ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মধুপুরের আনারসের বাজার এখন দালাল-ফড়িয়াদের হাতে জিম্মি

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৮, ১৪ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মধুপুরের আনারসের বাজার এখন দালাল-ফড়িয়াদের হাতে জিম্মি

কেএমএ হাসনাত, মধুপুর থেকে ফিরে : প্রভাবশালী একশ্রেণির দালাল-ফড়িয়ার সিন্ডিকেটের কারণে প্রতিবছরই আনারসের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর গড়ের আশপাশ এলাকার কৃষকরা। ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হলেও এ পেশা ছাড়তে পারছেন না তারা। এই প্রতিবেদক সরেজমিনে দেখেছেন, মধুপুর জলছত্র হাটে যে আনারস ১৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে সেই আনারস ঢাকায় বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়।

জানা গেছে, চলতি বছর মধুপুর এবং এর আশপাশ এলকায় প্রায় সাড়ে ৮-১০ হাজার একর জমিতে কৃষক আনারস চাষ করেছেন। ফলনও ভালো হয়েছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় রোগবালাইয়ে আনারস নষ্ট হওয়ার হারও অনেক কম। আনারস উৎপাদনে ব্যয় বেড়েছে, কিন্তু সে তুলনায় দাম বাড়েনি।

 



আনারসের মৌসুমে প্রতিদিনই শত শত সাইকেল এবং রিক্সা-ভ্যানে করে বিভিন্ন এলাকা থেকে আনারস সংগ্রহ করে মধুপুরের জলছত্র হাটে নিয়ে আসেন কৃষকরা। কৃষকের কাছ থেকে কয়েক হাত ঘুরে দেশের বিভিন্ন স্থানে যখন এই আনারস পৌঁছে, তখন গ্রাকককে চার গুণের বেশি দামে কিনতে হয়। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আনারসের একটি বিশাল বাজার রয়েছে দেশজুড়ে। এটি অর্থকরী ফসলও বটে। অথচ যুগ যুগ ধরে সুষ্ঠু বিপণন ব্যবস্থার অভাবে এ পণ্যটির উৎপাদকরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব এলাকায় আনারস চাষ হয় তার বেশিরভাগই দুর্গম। এসব জায়গা এমনই দুর্গম যে উৎপাদিত আনারস বাজারজাত করা অত্যন্ত দুরূহ। ফলে শুরুতেই একশ্রেণির ফড়িয়ার খপ্পড়ে পড়তে হচ্ছে কৃষকদের। আনারস উৎপাদনের জন্য মূলধনের অভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আগাম বিক্রি করে দিয়ে টাকা সংগ্রহ করতে হয়। এসব ফড়িয়া আবার জমিতেই অনারস বিক্রি করে দিচ্ছে অন্যজনের কাছে। ফসলের মালিকানা বদল হলেও চুক্তি অনুযায়ী কৃষককেই ফসলের দেখভাল করতে হয়। বাগানে আনারস কাটার পর সেগুলো হাট পর্যন্ত পৌছে দিতে সাইকেল বা ভ্যান ছাড়া কোনো উপায় নেই।

 



সাইকেলে করে জলছত্র হাটে আনারস বহন করে আনা আনসার আলী বলেন, একটি সাইকেল বা ভ্যানে সর্বোচ্চ ১০৩টি আনারস বহন করা করা যায়। ১০০টি বিক্রির জন্য আর একটি হাট পরিষ্কারকর্মী এবং বাকি দুটি হাটের দালালদের জন্য। প্রতি শ’আনারস পরিবহনের জন্য ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা ভাড়া পাওয়া যায়।

আলাউদ্দিন নামের এক কৃষক নিজেই সাইকেলে করে আনারস এনেছিলেন বিক্রির জন্য। আনারসের আকার বেশ ভালো। তিনি প্রতিটি আনারস ২০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন। তিনি বলেন, হাটে এক ধরনের মানুষ আছে তারা জোর করে যে দাম দেন তাই নিতে হয়। তাদের মুখের ওপর প্রতিবাদ করা যায় না। প্রতিবাদ করলে ওই আনারস আর কেউ বিক্রি করতে পারবে না।

 



তিনি বলেন, প্রতিটি আনারসে ৬/৭ টাকা মুনাফা হয়েছে। এ দিয়ে সংসার চালবো কীভাবে আর পরবর্তীতে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় টাকাই বা রাখব কীভাবে?

আলাউদ্দিন যে আনারস প্রতিটি ২০ টাকা করে বিক্রি করেন তার চেয়ে অনেক ছোট একটি আনারস মিরপুর ১০ নাম্বার গোল চক্কর থেকে কয়েক দিন আগে কিনেছেন এমন একজন সঙ্গী ফটোগ্রাফার সাইফুল ইসলাম জানালেন, তিনি ৭০ টাকা দিয়ে এরকম আনারস কিনেছেন। অর্থাৎ যে আনারস মধুপুরের জলছত্র হাটে কৃষকরা ২০ টাকায় বিক্রি করছেন সেই আনারস রাজধানীর মিরপুরে বিক্রি হচ্ছে ৭০ টাকায়।

 



প্রকাশ্য দিবালোকে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট আনারস বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করলেও পুলিশ অবৈধ সিন্ডিকেট সদস্যদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে আনারস চাষিরা অভিযোগ করেছেন। মধুপুর গড় এলাকার শোলাকুড়ি, অরণখোলা, আউশনারা ও আলোকদিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১০ হাজার একর জমিতে আনারস আবাদ হয়ে থাকে। চাষিরা জানান, এ বছর আনারসের ফলনও হয়েছে ভালো। কিন্তু এলাকার একশ্রেণির প্রভাবশালী ফড়িয়া-দালাল এবং ট্রাক মালিক-শ্রমিকের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি সিন্ডিকেট মধুপুরের জলছত্র, টেলকি, মোটের বাজার ও গারোবাজারসহ আনারস বাজার নিয়ন্ত্রণ করায় চাষিরা আনারসের ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেন, ফড়িয়া-দালালরা কাঁচামাল ব্যবসায়ী নামে সমিতি গঠন করে নামমাত্র মূল্যে চাষিদের কাছ থেকে আনারস কিনছে। খুলনা, সিলেট, দিনাজপুর ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ব্যবসায়ীদের ফড়িয়ারা আনারস কিনতে দিচ্ছে না। বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীরা চাষিদের কাছ থেকে আনারস না কিনে ফড়িয়াদের কাছ থেকে আনারস কিনছে। এতে চাষিরা আনারসের উপযুক্ত দাম না পেলেও মধ্যস্বত্বভোগী ফড়িয়ারা বিপুল মুনাফা লুটছে। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, আনারস পরিবহনের জন্য বাইরের জেলা থেকে ভাড়া করা ট্রাক ব্যবহার করা হলে মধুপুরের ট্রাক মালিক-শ্রমিকদের ৮৫০ টাকা হারে প্রতি ট্রাকের জন্য চাঁদা দিতে হচ্ছে। আবার মধুপুরের ট্রাক ভাড়া করল প্রতি ট্রাক ২ থেকে ৩ হাজার টাকা অতিরিক্ত ভাড়া দিতে হয়। এতে দূরবর্তী জেলার ব্যবসায়ীরা অনেকটা জিম্মি হয়ে পড়েছেন এদের হাতে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ জুলাই ২০১৮/হাসনাত/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়