ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

বুক রিভিউ

অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

অঞ্জন আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৬, ১৪ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

অঞ্জন আচার্য: দক্ষিণ এশিয়ার মানচিত্রে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয় খুব বেশি বছর আগের ঘটনা নয়। কিন্তু এদেশ ও মানুষের ইতিহাসের সূচনা ঘটেছে খ্রিষ্টপূর্ব প্রায় এক হাজার বছর আগে। বর্তমান বাংলাদেশের ভূখণ্ডে কয়েকটি প্রাথমিক ধরনের রাষ্ট্রীয় কাঠামো বিদ্যমান ছিল খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম ও চতুর্থ শতাব্দীতে এই ভূখণ্ড অন্তর্ভুক্ত ছিল প্রাচীন মৌর্য ও গুপ্ত সাম্র্রাজ্যের। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর বাংলাদেশে এবং বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গে সামন্তবাদী স্বাধীন বঙ্গরাজ্যের গোড়াপত্তন হয়, যার অস্তিত্ব বজায় ছিল দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত। ১১৯৯ থেকে ১২০২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল অধিকৃত হয় দিল্লির সুলতান ঘোরির (১১৮৫-১২০৬) সৈন্যবাহিনী দিয়ে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলও মুসলিম বাহিনীর করায়ত্ত হয়। একই সঙ্গে ইসলাম ধর্মও প্রসার লাভ করে।

দিল্লির সুলতানদের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে আসার ফলে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলার সুবেদাররা এ অঞ্চলে কার্যত তাদের স্বাধীন রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তোলেন। ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মোঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় বাংলাদেশের ভূখণ্ড। সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলার প্রশাসনিক  এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয় ঢাকা। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মোঘল সাম্রাজ্যের দুর্বলতা, অন্তর্কলহ, পারস্য ও আফগান অনুপ্রবেশ প্রভৃতির সুযোগে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশের এক বিশাল এলাকাজুড়ে দখলদারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ১৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলা কার্যত চলে আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে। ফলে ব্রিটেনে কৃষিজ কাঁচামাল পাচারের উৎসে পরিণত হয় বাংলা। ভেঙে পড়তে থাকে শহর-নগরের সামাজিক-অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড। কুটির শিল্প ও কৃষির অবনতি হতে থাকে। মোট কথা, দেশ নিঃস্বতার দিকে অগ্রসর হয়। বাংলার ইতিহাসের ঔপনিবেশিক অধ্যায়ে (১৭৫৭-১৯৪৭) অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো ধীরে ধীরে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। আর বর্তমান বাংলাদেশের অঞ্চলগুলো পরিণত হয় জনবহুল গ্রামাঞ্চলে। অন্যদিকে ব্যাপক ফসলহানি ও দুর্ভিক্ষের শিকার হতে থাকে এ অঞ্চলের মানুষ।

প্রায় দুইশ বছর ব্রিটিশ শাসন করে অবিভক্ত ভারত। অবশেষে ১৯৪৭ সালের ৩ জুলাই প্রণীত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংক্রান্ত আইনের অধীনে হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল ভারতের এবং মুসলিম প্রধান অঞ্চল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ভারতের উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্বাংশে মুসলমানেরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। ফলে দুটি খণ্ডিত অঞ্চলের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল পাকিস্তান (পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান)। পরস্পরের মধ্যকার প্রায় ১৬শ কিলোমিটার দূরবর্তী এই দুই অঞ্চলের মধ্যবর্তী অঞ্চলজুড়ে অবস্থান করছিল ভারত। ১৯৪৭ সালে এই দুটি ভূখণ্ডের সাধারণ জনগণ কেবল ধর্ম ছাড়া আর কোনো ক্ষেত্রেই সম্পর্কিত ছিল না। পাকিস্তানের জন্মলাভ বাংলাকেও করেছিল দ্বিখণ্ডিত। বাংলার অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর পশ্চিমাঞ্চল ভারতের আর পূর্বাঞ্চল পাকিস্তানের অংশে পরিণত হয়। পাকিস্তান গঠনের সময় ব্রিটিশ শাসকরা এই রাষ্ট্রের নেতৃত্ব অর্পণ করে মুসলিম লীগের হাতে। এ দলের নেতৃত্বে আসীন ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের ভূস্বামী পরিবারসমূহ এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত ধনী মুসলিম ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিরা। দ্বিতীয় গোষ্ঠী ভারত বিভক্তির পর করাচি এবং অন্যান্য শহরে এসে বসতি গড়ে। শুরু থেকেই পাকিস্তানের ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ও সামাজিক-অর্থনৈতিক নীতির উদ্দেশ্য ছিল পাঞ্জাবি ভূস্বামীদের এবং পশ্চিম পাকিস্তানি ধনিক শ্রেণির অবস্থান আরো উন্নত করা। তাই তাদের পরিচালিত নীতি উক্ত ধনীগোষ্ঠীকে দ্রুত বিকাশে সাহায্য করছিল। পূর্ববাংলার মাঝারি ও ক্ষুদ্র পুঁজিপতিদের মুনাফা আত্মসাৎ করে নিতে থাকে তারা। যার ফলে পূর্ববাংলার পুঁজিপতিরা তাদের সঞ্চিত পুঁজিকে অর্থনীতির উৎপাদনমূলক খাতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখীন হয়। সূচিত হয় সামাজিক-অর্থনৈতিক সংঘাত। সেই সংঘাত রাজনৈতিক রূপ পায় ভাষার প্রশ্নে। উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষায় পরিণত করতে উদ্যোগী হয় শাসকগোষ্ঠী। বাংলার ওপর এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চায় তারা। অথচ উর্দু ছিল পূর্ববাংলার মাত্র এক শতাংশ অধিবাসীর মাতৃভাষা। বিদ্যমান সমস্যা ও সংকটের মধ্যেই পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগ, যা তৎকালীন বাংলার অঞ্চলের জনসাধারণের প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে এরই মাঝে ১৯৫৪ সালে প্রথমে পূর্ব এবং পরে পশ্চিম পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করা হয় কমিউনিস্ট পার্টির সকল কার্যকলাপ। এভাবে চলতে চলতে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন এবং সবশেষ ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতীধারা বইটিকে দুটি পর্বে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম পর্ব : ‘বাংলাদেশের রাজনীতি ১৯৭১-১৯৭৫’। এ পর্বে আলোচিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক জীবনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে গৃহীত পদক্ষেপসমূহ, বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামো, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন ও গ্রহণ, পররাষ্ট্রনীতি এবং সোভিয়েত-বাংলাদেশ সম্পর্ক, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, মুজিববাদ, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর কর্মতৎপরতা, প্রথম সংসদ নির্বাচন, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ও গণ-ঐক্যজোট গঠন, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও দেশের সংকট বৃদ্ধির পটভূমি, দেশের রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক কাঠামোর পুনর্গঠন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থান এবং সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা।

দ্বিতীয় পর্ব ‘সামারিক অভ্যুত্থান ও তৎপরবর্তী রাজনীতি ১৯৭৫-১৯৮৫’। এতে আলোচিত হয়েছে সামরিক আইন জারি : রাজনীতিতে ডানপন্থিতার সূচনা, জিয়াউর রহমানের শাসনকাল : রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মতৎপরতা, দেশের পরিস্থিতিতে স্থিরতা আনতে পথ অনুসন্ধান, জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও জাতীয়তাবাদী দল গঠন, দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন, জিয়া সরকারের নির্বাচন-উত্তর নীতি, সংসদ নির্বাচন-উত্তরকালে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে জটিলতা সৃষ্টি, চট্টগ্রামে সেনাবিদ্রোহ ও জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড, অন্তবর্তীকালীন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও আবদুস সাত্তার সরকারের রাজনীতি, এরশাদের সামরিক শাসন আমলে বাংলাদেশ, সামরিক সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও পররাষ্ট্রনীতি, রাষ্ট্রক্ষমতার বেসামরিকীকরণের জন্য বিরোধী দলগুলোর সংগ্রাম, নিজের অবস্থান দৃঢ়করণে এরশাদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা ইত্যাদি।

অষ্টাদশ শতাব্দীতেই রাশিয়ায় প্রথমবারে মতো বাঙালি জাতির ইতিহাস, সংস্কৃতি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কিত গবেষণা শুরু হয়। বঙ্গচর্চায় বিখ্যাত রুশ প্রাচ্যবিদ লিয়েবেদেভ (১৭৪৯-১৮১৯) এবং মিনায়েভ (১৮৪০-১৮৯০)-এর অবদানের কথা সর্বজনবিদিত। মহান অক্টোবর বিপ্লবের পর বঙ্গচর্চার ঐতিহ্য ধরে রাখেন : আ.প. বারান্নিকভ, আ.স. জিমি, দ.আ. সুলেইকিন, ম.ই. তুব্‌ইয়ানস্কি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে ইয়া ল্যুস্তেরনিক, ভ.আ. নোভিকভা, ইয়ে ম. বিকভা, আ.প. গ্রাতিউক-দানিয়েলচুক, ভ.ই. ইভবুলিস, ই.ভ. পায়েভস্কায়া, ই.দ. সেরেবরিকভ, ই.আ. তোভ্স্তিক, ল.ম. চেভকিনা এবং অন্যান্য গবেষক। বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাস, ইংরেজ ঔপনিবেশিক রাজনীতির বৈশিষ্টসমূহ, বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের উৎপত্তি ও বিকাশের সমস্যাসমূহ নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন আ.ম. দিয়াকভ, ক.আ. আস্তনভা, এ.ন. কামারোভ, ভ.ই. পাভলভ, র.আ. উলিয়ানভস্কি, আ.ই. চিচেরোভ প্রমুখ। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সালব্যাপী পূর্ববাংলার আধুনিক ইতিহাস, অর্থনীতি, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিকাশ সম্পর্কে অসংখ্য গবেষণা কাজ প্রকাশ করেন : স.স. বারানভ্‌, স.ভ. লেভিন, ভ. ইয়া বেলোক্রেনিত্স্কি, ল.র. গরদনপলন্‌য়া প্রমুখ। এছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে বেশি কিছু প্রবন্ধ-সংকলন। ভ্লাদিমির পুচকভ-এর এ বইটি রাশিয়ায় প্রকাশিত প্রথম ও একমাত্র বই, যাতে বাংলাদেশ গঠনের শুরু থেকে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এদেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিবর্তনের বৈশিষ্ট্যসমূহ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বইটির বিভিন্ন অধ্যায় অনুবাদ করেছেন : অভিজিৎ পোদ্দার, ফখরুজ্জামান বাবুল, কাজী তৌফিকুল ইসলাম, রুচিরা তাবাসসুম নভেদ, মুশফিকুর রহমান বাবলা, আতাউর রহমান মুকুল, খন্দকার রহমতউল্লা টিটো এবং সুপ্রভাত রায়। বইটিতে আলোচনা করা হয়েছে ১৯৭১ সাল থেকে ১৯৮৫ সালকালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনসমূহের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিধারা : ১৯৭১-১৯৮৫; লেখক : ভ্লাদিমির পুচকভ; প্রকাশক : দ্যু প্রকাশন; প্রচ্ছদ : মিতা মেহেদী; পৃষ্ঠা : ২১৬; মূল্য : ৩০০ টাকা।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়