ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

দেখে এলাম হিমালয়কন্যা নেপাল

মাহী ফ্লোরা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০২, ১৩ নভেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দেখে এলাম হিমালয়কন্যা নেপাল

মাহী ফ্লোরা: কখনো ধোঁয়ার মতো মেঘ, কখনো প্রাচীন দানবীয় রূপে মেঘেরা দখল করে আছে আকাশ। আকাশ থেকে দেখি পৃথিবী নীল। নীল আর নীল। সূর্য এলে রোদে পুড়ে যায় রং। ভাসতে ভাসতে পাখির চোখে দেখে নিই এই পুরনো হতে হতে নতুন হয়ে যাওয়া সময়। আলো মেঘ, ভালো মেঘগুলোকে দুচোখ ভরে দেখি। শাদা মেঘ, কাদা মেঘগুলোকে আপন করে দেখি। মেঘেদের এ যেন অন্য পৃথিবী। আকাশ যেন গভীর সমুদ্র, আর তাতে গা ডুবিয়ে ভেসে আছে শত শত মেঘ।

ভালো মেঘগুলো পেরুতেই এক ঝাঁক কালোমেঘ হামলে পড়ল। একবার তো অন্ধকার মেঘের ভেতর বৃষ্টিও হতে দেখলাম, জানালা ভিজে গেল, আমাদের লাল পাখাটাও। বৃষ্টি পেরিয়ে এলেই ঝকঝকে রোদ। আবার কিছু ফুল মেঘ। ফুলের মতো ভুল মেঘেদের তবুও ভাল লাগতে থাকে। নামছি নিচের দিকে। ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে সবুজ পাহাড়, উপত্যকা। নেপালের ঘরবাড়ি।

থামেল: কাঠমাণ্ডু এয়ারপোর্টে নেমে সব প্রক্রিয়া শেষে বাইরে বের হতেই একঝলক ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে গেল। ঝির ঝির বৃষ্টি। দূরে পাহাড়ের সারি। মেঘের সাথে যুদ্ধ করেই কিন্তু রিগেন্ট এয়ার ওয়েজের ২৪ তারিখ দুপুর ৩.১৫ তে বাংলাদেশ ছেড়ে আসা বিমানটি ল্যান্ড করছিল নেপালি সময় ৪.১৫-তে। বাংলাদেশ থেকে পনেরো মিনিট পিছিয়ে দিলাম আমার ঘড়ি। নেপালের জন্য শরীর মন প্রস্তুত, সময়টাকেও প্রস্তুত করে নেওয়া আর কি। এক ঘণ্টা দশ মিনিটে পৌঁছে গেলাম লর্ড বুদ্ধের দেশ নেপালে। মেঘের সাথে যুদ্ধটা আতঙ্কের হলেও রোমাঞ্চকর। থামেলে যাচ্ছি। বৃষ্টি হচ্ছে আবার ঝকঝকে রোদ। জায়গায় জায়গায় প্যাঁচপ্যাঁচে কাদা। লোকালয়ের ভেতর একটা পাহাড়ি নদীর সাঁকো পেরিয়ে এলাম। ভীষণ স্রোত। ঘোলা জলের স্রোত। দুপাড়ে গাছ ভেঙে নুয়ে পড়েছে। পাড় ভাঙছে নদীর। তবু সুন্দর।

 


চোখে হয়ত সব সৌন্দর্য ভর করেছে পাহাড় দেখার মোহে। এয়ারপোর্টের ট্যাক্সিচালক খুব চালাক। যেমনটা সব রাজধানী শহরেই হয়। সাড়ে তিনশ রুপির রাস্তা ছয়শ নেয় সেও দরাদরি করে। তবু ভালো লাগে। বিকেল পড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। একটা হোটেল ঠিক করে উঠে পড়লাম। সময়টা বর্ষাকাল বলেই গরম বেশি। তাই বলে কাঠমাণ্ডুতে এসেও এসির মধ্যে থাকতে হবে ভাবিনি। রমজান মাস। থামেলে মুসলমান আছে বেশ। মুসলমান ব্যবসায়ী, বাংলাদেশিও অনেক মেলে। বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে ঈদ, মন দু-একবার খারাপ হলেও সামনে যে দারুণ দিনের হাতছানি তাই হয়ত ভুলিয়ে দিচ্ছে বাকি সব। রোজা ছিলাম আমরা। সাতটা পাঁচ-এ ইফতার শেষে একটু গড়িয়ে নিচ্ছি। অন্ধকার শহর ডাকছে আমাদের। হোটেল থেকে বেরুতেই চারপাশে দোকান পাট, গলি-উপগলি গলাগলি করে জড়িয়ে আছে, পুরনো শহর যেমন হয়। ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে একটা দোকানে ঢুকে রাতের খাওয়া সেরে নিলাম। ভাত, সবজি আর মহিষের মাংস। রান্না ভালো ছিল। নেপালে খাবারের দাম অসম্ভব বেশি কিন্তু রান্না দারুণ মশলাদার আর স্পাইসি। পরের দিন কাঠমাণ্ডু শহর ঘুরে দেখব। উত্তেজনা আর সারাদিনের ক্লান্তি দুটোই সমান।

হোটেলে ফিরে এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সাড়ে তিনটায় সেহেরির শেষ সময়। সামনে একটা দীর্ঘদিন। শুরুটা গরম হলেও শেষ রাতের দিকে বেশ ঠান্ডা। লেপের ভেতর থেকে কোনোরকমে বেরিয়ে সেহরি করলাম দুজন। পরদিন বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে কাঠমাণ্ডুর ট্যুরিস্ট স্পটগুলো ঘুরে দেখার সিদ্ধান্ত। জুনের এই সময় বাংলাদেশের মতোই গরম, বৃষ্টি, কাদা, রাস্তা খুব একটা ভালো না। তবে দেশের সীমানা পেরোলেই একটা অন্যরকম গন্ধ। যেন অচেনা অন্যরকম। এ আমার দেশ নয় প্রতি মুহূর্তে মনে হতে থাকে। প্রথমে যাব আমরা নেপালের রাজদরবারে।

রাজদরবার: রাজদরবার শুনলেই কেমন একটা থ্রিল কাজ করে। পৌঁছে টিকিট কেটে ঢুকতেই কাঁধের ছোট ব্যাগটা লকারে রাখতে বললেন সিকিউরিটি গার্ড। তার আগে ঝটপট দূর থেকে ছবি তোলা হলো। ফোন, ক্যামেরা কিছুই রাখা যাবে না সাথে। আকাশ ভীষণ নীল। গাছের পাতা সতেজ। নেপালে প্রথম দিন। এখনো কিছুই দেখিনি। না দেখারা এত তাড়া দিচ্ছিল কিছুতেই তর সইছিল না। রাজদরবারে যাচ্ছি প্রায় অনেকটা মসৃণ পথ হেঁটে। সেদিন এক গাদা সিক্স সেভেন-এর বাচ্চাকাচ্চা রাজদরবার ভ্রমণে এসেছে। প্রত্যেকের হাতে একটা খাতা, একটা কলম। তাদেরও আমার মতো সবকিছুতে ভীষণ উৎসাহ। গাছের পাতা পর্যন্ত ছুঁয়ে দেখছে। পুরো সময় তাদের আশপাশে পেছনে সামনে থাকতে হলো।

 


কিছুদিন আগেও রাজার শাসন ছিল। আজ সেটা জাদুঘর। এ-ঘর, ও-ঘর যে ঘরেই যান আপনার আর পেছনে ফেরার সুযোগ নেই। ঘুরে আসার সুযোগ নেই সবটুকু না দেখে। ব্যাপারটা এমন যে, ঢুকে যখন পড়েছেন আপনাকে দেখতেই হবে। আমরা তো শেষে ক্লান্তই হয়ে পড়েছিলাম। বাঘ, সিংহ, মোষ, হাতি, হরিণ রাজারা শিকার করে চামড়া ছড়িয়ে রাখে মাথাসহ। সেসব প্রতি ঘরেই প্রায় কিছু না কিছু রয়েছে। ডাইনিং-এ খাবার থালা, বাটি সাজানো যেন এক্ষুণি  কেউ ছবি হয়ে গেছে। তবে বিদেশের মাটিতে দেশি কাউকে দেখতে কিন্তু দারুণ লাগে। রাজপরিবারের সাথে ছবিতে হঠাৎ খালেদা জিয়াকে দেখে দারুণ উৎসাহী হয়ে অন্য কেউ আছে কি না খুঁজতে লাগলাম অন্য ছবিগুলোতে।

জিয়াউর রহমান, এরশাদ, রওশন এরশাদ...আশি নব্বই দশকের বিভিন্ন সময় তাঁরা সফরে গিয়েছিলেন সেসব ছবি। একসময় রাজদরবারের সেই রুমটায় পৌঁছে গেলাম যেখানে রাজ্যাভিষেকের মতো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলো হতো। এখন সেই সিংহাসনের নিচে জানি না কেন সবাই খুচরো পয়সা ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছে! এটা কি রাজার প্রতি প্রজার ভেট? তবে আমার ভালো লাগেনি, কোনো কিছুরই শেষ... ধ্বংসাবশেষ.. নিজের চোখে দেখা বেদনার। এত শান এত শওকত... একসময় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকা রাজদরবার এখন কেমন সেনাবাহিনী দ্বারা রক্ষিত, অবলীলায় লোক ঢুকছে এই জীর্ণতা কী নেপালের মানুষ চেয়েছিল? রাজাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছিল যে অংশে, গুলির দাগ সংরক্ষণ করা হয়েছে। খারাপ লাগে, গায়ে কাঁটা দেয়। নিজের চাচাতো ভাই গুলি করে মেরেছিল রাজাকে।
বঙ্গবন্ধুর বত্রিশ নম্বর বাড়িটা বারবার চোখে ভাসছিল। প্রতিটা পদচিহ্ন প্রতিটা স্মৃতি এমনভাবে জড়িয়ে থাকে পুরো জায়গায়, গা ছমছম করে... চোখের কোণায় কোথাও কী একটু কান্নাও জমে না?

পোহারা গার্ডেন ঘুরে একটা ছোট্ট ঝিল পার হয়ে উঁচু দেয়ালের পাশ দিয়ে বেরিয়ে আসছি। মাথা উঁচু করে দেয়ালের ওপর দিয়ে এক সৈন্য তাকিয়ে দেখছিল। প্রাচীন দেয়াল পাথর হয়ে কত লক্ষ্য স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। আমরাও সাথে স্মৃতি নিয়ে ফিরছি রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাক্সিটার কাছে। পরবর্তী গন্তব্য বসন্তপুর। সে গল্প অন্য কখনো।

 


বসন্তপুর: বসন্তপুর একটা প্রাচীন নগর। ভূমিকম্পে ভীষণ ক্ষতি হওয়া অংশগুলো কোনোভাবে ঠিকঠাক করা। কোনো কোনো অংশে মেরামতের কাজ চলছে। এখানে নিচতলার ঘরগুলোয় নানারকম জিনিসপত্রের দোকান। একটু এগোতেই ঘর কাঠামোর ছাদ উঠোনজুড়ে শত শত কবুতর। ইচ্ছে করছিল উড়িয়ে দিই। ঝটপট শব্দ করতে করতে ওরা আবার এসে বসুক। ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। কাঠের ওপর নকশা করা থাম, দেয়াল, প্রাচীনতা। পূজো হচ্ছে কোথাও কোথাও। আমি তো প্রায় সব দেবতার আলাদা আলাদা মন্দিরই দেখলাম, শিব, গণেশ, কালি। পূজোর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাশেই বিক্রি হচ্ছে। মাজারের চেহারাগুলো যেমন হয়। সবখানেই ধর্ম একটা ব্যবসায় রূপ নিচ্ছে। রুদ্রাক্ষের মালা দরদাম করলাম। একটু সময় কাটানো। একটা ছবি নেবো বলে। চমৎকার বাঁশি বাজাচ্ছিল পাশেই এক বাঁশিওয়ালা।
রোদের তাপ বাড়ছে। নেপাল হিমালয়ের দেশ। একটু ঠান্ডার চিহ্ন নেই কোথাও।

সয়ম্ভুনাথ সদন: এবারের গন্তব্য সয়ম্ভুনাথ মন্দির। অনেক ওপরে সেই মন্দির। সারা কাঠমাণ্ডু শহর দেখা যায়। একটু সবুজ দেখার জন্য এতদূর আসা। অথচ নোংরা একটা শহর, ধোঁয়াধূলিময়। শহর থেকে বাইরে বেরুলে তারপর চারপাশে দূরে পাহাড়। গরমে প্রাণ যেন ছটফট করে।

মন্দিরটা অনেক ওপরে তাই এখানে একটু ঠান্ডা। শান্ত জায়গা। পর্যটকদের আনাগোনা। ঢুকতেই ডানপাশে বিশাল একটা ঘণ্টা। বামপাশে জলপ্রপাত, নিচ দিয়ে পর্যটকদের বসার জায়গা। সামনেই বুদ্ধের মূর্তি। পায়ের কাছে রাখা পাত্রে মনের ইচ্ছে পূরণ করার জন্য পয়সা ছুঁড়ে ফেলছে সবাই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম কিছুক্ষণ। পাত্রে সবার পয়সা পড়ে না। যারটা পড়ে সে ভাগ্যবান। ফেলতে পারলে অন্যের ঈর্ষাও কি হয় না! বড় একটা ঘণ্টা! ঘণ্টা বাজিয়ে ঈশ্বরকে জাগিয়ে দিয়ে এলাম। থাকুক জেগে। এত মানুষ সারাক্ষণ তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। তাঁর কী ঘুমিয়ে থাকা মানায়! (চলবে)

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ নভেম্বর ২০১৭/সাইফ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়