ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

সাকিবময় ম্যাচে প্রত্যাশিত জয় বাংলাদেশের

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:৫৯, ২৪ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাকিবময় ম্যাচে প্রত্যাশিত জয় বাংলাদেশের

সাউদাম্পটন থেকে ইয়াসিন হাসান :  ‘কনগ্রাচুলেশন গায়েস’- ডাইনিং টেবিলে আফগানিস্তানের এক সাংবাদিক যখন জয়ের আগাম শুভেচ্ছা জানালেন, তখন মোহাম্মদ নবী মাত্র সাকিবের বলে বোল্ড হয়ে ফিরলেন। ম্যাচের তখনো অনেক বাকি।  কিন্তু আফগান সাংবাদিকও বুঝে গেলেন আজ সম্ভব না। হলোও না।

সাকিব আল হাসানের কীর্তির দিনে বাংলাদেশ কখনো হারে না। হারল না এবারও। সাউদাম্পটনে বাংলাদেশকে হারানোর হুমকি দিয়েছিল আফগানিস্তান। কিন্তু বাঘের গর্জনে তাদের খুঁজেই পাওয়া গেল না। বাংলাদেশের করা ২৬২ রানের জবাবে আফগানিস্তান অলআউট হলো তিন ওভার বাকি থাকতে। স্কোরবোর্ডে তখন তাদের রান ২০০।  ৬২ রানের বিশাল জয়ে সেমিফাইনালের আশাটা ভালোভাবেই বাঁচিয়ে রাখল বাংলাদেশ।

ম্যাচটা সাকিবের একার। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ কিংবা টিভি ক্যামেরা কোনো কিছু থেকেই তাকে দূরে সরানো যাচ্ছিল না। সুপারম্যান সাকিব বলে কথা। প্রথমে ব্যাট হাতে হাফ সেঞ্চুরি, পরবর্তীতে বল হাতে ৫ উইকট। তাতেই আফগান বধের গল্প লেখা হয়ে গিয়েছিল নয়নাভিরাম সাউদাম্পটনে।

এক ম্যাচে সাকিব কত রেকর্ড গড়লেন, তা হয়তো নিজেও জানেন না! পরিসংখ্যানবিদরাও খুঁজে পেতে ব্যস্ত। তাইতো অফিসিয়ালি স্কোরার জেমস এমারসন প্রেসবক্সে বলেন, ‘আরো কিছু রেকর্ড হয়তো আছে। খুঁজে বের করে জানাব।’

 

প্রথমে ব্যাটিংয়ে ৫১ রান করে বিশ্বকাপে হাজার রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন সাকিব। প্রথম বাংলাদেশি এবং ক্রিকেট বিশ্বের ১৯তম খেলোয়াড় হিসেবে হাজার রানের ক্লাবে ঢুকেন। পরবর্তীতে বল হাতে ২ উইকেট নিয়ে গড়েন আরেক কীর্তি। ২৮ উইকেট নিয়ে আজ মাঠে নেমেছিলেন। শুরুতেই তার শিকার রহমত শাহ। দ্বিতীয় স্পেলে বোলিংয়ে ফিরে পান গুলবাদিন নাইবের উইকেট।  বিশ্বকাপে হাজার রান ও ৩০ উইকেটের নতুন ক্লাব ওপেন করেন সাকিব। এমন কীর্তি নেই বিশ্বকাপের অন্য কোনো খেলোয়াড়ের। 

সাকিবের উইকেটের ক্ষুধা তখনো শেষ হয়নি। আসগর আফগান ও নাজিবুল্লাহ জারদানের উইকেট নিয়ে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে দ্বিতীয়বারের মতো পাঁচ উইকেটের স্বাদ পান। প্রথম বাংলাদেশি খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপে পাঁচ উইকেট পান সাকিব। আর ম্যাচে ৫০ রান ও বোলিংয়ে পাঁচ উইকেটে সাকিব যুবরাজ সিংকে ছুঁয়ে ফেলেন। ভারতীয় এ অলরাউন্ডার ২০১১ বিশ্বকাপে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ৫০ রান ও পাঁচ উইকেট পেয়েছিলেন।

আরেকটি রেকর্ড সাকিবভক্তদের আরো আনন্দিত করতে পারে। এবারের আসরে সাকিবের রান ৪৭৬, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। বোলিংয়ে নিয়েছেন ১০ উইকেট।  বিশ্বকাপের এক আসরে ৪০০ রান ও ১০ উইকেট নিতে পারেননি আর কোনো ক্রিকেটার। সাকিব কতটা মহামূল্যবান, তা বোঝা যায় শুধু তার কীর্তিতেই।

 

রেকর্ডের পাতা তছনছ করতে সাকিব পেয়েছিলেন মনের মতো উইকেট। আগের দিন কোচ স্টিভ রোডস বলেছিলেন ঘরের মাঠে বাংলাদেশ এমন উইকেটে খেলে অভ্যস্ত। উইকেটে ছিল টার্ন। উইকেট ছিল মন্থর। এই উইকেটে আগের দিন ২২৪ করে আফগানিস্তানকে হারিয়েছিল ভারত। বাংলাদেশ সেখানে করেছিল ২৬২।

জয়ের পুঁজি বাংলাদেশ পেয়েছিল শুরুতেই। ব্যাট হাতে ৮৩ রানের দুর্দান্ত ইনিংস উপহার দিয়েছেন আগের ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেঞ্চুরি পাওয়া মুশফিকুর রহিম। নটিংহামে যেখানে থেমেছিলেন সাউদাম্পটনে সেখানেই শুরু করেছিলেন। উইকেটের গুনগত মান বুঝে শেষ পর্যন্ত ব্যাটিংয়ের চেষ্টায় ছিলেন মুশফিক। ৮৭ বলে মাত্র ৪ চার ও ১ ছক্কায় করেন ৮৩ রান। সাকিব বিশ্বকাপে নিজের তৃতীয় হাফ সেঞ্চুরি তুলে আউট হন ৫১ রানে।

আফগান স্পিনারদের সামলাতে ভিন্ন পরিকল্পনা নেয় বাংলাদেশ। সৌম্যর পরিবর্তে শুরুতেই ব্যাটিংয়ে আসেন লিটন। ১৭ বলে ২ চারে ১৬ রানে বিদায় নেন। তামিম ছিলেন স্লো এন্ড স্টেডি।

 

নবম বলে প্রথম বাউন্ডারির পর দ্বিতীয় বাউন্ডারি পেতে তাকে খেলতে হয় ২৮ বল। পেসারদের বিপক্ষে ছিলেন স্বাচ্ছন্দে। স্পিনারদের বিপক্ষে খানিকটা নড়বড়ে। দ্বিতীয় উইকেটে সাকিব ও তামিমের জুটির পঞ্চাশ রান আসে তামিমের চারে। নিজের ৫২তম বলে নবীকে চার মেরে স্পিনারদের বিপক্ষে তামিম প্রথম বাউন্ডারির স্বাদ পান। পরের বলে নবী প্রতিশোধ নেন তামিমকে বোল্ড করে।  ৫৩ বলে মাত্র ৩৬ রানে বিদায় নেন তামিম। 

এক ওভার পর রশিদ খানের এলবিডব্লিউর আবেদনে সাকিবকে আউট দেন আম্পায়ার। রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান সাকিব। পরবর্তীতে তুলে নেন ফিফটি। কিন্তু ওই এলবিডব্লিউতেই সাকিবের উইকেট কাটা পড়ে। 

চোট নিয়ে লড়াই চালিয়ে যান মাহমুদউল্লাহ। তার লড়াকু মনোভাবে হাতে তালি দিয়েছে সবাই। ৩৮ বলে ২৭ রানে বিদায় না নিলে মোসাদ্দেকের ইনিংসটি দেখাই হতো না। লোয়ার অর্ডারে ব্যাটিংয়ে নেমে ২৪ বলে ৩৫ রান করেন মোসাদ্দেক।

 

মন্থর উইকেটের সঙ্গে বড় বাউন্ডারি; সাউদাম্পটনে যেভাবে ব্যাটিং করা দরকার ছিল বাংলাদেশ সেভাবেই পেরেছিল। প্রথম ১০ ওভারে ৪৪ রান। শেষ ১০ ওভারে ৬৯ রান তোলে মাশরাফির দল। পুরো ইনিংসে ৪ ছিল মাত্র ১৭টি। ছক্কা ১টি।  ১১৩টি সিঙ্গেল ও ২৭ ডাবলসে ব্যাটসম্যানরা নিজেদের ফিটনেস প্রমাণ করেছেন দারুণভাবে।  ইনিংসে ডট বল ছিল ১৩৮টি। সেগুলোর অর্ধেক রান হলে আজও তিনশর চূড়ায় যেত বাংলাদেশ।

বোলিংয়ে বাংলাদেশের শুরুটা ভালো না হলেও মাঝের ওভারগুলোতে স্পিনারদের আক্রমণে এলোমেলো হয়ে যায় আফগানিস্তান। তিন স্পিনার মিরাজ, মোসাদ্দেক ও সাকিব এমনভাবে তাদের আটকে ধরেন যে, বের হওয়ার পথ খুঁজে পাচ্ছিল না আফগানরা। সাকিবের একের পর এক আক্রমণ, মিরাজের ধারাবাহিক বোলিং ও মোসাদ্দেকের একেকটি ঘূর্ণিতে পথ হারায় নবী, নাইবরা।  শেষ দিকে মুস্তাফিজও পেয়েছেন ২ উইকেট।  আফগান কফিনে শেষ পেরেকটি ঢুকে দেন সাইফউদ্দিন।

বোলিংয়ে বাংলাদেশ ১৫৮ ডট বল দিয়েছে। বাউন্ডারি হজম করেছে ১৩টি। ছক্কা মাত্র ১টি। ১০ ওভারে ১ মেডেন, ২৯ রানে ৫ উইকেট নিয়ে সাকিব সেরা।  চলতি বিশ্বকাপের যা সেরা বোলিং ফিগার। ৩০ রানে ৫ উইকেট পেয়েছিলেন পাকিস্তানের মোহাম্মদ আমির, অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। 

দারুণ জয়ে বাংলাদেশ উঠে এসেছে পয়েন্ট টেবিলের পাঁচে। বাংলাদেশের পরবর্তী দুই ম্যাচ ভারত ও পাকিস্তানের বিপক্ষে। এশিয়ার দুই জায়ান্টকে শেষ দুই ম্যাচে হারাতে পারলে বাংলাদেশ উঠে যেতে পারে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে। আপাতত জয়ের সুখস্মৃতি নিয়েই বার্মিংহাম যাচ্ছে বাংলাদেশ। 

 

রাইজিংবিডি/সাউদাম্পটন/২৫ জুন ২০১৯/ইয়াসিন/পরাগ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়