ভিয়েতনামের পথে : সূচনা পর্ব
ফেরদৌস জামান : যাওয়ার কথা ছিল চীন-ভিয়েতনাম। দুই বছর আগে; দুই হাজার পনের সালের কথা। এক সাংবাদিক সদ্য ঘুরে এসেছেন চিনের কুনমিং হয়ে ভিয়েতনাম, রেলপথে। দারুণ অভিজ্ঞতার সেই ভ্রমণ কাহিনি শোনার পর থেকেই সেই পথে ঘুরতে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা হলো। ভ্রমণকারীর নিকট থেকে তখনও সরাসরি পুরো কাহিনি শোনা হয়নি। শুনেছি অগ্রজতুল্য এক বন্ধুর কাছ থেকে, যার সাথে আমার বেশ কয়েকটি চমৎকার ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রয়েছে।
কাহিনির সাদামাটা বর্ণনা শুনে মনে হয়েছিল, আমি নিজেই সেই অচেনা অজানা গ্রামীণ পথে চীন থেকে লোকাল ট্রেনে ভিয়েতনামের যাত্রী! কখনও পাথার, কখনও পাহাড়, কখনও বা গ্রামের পাশ দিয়ে লোহার লাইনের উপর দিয়ে ঝমঝম শব্দ তুলে গড়িয়ে যাচ্ছে ট্রেনের চাকা। আর আমি সেই ট্রেনের জানালায় হেলান দিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখছি বৈচিত্রে ভরা চারপাশের রং, রূপ, গন্ধ আরও কত কি! যতদূর মনে পড়ে সেদিনই আমরা দুজন সিদ্ধান্ত নেই চীন-ভিয়েতনাম ভ্রমণে যাব এবং তা অক্টোবরে।
এরপর মাঝেমধ্যে দেখা হলে কেবল এ নিয়েই কথা হচ্ছে দুজনের। অর্থকড়ি সংস্থানের চেষ্টা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা শিক্ষা ইনস্টিটিউটে ভ্রমণকারী সেই ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তার মুখেই শুনলাম অভিজ্ঞতার কিছু অংশ। আমাদের পরিকল্পনার কথা শুনে অনেক উৎসাহ দিয়ে বললেন, ভিয়েতনামের সা পায় তার এক বন্ধু আছে, প্রয়োজনে আমাদের কথা তাকে জানাবেন। ভ্রমণের জন্য কী পন্থায় অর্থ সংগ্রহ করতে হয়, সে কথাও শিখিয়ে দিলেন।
খেয়ে না-খেয়ে দিনে দিনে দুটি-চারটি করে টাকা যোগ হতে হতে এক সময় বেশ কিছু টাকা জমল। ওদিকে আমার ভ্রমণসঙ্গীর উদ্যমও সেই অনুপাতে কমতে শুরু করল। তার আগ্রহ যে এত তাড়াতাড়ি নিভে যাবে জানা ছিল না। দেখা হলে নানান বিষয়ে আলোচনার মাঝে বিশেষ একটি জায়গাজুড়ে থাকত অক্টোবরের ভ্রমণ। অথচ, আলোচনায় এক সময় চীন-ভিয়েতনাম, লোকাল ট্রেনে দীর্ঘ ভ্রমণ এসব আর আসতেই চায় না। বুঝতে নিতে এতটুকু বেগ পেতে হলো না যে, এই ভ্রমণ আর হবার নয়! এমনিতেও অর্থের সংস্থান কাক্সক্ষীত মাত্রায় হয়ে উঠছিল না, তার উপর দিয়ে এমন পরিস্থিতি। কিছু দিন পর ভাবলাম একাই যাব। এখানে সেখানে ছোটাছুটি করে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল চাইনিজ ভিসা আবেদনে জটিলতা একেবারে নেই- তা বলার সুযোগ নেই। তাদের দেশ থেকে আমন্ত্রণপত্র আনতে হবে, ইত্যাদি। শুনলাম সেই ব্যবস্থা এজেন্সিই করে দেয়। বিনিমনে হাতিয়ে নেয় মোটা অঙ্কের টাকা। এসব দেখে আপাতত মাথা থেকে চীন-ভিয়েতনাম সরিয়ে ফেলতে হলো।
বন্ধু নবীন একদিন কানাডা থেকে ফোন করে ইউএস টুরিস্ট ভিসার জন্য আবেদন করতে বলল। ভিসা যদি হয়েই যায় তাহলে তো সেই ভিসার সদগতি করার মতো বাস্তব সামর্থ আমার নেই। তার কথা সেটা পরে দেখা যাবে। এমনকি ভিসা ফি পাঠাতে চাইল। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলাম ইউএস ভিসা আবেদনের শর্তাবলী পূরণ করতে যা যা দরকার তার অনেকটাই আমার নেই। অতএব, এই চিন্তাও বাদ। ইন্ডিয়ান ভিসা প্রাপ্তির ব্যাপারেও জটিলতার আশঙ্কায় আছি সেই চৌদ্দ সাল থেকে, যার কারণে আবেদন করার ঝুঁকি নিতে পারিনি। সুতরাং সাধ্যের মধ্যে ইন্ডিয়া, নেপাল অথবা ভুটান ভ্রমণের স্বপ্নও বাধ্য হয়ে ভুলতে হয়েছে। অনেক দিন হলো বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে ইন্ডিয়া সড়ক পথে নেপাল যেতে ট্রানজিট দেয় না। তার উপর দিয়ে নেপালের নতুন সংবিধান তাদের (ইন্ডিয়া) পরামর্শে না হওয়ায় পনের সালের সেপ্টেম্বর থেকে ইন্ডিয়া নেপালের বিরুদ্ধে কয়েক মাস অবরোধ করে রাখে, যার ফলশ্রুতিতে দুই দেশের সম্পর্কে চিড় ধরার পরিস্থিতি তৈরি হয়। সুতরাং, নেপালের স্বার্থের প্রতি আপাতত তাদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাশার অতীত। এই পরিস্থিতিতে খোলা থাকে কেবল আকাশ পথ। কিন্তু প্রতিবেশী এই দেশগুলো আকাশ পথে ঘুরতে যাওয়া কখনও যৌক্তিক মনে হয়নি, এখনও হয় না। সব মিলিয়ে যেন বন্দী দশায় পতিত হলাম। এদিকে দেশের মধ্যে প্রকৃতির সান্নিধ্য নেয়ার জন্য ঘুরতে চাইলে কক্সবাজার, সুন্দরবন অথবা সিলেট বিভাগের পর সর্বপ্রথম আসে পার্বত্য চট্টগ্রাম। সেখানেও প্রায় দুই বছরের বেশি সময় ধরে জারি রয়েছে এক অযৌক্তিক নিষেধাজ্ঞা।
এমন বাস্তবতায় এ বছরের শুরুর দিকে সিদ্ধান্ত নেই, আসছে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং সিঙ্গাপুর ভ্রমণে যাব। সেই লক্ষ্যে খোঁজখবর নেয়ার পাশাপাশি অর্থের জোগাড়যন্ত্রে মনোযোগ দিলাম। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বছরের মাঝামাঝি এসে দেখলাম ভ্রমণটা করতে পারব। আমার ভ্রমণগুলো যেহেতু খানিকটা অভিযাত্রা ধরনের হয়ে থাকে সেহেতু, সাথে আর একজন হলে ভালো হতো। কিন্তু চাইলেই তো আর প্রত্যাশা করা যায় না যে, পরিচিত বা বন্ধুবান্ধব কাউকে বললাম আর সঙ্গে সঙ্গে সে কক্সবাজার যাওয়ার প্রস্তাবের মতো রাজী হয়ে বলবে- ঠিক আছে চলো যাই। উল্লেখিত তিনটি দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আছে এমন যার যার সাথেই কথা বলেছি তারা সকলেই উৎসাহ দিয়ে বলেছে, পারতপক্ষে তিনটি দেশ একসাথে ভ্রমণ করা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এরপর নিজের সিদ্ধান্তকে উপযুক্তই মনে হলো। নড়েচড়ে শুরু করলাম, ভ্রমণ সফল ও সুন্দর করে তুলতে তালিকা করে একটার পর একটা ধাপ বা পর্যায় অতিক্রম করতে থাকলাম। এই যেমন- ভিসা, বিমান ভাড়া, কোন কোন জায়গায় যাওয়া যেতে পারে; এসবের নির্ভরযোগ্য ও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে একটা হাফপ্যান্ট কিনতে হবে ইত্যাদি। তখন বোধহয় জুন কি জুলাই মাস, আমার বেশ কয়েকটা ভ্রমণের আরেক সঙ্গী সুজিত কথাপ্রসঙ্গে ভ্রমণ পরিকল্পনার বিস্তারিত শুনে সে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করল। কিছু দিনের মধ্যে সে তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা জানায় এবং পাসপোর্ট করতে দেয়। সুজিতের যোগদানে আমার ভ্রমণ যেন সফল হওয়ার দিকে একধাপ এগিয়ে গেল।
সেক্ষেত্রে ভ্রমণের তারিখ পিছিয়ে নির্ধারণ করা হলো অক্টোবরের দশ তারিখ থেকে পরবর্তী বিশ দিন। অর্থাৎ মাসের শেষ অথবা নভেম্বরের শুরুতে দেশে ফেরা। দিন এগিয়ে আসছে। একেবারে ফাঁকা পাসপোর্টে এই দেশগুলো সাধারণত ভিসা দিতে চায় না, তাই সুজিতকে চার-পাঁচ দিনের একটা ইন্ডিয়া ভ্রমণ করতে হলো। এরই মধ্যে পেশাগত এক বিশেষ কাজ এবং প্রকৃতি প্রেম উভয় টানে দুই সপ্তাহের জন্য আমাকেও যেতে হলো পার্বত্য চট্টগ্রামে। তার আগে সেপ্টেম্বরের দশ কি বারো তারিখে ভিসার জন্য পল্টনে এক এজেন্সিকে পাসপোর্ট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেই। অক্টোবরের তিন তারিখ ঢাকা ফিরে জানতে পারি থাইল্যান্ডের ভিসা হলেও মালয়েশিয়ার এখনও কোনো সংবাদ নেই। স্বাভাবিকভাবেই ভ্রমণ নিয়ে পুনরায় ভাবনায় পড়ে যাই। এদিকে দিন যত নিকটবর্তী হচ্ছে বিমানের ভাড়া তরতর করে বেড়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি বুঝতে আর বাকী রইল না। অতএব, তালিকা থেকে সিঙ্গাপুর বাদ দেয়া হলো এবং তার স্থলে যুক্ত হল ইন্দোনেশিয়া কারণ এখানে যেতে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসার প্রয়োজন পড়ে না। সুতরাং ভিসা প্রাপ্তির জন্য কাল ক্ষেপনের কোনো প্রশ্ন নেই। সঠিক সময়ে ভ্রমণ শুরু করা যাবে না বুঝতে পেরে থাকার জায়গার বুকিংগুলো নতুন করে সংশোধন করতে হলো, সাথে ভ্রমণ পরিকল্পনায় এলো পূর্ণাঙ্গ পরিবর্তন।
যাত্রার পূর্ব নির্ধারিত তারিখ দশ অক্টোবর পেরিয়ে যায় কিন্তু মালয়েশিয়ার ভিসার কোনো খবর নেই। তিন দেশের ভিসার জন্য যেখানে সর্বোচ্চ তিন সপ্তাহ লাগার কথা সেখানে থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ার ভিসা পেতেই অক্টোবরের বারো তারিখ। এদিকে ছুটির নরচর করা সম্ভব নয়। অতএব, পরের দিন তেরো তারিখের টিকিট নিশ্চিত করতে আর কোনো দ্বিধা করলাম না। টিকিট কাটার সাথে সাথে শুরু হলো পরের দিন রওনা দেয়ার প্রস্তুতির দৌড়াদৌড়ি। যখন টিকিট কাটি তখন বাজে সন্ধ্যা সাতটা। পরের দুই দিন শুক্র ও শনি সাপ্তাহিক বন্ধের দিন। এখন নাকি ডলার এনডোর্স করতে হয় অনলাইনে। সেটার সময় আবার অফিস টাইমের মধ্যে। আর এই জিনিস ছাড়া যাওয়া যাবে না। এখন কি করি! যাত্রার তারিখ না হয় পিছিয়ে দিলাম কিন্তু টিকিট তো ইস্যু হয়ে গেছে। এজেন্সি থেকেই যোগাযোগ করে দেয়া হলো পল্টনের কোনো এক ব্যাংক কর্মচারীর সাথে। ছুটে গিয়ে তার মাধ্যমে কাজটা অবশেষে করা সম্ভব হলো। মাঝখান থেকে দুই পাসপোর্টের জন্য গুনতে হলো দুই হাজার টাকা। পাশেই ব্যাংক থেকে কীভাবে কী করে আনল তা কেবল তারই জানা। ঢকা শহরে টাকার বিনিময়ে হয় না এমন কোনো কাজ বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না।
বিকেল সোয়া চারটায় ফ্লাইট। নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের দুই-আড়াই ঘণ্টা আগে বিমানবন্দরে উপস্থিত হলাম। সমস্ত আনুষ্ঠানিকতার পর ইমিগ্রেশনের ও-পাড়ে গিয়ে বসে আছি অনেকক্ষণ। পরিবারের সদস্য এবং দু’একজন বন্ধুবান্ধবের সাথে ফোনে আপাতত শেষ বারের মতো কথাবার্তা চলছে। মাঝে মধ্যে চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে এই দোকান সেই দোকানে ঘুরছি। মিষ্টির দোকানে সাজিয়ে রাখা হরেক পদের মিষ্টি। চেখে পড়ার পরও নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু শেষ পর্যন্ত মন তো তার আশপাশেই ঘুরঘুর করছে। বিমানে বসে বসে খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলে মন্দ হতো না, কমপক্ষে আধা কেজি নেয়া যেত। সব শেষে অবশ্য দোকানে দাঁড়িয়ে একটা করে খেয়েছিলাম। যাহোক, সাউন্ড সিস্টেমে বোর্ডিংয়ের ঘোষণা ভেসে এলো। হাতব্যাগ ও দেহ তল্লাশির পর বসিয়ে রাখা হলো আরও খানিকক্ষণ। অবশেষে একটি বাসে সকল যাত্রীকে ঠেঁসে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো বিমানের দরজায় লাগানো সিঁড়ির নিচে। অমনি সকলেই তাড়াহুড়ো শুরু করে দিলো। যেন না নিয়েই বিমান উড়াল দেবে। সিঁড়ির মুখে এক ধরনের অপ্রত্যাশিত জট বেঁধে গেল। পেছন থেকে ধাক্কার চোটে সিঁড়ির মধ্যে দিয়ে নিজেও যে কখন সোজা বিমানের মধ্যে চালান হয়ে গেলাম টেরই পেলাম না। (চলবে)
রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন