ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

দুবাইয়ে পাচারকৃত ১৬৫ কোটি টাকা সিঙ্গাপুর ও কানাডায়

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৭, ২৫ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুবাইয়ে পাচারকৃত ১৬৫ কোটি টাকা সিঙ্গাপুর ও কানাডায়

এম এ রহমান মাসুম : আরব বাংলাদেশ (এবি) ব্যাংকের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাতে পাচার হওয়া ১৬৫ কোটি টাকা এখন সিঙ্গাপুর ও কানাডায় পাচার হয়ে গেছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে এ সত্যতা পাওয়ার পর সেই অর্থ ফিরিয়ে আনতে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিআইএফইউ) সহায়তা চেয়েছে সংস্থাটি।

যদিও এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দুই দেশের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ উঠেছে। কেননা, প্রথম দফায় চিঠি দেওয়ার ৬ মাস পরও বিআইএফইউ কাক্ষিত নথিপত্র হাতে পায়নি। বিআইএফইউ দুদককে জানিয়েছে তারা সিঙ্গাপুর ও কানাডায় মামলা সংশ্লিষ্ট তথ্য উপাত্ত চেয়ে চিঠি দিলেও এখনো তা পাওয়া যায়নি। তারপর তদন্তের স্বার্থে এ সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বিআইএফইউকে তাগিদপত্র দিয়েছে দুদক। যেখানে মামলার তদন্তের প্রয়োজনে দুবাই, সিঙ্গাপুর ও কানাডায় পাচার হওয়া অর্থের বিষয়ে আরো কিছু তথ্য সংযুক্ত করে নথিপত্র চাওয়া হয়েছে।

২৪ অক্টোবর (বুধবার) দুদকের পরিচালক ও মামলার তদারককারী সৈয়দ ইকবাল হোসেনের সই করা ওই চিঠি বিআইএফইউর মহাব্যবস্থাপক বরাবর পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে তিনি সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে অভিযোগের তদন্তকারী কর্মকর্তা সহকারী পরিচালক মো: গুলশান আনোয়ার প্রধানের কাছে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট যে সকল রেকর্ডপত্র ও তথ্য সরবরাহের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেছেন সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণে পুনরায় অনুরোধ করেছেন।

অন্যদিকে তদন্ত কর্মকর্তা মামলার তদন্তের প্রয়োজনে দুবাই, সিঙ্গাপুর ও কানাডায় পাচার হওয়া অর্থ দুবাইয়ের ফাইন্যান্সিয়াল ইউনিটের (এফআইইউ) মাধ্যমে মামলা সংশ্লিষ্ট তথ্য জরুরি ভিত্তিতে সংগ্রহ করে দুদকে সরবরাহ করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান আনোয়ার প্রধান চিঠিতে যেসব নথিপত্র চেয়েছেন তা হলো-

১। সিংগাপুরস্থ পিনাকল গ্লোবাল ফান্ড (পিজিএফ) নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বাংলাদেশের এবি ব্যাংকের মধ্যে ২০১৩ সালের ২৬ নভেম্বর সম্পাদিত চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দুই ব্যক্তি যাদের পাসর্পোট নম্বর: এজিবিআর ৭৬১০৫৭৪৮৪ ও বিএ-৩৬৭৭৯০ এবং সাক্ষী আব্দুস সামাদ খানের পাসর্পোট নম্বর: বিএ-৩৭৮৪৯৭ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্যাদি ও রেকর্ডপত্রাদি।

২। সিংগাপুরস্থ পিনাকল গ্লোবাল ফান্ড (পিজিএফ) নামীয় কোম্পানি সংক্রান্ত সার্টিফিকেট অব ইনকরপোরেশন, উক্ত কোম্পানির শেয়ারধারী পরিচালকদের বিস্তারিত তথ্যাদি, ব্যাংক ট্রানজেকশন প্রোফাইল, মেমোরেন্ডাম, আর্টিক্যাল অব এসোসিয়েশন, নিবন্ধন সনদ, ক্রেডিট রির্পোট ও বিজনেস প্রোফাইল এবং কোম্পানি সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্যাদি ও রেকর্ডপত্রাদি। কোম্পানি বা কোম্পানির পরিচালকদের নামীয় ব্যাংক হিসাব বিবরণী।

৩। দুবাইস্থ এডিসিবি ব্যাংকের চেং বাও জেনারেল ট্রেডিং এলএলসি নামীয় কোম্পানির সার্টিফিকেট অব ইনকরপোরেশন, কোম্পানির শেয়ারধারী পরিচালকদের বিস্তারিত তথ্যাদি, ব্যাংক ট্রানজেকশন প্রোফাইল, মেমোরেন্ডাম, আর্টিক্যাল অব এসোসিয়েশন, নিবন্ধন সনদ, ক্রেডিট রির্পোট ও বিজনেস প্রোফাইল এবং এ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্যাদি ও রেকর্ডপত্রাদি, কোম্পানি বা কোম্পানির পরিচালকদের নামীয় ব্যাংক হিসাব বিবরণী, ওই প্রতিষ্ঠানের ২০১২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ব্যাংক স্টেটমেন্ট, এবি ব্যাংক লি: হতে দুবাই এর উক্ত হিসাবে ২০ মিলিয়ন ইউএস ডলার প্রেরণের পর যে বা যাদের অনুকুলে/মাধ্যমে উক্ত ডলার স্থানান্তর করা (ডিজবার্স) হয়েছে, তাদের বিস্তারিত তথ্য, কোন ব্যাংকের কোন একাউন্টে উক্ত ডলার পাঠানো হয়েছে তার স্টেটমেন্ট ও চেক বা পে-অর্ডার নম্বর  সংক্রান্ত তথ্যাদি।

এর আগে চলতি বছরের গত ৮ মার্চ তদন্ত কর্মকর্তা বিআইএফইউয়ের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) বরাবর পাঠানো চিঠিতে দুবাইয়ে পাচার করা অর্থের বিষয়ে তথ্য চাওয়ার অনুরোধ করেছিলেন।

তদন্ত কর্মকর্তা পাচার হওয়া অর্থ আরো দুই পদ্ধতিতে ফেরত আনার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। এর মধ্যে মিউচ্যুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠিয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে অর্থ ফেরত আনা। অন্যটি হচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দুবাইয়ে বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে সরাসরি সরকারের সাহায্য নিয়ে অর্থ ফেরত আনা। তবে এ দুই পদ্ধতি কার্যকর করতে সিঙ্গাপুর ও কানাডায় পাচার হওয়া অর্থের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য উপাত্ত প্রয়োজন। সেজন্যই দুবাইয়ের এডিসিবি ব্যাংকের কাছে পাচার করা ব্যাংক হিসাবের বিবরণী, ওই হিসাবে কী পরিমাণ টাকা পাঠানো হয়েছিল তার বর্ণনা ও অর্থ পাঠানোর পরে ওই হিসাব থেকে কোন কোন হিসাবে টাকা স্থানান্তর হয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে বিআইএফইইউয়ের সাহায্য চাওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘মূলত দুদক চাচ্ছে পাচার করা অর্থ যেকোনো উপায়ে বাংলাদেশে ফেরত আসুক। দুদকের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দোষীদের শাস্তির আওতায় আনার পাশাপাশি দেশের বা ব্যাংকের টাকা পুনরুদ্ধার করা। এজন্য সুনির্দিষ্ট তথ্যের জন্য বিআইএফইউয়ের কাছে এরই মধ্যে প্রথম দফায় চিঠি পাঠানো হয়েছে। ছয় মাস অপেক্ষার পর দ্বিতীয় দফায় আবারো তাগিদ দিতে চিঠি দেওয়া হলো। কারণ, সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া আমাদের অর্থ পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব।

দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ এ প্রসঙ্গে রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘পাচার বা আত্মসাৎ করা অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত আসুক- এই বিষয়টিকে দুদক সব সময়ে অগ্রাধিকার দেয়। আমাদের লক্ষ্য অপরাধীর সাজা পাওয়ার পাশাপাশি অর্থ যেন রিকভারি হয়। এরই মধ্যে এ বিষয়ে বেশ কিছু সফলতাও এসেছে।’

এদিকে দুদকে এবি ব্যাংকের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হক, প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম আহমেদ চৌধুরী, মো. ফজলুর রহমানসহ অর্ধশত কর্মকর্তাকে বিভিন্ন সময়ে তদন্তের স্বার্থে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক। এরই মধ্যে জিজ্ঞাসাবাদে এজাহারভুক্ত আসামিরা নিজেদের ভুল স্বীকার করেছেন বলে জানা যায়। তারাও চান যেকোনো উপায়ে হোক পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আসুক। এজন্য দুদককে সব ধরনের সহযোগিতা করবেন বলে আসামিরা জানিয়েছেন। দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র এসব কথা জানিয়েছে।

ভুয়া অফশোর কোম্পানিতে বিনিয়োগের নামে ১৬৫ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে গত ২৫ জানুয়ারি মামলা দায়ের করে দুদক। মামলায় মোট ৮ জনকে আসামি করা হয়। তারা হলেন এবি ব্যাংকের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এম ওয়াহিদুল হক, প্রাক্তন ব্যবস্থাপনা পরিচালক শামীম আহমেদ চৌধুরী, মো. ফজলুর রহমান, কর্মকর্তা আবু হেনা মোস্তফা কামাল, এবি ব্যাংকের হেড অব অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের (ওবিইউ) মোহাম্মদ লোকমান, হেড অব করপোরেট ব্যাংকিং মোহাম্মদ মাহফুজ উল ইসলাম, জ্যেষ্ঠ ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. নুরুল আজিম এবং এবি ব্যাংকের গ্রাহক আটলান্টিক এন্টারপ্রাইজের মালিক সাইফুল হক।

দায়ের মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া অফশোর কোম্পানিতে বিনিয়োগের নামে ১৬৫ কোটি টাকা এবি ব্যাংকের চট্টগ্রাম ইপিজেড শাখা থেকে দুবাইয়ে পাচার করে এবং পরে তা আত্মসাৎ করে। আত্মসাতকালে ওয়াহিদুল হক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন। কথিত ওই বিনিয়োগ এবং অর্থ আত্মসাতের নেপথ্যে ব্যাংকের গ্রাহক আটলান্টিক এন্টারপ্রাইজের সাইফুল হকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এক সময় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে কাজ করা সাইফুল হকের এবি ব্যাংকে কোনো অংশীদারিত্ব নেই। তবে তিনি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা মোরশেদ খানের মেয়ের স্বামী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, সাইফুল হক দুবাইয়ে থাকাকালে আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের সদস্য খুররম আবদুল্লাহ ও আব্দুস সামাদ খানের সঙ্গে তার সখ্য হয়। তিনি এবি ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান ওয়াহিদুল হকেরও পূর্বপরিচিত। সাইফুল হকই এবি ব্যাংকের অর্থপাচারের বিষয়ে ওই প্রতারক চক্রের সঙ্গে ‍ওয়াহিদুল হকের পরিচয় করিয়ে দেন। পরে দুবাই ও বাংলাদেশে একাধিকবার বৈঠক করেন তারা।

মামলার এজাহারে আরো বলা হয়, ওয়াহিদুল হক ও আবু হেনা মোস্তফা কামাল ব্যাংকের বোর্ডকে না জানিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে দুবাই গিয়ে প্রতারক চক্রের সঙ্গে বৈঠক করেন। আর ওই প্রতারক চক্র পিনাকল গ্লোবাল ফান্ড (পিজিএফ) নামে একটি কোম্পানি সৃষ্টি করে। সেই কথিত পিনাকলের ৮ কোটি ডলারের সঙ্গে এবি ব্যাংকের ২ কোটি ডলার মিলিয়ে ১০ কোটি ডলারের একটি তহবিল গঠন করে তা দুবাইয়ে বিনিয়োগের একটি কাল্পনিক প্রস্তাব তৈরি করা হয়। আবু হেনা মোস্তফা কামাল ও শামীম আহমেদের যৌথ স্বাক্ষরে ব্যাংকের বোর্ড সভায় উপস্থাপন করে তা পাস করিয়ে নেওয়া হয় ২০১৩ সালে। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুবাইয়ে চেং বাও জেনারেল ট্রেডিং এলএলসি নামের এক কোম্পানির নামে পাঠানো ওই ২ কোটি ডলার আবুধাবির একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যায়। সেখান থেকে পরে তা আত্মসাৎ করা হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছে মামলায়।

২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে অর্থ পাচারের ওই ঘটনা ঘটে বলে উল্লেখ করা হয়েছে মামলায়। মামলা দায়ের করার পর এম ওয়াহিদুল হকসহ তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করে দুদক। যদিও ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম ছাড়া বাকি আসামিরা জামিনে আছেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ অক্টোবর ২০১৮/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়