ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

নেপালে সারাংকোটে বৃষ্টির বাগড়া

মাহী ফ্লোরা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৪, ২০ নভেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নেপালে সারাংকোটে বৃষ্টির বাগড়া

(দেখে এলাম হিমালয়কন্যা নেপাল: ৩য় কিস্তি)

মাহী ফ্লোরা : আমাদের ডান পাশে গুর্খা মিউজিয়াম। গুর্খারা বীরযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তীর, ধনুক নিয়ে। ইংরেজদের কামানের গোলার বিরুদ্ধে বীর গুর্খাদের অসামান্য সাহসী অবদান ভোলার নয়। মিউজিয়ামে তাদের গৌরবগাঁথা সযত্নে ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।

পাশের রাস্তা দিয়ে আরো একটু গেলে কালিখোলা কি পুল দেখা যায়। নিচে বয়ে যাওয়া পানির রং কালো। তাই কালিখোলা কি পুল। এটা ঝুলন্ত ব্রিজ। এক পাহাড়কে আরেক পাহাড়ের সাথে সংযুক্ত করেছে এই পায়ে চলার ব্রিজ। ব্রিজের ওপাশে একটা ছবির মতো সুন্দর গ্রাম। নাম ভালাম।

ভুট্টো ক্ষেত। পাহাড়ি পাথর একটার ওপর আরেকটা সাজিয়ে দেয়াল বানানো। হঠাৎ দেখি একটা গাড়ি। মোটরবাইক! কি করে এলো? খুঁজতে খুঁজতে জানা গেলো আরো পাশে যানবাহন চলাচলের রাস্তা আছে। এই ঝুলন্ত ব্রিজটা পায়ে হাঁটার। শর্টকার্ট রাস্তা শহরে আসার। আসলে ছবিতে বা বর্ণনায় বোঝানো সম্ভব না। ওই বিশালত্বের কাছে গিয়ে দাঁড়ালে একটা পিঁপড়ার মতো লাগে নিজেকে। মনে হয় জীবন জীবন করে মরে যাচ্ছি। কত অযাচিত তুচ্ছ আর সবকিছুর মতো আমিও!



ফিরে এলাম। লাভলি হিল দেখলাম দূর থেকে। ভালোবাসার জন্য বিখ্যাত এই পাহাড়। জুটিরা গিয়ে ভালোবাসার জন্য প্রার্থনা করে। বিকেলে ছোট্ট একটা পাতার ট্যাটু করালাম হাতে। ট্যাটু পার্লার কিছু দূর পরপরেই। হিমালয়ান স্পাসহ আরো নানারকম ম্যাসেজিংয়ের জন্য বিখ্যাত এই পার্লারগুলো। শখ পূরণ করে অনেক দূর হেঁটে তারপর হোটেলে ফিরে এলাম।

সারাংকোট: আগামীকালের যাত্রা সারাংকোট। ভাগ্য ভালো থাকলে ফিশ টেইল বা মাছলিপুচ্ছের ওপর দেখব প্রথম সূর্যের আলো। সোনাভাঙা রোদ! সেই আশায় খুব ভোরে হোটেল থেকে ডেকে তুলে দিলো ওরা। রাতে বলা ছিল। তুমুল বৃষ্টির ভেতর পিচ্ছিল পথ ধরে রওনা হলাম সারাংকোটের উদ্দেশ্যে। যেহেতু পরের দিন ভোরেই কাঠমান্ডু ফিরবো তাই রিস্ক নিয়েই রওনা হলাম। পাহাড়ি বৃষ্টি মেজাজ ভালো হলে মেঘ ভেঙে সূর্য উঠতেই পারে।



ভোর চারটায় রওনা হলাম। অনেক ওপরে উঠতে হবে। বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তা পিচ্ছিল। যত ওপরে উঠছি গা ছমছম, অন্ধকার চারপাশ। তার ওপর একঘেয়ে বৃষ্টি। মনে মনে প্রার্থনা বৃষ্টি থামার। রোদ উঠুক। রোদ। আজ রোদের খুব প্রয়োজন। পৌঁছালাম সারাংকোট। এতদূর এসে সূর্যের সোনালি রোদ্দুর, বরফের পাহাড়ে রোদের ঘ্রাণ পাওয়া প্রয়োজন ছিল। ২০০৪-এ আমরা গিয়েছিলাম দার্জিলিং। কাঞ্চনজঙ্ঘায় রোদ ওঠা দেখেছিলাম। সেই অদ্ভুত সৌন্দর্য হয়ত প্রকৃতি বারবার দেখার সুযোগ দেয় না। এতদূর এসে তাই বৃষ্টির ভেতর মহিষের দুধের চা আর বিস্কুট খেয়েই ফিরতে হলো হোটেলে।

প্যারাগ্লাইডিং: আজই শেষদিন পোখরায়। প্যারাগ্লাইডিং করব। এমন মেঘ-বৃষ্টি হলে প্যারাগ্লাইডিং অসম্ভব। সারারাত অদ্ভুত এক টেনশন। আকাশে উড়বো পাখির চোখে দেখবো পোখারা। আবার উড়বো সত্য কিন্তু সবকিছু ঠিক থাকবে তো? ফিরতে পারবো তো আবার?

বৃষ্টিতে ওড়া হচ্ছে না শোনার পর নাস্তা না করেই দারুণ একটা শান্তির ঘুম দিয়ে উঠেই দেখি কোনো বৃষ্টি নেই। হোটেল থেকে ফোন পেলাম রেডি হতে। ১২টায় গাড়ি আসবে। সারাংকোটের অন্য দিকটায় যেতে হবে প্যারাগ্লাইডিংয়ের জন্য। এমন ধক ধক এমন বেঁচে থাকা বহুদিন শুনিনি। মাঝে মাঝে মনে হয় তীব্রভাবে বেঁচে আছি সেটা বোঝার জন্য হলেও এমন কিছু প্রয়োজন।



উড়লাম। নেপাল এখন প্যারাগ্লাইডিংয়ের জন্য খুব সম্ভাবনাময় একটা জায়গা। আমার সাথে ছিল গণেশ। ছয় বছর ধরে তিনি এই কাজ করছেন। উড়তে উড়তে এসব নিয়ে বেশ টুকটাক ভাঙা হিন্দি ইংলিশ মিশিয়ে কথা হলো। বাংলাদেশ গিয়েছেন কখনো? উনি বললেন একবার মালোয়েশিয়া যাবার পথে ট্রানজিট রুট হিসেবে ঢাকায় থেমেছিলেন আধাঘণ্টা। নিচে নেমে আসার আগে শেষ দুই মিনিট দারুণ একটা স্টান্ট দিয়ে শেষ করলেন আমার এই পাখির চোখে ভ্রমণ! উপর থেকে হোয়াইট প্যাগোডা, ফেওয়া লেক, মাছলিপুচ্ছ (বরফের পাহাড়) আর ছোট ছোট বাড়িঘর, নিচের গাছপালা দেখার অনুভূতি বুকে নিয়ে ভেজা উপত্যকায় নির্বিঘ্নে নামলাম।

ফিরে এলাম হোটেলে। দুপুরের খাওয়া শেষে একটু আশপাশে ঘোরাঘুরি। লেকে যাওয়া। সাইকেল ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া নিয়ে চালানোর চেষ্টা করতে করতেই মনে হচ্ছিলো আজই শেষদিন এখানে। লেকের পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাবার সময় রাস্তার ওপাশের হোটেলের লবিতে নেপালি সংগীত শুনে আমরা দাঁড়িয়ে উপভোগ করলাম। রাত বাড়ছে।

রাতের খাবার সেরে ঘুম। ভোরে কাঠমান্ডু রওনা দিওতে হবে।

বুদ্ধ ওয়াজ বর্ন ইন নেপাল। লুম্বিনিতে বুদ্ধের জন্ম। রাস্তা খুব খারাপ হওয়ায় লুম্বিনি যাওয়া হলো না আমাদের। বিভিন্ন জায়গায় এই লেখাটা দেখছি। ট্যাক্সির পিছে, হোটেলে, সাইনবোর্ডে। হোটেলগুলোয় বুদ্ধের শান্তিময় চোখ। শান্তির শহরে শান্তি থাকুক ছবির মতো সাজানো।

কাঠমান্ডু ফিরে: সব মিলিয়ে কয়েকটা দিন অন্যরকম ভালো লাগায় কেটে গেল। পর দিন সিনেপ্লেক্সে মুভি দেখলাম কাঠমান্ডুতে। নিউমার্কেটে গেলাম বহু পথ হেঁটে। রাস্তা ভাঙা, নোংরা, কাদা, গন্ধ। এর ভেতরেই লোক চলাচল করছে। ফেরার পথে নুডুলস ভাজা খেলাম। থামেলে রাস্তার দুই ধারে কাশ্মীরি শাল, সোয়েটার হাতে তৈরি বিভিন্ন জিনিসের দোকান। কাশ্মীর থেকে অনেক লোক এসে ব্যবসা করছে। বাংলাদেশিও কম নেই। মদিনা রেস্টুরেন্টে খেতে গেলে তো তিন বেলা বাংলাদেশির দেখা পাওয়া যায়। অসংখ্য বাংলাদেশি ট্যুরিস্ট।



বিকেল ৫টায় ফ্লাইট বাংলাদেশে ফেরার। ঝিরঝির বৃষ্টি আমাদের স্বাগতম জানিয়েছিল নেপালে। আজ বিদায়ের দিনও ঝিরঝির বৃষ্টি। প্লেন ওড়ার সাত মিনিটের মধ্যে হিমালয় দেখতে পারার কথা। বৃষ্টির জন্য দেখা হলো না। তাতে কী! এক বাক্স মন ভালো নিয়ে নেপাল ভ্রমণ শেষ হলো আমাদের।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ নভেম্বর ২০১৭/সাইফ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়