রহস্যময় গুহায় আলোর নড়াচড়া
(ভিয়েতনামের পথে : ২৩তম পর্ব)
ফেরদৌস জামান : পরের গন্তব্য লড কেইভ। আমরা বোধহয় পাই থেকে মে হং সন অভিমুখে আছি। কারণ সেদিন মে হং সন থেকে আসার সময় এ পথের কোন এক পর্যায়ে কেইভে যাওয়ার পথটির নিশানা দেখেছিলাম। নিশানা ধরে গাড়ি ঢোকে। এই উঁচু তো এই নিচু। এমন করে এগিয়ে চলছে আমাদের ক্যারিবয়। চালকের সাথে দু’চারটা কথাও হচ্ছে। মাত্র নয় হাজার বাথের চাকরিতে পোশায় না। স্বপ্ন দেখে; একদিন নিজের একটা গাড়ি হবে। তখন নিজেকে অনেক স্বাধীন ভাবতে পারবে। চেষ্টা করবে নিজেই একটা প্যাকেজ ভ্রমণের ব্যবসা খোলার।
নিজ থেকেই ফোন নাম্বার দিয়ে বলল, পরোবর্তী সময়ে পাই এলে তার সাথে যেন যোগাযোগ করি। তখন আরও ভালো করে এলাকা ঘুরে দেখাবে। কথায় কথায় প্রবেশ করি অতি পুরনো বৃক্ষের নিচ দিয়ে এগিয়ে যাওয়া শান্ত সুনিবিড় ছায়াময় পথে। অনেক দূর পরপর বসতি। পৌঁছে গেলাম এক চত্বরে। চত্বরের ও-মাথায় একটি তোরণ এবং পাশেই কাউন্টার। ওই তোরণের নিচ দিয়ে গুহার পথ। এখানকার সমস্ত আনুষ্ঠানিকতার ভার চালকের ওপর। আমাদের তুলে দেয়া হলো দুইজন নারী পথ প্রদর্শকের হাতে। তোরণ পেরিয়ে বাম পাশে সতেজ হওয়ার জায়গা। যার যার প্রয়োজন পড়লো হাতমুখ ধুয়ে নিল। পথ প্রদর্শকদ্বয়ের হাতে একটি করে বাতি। পরনে নির্দিষ্ট পোশাক। তাদের অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছি। ইট বিছানো পাহাড়ি পথের ওপর ছোট্ট নদীর মতো খাল। খালের পাড় ধরে কিছু দূর এগিয়ে দেখা দিল গুহার মুখ। যেন তেন মুখ নয়, আনায়াসে দু’একটা রেলগাড়ি ঢুকে যেতে পারে। নিকটে যেতে যেতে গুহার মুখ আরও বড় হয়ে ধরা দিল।
একটা কাঠের সাঁকো দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। সাঁকোয় আরোহণের আগে সরু পথটা যেন নিজেই আমাদের সারিবদ্ধ করে নিল। সাঁকোর নিচে নানা রঙের মাছ খলবল করছে। দেখে মনে হয় বদ্ধ মাছ। কিন্তু না। পর্যটকদের চিত্তে একটু বাড়তি আনন্দের যোগান দিতে উন্মুক্ত মাছগুলোর বিচরণ মন্দ নয়। আমাদেরকে মাঝে নিয়ে পথ প্রদর্শকের একজন সামনে এবং অপরজন পেছনে। একটু আগেই তারা বাতি জ্বালিয়ে নিয়েছেন। সাঁকো থেকে নামার পর কয়েক গজ সামনে গিয়ে কিছুটা জলপথ। বাঁশের লম্বা ভেলায় পথটুকু পার হতে হলো। আরোহীদের নড়াচড়া আর কাঁপাকাঁপিতে টুপ করে উল্টে যাওয়ার উপক্রম! নৌ-পথের মাঝামাঝির পর থেকেই চারদিক থেকে অন্ধকার এগিয়ে এলো। প্রবেশ করলাম এক কৃষ্ণ গহ্বরে। ঘুটঘুটে অন্ধকার গিলে ফেললো সবকিছু। স্যাঁসস্যাঁতে অসমতল পাথরের পথ। মাঝে মাঝে কাঠ দিয়ে তৈরি সিঁড়ির ব্যবস্থা করা আছে। আমরা এখনও সারিবদ্ধ হয়েই চলছি। জীবনে অন্ধকার দেখেছি অনেক; ঘরের অন্ধকার, জঙ্গলের অন্ধকার, গুহার অন্ধকার, সমাজের অন্ধকার এমনকি মানুষের মনের অন্ধকার। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে এত গভীর, চাপা এবং বিরাট অন্ধকার এর আগে কখনই দেখা হয়নি।
ছমছমে নীরবতার পড়ত কেটে কেটে এগিয়ে চলছে আমাদের মানব গাড়ি। পথ প্রদর্শকদ্বয় এখনও ছয়জনকে মাঝে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। ভাঙ্গা ইংরেজি কথায় দু’একটা বিষয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। গুহার ছাদ থেকে নানান আকৃতি নিয়ে নেমে এসেছে পাথরের লতা। উপর থেকে নেমে আসতে আসতে মাঝ পথেই চোখা রূপ নিয়ে থেমে আছে বা থমকে গেছে। জমাট বাঁধা, শক্ত লতাগুলো দেখে অনুমান করা যায় কত না কত শহস্রাব্দের ফসল! দেখে মনে হয় দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় ফেনার মত বিশেষ কোন পদার্থ চুঁয়ে চুঁয়ে কঠিন রূপ নিয়ে গঠিত হয়ে চলেছে এসব লতার বাহার। কি অনবদ্য শিল্পকর্ম, প্রকৃতি নিজেই এর শিল্পী! গুহার অভ্যন্তরে কখনও সরু আবার কখনও সুবিশাল ছড়ানো জায়গা। বিভিন্ন দিকে চলে গেছে শাখাপ্রশাখা। ছাদ এত উঁচুতে যে, আলো অত দূর পৌঁছতে চায় না। কোন কোন লতা সেই ছাদ থেকে নেমে এসে ভূমিতে গেঁথে গেছে। লতার ব্যাস শতবর্ষী কড়ই গাছের কান্ডসম। কান্ডের সম্পূর্ণ শরীর জুরে আবার অদ্ভুত কারুকাজ। আবেগ বা অনুভূতি ভাষায় প্রকাশের যে একটা সীমা পরিসীমা থাকে এই মুহূর্তে তা খুব নির্মমভাবে উপলব্ধি হলো।
আমার সঙ্গীদের যেন কি না কি তাড়া আছে। তাদের সাথে কুলাতে না পেরে পথ প্রদর্শকের একজনকে নিয়ে আমি এগুতে থাকলাম আমার মত করে। তিনি বোধহয় আমার মেজাজটা ঠিকই আন্দাজ করে নিলেন। নিজ থেকেই আলো তাক করে ধরে দেখালেন গুহার ভেতরের বিশেষ কিছু জায়াগা। একটু ধৈর্য ধরে চললে পথের ডানে-বামেই এসব দেখতে পাওয়া যায়। নিজেদের মত করে কোনো কোনোটার তারা নামকরণও করেছে। যেমন- ছাদ থেকে নেমে আসা এক লতার নামকরণ হয়েছে মানুষের দাঁত। আকৃতি অবিকল একটি উপড়ানো মাড়ি দাঁতের মত, তাই এমন নামকরণ। আলোয় যতটুকু জায়গা আলোকিত হচ্ছে তা এই বিশাল অন্ধকারের মধ্যে খুবই সামান্য। অন্ধকারের ঘনত্ব বাড়ে কি না জানি না তবে এক পর্যায়ে মনে হলো আলোকে গ্রাস করে নিয়ে তা ক্ষুদ্র আয়তনে আবদ্ধ করে দিচ্ছে। এখনই যদি আলো নিভে যায়, তাহলে তো বিভূতিবাবুর ‘চাঁদের পাহাড়’র শঙ্করের দশা! শঙ্কর তো কয়েক দিনের মধ্যেই গুহাবাস থেকে নিস্তার লাভ করেছিল। শুনেছি এই গুহার প্রায় পঞ্চাশটির মত শাখাপ্রশাখা আছে। পরিস্থিতি তেমন রূপ হলে তো এই সুবিশাল লড কেইভের ঘুটঘুটে অন্ধকার শাখা প্রশাখা প্রদক্ষিণ করতে করতে লীলা সাঙ্গ হয়ে যাবে। এমন অমূলক ভাবনাগুলো মনের মধ্যে ঢুকে এক ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। পরক্ষণেই তার স্থলে জায়গা করে নিচ্ছে বিস্ময়! আমাদের দল বেশ সামনে এগিয়ে গেছে। প্রকোষ্ঠের একেবারে অপর প্রান্তে, প্রবেশ করতে যাচ্ছে আর এক শাখায়। দূর থেকে শুধু একটা আলোর বলয় চোখে পড়ছে আর তার ভেতর কয়েক জোড়া হাত-পায়ের নড়াচড়া।
আমার পথ প্রদর্শক একটুও অধৈর্য হচ্ছেন না। নিজ থেকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখানোর চেষ্টা করছেন সব কিছু। কায়দা করে আলো পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন কিছু জায়গায়। আমাদের আগে পিছে আরও দু’একটা দল ঢুকে পরেছে। তাদের মাঝে অনেকেই এমনকি আমাদের দলেরও কেউ কেউ অযাচিত উৎপাত হিসেবে আবির্ভুত হলো। নিজেদের শোরগোলের দরুণ যদি প্রকৃতির ভাষাটাই পালিয়ে যায় তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না। একটা পর্যায়ে পথ থেমে গেল। অনেকটা নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদী। পাড়ে দাঁড়িয়ে নদীর উজান বা ভাটি কোন কিছুরই কূলকিনারা করা গেল না। কি বিস্ময়, এই অন্ধকারের তলদেশ দিয়ে বয়ে গেছে চুপচাপ জলের ধারা! কে জানে কোথায়, কতদূর গিয়ে নদীটি আলোর দেখা পেয়েছে। এবার ফেরার পথে পা বাড়ানোর সময় হয়ে এসেছে। এত কিছু দেখার পরও আমার প্রত্যাশা যেন অপূর্ণ থেকে গেল। অপূর্ণ প্রত্যাশা নিয়ে আবারও ভেলা যোগে বেরিয়ে আসা। এগিয়ে যাচ্ছি আলোর পথে। গুহার মুখ দিয়ে দেখা যাচ্ছে সূর্যের আলো। কি যে ভালো লাগছে! এই আলো যেন আর কোন আলোরই সমকক্ষ নয়।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ এপ্রিল ২০১৮/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন