ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

কাঠমান্ডুর দিনকাল

শান্তা মারিয়া || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০০, ৩১ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কাঠমান্ডুর দিনকাল

(লক্ষ্মণরেখার বাইরে-২৩)

শান্তা মারিয়া: কাঠমান্ডুতে প্রথমবার গিয়েছিলাম উই ক্যানের সম্মেলনে। হোটেল এভারেস্টে ছিলাম সেবার। হোটেল এভারেস্ট পাঁচতারকা হোটেল। পাটনে হচ্ছিল পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোট উই ক্যানের সম্মেলন। সেখানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো অংশ নেয়। সব দেশের মতো বাংলাদেশের আলাদা স্টল ছিল। এই স্টলটি আমরা চারজনে মিলে সাজাই। আমাদের স্টলের সাজসজ্জা এবং পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধে বাংলাদেশে উই ক্যানের কাজ বেশ প্রশংসিত হয়।

সম্মেলনে আমি একটা সংক্ষিপ্ত পেপার উপস্থাপন করি। নেপালের টিভিতে সাক্ষাৎকার দেই। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আমরা দলবদ্ধভাবে এক ঘণ্টার একটি পরিবেশনা করি। সেখানে বাংলার মুক্তিযুদ্ধ, নারী নির্যাতন এবং সম্মিলিতভাবে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের বিষয়টিও তুলে ধরি। আমাদের গান, নাচ সবই প্রশংসা পায়। সেলিম ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে কোরাসে গান গাইতে গাইতে ভাবছিলাম আমার মতো বেসুরো মানুষকে নিয়ে গান গাইতে গিয়ে বেচারার না জানি কি অবস্থা হচ্ছে!

অনুষ্ঠানটি হয়েছিল পাটনে একটি বড় কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। জায়গাটা বেশ সুন্দর। নেপালের পাহাড়ি গাছগুলোর সৌন্দর্যই অন্যরকম। দ্বিতীয়বার ছিলাম হোটেল মারশিয়াংদিতে নেটজ বাংলাদেশের ওয়ার্কশপের জন্য। হোটেল মারশিয়াংদি থামেলে অবস্থিত মাঝারি মানের হোটেল। রুমগুলো বেশ সুন্দর করে সাজানো। সকালে ও দুপুরে বুফে খাবারটিও বেশ ভালো। মারশিয়াংদির খাবার ঘরের সামনে ছোট্ট উঠোন ছিল্, সেখানে কাঠের কারুকার্য করা বসার জায়গাগুলো ছিল চমৎকার।

আলাপ হয়েছিল মারশিয়াংদি হোটেলের বেশ কয়েকজন কর্মীর সঙ্গে। তাদের মধ্যে মনে আছে নীলিমার কথা। সদা হাস্যময় মুখ। সকালের স্নিগ্ধতাকে আরও যেন বাড়িয়ে দেয় তার প্রফুল্ল চাহনি। হোটেলের ফুড কর্নারে কাজ করেন নীলিমা। অফিশিয়াল ইউনিফর্ম পরা। দক্ষ হাতে খাবার পরিবেশনার তদারকি করছেন। প্রয়োজন পড়লে নিজেও পরিবেশন করছেন। বিবাহিতা, দুই সন্তানের মা নীলিমাকে দেখে তার বয়স বোঝার উপায় নেই। কর্মঠ এই নারী বেশ কয়েক বছর ধরে কাজ করছেন এই হোটেলের ডাইনিংয়ে।

কাঠমান্ডুতে দোকানে, হোটেলে, ব্যাংকে, অফিসে সর্বত্র চোখে পড়ে নীলিমার মতো নারীদের স্বচ্ছন্দ বিচরণ।

তবে একথা অনস্বীকার্য যে, নেপালের নারীরাও নানা রকম বৈষম্যের শিকার। পারিবারিক নির্যাতন রয়েছে, রয়েছে যৌতুকের সমস্যা। মাতৃমৃত্যু হারও অনেক বেশি। তবে নেপালের নারীরা এসব বাধা ক্রমশ কাটিয়ে উঠছেন। সার্বিকভাবে তারা প্রচণ্ড পরিশ্রমী। গ্রামাঞ্চলে তারা নানা রকম নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হলেও কাঠমান্ডু নারীর জন্য মোটামুটি নিরাপদ।



আগেই বলেছি ২০১৬ সালে আমি ছিলাম থামেল এলাকায়। এখানে পর্যটকের সংখ্যা অনেক বেশি। ফলে হোটেল রেস্টুরেন্ট রয়েছে প্রচুর। এসব হোটেলে অনেক নারী কাজ করছেন। মারশিয়াংদি হোটেলেই দেখলাম হাউসকিপিং, রিসেপশনসহ বিভিন্ন বিভাগে কাজ করছেন অনেক নারী। আলাপ হলো হাউসকিপিং বিভাগের কর্মী লক্ষ্মীর সঙ্গে। কঠোর পরিশ্রমী এই নারী দক্ষ হাতে পরিষ্কার করছেন, সাজিয়ে রাখছেন প্রতিটি কক্ষ। নিপুণভাবে পাতা কেটে ফুলসহ সাজাচ্ছেন ফুলদানিতে। বললেন, গত পনের বছর ধরে এই কাজ করছেন তিনি। পরিবারে তার স্বামীর সমান উপার্জন করেন তিনি। তার তিন সন্তানই স্কুলে লেখাপড়া করছে। হোটেল রিসেপশনে কাজ করছেন অনিতা। তিনিও হাসিমুখে অতিথিদের সেবা দিচ্ছেন। শিফটিং ডিউটি করেন তিনি। নাইট শিফটে ডিউটি থাকলে সেটাও পালন করেন ঠিক মতো।

কাঠমান্ডু শহরে অসংখ্য চায়ের দোকান, কফিশপ, ছোটখাটো রেস্টুরেন্ট চালাচ্ছেন নারীরা। এমনি একজন নারী সীতা। ছোট্ট একটি চায়ের দোকান চালান তিনি। বললেন, চাঁদাবাজি বা ও ধরনের কোনো ঝামেলা নেই। বিশেষ করে পর্যটন এলাকায় পুলিশ খুবই কড়া। কাঠমান্ডু শহরে ইভটিজিং বা এ ধরনের অপরাধ যথেষ্ট কম। থামেলে পায়ে পায়ে নাইটক্লাব, মদের দোকান, বার ইত্যাদি। কিন্তু মদ খেয়ে মাতলামি করছে কেউ এমন চোখে পড়েনি। ছিনতাই, নারীর প্রতি যৌন হয়রানি ইত্যাদি দিক থেকেও যতদূর দেখেছি কাঠমান্ডু মোটামুটি নিরাপদ। নেপাল যাবার পথে বিমানে আলাপ হলো নেপালের তরুণী নীরা এবং সুনীতার সঙ্গে। তারা ঢাকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্নাতক পর্যায়ে লেখাপড়া করেন। হোস্টেলে থাকেন। জানালেন, কাঠমান্ডুতে কখনও ইভটিজিংয়ের শিকার হননি তবে ঢাকায় মাঝেমধ্যে হয়রানির কবলে পড়েছেন।

কাঠমান্ডুতে দোকানে পুরুষের পাশাপাশি কাজ করছেন নারী বিক্রেতারা। অনেক ছোট ছোট দোকানে নারীরা নিজেরাই দোকান চালাচ্ছেন। আলাপ করে জানলাম, হয়রানির শিকার তেমন কখনও হতে হয়নি তাদের। কাঠমান্ডুর দরবার স্কোয়ার, শহরের উপকণ্ঠে পাটন বা ললিতপুর এবং শহর ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে পর্যটনকেন্দ্র ভক্তপুর। এখানেও প্রচুরসংখ্যক নারী ভ্রাম্যমাণ দোকান চালাচ্ছেন। ভিড়ের মধ্যেও নারীদের বিচরণ দেখে মনে হয় না তারা কোনোভাবে ইভটিজিং বা হয়রানির আশংকা করছেন। যাদের সঙ্গে পুরুষ সঙ্গী রয়েছে তারাও নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত বা তাদের আগলে রাখার চেষ্টা করছেন এমন কিছু চোখে পড়লো না। এসব দেখছিলাম আর মনে মনে ভাবছিলাম- কাঠমান্ডুর মতো ঢাকাতেও যদি পথেঘাটে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেত তাহলে আমাদের জীবন কত সুন্দরই না হতো!

নেপাল কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে আমাদের চেয়ে পিছিয়ে পড়া দেশ। শিক্ষাদীক্ষা, অবকাঠামোগত দিক থেকেও পিছনে। নারীর নিরাপত্তা অন্তত কাঠমান্ডু শহরে তারা নিশ্চিত করতে পেরেছে। কিন্তু আমরা ঢাকা শহরকেও নারীর জন্য নিরাপদ করতে পারিনি।

দারিদ্র্য এবং অবকাঠামোগতভাবে আমাদের চেয়ে পিছিয়ে পড়া একটি দেশ হলেও নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীতে আমাদের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে তারা। এই শহরে পর্যটকের অভাব নেই। বিশেষ করে থামেলে তো বিদেশিই বেশি। সেই বিদেশি পর্যটকের মধ্যে তরুণী, বৃদ্ধা, সুন্দরী, অসুন্দরী সব রকম নারীই আছেন। পোশাকও তাদের বিচিত্র রকম। শর্টস, স্লিভলেসও পরছেন তারা দেদার। কিন্তু শিশু, কিশোর, তরুণ, প্রৌঢ় কোনো বয়সের কোনো অবস্থানের নেপালি পুরুষই তাদের প্রতি কটাক্ষ, ইশারা, ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, মুগ্ধতা কিছুই প্রকাশ করছে না। তারা নির্বিকার। আমি শুধু ভাবছিলাম প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতবিক্ষত একটি দেশ অথচ সেই দেশের রাজধানীতে নারীরা কত স্বাধীন, কর্মচঞ্চল। ৪ সেপ্টেম্বর আমরা যখন দেশে ফেরার উদ্দেশ্যে ত্রিভুবন এয়ারপোর্টের দিকে যাত্রা করলাম তখন দেখি দলে দলে লাল রঙের পোশাক পরে মেয়েরা যাচ্ছে। কি ঘটনা? আমাদের গাড়ির চালককে জিজ্ঞাসা করে বুঝলাম সেদিন একটি বিশেষ উৎসব রয়েছে। সেই উৎসব শুধুই মেয়েদের। কাঠমান্ডুর পথে পথে তাই লালপোশাকে মুক্ত, স্বাধীন, হাস্যোজ্জ্বল নারীর বিচরণ। আহা, ফিরে আসার পথেও মনটা জুড়িয়ে গেল আরেকবার। এমন মুক্ত আকাশ, স্বাধীন জীবন বাংলাদেশের মেয়েরা কবে পাবে?



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ জুলাই ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়