সাকিবময় দিনে ইংল্যান্ডের শক্তি দেখল বাংলাদেশ
কার্ডিফ থেকে ইয়াসিন হাসান: একটা ভালো দিনের প্রত্যাশায় ছিলেন অধিনায়ক মাশরাফি। ভালো দিন বলতে, বিশ্বকাপের ফেবারিট ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সাহসী বোলিং ও ব্যাটিং। তাতেই চলবে। জয় না পেলেও আত্মবিশ্বাসে জ্বালানি পাওয়া যাবে। হলো না কিছুই।
নির্বিষ বোলিংয়ের পর নিষ্প্রাণ ব্যাটিং। সাথে নতুন করে যোগ হলো মিস ফিল্ডিংয়ের মহড়া। তাতে বিশ্বকাপে সবথেকে খারাপ দিনটি হয়তো দেখেই ফেলল বাংলাদেশ!
বাংলাদেশের এমন খারাপের দিনে ইংল্যান্ড হাসল পুরোদিন। তাদের চওড়া হাসির সামনে সাকিব জ্বললেন নিজের মতো করে। বাজে বোলিংয়ের দিনে সাকিব পেলেন বিশ্বকাপের প্রথম সেঞ্চুরি, ক্যারিয়ারের অষ্টম। দলের ব্যর্থতায় দিন শেষে ম্লান তার হাসিও।
বাংলাদেশের আমন্ত্রণে ব্যাটিংয়ে নেমে ৬ উইকেট ৩৮৬ রান তোলে ইংল্যান্ড। এই ইনিংসে কত কিছুই না পেয়েছে এউয়ন মরগানের দল। টানা সাত ম্যাচে তিনশর বেশি রান, বিশ্বকাপে নিজেদের সর্বোচ্চ রান ও বাংলাদেশের বিপক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। রানের পাহাড়ে ওঠার পর বোলিংয়েও ইংল্যান্ড নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশকে আটকে দেয় ২৮০ রানে। ১০৬ রানের বিশাল জয়ে প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের মিশনে আবার সঠিক পথে ফিরল স্বাগতিকরা।
লক্ষ্য ছিল আকাশচুম্বি। ওই লক্ষ্য তাড়া করতে প্রয়োজন ছিল বিধ্বংসী সূচনা। দুই ওপেনার পারলেন না কিছুই। সৌম্য আর্চারের গতির ঝড়ে স্রেফ উড়ে যান। তামিম ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বের হতে পারেননি আজও। ১৯ রানে আউট হন মার্ক উডের শর্ট বলে।
সবথেকে নির্ভরযোগ্য জুটি সাকিব ও মুশফিক খাদের কিনারা থেকে দলকে তুললেন আবারও। এক্সে-লেটার চেপে যখন দ্রুত রান করতে চেয়েছিলেন তখনই ফিরলেন মুশফিক। তাদের জুটিতে আসে ১০৬ রান। সাকিব টিকে ছিলেন। লড়াই করেছেন একা। পেয়েছেন বিশ্বকাপের প্রথম সেঞ্চুরি।
বড় ব্যবধানে জিততে হলে সাকিবকে থামানোর প্রয়োজন ছিল ইংলিশদের। স্টোকসের ডেডলি ইয়র্কারে সাকিব থামেন। পরের ব্যাটসম্যানরা পরাজয়ের ব্যবধান কমিয়েছেন মাত্র।
সাকিবের ইনিংসের শুরুটা নড়বড়ে হলেও উইকেটে থিতু হওয়ার পর খোলস থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর তাকে আর আটকানো যায়নি। ৫৩ বলে পঞ্চাশ ছোঁয়া সাকিব তিন অঙ্কে পৌঁছে যান ৯৫ বলে। ক্যারিয়ারের অষ্টম ও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম সেঞ্চুরি। এবারের বিশ্বকাপের শুরু থেকে সাকিব যেভাবে পারফর্ম করছেন, তার থেকে একটি বড় সেঞ্চুরির প্রত্যাশা করছিল সবাই। সোফিয়া গার্ডেনে ফিরে সাকিব সেই অপেক্ষা দূর করেন।
২০১৭ সালে এই মাঠেই চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করেছিলেন বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার। পাক্কা দুই বছর পর সাকিব আবার সোফিয়া গার্ডেনে পেলেন ওয়ানডে সেঞ্চুরি। এ সময়ে ২৩টি ওয়ানডে খেলেছেন তিনি।
সাকিব বাদে মুশফিকুর রহিমের ব্যাটই শুধু হেসেছে। ৫০ বলে ২ বাউন্ডারিতে উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান করেন ৪৪ রান। মোসাদ্দেকের ১৬ বলে ২৬ রানের ব্যাটিং যেমন খানিকটা আনন্দ দিয়েছে ঠিক তেমনই মাহমুদউল্লাহর ৪১ বলে ২৮ রান বিরক্ত ধরিয়েছে।
তিনশর বেশি লক্ষ্য হবে, এমনটা প্রত্যাশিত ছিল। শেষ ছয় ম্যাচে যাদের প্রতিটি ইনিংসের রান তিনশ ছাড়িয়েছে তাদের বিপক্ষে ‘দুর্বল’ বোলিং অ্যাটাক নিয়ে কতটুকু লড়াই করা যাবে, তা ছিল দেখার। প্রত্যাশার চাপ তো বোলাররা মেটাতে পারেননি বরং নির্বিষ বোলিংয়ে হতাশ করেছেন। সাথে মিস ফিল্ডিং। ফিল্ডিংয়ে পুরো দিনই বাংলাদেশ ছিল বাজে।
আগের দুই ম্যাচে শুরুতেই স্পিন আক্রমণের বিপক্ষে আউট হয়েছিলেন জেসন রয়। এবার বাংলাদেশ একই পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছিল। সাকিব করেছিলেন প্রথম ওভার। মাশরাফি ছিলেন অপরপ্রান্তে। দুজন ৫ ওভার থামিয়ে রাখেন জেসন রয় ও জনি বেয়ারস্টোকে।
উইকেটে টিকে যাওয়ার পর দুই ব্যাটসম্যানকে আর কেউ থামাতে পারেননি। মাশরাফির তৃতীয় ওভারে মুস্তাফিজ আরেকটু মনোযোগী হলে রয় ফিরতে পারতেন ১৬ রানে। কিন্তু ইনজুরি প্রবণ মুস্তাফিজ রয়ের ক্যাচ নিতে ঝুঁকি নেননি।ওই সুযোগটি কাজে লাগিয়ে রয় নিজের ইনিংস বড় করেছেন। খেলেছেন ১২১ বলে ১৫৩ রানের ঝোড়ো ইনিংস। ১৪ চার ও ৫ ছক্কায় সাজানো ইনিংসটি গড়ে দিয়েছে বড় ব্যবধান।
স্পিনার মিরাজ তাকে থামান ৩৫তম ওভারে। পরপর তিন ছক্কা মারার পর মিরাজকে চতুর্থ ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে মাশরাফির হাতে ক্যাচ দেন রয়। এর আগে ২০তম ওভারে মাশরাফি নিজের দ্বিতীয় স্পেলে বোলিংয়ে ফিরে ভাঙেন ১২৮ রানের উদ্বোধনী জুটি। রয়ের জ্বলে ওঠার দিনে বেয়ারষ্টো করেন ৫১ রান।
বাংলাদেশকে লেট অর্ডারে সবথেকে বড় ধাক্কাটি দেন জস বাটলার। তাকে নিয়ে ভয় ছিল। যেকোনো মুহূর্তে ম্যাচের রঙ পাল্টে দেন এ ব্যাটসম্যান। সেই কাজটি করলেন। ৪৪ বলে ২ চার ও ৪ ছক্কায় করলেন ৬৪ রান। ১৪৫.৪৫ স্ট্রাইক রেটে খেলা ইনিংসটি দেখে ছন্নছড়া পুরো দল।
২০১৫ সালের এপ্রিলের পর ১৪ বার শেষ ১০ ওভারে শতরানের ওপরে তুলেছে ইংল্যান্ড। আজ তারা পায় ১১১ রান। ইংল্যান্ডের রান উৎসবের এমন দিনে দিশেহারা ছিলেন প্রত্যেক বোলার। সাকিব ১০ ওভারে দিয়েছেন ৭১ রান। মাশরাফি খরচ করেছেন ৬৮। দুই স্পিনার মিরাজ ও মোসাদ্দেক দুই ওভারে সর্বোচ্চ ১৯ রান করে দিয়েছেন। মোসাদ্দেক ২ ওভারে ২৪, মিরাজ ১০ ওভারে ৬৭ রান খরচ করেছেন। সাইফউদ্দিন ৯ ওভারে ৭৮, মুস্তাফিজ সমান ওভারে ৭৫।
বোলিংয়ে আক্রমণের জন্য প্রয়োজন ডট বল। বোলিংয়ে ১১২ ডট বল পেলেও বাংলাদেশ বাউন্ডারিতে হজম করেছে ১৯৬ রান। ম্যাচ বেরিয়ে গেছে সেখানেই।
অন্যদিকে বাংলাদেশের ইনিংসে ডট বল ১২৫টি, বাউন্ডারিতে এসেছে ১০০ রান। সাকিবের অষ্টম সেঞ্চুরির দিনটিকে বাংলাদেশ জয়ে রাঙাতে পারেনি ঠিকই। কিন্তু সাকিবের সেঞ্চুরি এ ম্যাচে বাংলাদেশের একমাত্র প্রাপ্তি। কার্ডিফের সোফিয়া গার্ডেনে এই ম্যাচের আগে বাংলাদেশ দুবার খেলেছিল। দুবারই জিতেছিল। কিন্তু এবার সোফিয়া গার্ডেন বাংলাদেশকে দিল বিষাদময় স্মৃতি।
রাইজিংবিডি/কার্ডিফ/৯ জুন ২০১৯/ইয়াসিন/পরাগ
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন