় সলোমনকে দেবতা এবং রাজাদের পাহারা দিতে দেখা যায়। এমনকি চীন বা ইংল্যান্ডেও রাজ সিংহাসন পাহারা দেবার কাজে সিংহের উপস্থিতি নানা ছবিতে লক্ষ্য করা যায়। ব্যবিলনীয়, হিত্তিতসহ নানা আদি জাতির প্রাচীন সাম্রাজ্যের বড় নগরীগুলোর প্রবেশদ্বারে সিংহ পাহারা দিচ্ছে এমন সব বিগ্রহ থাকতো। বিভিন্ন ধরণের সিংহ বিগ্রহ নানা দেবতার রক্ষক হিসেবে প্রতিভাত হতো। প্রাচীন যুগের শিল্পকলায় মানবীয় মস্তক বা মানুষের মাথাসম্পন্ন তবে ডানাঅলা সিংহের দেখা মেলে- যারা কিনা বাইবেলে কথিত অমরাবতীর উদ্যান পাহারা দিতেন। পরে এই ডানাঅলা ও মানুষের মাথাবিশিষ্ট সিংহকে ‘দেবদূত’ হিসেবে মনে করা হতো। মানুষের মস্তকসম্পন্ন সিংহরূপী স্ফিঙ্কস আজো মহান পিরামিড পাহারা দেয়।

সবচেয়ে যেটা গুরুত্ববহ বিষয় তা হলো রাজা সলোমনের সময়ের বহু আগে থেকেই, এমনকি ‘রাজা’ নামক বিষয়টি মানবেতিহাসে শুরু হবার আগেই, প্রাচীন মানব সভ্যতার দেবীদের সুরক্ষায় থাকত যত সিংহ বিগ্রহ। সেই নিওলিথিক যুগের অস্পষ্ট অতীতেই আনাতোলিয়ার আদি কৃষক যে দেবীদের পূজা করতেন, সেই দেবীদের পাহারা দিতে থাকতো বিড়াল গোত্রের বড় প্রাণী সিংহ। প্রাচীন সভ্যতায় সিংহ ছিল এই দেবীদের সঙ্গী এবং অভিভাবক।

সিংহ নারীরা
আজকের তুরস্কে অবস্থিত এবং পৃথিবীর প্রাচীনতম নগরীগুলোর একটি ক্যাটাল হয়ুকে এক প্রাচীণা দেবীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। প্রায় ৮ হাজার বছর আগে এই দেবী প্রতিমার সৃষ্টি হয়েছিল (ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স)।


 

যদিও উপরের এই দেবীর সৃষ্টি হয়েছিল মানুষের লিখিত ভাষা সৃষ্টিরও আগে, আমরা এই ছবিতে দেখতে পাচ্ছি যে, তিনি একটি সিংহাসনে বসে আছেন- ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে। পাঁচ হাজার বছর পরে সলোমনের সিংহাসনে যেমন দুই হাতলে দুই সিংহের ছবি দেখা যায়, এই দেবীর সিংহাসনের হাতলেও তেমনি দুই সিংহের চিত্র। এই দুই সিংহকে কখনো কখনো চিতাবাঘও বলা হয়, তবে সিংহ বলেই তাদের বেশি প্রতীয়মান হয়। এই বিগ্রহ যখন তৈরি করা হয়, তখন এশিয়াটিক বা প্রাচ্যদেশীয় সিংহ পশ্চিম এশিয়ায় ঘুরে বেড়াত। খোদ ভারতের পূবদিকেও এই সিংহগুলো দেখা যেত। এবং আজো ভারতে প্রাচ্যদেশীয় সিংহের প্রায় ৪০০ বংশধর আজো আছে। এই ছবির সিংহ নারীটি দেবী আশেরাহ এবং আরো অন্য অনেক ‘দেবীমাতা’র মতোই নগ্ন। এই দেবীর নাম আজ আর জানা যায় না, তবে আমরা তাঁকে চিনতে পারি।

সিবিল
গ্রেকো-রোমান দেবী সিবিল দেবী ক্যাটাল হয়ুকের জন্মভূমি থেকেই এসেছেন। তবে তিনি এসেছেন আরো প্রায় ৬ হাজার  বছর পর। যদিও সিংহকে একটি ‘সৌর প্রতীক’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং সিংহবাহিনী দেবীদের প্রায়ই ‘সৌর দেবী’ হিসেবে ভাবা হয়, দেবী সিবিল কিন্তু ছিলেন মৃত্তিকা দেবী। আরো ভালো করে বললে পৃথিবীর দেবী। রোমকরা তাঁকে বলতেন ‘ম্যাগনা মাটের’ বা ‘মহা মাতা’, ‘পর্বত মাতা’ বা ‘দেবতাদের জননী’। প্রকৃতির দেবী হিসেবে তিনি ছিলেন বিভিন্ন মানব প্রজাতিরও রক্ষাকারীনী দেবী। তাঁর মস্তকের রাজমুকুট নগরীর প্রকার তোরণের প্রতিনিধি আর তাঁর রথে যোজিত সিংহগুলোও তাঁর সিংহবাহিনী দেবী সত্তারই প্রতীক। ২০০ অব্দে রোমে তাঁর পূজা শুরু হয় মূলত এই আশা থেকে যে তিনি দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধে অসীম পরাক্রমশালী নৃপতি হানিবলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রোম সাম্রাজ্য রক্ষা করবেন। যুদ্ধে হানিবল পরাজিত হন এবং রোমে দেবী সিবিলের উপর ভক্তি আরো বেড়ে যায়।

 

উপরের ছবিটিতে ব্যবিলনীয় সম্রাট নেবুচাঁদনেজার দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠিত ‘ইশতার তোরণে’র বাঁ দিকে একটি সিংহকে পাহারা দিতে দেখা যাচ্ছে। নেবুচাঁদনেজার দেবী ইশতারের নামে এই প্রাকার তোরণ প্রতিষ্ঠা করেন আনুমানিক ৬০০ অব্দে।  নেবুচাঁদনেজারই জুদাহ গোত্রকে জয় করেন এবং নিজ সাম্রাজ্যের আওতাধীনে নিয়ে আসেন। ইশতার- যাঁর নামে এই প্রাচীরের নাম তিনি ছিলেন প্রেম ও যুদ্ধের ব্যবিলনীয় দেবী।

দেবী ইনান্নার হাতে শেকলবন্দী এক সিংহ

 

আর নিচের ছবিতে রিলিফ চিত্রে দেখা যাচ্ছে যে ব্যবিলনীয় দেবী ইশতারের আগের প্রাচীন সুমেরীয় দেবী ইনান্নাকে যাঁর হাতে ধরা এক শেকলবন্দী সিংহ। মানবেতিহাসে সুমেরীয়রাই প্রথম আধুনিক সভ্যতার মাপকাঠিতে জটিল নগরকাঠামো, লিখিত লিপি এবং চাকা সৃষ্টিতে সক্ষম হয়। সময়টি ছিল সেই ৫ হাজার বছর আগে। সুমেরীয়রা বিশ্বাস করতেন যে, দেবীই জ্ঞানের দেবতা এনকির কাছ থেকে মানুষের জন্য অনেক জ্ঞানবাহী ধারাপাত বা লিপিচিত্র চুরি করে নিয়ে আসেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়