ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

আইজাক বাশেভিস সিঙ্গারের গল্প ।। বোকা গিম্পেল

এমদাদ রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৪২, ১৪ আগস্ট ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আইজাক বাশেভিস সিঙ্গারের গল্প ।। বোকা গিম্পেল

অলঙ্করণ : শতাব্দী জাহিদ

অনুবাদ ।। এমদাদ রহমান

 

আমিই সে লোক, বুঝলেন, মানে, আমিই বোকা গিম্পেল; কিন্তু বললে কী আর হয়, আমি তো নিজেকে কখনওই বোকা মনে করি না, মনে মনে বরং উল্টোটাই ভাবি। কিন্তু লোকে আমাকে বোকাই বলে! তারা যখন আমাকে এই নামটি ধরে ডাকতে শুরু করেছিল, তখনও আমি স্কুলে পড়ছি। স্কুলে সব মিলিয়ে আমার মাত্র সাতটি নাম ছিল- হারামি, গর্দভ, মাথামোটা, উজবুক, মনমরা, হাবা এবং বোকা। এই শেষ নামটাই আমার আজীবনের সঙ্গি হয়ে গেল। তো, কেমন ছিল আমার বোকামির ধরন? পুরো ব্যাপারটিই এমন, চাইলেই যে কেউ আমাকে অতি সহজে বোকা বানিয়ে দিতে পারতো। ওরা আমাকে বলতো- গিম্পেল, শুনেছিস, আমাদের র‌্যাবাই-বৌ তো (র‌্যাবাই  ইহুদি আইনের শিক্ষক এবং ধর্মযাজক) বাচ্চার জন্ম দিতে চলেছে। ওদের কথায় বিশ্বাস করে আমি সেদিন আর স্কুলেই গেলাম না। পরে জানা গেল সম্পূর্ণ ব্যাপারটিই মিথ্যা। কিন্তু আমি কী করব! র‌্যাবাই-বৌয়ের পেটটা ফুলে ওঠেছে কি ওঠেনি তা তো বলতে পারি না, কারণ আমি তো তার বৌয়ের পেটের দিকে কখনও তাকাইনি। না তাকানোটা কি খুব বোকামো হয়ে গেল? আমাকে বোকা বানাবার দলটি আমার এসব কাণ্ডে হেসে গড়িয়ে পড়ত এ ওর গায়ে, তারা ঠাট্টা তামাশা করতো, আর গান গাইত কোরাসে, যেন আজকের এই শুভরাত্রিটিকে নিবেদনের জন্য এই একটা গানই আছে, এই একটাই মাত্র প্রার্থনা সঙ্গীত, আর হতো কী, কোনও মহিলার ঘরে বাচ্চা হলে রীতিমাফিক ছোটদের মুঠোভরে যে সুলতানা (কিশমিশ) দেওয়া হতো, সেই সুলতানার বদলে তারা সব সময়ই আমার মুঠোয় ভরে দিতো ছাগলনাদির দলা। কিন্তু আমি তো আর শালার দুর্বল লোক ছিলাম না, গায়ে জোরও যথেষ্ট ছিল। যদি আমি কারও গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে বসতাম, তাহলে চোখের পলকে সে ক্রাকো যাওয়ার পুরো রাস্তাটিকে চোখের সামনে দেখতে পেতো। কিন্তু হয়েছে কী, স্বভাবগত দিক থেকে আমি অলস প্রকৃতির ছিলাম না বলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম- মারপিটের চিন্তা একদম বাদ। আর ওরা ঠিক এই সুযোগটিই নিতো।

ক’দিন পরে ইশকুল ছুটির পর পথে শুনতে পেলাম- পেছনে ক্ষ্যাপা কুকুর ডাকছে! যদিও কুকুর আমি ভয় পেতাম না, তাই বলে তাদের ক্ষেপিয়ে দিতেও চাইতাম না কখনও। এটা তো ভালো করেই জানতাম যে কুকুরদের ক্ষেপিয়ে লাভ নেই।  ভিড়ের যে কোনও একটি কুকুর তো পাগলও হতে পারে, আর হঠাৎ কী মনে করে যদি কামড়ে দেয়, তাহলে এই পৃথিবীতে এমন একজনও তাতার নেই যে তোমাকে রক্ষা করতে পারবে। তাই পেছনে কুকুরের ডাক শুনেও আমি ফিরে তাকালাম না, সমানে এগোতে লাগলাম; কী মনে করে এক সময় চারপাশে তাকাতেই দেখলাম বাজারের সবাই বন্য হাসিতে ফেটে পড়ছে। আসলে আমার পেছনে কুকুর ডাকছিল না, তাদের হয়ে ডাকছিল এলাকার চোরচোট্টা আর বাটুয়া লোকটি- লিয়েভ। সেই এতক্ষণ কুকুর সেজে পিছু নিয়েছিল। কিন্তু এদের এই চালাকিটা আমি কীভাবে বুঝব? পেছনের ডাকটা ছিল এমন যেন কোনও হিংস্র জন্তু অবজ্ঞা আর কৌতুকে উৎকট চেঁচাচ্ছে।

                যে-কাউকে বোকা বানাতে আর ঠাট্টা করতে যারা ওস্তাদ, তারা বুঝে গেল যে আমি খুব সহজেই কাবু হয়ে যাই। এ কাজটা তাদের জন্য ছিল জলের মতো সহজ। তখন দলের সকলেই পালাক্রমে আমাকে বোকা বানিয়ে যেতে লাগলো- এই গিম্পেল, ফ্র্যামপোলে আজ মহামান্য জার আসছেন; গিম্পেল, টারবিনে হয়েছে কী, গতরাতে পুরো চাঁদটাই খসে পড়েছে; গিম্পেল, শুনেছিস পিচ্চি হোডেলের কাণ্ড, গোসলখানার ঠিক পেছনেই সে খুঁজে পেয়েছে অঢেল গুপ্তধন! আমিও তাদের এসব কথা শুনে যেতাম একদম সেই গুলেমের মতো (ইহুদি মিথ অনুসারে- গুলেম হচ্ছে সহজে প্রতারিত হয় এমন এক পৌরাণিক প্রাণি যাকে সৃষ্টি করা হয়েছে কাদামাটি থেকে, তারপর প্রাণ দেওয়া হয়েছে। পুরাণে বর্ণিত একজন র‌্যাবাই মাটি থেকে মানুষের মতো একটি প্রাণি সৃষ্টি করেন, তারপর মুখে মন্ত্র ঢুকিয়ে তাকে জীবিত করে তোলেন। গুলেম প্রাগ-এর ইহুদি বসতিতে তাদের নানা কাজে সাহায্য করতো; সে ছিল অস্থির, অসহায় এবং শক্তিশালী, নির্ভিক; যে কোনও আক্রমণ থেকে ইহুদিদের রক্ষা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ) সবকিছু শুনে যেতাম আর বিশ্বাস করতাম, কেননা ‘আমাদের পিতাদের প্রজ্ঞা’ বইয়ে তো লেখাই আছে- প্রথমত, সব কিছুই সম্ভব, কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব তা অবশ্য আমি আর মনে রাখতে পারিনি, সবকিছু সম্ভবের ব্যাপারটি আমি বেমালুম ভুলে গেছি; দ্বিতিয়ত, পুরো একটি শহরের সমস্ত লোক মিলে আমাকে যখন কিছু একটা বোঝাতে চাইছে, বিশ্বাস করাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে, তখন তো আমাকে সব কিছুই বিশ্বাস করতে হয়। যদি আমি বুক ফুলিয়ে তাদেরকে বলতে যেতাম- আরে, তোমরা তো গুল মারছো, তোমাদের ইয়ার্কিটা বুঝতে পারছি, তখন তারা রেগে যেত না? রেগে গিয়ে ওরা বলতো না- তুমি কি বোঝাতে চাইছো বলো তো? আমরা মিথ্যা বলছি? মিথ্যা? সকলকে তুমি মিথ্যেবাদী বলতে চাইছো? সমগ্র পরিস্থিতি যদি এরকম হতো, তাহলে কী করার থাকতো আমার? ফলে, তাদেরকে আমার বিশ্বাস করতেই হতো, আর সেই সঙ্গে আশা করতে হতো যে এই বিশ্বাসের ফলে তাদের অন্তত কিছু পুণ্য সঞ্চয় হয়েছে।

                আমি তো সেই ছোটকাল থেকেই অনাথ। মা-বাবা কেউই নেই। কোথায় হারিয়ে গেছেন। যে-দাদা আমাকে বড় করেছিলেন, বয়সের ভারে বেঁকে যেতে যেতে তিনিও কবরের দিকে হাঁটা দিয়েছেন, ফলে সকলে আমাকে এক রুটি-কারখানায় নিয়ে যায় কাজের জন্য, কিন্তু হায়- সেখানেও, কী ঝঞ্ঝাটটাই না গেছে আমার ওপর দিয়ে! নুডলস্‌-এর থোকা সেঁকতে আসা মেয়েগুলো আর প্রত্যেকটি মহিলা, অন্তত একবার হলেও আমাকে বোকা বানাবেই- ‘গিম্পেল রে, স্বর্গে আজ বিরাট মেলা বসেছে; গিম্পেল রে, র‌্যাবাই-বউ সাতমাস যেতে না যেতেই আস্ত একটা বাছুর বিইয়েছে; শুনেছিস গিম্পেল, কার একটি গরু ছাদের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে পেতলের ইয়া বড় ডিম পেড়েছে।’ ইয়াশিভা থেকে একবার এক স্কুলের ছাত্র এলো গোল গোল রুটি কিনতে, সে বলল, ‘গিম্পেল রে, তুই যখন কোদালে রুটির ময়দা কাটছিলি, ঠিক তখনই যিশু (মানব জাতির ত্রাণের উদ্দেশ্যে যিশুর আগমন হবে বলে ইহুদিরা আশা করেন) এসে গেছেন; মৃতরা সব কবর ছেড়ে উঠে আসছেন।

বলিস কী?- বললাম আমি, কাউকেই তো শিঙা ফুঁকতে দেখলাম না!

সে বলল, তুই কি ভাই আজকাল কানেও শুনতে পাস না?

ইয়েশিভার সেই ছাত্রটির এ-কথা বলবার সঙ্গে সঙ্গে সমবেত সকলে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো- আমরা শুনেছি, আমরা শুনেছি, ঘটনা সত্য, ঘটনা সত্য...

মোমবাতির কারখানা থেকে দৌড়ে আসা রিজ গলাটাকে যথাসম্ভব রুক্ষ করে বলতে লাগলো- গিম্পেল, তুই এখনও এখানে! বলিস কী রে! এদিকে তোর মা বাবা কবর থেকে উঠে এসেছেন, তোকে খুঁজছেন!

একদম সত্যি কথাটিই বলছি- আমি খুব ভালো করেই জানতাম যে এমন কিছুই ঘটেনি, এমন ঘটনা ঘটতেই পারে না। তবুও কেন জানি মনে হলো এতগুলো লোকে কথাটা বলছে যখন, তাহলে কিছু একটা আসলেই ঘটেছে, উলের জাম্পারটা গায়ে গলিয়ে এক দৌড়ে গিয়ে দেখাই যাক না! যদি সত্যি সত্যিই তারা ফিরে আসেন। গিয়ে দেখতে তো আর দোষের কিছু নেই। আমি দৌড় লাগাতেই তারা বেড়ালের ডাক ডাকতে শুরু করে দিল।

                আর, তখনই আমি মানত করলাম যে আর কিছুকেই কোনওদিন বিশ্বাস করব না। কিন্তু আমার এসব মানত ফানতে কাজের কাজ কিছুই হল না; তারা আমাকে এমনভাবে বোকা বানাতো যে আমার মাথার ভিতরে সব কিছুই উলটপালট হয়ে যেত।

                কোনও একটা উপায় বের করতে একদিন আমাদের র‌্যাবাইয়ের কাছে গেলাম, এসবের প্রতিকার চাইলাম; র‌্যাবাই বললেন, বর্ণিত হয়েছে যে একঘণ্টা পাপ করার চেয়ে সারা বছর বোকামি করা ভালো। তুমি মোটেও বোকা নও গিম্পেল, যে বা যারা তোমার সঙ্গে ইয়ার্কি বেলেঙ্গি ইত্যাদি মারছে, বোকা তারাই। দেখো, পবিত্র গ্রন্থ কী বলছে। বর্ণিত হয়েছে- যে-ব্যক্তি তার পাড়া-পরশিকে লজ্জিত করে, স্বর্গের বাগানে সে আর প্রবেশ করতে পারবে না। এতসব কথা সত্ত্বেও, স্বয়ং র‌্যাবাইয়ের মেয়েটিই যদি আমাকে বোকা বানায়, তাহলে আর যাবো কোথায়! আমি যখন র‌্যাবাইয়ের বিচার-ঘর থেকে বের হতে যাচ্ছিলাম, মেয়েটি তখন কোত্থেকে যে উড়ে এল আর আমাকে বলল, তুমি কি এখনও দেয়ালে চুমু খাওনি?

                না তো! কেন?

                উত্তরে সে বলল, এটাই তো এখানকার আইন, ঠিক যতবার এখানে কেউ আসবে, যাওয়ার সময় ঠিক ততোবারই দেয়ালে চুমু খাবে।

                দেয়ালে চুমু খেতে তো কোনও লাভক্ষতি নেই, অন্তত আমি এখনও দেয়ালে চুমু খাওয়ার ব্যাপারে কোনও ক্ষতির কথা শুনিনি। কিন্তু চুমু খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই র‌্যাবাইয়ের মেয়েটি খলখল হাসিতে ফেটে পড়ল। আমাকে বোকা বানাবার দারুণ একটা খেলা সে শেষতক আবিষ্কার করতে পেরেছে। বোকা বানাবার খেলার একটি কৌশল আমার ওপর প্রয়োগ করে দারুণ সফল হয়েছে সে। ঠিক আছে। আমি ভাবলাম।

                পরে আমি অন্য কোথাও চলে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু এটা সবাই জেনে ফেলবার পর আমার বিয়ের ঘটকালি শুরু হয়ে গেল মহা উৎসাহে। আমার বিয়ের ব্যাপারে সবাই এমন মরিয়া হয়ে পেছনে ঘুরঘুর করতে শুরু করলো যে মনে হচ্ছিল তারা বুঝি আমার জোব্বার পেছনটাই কাকুতি মিনতি করতে করতে ছিঁড়ে ফেলে দেবে। তারা আমাকে বিয়ের ভালোমন্দ বোঝাতে শুরু করে দিল আর ঠিক ততোক্ষণই বোঝাল যতক্ষণ না আমি কানে পানি ঢুকিয়ে দিলাম যাতে কানে একদম তালা লেগে যায় আর আমি বেঁচে যাই, কারণ আর এসব নিতে পারছিলাম না। মেয়েটি বহুচারিতা থেকে মুক্ত ছিল না কিন্তু সকলে বোঝাল যে সে এখনও কুমারি। তাছাড়া মেয়েটির একটি পায়ে সমস্যা থাকার কারণে খুঁড়িয়ে হাঁটতো, তবু তারা বলল, প্রচণ্ড লাজুক বলেই ইচ্ছা করে সে এমন করে হাঁটে। তার একটি অবৈধ সন্তান ছিল, কিন্তু তারা বলল, ছেলেটি কোনও অবস্থাতেই অবৈধ নয় কারণ এ তার সবচে ছোট ভাই। বুঝুন অবস্থা।

                তাদের কোনওভাবে বোঝাতে না পেরে শেষমেষ চিৎকার করে উঠলাম- তোমরা শুধুশুধু সময় নষ্ট করছো। আমি কিছুতেই ওই খানকিটাকে বিয়ে করব না।

                তারা তবু দমে যাওয়ার লোক নয়, আমাকে বলল, এভাবে কথা বলার মানে কী? তোমার কি লজ্জাশরমও নেই? এখন আমরা তো তোমাকে র‌্যাবাইয়ের দপ্তরে নিয়ে যাবো, মেয়েটিকে খানকি বলে ডাকবার অপরাধে তোমার জরিমানা হবে।

                দেখলাম যে এদের হাত থেকে আমার নিস্তার নেই, এখন আর পালিয়ে যাওয়ারও উপায় নেই, যাওয়াটা সম্ভবও নয়, কাজেই আমাকে ভাবতে হলো- ওরা তো আমাকে তাদের হাস্যকৌতুকের একমাত্র লক্ষ করে নিয়েছে, তাই আমাকে সহজে ছাড়বে না; এখন, কথা হলো বিয়ের পর তো বৌয়ের স্বামীই তার সবকিছু, স্বামীই তার পতি, তার প্রভু; এতে যদি মেয়েটি রাজি থাকে তাহলে তো আমার কোনও আপত্তি নাই। একটা কথা তো অবশ্যই সত্য যে আগুনের প্রচণ্ড তাপ ও জ্বালাকে উপেক্ষা করে জীবনের পথে চলা যায় না, তাই আগুনকে উপেক্ষা করার আশা করাও ঠিক নয়।

                একদিন মেয়েটির মাটির বাড়িতে গেলাম, ঘরগুলি বানানো হয়েছিল বালি আর কাদামাটি দিয়ে, সেদিন আমার সঙ্গে জুটেছিল শহরের সব বাটুয়া আর বেজন্মার দল, তারা হেসে ঢলে পড়তে পড়তে আর চিৎকার করতে করতে আসছিল আমার পিছু পিছু। তারা এমন অভিনয় করছিল যাতে মনে হচ্ছিল তাদের কাছে আমি তাদের পোষমানা একটি ভালুক ছাড়া আর কিছুই না। যেন, কিছুক্ষণ পর পর তারা আমাকে নিয়ে ইচ্ছাখুশি খেলাবে, লোকে সে খেলা দেখে হেসে খুন হবে। বাড়ির কুয়োর কাছে এসে ওরা থেমে গেল, আমার মতো, ভয়ে তারা এলকার সঙ্গে একটা কথাও বলতে পারল না। এলকার মুখটা কথা বলার সময় এমনভাবে খুলে যায় যে মনে হয় যেন একটা কব্জা লাগানো দরজা। তার ছিল একখানা ধারাল চাকুর মতো জিহ্বা। ভয়ানক। আমি এলকার ঘরে ঢুকলাম, ভিতরে এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়ালে টানানো দড়ি, সে দড়িতে কাপড় শুকোচ্ছে এলকা; সে খালি পায়ে চৌবাচ্চার কাছে দাঁড়িয়ে আরও কাপড় কেচে চলেছে, পরে আছে রঙজ্বলা পুরোনো রেশমি গাউন।

                এলকা মাথার চুলগুলোকে ঝুঁটি বেঁধে খুব কৌশলে পিন দিয়ে আটকে রেখেছে। কেমন এক গা গুলোনো বোটকা গন্ধে জায়গাটা ভরে আছে যে কী বলবো! মুহূর্তে মুহূর্তে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।

                দেখলাম, আমি যে কে সে তা জানে। আমাকে একবার আড়চোখে দেখেই সে বলল, কে এসেছে, আজ কে এসেছে দেখো, সেই লোকটা, সেই নীরস গাধাটা। জলদি বসার কিছু নিয়ে এসো।

                তাকে খুলে বললাম সবকিছু, কিছুই লুকোলাম না : আমাকে সত্যি কথাটাই বলবে। তুমি এখনও কুমারি আছো? আর ওই হতচ্ছাড়া ঈশেল কি সত্যিই তোমার ছোট ভাই? দেখো, ছলচাতুরি করবে না, আমি অনাথ মানুষ, কেউই নেই।

‘আমিও নিজেও অনাথ’, এলকা বলল, আর কেউ যদি ছলনা করে একটিও প্যাঁচালো কথা বলে তাহলে তার নাকেও যেন গিঁট লেগে যায়। কেউ যেন ইচ্ছাখুশি কথা বলে আমাকে বিপদে ফেলে সুবিধা নিতে না পারে। আমি পণ হিসেবে পঞ্চাশ গিলডার দাবি করছি। আর ওরা যেন চাঁদা তুলে আরও কিছু মালকড়ি দেয়, না দিলে ওরা সবাই যেন আমার ওই জায়গায় চুমা খায়। জায়গাটা যে কোথায়, তা নিশ্চয়ই কারও অজানা নয়, আমি নাই বা বললাম।

                দেখলাম, এলকা বেশ সোজা কথার মানুষ, তেমন প্যাঁচঘোচ নেই ভিতরে, কথাবার্তা খোলাখুলিই বলে। আমি তাকে বললাম, পণ কনে দেয় বলেই জানি, বর তো কখনও পণ দেয় না।

                এলকা শুনে বলল, আমার সঙ্গে এতো হিসাব আর দরাদরি দেখাতে এসো না, হয় হ্যাঁ বলবে, যা বলেছি মেনে নিবে, নয় তো সোজা না বলবে, তারপর ঠিক যেখান থেকে এসেছ ঠিক সেখানে ফিরে যাবে।

                আমি ভেবেছিলাম- এই মাখানো ময়দা দিয়ে আর রুটি বানানো যাবে না কিন্তু আমাদের এই জায়গাটি ওতো গরিব নয়, শহরের লোকজন এলকার সব শর্তে রাজি হয়ে গেল আর বিয়ের উৎসবের প্রস্তুতি নিয়ে শুরু করে দিল। ঘটনাচক্রে, সেই সময়ে আমাদের শহরে পাতলা পায়খানা ছড়িয়ে পড়েছিল, অনেকেই আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল সে অসুখে, ফলে বিয়ের উৎসবটি কবরখানার ফটকের পাশে অনুষ্ঠিত হলো, ঠিক সেখানে, যেখানে লাশকে গোসল দেওয়ার জন্য কুঁড়েঘরটি তৈরি করা হয়েছিল। অতিথিরা মদ খেতে খেতে বেসামাল হলো। যখন বিয়ের চুক্তিনামা লেখা শুরু হলো, তখন আমাদের সবচে পবিত্র, বিশ্বস্ত আর সবচে বড় র‌্যাবাই জানতে চাইলেন- কনে কি বিধবা, বা, অতীতে তার কি বিচ্ছেদ হয়েছিল, তখন স্যাক্সটনের (গির্জার কবর খোঁড়া আর ঘণ্টা বাজাবার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি'র) স্ত্রী কনের পক্ষ থেকে জবাব দিল- সে বিধবাও হয়েছে, তালাকও পেয়েছে।

                সেই মুহূর্তটিকে বড় কালো বড় অন্ধকার মনে হয়েছিল। কিন্তু তখন আর কী-ই-বা করার ছিল আমার! কী করতে পারতাম? বিয়ের আসর ছেড়ে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া কোনও বরের পক্ষে সম্ভব?

                তারপর ওরা হুল্লোড়ে গান গাইলো, নাচলোও। বৃদ্ধা দাদিমা আমার কাছেপিঠেই নাচলেন কনের মা বাবার স্মৃতির উদ্দেশ্যে। তার নাচের পরই শুরু হলো প্রার্থনা; ছোটরা ছড়িয়ে দিল কাপড়ে লেগে থাকবার চোরকাঁটা যা তারা তিশে বা'আভের দিনের উপোষের সময় ছড়ায়। হিতোপদেশের পর উপহারের পালা এলো। নুডলস্‌ মাখাবার পিঁড়ি, ময়দা মাখার পাতিল, বালতি, ঝাড়ু, হাতা আর গৃহস্থালি দরকারে লাগে এমন সব দ্রব্যের সম্ভার ছিল উপহার তালিকায়। সুদর্শন দু'জন তরুণকে দেখলাম যাদের হাতে ছিল দোলনা, যেসব দোলনায় শিশুরা আরামসে ঘুমোয়। 'এটা কোন কাজে লাগবে?' আমি জানতে চাইলাম। তারা বলল, এ নিয়ে এখনই তুমি মাথা খারাপ করে ফেলো না, এটা খুবই দরকারি জিনিস, ভবিষ্যতে কাজে আসবে। বুঝলাম আমাকে নিয়ে ইয়ার্কি ঠাট্টা হচ্ছে। এখন যদি, অন্যভাবে ভাবি, তাহলে দেখবো- জিনিসটি তো আমার কোনও ক্ষতি করছে না। ক্ষতি করছে না যখন, তাহলে ঘরের কোণায় থাকুক না পড়ে। মনে মনে বললাম, আমিও দেখবো রে ভাই মালটা কী কাজে লাগে। পুরো শহরটা একসঙ্গে তো আর পাগল হয়ে যাচ্ছে না।

।।২।।

রাতে, সেখানেই চলে এলাম যেখানে আমার স্ত্রী শুয়েছিল কিন্তু সে তার কাছে ঘেঁষতেই দিল না আমাকে, ফিরিয়ে দিল। আরে কী করছো তুমি? দেখো, দূরে দূরে থাকবার জন্যই কি আমাদের বিয়ে হয়েছে? আমি বললাম। উত্তরে, সঙ্গে সঙ্গে সে বলল, আমার মাসিক হয়েছে।

                কিন্তু ওরা যে গতকালই তোমাকে পবিত্রস্নানে নিয়ে গেলো! পবিত্রস্নান তো মাসিকের পরেই হয়, না কি? তাহলে কেমনে কী হলো?

                এলকা রোষে বলে উঠল- আজ তো আর গতকাল নয় আর গতকালও নয় আজ। আর, দেখো, তুমি যদি এসব দেখতে না পারো তো দূর হও।

                এরপর আমাকে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করতে হবে না। তাই করবো।

                এদিকে, বিয়ের চার মাসও যায়নি, বৌয়ের উঠলো প্রসব ব্যথা। শহরের লোকেরা এ-ঘটনায় খুব হাসতে লাগলো, নিজেদের হাসিমুখকে তারা ঢাকতে লাগলো মুঠোকরা হাতের আঙুলের গাঁট দিয়ে। কিন্তু, আমার কী করার আছে? কী করতে পারতাম? এলকা অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে মরছিল আর দেয়ালে আঘাত করছিল, আঁচড়াচ্ছিল। গিম্পেল, সে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো- গিম্পেল আমি চলে যাচ্ছি, আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে, ক্ষমা করে দিও। দেখতে দেখতে ঘরটি মেয়েমানুষে ভরে গেল। তারা বড় পাত্রে জল গরম করতে শুরু করলো। এলকার চিৎকার বাড়তে লাগলো উত্তরোত্তর। আমি মনে করলাম- ঠিক এখনই আমাকে প্রার্থনা-ঘরে চলে যাওয়া উচিৎ, এখনই আমাকে স্তোত্রগীতগুলোকে বারবার গাওয়া উচিৎ আর একমাত্র এটাই এখন আমি তার জন্য করতে পারি। শহরের লোকরাও প্রার্থনার ব্যাপারটি পছন্দ করলো- ঠিক আছে, ঠিক আছে, জলদি যাও গিম্পেল, জলদি যাও। আর তখন, সিনাগগের (ইহুদি প্রার্থনা-ঘর) এক কোণায় বসে আমি যখন প্রার্থনার উদ্দেশ্যে স্তোত্রগীতগুলো গাইছিলাম, শহরের লোকেরাও মাথা নেড়ে বলছিল- প্রার্থনা করো, প্রার্থনা করো, প্রার্থনা করে কেউ কোনও নারীকে আজ পর্যন্ত গর্ভবতী করতে পারেনি। সিনাগগের নিয়মিত একজন উপাসক আমার মুখে খড়ের কাঠি গুঁজে দিল, বলল, ‘একমাত্র গরুর জন্যই খড়’। ঈশ্বরই ভালো জানেন, হয়তো এই উপাসকের কথাতে সত্য লুকিয়ে ছিল।

                এলকা ছেলের জন্ম দিলো। শুক্রবারের সিনাগগে হলো কী, স্যাক্সটন (গির্জার কবর খোঁড়া আর ঘণ্টা বাজাবার দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি) গিয়ে দাঁড়াল সিন্দুকের সামনে, তারপর ঠিক যেখান থেকে কোনও ঘোষণা পাঠ করা হয়, সেখান থেকে ঘোষণা করলো- আমাদের সম্মানিত সম্পদশালী ব্যক্তি রীব গিম্পেল সন্তানের জন্ম উপলক্ষ্যে সকলকে ভোজের নিমন্ত্রণ করেছেন। সিনাগগ হাসিতে ফেটে পড়ল। আর তাতে আমার মুখ হয়ে উঠল আগুনের মতো লাল, যেন কেউ চুলায় দাউদাউ আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। কিন্তু মুখে আগুন হলে কী হবে, আমার তো সেখানে করবার কিছুই ছিল না। বাচ্চাটির খৎনা (ইহুদি ও মুসলিমদের মধ্যে প্রচলিত লিঙ্গচর্ম কেটে ফেলবার প্রথা) ও অন্যান্য দায়দায়িত্ব তো আমারই।

                শহরের লোকেরা উৎসবে ভেঙে পড়লো, দেখে মনে হলো অর্ধেক লোক এখানে চলে এসেছে, আর কসরত করে ঠেসে ঠুসেও কাউকে জায়গা দেওয়া যাবে না, ঘরটায়। মহিলারা নিয়ে এল গোলমরিচের গুঁড়োমাখা মটরদানা, শুঁড়িখানা থেকে এলো পিপাভর্তি বিয়ার। অন্যদের মতো আমিও পেটপুরে খেলাম। সকলে আমাকে অভিনন্দিত করলো। তারপর ছেলেটির খৎনা হলো। বাবার অবর্তমানে আমিই বাচ্চাটির নামকরণ করলাম। বাবার আত্মা শান্তি পাক। তারপর একে একে সকলে চলে গেল আর আমি তখন আমার ঘরে একাই রয়ে গেলাম, তখন আমার স্ত্রী তার খাটের চারপাশের পর্দা থেকে মুখ বের করলো, আমাকে দেখে তার কাছে যেতে ঈশারা করলো।

                গিম্পেল, হয়েছে কী তোমার? এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার মানে কী? ঝড়তুফানে তোমার মালভর্তি জাহাজ ডুবে টুবে যায়নি তো?

                আমি আর কী বলবো? আমার জন্য দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ কাজটাই তুমি করে দিয়েছ। হ্যাঁ, আমার জন্যই করেছ। আজ যদি মা এসব কথা জানতে পারতেন তাহলে আজই তিনি দ্বিতীয়বার মরতেন।

                সে বললো, তুমি কি পাগল নাকি অন্যকিছু?

                কীভাবে এতোটা বোকা তুমি আমাকে বানাতে পারলে? আর তাকেই তুমি বোকা বানালে ধর্মমতে যে তোমার সবকিছুর অধিকারী।

                ব্যাপারটা খুলে বলো তো দেখি, তুমি কি কিছু কল্পনা করতে শুরু করেছ?

                ভেবে দেখলাম এলকার সঙ্গে আজ আমি খোলাখুলি এবং স্পষ্ট ভাষায় কথা বলছি, যার কেউ নেই, যে অনাথ, এরকম কারও সঙ্গে কি এমন ব্যবহার করতে হয়? তুমি একটা পরিচয়হীন বাচ্চার জন্ম দিলে।

                উত্তরে সে বললো, মাথা থেকে এসব বালফালানি চিন্তা বাদ দিতে পারবে? এ তোমারই সন্তান।

                শুনেই রাগ চড়ে গেলে বললাম, কীভাবে আমার হলো? তার জন্ম হলো আমাদের বিয়ের মাত্র সতেরো সপ্তা পর।

                বাচ্চাটি অকালিক (প্রিম্যাচিউর, গর্ভধারণের ৩৮ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগে যার জন্ম হয়)।

                অকালিক তা বুঝলাম, কিন্তু এত অকালিক?

                এলকা বোঝাতে চাইলো- ওর এক দাদিমারও এরকম একটি অকালিক বাচ্চা হয়েছিল, জলের একটি ফোঁটার সঙ্গে অন্য ফোঁটাটির যে অচ্ছেদ্য সম্পর্ক আর আশ্চর্য মিল, তার সঙ্গেও দাদিমার সেরকমই মিল। সে যে একটুও মিথ্যে বলছে না এটা বোঝাতে গিয়ে এত্তগুলি শক্তিশালী দিব্যি দিল যে মেলায় দামাদামি করবার সময় কোনও চাষাও যদি এতোগুলি দিব্যি দিতো তাহলে যে কেউই তাকে বিশ্বাস করে বসতো। নির্জলা সত্য কথাটি বলতে হলে বলবো যে এলকাকে আমি বিশ্বাস করতে পারলাম না। কিন্তু পরের দিন যখন আমাদের এখানকার স্কুল-মাস্টারের কাছে এসব বিষয়ে আলাপ করলাম, শুনে তিনি বললেন ইভ ও আদমের জীবনেও নাকি এমন ঘটনা আছে। একসঙ্গে ঘুমোলেন দু'জন, উঠলেন চারজন হয়ে।

                শেষে এই বলে তিনি আমায় বুঝ দিলেন যে- দুনিয়ায় এমন একটিও মেয়ে নেই যে ইভের নাতনি নয়।

                আমার বেলায় এমনটাই ঘটতো সব সময়। যুক্তি দিয়ে তারা আমায় চুপ করিয়ে দিতো। কিন্তু সত্যি কথা ভাবতে গেলে কে-ই-বা বলতে পারে সত্যি কোনটা আর মিথ্যে কোনটা?

                সব দুঃখকে আমি ভুলতে চাইলাম। নবজাতকটিকে আমি পাগলের মতো ভালোবাসতাম, সেও আমাকে ভালোবাসতো। দেখামাত্রই তার ছোট্ট দু'টি হাত বাড়িয়ে দিতো, সঙ্গে সঙ্গে তাকে কোলে তুলে নিতাম। পেটের ব্যথায় কাঁদতে শুরু করলে একমাত্র আমিই তাকে শান্ত করতে পারতাম। নতুন-ওঠা দাঁতে কামড়াবার জন্য আমি তাকে কিনে দিলাম চুষনি আর একটা ছোট্ট সুন্দর টুপি। প্রায়ই তার ওপর শয়তানের কুদৃষ্টি পড়ত, তখন ঝাড়ফুঁকের জন্য এদিক সেদিক থেকে শিখে নিতাম নানাপ্রকারের হাউমাউখাউ মন্ত্র। আমি কাজও করতাম ঠিক ষাঁড়ের মতো, খাটুনি বাড়ছিল প্রতিদিন। এটা তো জানেন, বাড়িতে বাচ্চাকাচ্চা থাকলে খরচাপাতি কীরকম বেড়ে যায়। আর এব্যাপারে আমি আপনাদের কাছে মিথ্যে বলবো না- এলকাকে আর তেমন খারাপ লাগতো না। ভালোবাসা জন্মে গিয়েছিল। বুঝলেন তো ব্যাপারটা। সে আমাকে গালিগালাজ করতো, সব সময় কটু কথা বলতো; সে যখন কটমট করে আমার দিকে তাকাতো, ভয়ে আমি বাক্‌শক্তিহীন হয়ে পড়তাম। বাব্বা, সে যে কতো শক্তি ধরে তার কথায়! তার লেকচার শুনলে মনে হতো- গন্ধক আর আলকাতরা একসঙ্গে আগুনের তাপে ফুটছে। তবুও তার প্রত্যেকটি কথা পছন্দ করতাম। তার প্রত্যেকটি কথাই আমাকে রক্তাক্ত করতো, আহত করতো, তবুও তার কথাগুলি ভালো লাগতো।

                সন্ধ্যায়, ঘরে ফিরবার সময় ওর জন্য নিয়ে আসতাম একটি সাদা রুটি, একটি কালো রুটি, নিজের হাতে বানানো পোস্তদানার পিঠা। ওর জন্য খাবার চুরি করতেও ভালো লাগতো। প্রতিদিনই কিছু না কিছু চুরি করতাম, হাতের কাছে যা পেতাম তার থেকেই এটা সেটা। সুলতানা, আখরোট, ম্যাকারোনি, কেক। শনিবারে এখানকার মেয়েরা বেকারির চুল্লিতে যেসব খাবার গরম করতে রেখে যেত, সেখানেও হাত লাগাতাম-  একটুখানি পুডিং, মুরগির ঠ্যাং কি মাথা, গরুর নাড়িভুঁড়ি; তাড়াতাড়ি যতটুক লুকোনো যায়। এসব খেয়েই না এলকা দিনে দিনে মোটা আর সুন্দরী হয়ে ওঠছিল।

                পুরোটা সপ্তাহই আমাকে বেকারিতে রাত কাটাতে হতো, শুক্রবার ছাড়া, শুধু এই দিনটাই আমি বাড়িতে থাকতে পারতাম, মানে শুক্রবার রাতটাই আর ঠিক সে রাতেই সে নানা বাহানা খুঁজে বের করতো যাতে একসঙ্গে শুতে না হয়। কত বাহানা ছিল তার একটা তালিকা করলে যা পাওয়া যাবে- বুক জ্বালাপোড়া করছে, দম ফেলতে পারছে না, গায়ের এক পাশে অসহ্য জ্বলুনি, হেঁচকি উঠছে, মাথাটা চাপ মেরে ধরে আছে। আপনারা তো মেয়েলি অজুহাত সম্বন্ধে জানেন, কীরকম অদ্ভুত না সেসব? এসব শুনে খুবই খারাপ লাগতো। তার ওপর ওর আচুদা ছোট ভাইটা যতোই বড় হচ্ছিল ততোই শয়তান হচ্ছিল। সে প্রায়ই আমার পেছনে লাগতো। বিরক্ত হয়ে ছোকরাটিকে মারতে গেলে এলকা এতো জোরে চেঁচিয়ে উঠতো আর গালাগাল করতো যে আমার কান চোখ ইত্যাদি দিয়ে সবুজ কুয়াশার মতো গরম ভাপ বের হতো। দিনে দশবারেরও বেশি সে আমাকে তালাকের ডর দেখাতো। আমার জায়গায় আর কোনও গিম্পেল হলে সবকিছু ফেলে ভেগে যেতো। কিন্তু আমি তো এমন মানুষ যে নারীদের সবকিছুই নীরবে সয়ে যায়। মানুষ আর কী করতে পারে। যে-ঈশ্বর তাকে কাঁধ দিয়েছেন, বোঝাও তিনি দিয়েছেন।

                সে রাতে বেকারিতে দুর্ঘটনা ঘটল। চুল্লি ফেটে গিয়ে বেকারিতে তো অগ্নিকাণ্ডই ঘটে যেত। এরপর তেমন একটা কাজ ছিল না বলে বাড়ি চলে এলাম। কাজে থাকি তো, তাই সপ্তাহের মাঝখানে কোনও দিনও বাড়ি থাকতে পারি না বলে ভাবলাম যে এরকম এক রাতে ঘরে থাকবার মজাটা কেমন আজ তা বুঝব। তাড়াহুড়া করলাম না, তাতে হয়তো ঘুমের শিশুটি জেগে যাবে; পা টিপে টিপেই বাড়িতে ঢুকলাম, কেমন জানি গড়বড় লাগলো সবকিছু, ঘরে মনে হলো দু'জন ঘুমোচ্ছে, নাক একজনের ডাকছে না। একজনের নাক ডাকার শব্দ এমন মিহি যেন বহুদিন পর কুয়াশা পড়েছে আর দ্বিতীয় নাকটি এমনভাবে ডাকছে যেন জবাই করা ষাঁড়টি প্রচণ্ড আক্ষেপে গোঙাচ্ছে। ওহ্, ব্যাপারটা মোটেও ভালো লাগলো না। বিড়ালের মতো নিঃশব্দে খাটের কাছে গেলাম। আমার দুনিয়াটাই কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। দেখলাম- এলকার পাশে পুরুষের মতো দেখতে কেউ একজন শুয়ে আছে। আমার জায়গায় অন্য এক গিম্পেল হলে এই এখনই এমন চেঁচিয়ে উঠত যে শহরের সব ঘুমন্ত লোক জেগে যেতো। কিন্তু নিজেকে শান্ত করলাম কারণ এখন আমিও যদি ষাঁড়ের মতো তড়পাতে শুরু করি তাহলে ছেলেটার ঘুম ভেঙে যাবে, তারপর ভয়ে কান্না জুড়ে দেবে। ও তো মাত্রই ছোট্ট একটা বাচ্চা, এখনও ছোট্ট একটা চড়ুইছানার মতো, তাকে এমন ভয় পাইয়ে দেবার কী দরকার? অগত্যা ভাঙামনে ফিরে গেলাম আবার সেই বেকারিতে, ঘুমোতে চেষ্টা করতে লাগলাম ময়দার বস্তার ওপর, কিন্তু চোখ আর জোড়া লাগলো না, এমন কাঁপছিল শরীরটা যেন আমি দীর্ঘদিনের ম্যালেরিয়ার রোগী; নিজেকে বারবার শান্ত করছিলাম এভাবে- গবেটের মতো আর কতদিন বেঁচে থাকবি গিম্পেল? সবকিছুর একটা শেষ আছে না? তুমি তো আর সারাজীবন এমন বোবা থাকতে পারবা না।  গিম্পেলের মতো বোকাদের বোকামিরও একটা সীমা আছে।

                উপদেশের জন্য সকাল হতে না হতেই র‌্যাবাইর কাছে ছুটে গেলাম আর শহরে আমাদের নিয়ে হৈচৈ কাণ্ড বেঁধে গেল। এলকাকে ডেকে পাঠানো হলো। এলকা এলো বাচ্চাটিকে কোলে করে আর সবকিছু অস্বীকার করলো- আসলেই গিম্পেলের মাথা আউলা হয়ে গেছে, আমি তার এসব স্বপন বা এসব কল্পনার কথার ব্যাপারে আগামাথা কিছুই জানি না। তার সবকিছুকে অস্বীকারের পর ওরা খুব চ্যাঁচামেচি করলো, পাপের ভয় দেখালো, টেবিলে চাপড় দিলো কিন্তু এলকা যেমন শক্ত ছিল তেমনই শক্ত রইলো, একটুও নড়চড় হলো না তার কথায়। শুধু বললো যে তার নামে মিথ্যা অপবাদ রটানো হচ্ছে। সে যেমন তেমন মেয়ে নয়।

                কসাই আর ঘোড়ার কারবারিরা এলকার পক্ষ নিলো। কসাইখানার বিচ্ছু এক ছোকরা আমাকে বললো, ‘এখন কে তোমাকে চোখে চোখে রাখবো, তুমি চিহ্নিত লোক হয়ে গেলে।’ এলকার বাচ্চাটা এ সময় মুতে দিলে কিছুটা সমস্যা হয়ে গেল, কেননা র‌্যাবাইর আদালতকক্ষে রক্ষিত থাকে পবিত্র ইহুদি আইনের সিন্দুক (আর্ক অফ দ্য কোভেনান্ট), ফলে এলকাকে বাচ্চাটিকে নিয়ে বাইরে যেতে হলো।

                র‌্যাবাইকে জিজ্ঞেস করলাম- আমি এখন কী করবো?

                র‌্যাবাই বললেন, তাকে অবিলম্বে তালাক দেবে।

                এলকা রাজি না হলে?

                সেক্ষেত্রে তালাকের নোটিশ পাঠাতে হবে, তাহলেই তোমার দায়িত্ব শেষ।

                বেশ, তাই হবে, এ ব্যাপারে ভেবে দেখি।

                এখানে এত ভাবাভাবির তো কিছুই নেই, এখন থেকে তোমরা আর কিছুতেই এক ছাদের নিচে বাস করতে পারবে না।

                কিন্তু যদি বাচ্চাটিকে দেখতে ইচ্ছে করে?

                খানকিটাকে চলে যেতে বলো, ওই বেজন্মাটিকেও যেন নিয়ে যায়।

                রায়ে তিনি বললেন যে আমি যেন জীবৎকালে আর কোনও দিনও তার চৌকাঠ না ডিঙোই, এমনকি একবারের জন্যও নয়।

                দিনের বেলা জীবনের এই শূন্যতা তেমন একটা বুঝতে পারতাম না, খালি ভাবতাম- একদিন না একদিন ঘটনাটি ঘটতোই, সবকিছু ভেঙে পড়তোই, বিষফোঁড়া পাকতে পাকতে ফেটে যেতোই কিন্তু রাতের বেলা যখনই ময়দার বস্তা পেতে ঘুমোতে যেতাম, জগৎসংসারকে তখন বড় তেতো, বড় কটু মনে হতো; তার কথা, বাচ্চাটির কথা ভুলতে পারতাম না কিছুতেই। আমি প্রচণ্ড রেগে যেতে চাইতাম, কিন্তু এটা আমার স্বভাবেরই একটা বড় দোষ যে সত্যি সত্যিই আমি রাগ করতে পারি না। কেননা, প্রথমত- মাথায় এ কথাটিই খেলা করতো যে মানুষ তো একদিন না একদিন ভুল করবেই, ভুল না করে তো কেউ বেঁচে থাকতে পারে না। সে-রাতে এলকার সঙ্গে শুয়েছিল যে-ছেলেটি, ওই বদের হাড্ডিটিই হয়তো তাকে বেপথে নিয়ে গেছে, এলকাকে প্রলোভিত করেছে নানা উপহার দিয়ে। মেয়েদের মাথার চুল লম্বা হতে পারে, বুদ্ধি লম্বা নয়, ফলে এলকার পক্ষে ভুল করাটা একদমই স্বাভাবিক ঘটনা।

                আর, সে যখন সবকিছুই অস্বীকার করছে, বলছে কিছুই সত্য নয়, তাহলে তো আমার কথাই ভুল, হতে পারে যে আমিই ভুলভাল শুনেছি; অন্ধকারে দৃষ্টির বিভ্রমে কিছুই বুঝতে পারিনি। এমন ভুল তো আমার হতেই পারে, তাই না? দূর থেকে কোনও ছায়া দেখে ভাবলাম মানুষ, নয় তো পুতুল, কাছে গেলে দেখা গেল ছায়া ছাড়া কিছু নয়, কোথাও কেউ নেই, যদি এমন কিছুই হয়? আহাহা, এমন হলে তো আমি আমার স্ত্রীর প্রতি অবিচারই করেছি।

                এসব ভাবছি আর চোখ বেয়ে নেমে আসছে নোনতা জলের ধারা। মনে হলো চোখের জলের অবিরাম ধারায় বস্তার ভিতরের ময়দাও ভিজে ভিজে কাই হতে শুরু করেছে। সকাল হতে না হতেই র‌্যাবাইর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম, বললাম যে আমারই কোথাও ভুল হচ্ছে হুজুর। কথা শুনে র‌্যাবাই পালকের কলম দিয়ে কী যেন লিখলেন। জানালেন যে তাই-ই যদি হয় তো সমস্ত ব্যাপারটিকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে। যতক্ষণ না তারা বিচারকার্য শেষ না করছেন, আমি যেন স্ত্রীর কাছে না যাই, তবে বাহক মারফত স্ত্রীকে খাবার আর টাকা পাঠাতে পারবো।

।।৩।।

সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পৌঁছাতে র‌্যাবাইদের ন'মাসের মতো লেগে গেল। এর মধ্যে কত চিঠি যে এলো আর কতো যে গেলো! বৌ তালাকের মতো এরকম একটা বিষয়ের ফয়সালা করতে এতো প্রজ্ঞাবান হতে হয়- আগে বুঝিনি। এদিকে এলকাও থেমে নেই, ইতিমধ্যে তার আরও একটি বাচ্চা হয়ে গেল, এবার হলো মেয়ে। স্যাবাথের (ঈশ্বর ছ'দিনে পৃথিবী তৈরি করে সপ্তম দিবসে বিশ্রাম নিয়েছেন— এ বিশ্বাস থেকেই ইহুদিরা প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার রাত পর্যন্ত স্যাবাথ পালন করেন। স্যাবাথ তাই ইহুদিদের কাছে বিশ্রামের সময়; কিন্তু শুধু বিশ্রাম নয়, সঙ্গে আছে প্রার্থনাও। সন্ধ্যেবেলা মোমবাতি জ্বালানো, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া আর সিনাগগে গিয়ে প্রার্থনায় অংশ নেওয়া— এই সব মিলিয়েই স্যাবাথ উদযাপন করেন তারা) দিনে সিনাগগে গিয়ে তার জন্য প্রার্থনা করলাম। আমাকে নিয়ে এমনকি তোরা'র লোকরাও হাসাহাসি করতে শুরু করলো আর আমিও বাচ্চাটির নামকরণ করলাম আমার শাশুড়ির হয়ে। তার আত্মা শান্তিতে থাকুক। শহরের যত খবিশ বাটুয়া আর বাচাল বাজখাই লোকেরা, যারা রুটির কারখানায় আসতো, তারা প্রত্যেকে আমার পাছায় আঙুল দিতো টিটকারি আর ঠাট্টায়, এমনকি ফ্র্যামপোলের লোকেরাও, বলতে গেলে সবাই, আমার মর্মপীড়া আর দুঃখে হাহা করে হেসে উঠতো, আমার যন্ত্রণা ছিল তাদের নিত্যদিনের আনন্দের প্রধান উৎস। যাই হোক, আমি একটা উপায় বের করেছিলাম, প্রতিজ্ঞা করেছিলাম- যে যাই বলবে তাতেই আস্থা রাখবো, বিশ্বাস করবো। অবিশ্বাসে লাভ কী? আজ তুমি যদি তোমার বৌকেও অবিশ্বাস করে বসো, কাল দেখা যাবে যে তোমার ভিতরের ঈশ্বর বিশ্বাসও হারিয়ে ফেলেছ।

                কাছেপিঠের এক শিক্ষানবিশ ছোকরাকে দিয়ে রোজ রোজ এলকার কাছে ভুট্টা কিংবা গমের পাউরুটি পাঠাতাম, কোনওদিন পেস্ট্রি, রুল আর বাগেল (ছোট্ট গোলাকার রুটি), কিংবা, যখনই হাত সাফাইর সুযোগ মিলতো, তখনই একখানা পুডিং, হানি-কেকের ফালি কিংবা বিবাহবার্ষিকীর স্ট্রুডেল, যখন যা পারতাম- মেরে দিতাম।

                শিক্ষানবিশ ছোকরার মনটা বড় নরম। কখনও সখনও সে নিজেও কিছু খাবার এনে দিতো। কিছুদিন আগ পর্যন্তও সে কিন্তু আমার পিছু লেগে থাকতো, অনুসরণ করতো, আর হতচ্ছাড়ার মতো জ্বালাতন করতো নাকে টিপ মেরে ধরে, বুকের পাঁজরে গুঁতো মেরে কিন্তু যেই না আমার বাড়িতে তার আসা যাওয়া শুরু হলো, আগের সব কিছুই গেল বদলে; আমার প্রতি তার নিত্যদিনের ব্যবহার বড় মোলায়েম হয়ে উঠলো।

                শুনছো তো, অ্যাঁ, গিম্পেল মশাই, তোমার বৌ বাচ্চারা এতো ভালো, আসলে কী জানো, তুমি মোটেও ওদের যোগ্য না।

                কিন্তু মানুষ তো তা বলে না রে, তারা যা তা বলে।

                লোকের অভ্যেসই তো আজেবাজে কথা বলে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া। শীতকালের শেষদিকের ঠাণ্ডাকে যেভাবে কেউ পাছা দিয়েও পোঁচে না তেমনি লোকের এসব কথাকেও পোঁচতে হয় না।

                একদিন র‌্যাবাই হুজুর ডেকে বললেন, তুমি কি নিশ্চিত যে তোমার বৌ নির্দোষ?

                আমি তো নিশ্চিতই।

                তুমি কিন্তু নিজের চোখেই সব দেখেছিলে...

                হয়তো ছায়াকেই কায়া দেখেছি, হুজুর।

                কার ছায়া?

                ঘরের কড়িবর্গার ছায়াই পড়েছিল।

                এখন তাহলে বাড়ি যেতে পারো। জেনোভেরের র‌্যাবাইর কাছে তো তোমার কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ। মাইমোনিদিসের (হিস্পানি র‌্যাবাই, পদার্থবিদ এবং দার্শনিক, জীবনকাল : ১১৩৫-১২০৪) প্রাচীন গ্রন্থ ঘেঁটে তিনি দুষ্প্রাপ্য একটি উদ্ধৃতি খুঁজে বের করেছেন, যেখানে তোমার বক্তব্যের সমর্থন আছে।

                র‌্যাবাইর হাতে ঘন করে চুমু খেলাম। দৌড়ে বাড়ি চলে যেতে ইচ্ছে করলো। এতোদিন স্ত্রী পুত্র পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকাটা সামান্য কথা না। ইচ্ছে করছিল ভোঁ দৌড়ে বাড়ি চলে যাই। কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলো। মনে করলাম যে এখন না হয় কাজেই যাই, বাড়ি ফিরব রাতে। র‌্যাবাইর সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কাউকেই কিছু বললাম না কিন্তু মনটা খুশিতে এমন পুলকিত হয়ে গেল যে মনে হলো আজ বড় কোনও উৎসবের দিন। তবে, এখানকার মেয়েগুলি আমাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করতে এতোটুকুও ছাড় দিলো না, রোজকার মতো। আর আমি খালি মনে মনে ভাবছিলাম- তোমাদের ইচ্ছাখুশি যা চাও আজ করো, তবে সত্য যদি থাকে তা প্রকাশ হবেই, যেমন তেল ছড়িয়ে পড়ে জলের ওপর, তেমনই প্রকাশ সত্যের। যেখানে মাইমোনিদিসের গ্রন্থের প্রাচীন বাক্যটি বলছে- সবই ঠিক, অতএব এটাই ঠিক।

                মাখানো ময়দার কাই ফেঁপে উঠবে বলে রাতেই ঢেকে রাখলাম, তারপর আমার ভাগের রুটি তো নিলামই, সঙ্গে কিছু ময়দাও নিয়ে নিলাম থলেতে করে আর পা বাড়ালাম। এবার বাড়ি যাব। পূর্ণচাঁদের অলৌকিক এক রাত নেমেছে। এমন অলৌকিক যে আত্মার ভিতরটাও যেন কেঁপে কেঁপে ওঠে। ভয় জাগে। পায়ে পায়ে এগোতে থাকি। যতো যাই ততোই সামনে হাঁটে দীঘল এক ছায়া। এখন শীতকাল বলে তুষার পড়ছে। গান গাইতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু এত রাতের গাওয়া গান ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে দিতে পারে বলে নীরব হয়ে রইলাম। তখন খুব শিস দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু সাবধান। রাতের শিসে জীনপরিরা বের হয়ে আসে। আমি চুপচাপ থেকে যতো দ্রুত সম্ভব পা চালাতে লাগলাম।

                খ্রিস্টান বাড়ির কুকুরগুলো উঠোন থেকেই আমার উদ্দেশ্যে চেঁচাচ্ছিল, ফলে আমাকে ভাবতেই হলো যে যতো ইচ্ছে চেঁচাও, আরে তোমরা তো কুকুর ছাড়া আর কিছু না কিন্তু আমাকে দেখো, আমি গিম্পেল, যে একটা মানুষ, একটা ভালো নারীর স্বামী, ভবিষ্যতে মানুষ হবে এমন সব বাচ্চার জন্মদাতা।

                যতই বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম বুকটাও ততোই দ্রিম দ্রিম করছিল অপরাধীদের হৃৎপিণ্ডের মতো কিন্তু আমার ভয় লাগছিল না, শুধু বুকটাই অজানা কারণে ধুকপুক শুরু করেছিলা। না, আজ আর পিছিয়ে যাব না, যেভাবেই হোক পৌঁছে যাব। সন্তর্পণে কেওড় ঠেলে ঘরে ঢুকলাম। এলকা ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি মেয়েটিকে দেখতে দোলনার কাছে গেলাম। চাঁদের মায়ামাখা আলোর কয়েক ফালি এসে পড়েছে শিশুটির ওপর। সে আলোয় নবজাতকের মুখটি আমি প্রথম দেখলাম আর তৎক্ষণাৎ তার ছোট্ট পুতুলের মতো শরীরটি ভালোবেসে ফেললাম। ঘুমন্ত এলকার দিকে তাকাতেই মনে হলো কী যেন দেখলাম! দেখলাম সেই শিক্ষানবিশ ছোকরাটি এলকার পাশে। নিদ্রাচ্ছন্ন। যেন মুহূর্তে মেঘের আন্ধার গ্রাসে ঢেকে গেল উজ্জ্বল চাঁদ। ঘরে আর আলো ছিল না বলে কেঁপে উঠলাম থরথরিয়ে। দাঁতের গায়ে দাঁত লেগে ঠকঠক করতে লাগলো। রুটি মুটি হাতে যা যা ছিল, খসে পড়ল। স্ত্রী সেই শব্দেই জেগে উঠে বললো, কে এসেছে?

                ফিসফিস করে বললাম, আমি।

                গিম্পেল? তুমি এখানে কেন? তোমার না এখানে আসা নিষেধ!

                র‌্যাবাই বলেছেন।

                আমি যেন জ্বরের ঘোরে কাঁপছিলাম।

                শোনো, পেছনের গুদামঘরে যাও তো, দেখো তো ছাগলটা কী করছে, অসুখ বিসুখ করেনি তো!

                আমাদের পোষা ছাগলটির কথা আগে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। ওর অসুখের কথা শুনে দ্রুত উঠোনে বেরিয়ে গেলাম। ছোট্টমুট্ট ছাগলটি বড় লক্ষ্মী। মানুষের বাচ্চার মতোই ওকে আমি ভালোবাসতাম। যাই হোক, খানিক ইতস্তত করেই গুদামঘরটির দরজা ঠেলে ভিতর ঢুকলাম। চারপায়ে দাঁড়িয়ে আছে মায়ার প্রাণিটি। ওর শিঙ, ওলান, আসলে পুরো শরীরে হাত ঘষে দেখলাম সব ঠিকই আছে। আহ্লাদে আটখানা নয়খানা হয়ে হয়তো কিছু পাতা বেশিই খেয়ে ফেলেছে। সব দেখে ওকে শুভরাত্রি জানালাম, উত্তরে ছাগল বললো- ম্যা। শুভরাত্রির জন্য ও আমাকে ধন্যবাদ জানালো।

তারপর ঘরে ফিরে গেলাম। এলকার পাশটা খালি। শিক্ষানবিশ ছেলেটি অদৃশ্য হয়ে গেছে। জানতে চাইলাম- ও কোথায় চলে গেল?

                কে কোথায় চলে গেল? আমার স্ত্রীর উলটো প্রশ্ন।

                বলছো কী? শিক্ষানবিশ ছেলেটি তো এখানেই ছিল, তুমি তার পাশে শুয়ে ছিলে।

                স্ত্রী কিছুটা যেন ক্ষ্যাপে গেল- গত কয়েকদিনে যতগুলো খারাপ স্বপন আমি দেখেছি সেগুলি যেন সব সত্য হয়ে তোমার আত্মার ক্ষতি করে। আসলে তোমার ওপর এমন এক কালো আত্মা ভর করেছে যে তোমার দৃষ্টিকে ঝাপসা করে রাখে। তোমাকে আমার সত্যিই ঘেন্না হয় গিম্পেল। একটা ভূত ছাড়া কিছুই নও তুমি। এখনই চলে যাও। যাও। না হলে কিন্তু আমার চিৎকারে ফ্র্যামপলের সমস্ত লোক জড়ো হয়ে যাবে।

                কিছু করবার আগেই এলকার বেজন্মা ভাইটা পেছন থেকে আঘাত করলো, মনে হলো সে আঘাতে আমার ঘাড়টাই মটকে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে হলো যে আমার নিজের মধ্যেই কী একটা গণ্ডগোল বেঁধে গেছে। মাথা তো পুরোটাই আউলা। এলকাকে শান্ত করতে বললাম- এমনটা কখনও করতে যেও না, না হলে লোকে বলবে আমি ভূতগ্রস্ত, যে পিশাচকেও ডেকে আনতে পারে।

                আসলে, এলকাও তাই চাইছিল। এই নীরবতাটুকুই সে কামনা করছিল। বললাম- তাহলে আমার হাতে বানানো রুটি আর কেউ কিনতে আসবে না। এইসব হাবিজাবি বুঝ দিয়ে তাকে শান্ত করলাম। এলকা বলল, বেশ তো, তাহলে এবার ঠাণ্ডা মাথায় শুয়ে পড়ো।

                পরের দিন সেই শিক্ষানবিশ ছোকরাটিকে কাছে পেয়ে বললাম, শোনো ভাই। তারপর সবিস্তারে বললাম তাকে, ঘটনাটি। ছোকরা এমনভাবে আমার দিকে হা মুখে তাকিয়ে রইলো যেন আমি এই মুহূর্তে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে থ্যাতলে গেছি।

                কী বলছো এসব, গিম্পেল ভাই!

                শপথ করে বলছি রে।

                ছোকরা বলল, তুমি বরং কাজে না গিয়ে কবিরাজের কাছে যাও। মনে হচ্ছে তোমার মাথার নাটবল্টু সব ঢিলা হয়ে গেছে। টাইট করাতে হবে। তবে তুমি কিচ্ছু ভেবো না, আমি এখনই শহরের কাউকে এসব কথা বলছি না।

                দীর্ঘ কাহিনি এবার সংক্ষেপে বলি, এলকার সঙ্গে আমার কুড়ি বছরের সংসারে একে একে ওর ছয় ছয়টি বাচ্চা হয়েছে, রঙবেরঙের কতো কিছুই না ঘটেছে কিন্তু এসবের কোনও কিছুর সঙ্গেই আমার কিছু ছিল না; আমি কিছু করিও নি, কিছু দেখিও নি, শুধু বিশ্বাস করে গেছি।

                এই তো ক’দিন আগে র‌্যাবাই হুজুর বললেন, সকল প্রকারের বিশ্বাসের নিজস্ব উপকারিতা আছে। আমাদের পবিত্র গ্রন্থে লেখা রয়েছে যে ভালোমানুষ বাঁচে তার বিশ্বাসের জোরে।

হঠাৎ করেই বৌ একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লো। শুরুতে তা সামান্য ব্যাপার ছিল। তার স্তনে ছোট্ট একটা গোটা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু এই গোটাটাই ছিল ভয়ংকর। বেশিদিন বেঁচে থাকা তার কপালে ছিল না। আমি ওর চিকিৎসার ঘাটতি রাখিনি, যখন যা লেগেছে, যতো লেগেছে, নির্দ্বিধায় খরচ করেছি। আমিও ইতিমধ্যে বেকারির মালিক বনেছি, এই শহরে যাকে পয়সাওলা বলে গণ্য করা হয়। এলকার জন্য প্রতিদিন একজন কবিরাজ আসতেন। আর আশপাশের শহরে বন্দরে যতো তান্ত্রিক, ভেল্কিবাজ, ডাকিনিবিদ ছিল যাদের কাজ মন্ত্রের সাধনে রোগ সারানো, সবাই এসে দেখে যেতে লাগলো। জোঁক দিয়ে ওর শরীরের কালো রক্ত পর্যন্ত শুষানো হলো, কাজের কাজ কিছুই হলো না। তারপর এলেন লুবলিন থেকে বড় ডাক্তার সাব। এলে আর হবে কী, দেরি হয়ে গেছে।

                মৃত্যুশয্যায় আমার স্ত্রী রত্ন আমাকে পাশে ডেকে নিলো, বলল, গিম্পেল আমাকে ক্ষমা করে দিও।

                ক্ষমা চাইছো কী জন্যে? অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে তুমি ভালো ছিলে, বিশ্বস্ত ছিলে।

                সেই তো দুঃখের জায়গা। আজ কুড়ি বছর ধরে যেভাবে আমি তোমায় ঠকিয়েছি তা ছিল নোংরা, জঘন্য। এবার সময় হয়েছে। ঈশ্বর মশায়ের কাছে যাবার আগে তোমাকে সত্যি কথাটা অন্তত বলে যাই। এই ছেলেমেয়েরা কেউই তোমার সন্তান নয়।

এই মুহূর্তে কেউ যদি আমার মাথাটাকে ভেঙে চৌচির করে ফেলত তাহলেও মনে হয় এতোটা আঁতকে উঠতাম না। বললাম, তাহলে ওরা কার সন্তান?

                জানি না, বলতে পারবো না, বহু পুরুষই তো এসেছিল, কে যে... ওরা একজনও তোমার নয়।

                কথা বলতে বলতে মাথাটা কেবল একটু নড়লো যেন, চোখ দুটো হয়ে গেল ঘষা কাচের মতো। মরে গেলো এলকা। আমার মনে হলো মরে গিয়েও সে বলছে- বোকা লোকটিকে আমি ঠকিয়েছি। ছোট্ট জীবনকালের এটাই আমার একমাত্র সার্থকতা।

।।৪।।

তারপর একরাতে, যখন শোকের সময়ও শেষ হয়ে এসেছে প্রায়, যেভাবে শুয়ে থাকি সেভাবেই ময়দার বস্তার ওপর শুয়েছিলাম, আচ্ছন্ন করা স্তব্ধতায় স্বপন দেখছিলাম- শয়তান স্বয়ং আমার কাছে চলে এসেছে তার সমস্ত কাজকর্ম ফেলে আর আমাকে বলছে, গিম্পেল তুমি ঘুমোচ্ছ কেন?

                তাকে বললাম, ঘুমোব না তো কী করব জনাব? স্যুপে ভিজিয়ে ক্রখলাস খাবো।

                সারা দুনিয়া তোমাকে কেবল ঠকিয়েছে আর ঠকিয়েছে। এবার তার প্রতিদান দাও।

                কিন্তু দুনিয়াকে ঠকানো সম্ভব?

                তা সম্ভব। শোনো, সারাদিনের মুত একটা বালতিতে জমাও। তারপর সেই মুত রাতে রুটির ময়দায় ঢেলে দাও। ফ্র্যামপোলের প্রজ্ঞাবানরা তোমার মুত খাবে।

                কিন্তু মৃত্যুর পরের দুনিয়ায় যখন এর বিচার হবে, তখন আর উপায় থাকবে?

                তাহলে তুমি কিছুই জানো না, মৃত্যুর পর আর দুনিয়া নেই। ওরা তোমাকে ভুল বুঝিয়েছে। তোমাকে তারা বলেছে যে তোমার পেটের ভিতরে একটা বেড়াল ঘোরাফেরা করছে। যত্তসব বাজে কথার লোক!

                ভালো, বেশ ভালো, আমি বললাম, ঈশ্বর আছেন?

                ধ্যাৎ, ঈশ্বর, এসব কিছুই নেই।

                কী! তাহলে কি আছে?

                একতাল কাদামাটি।

                দেখলাম শয়তানটির মুখে ছাগলদাড়ি, মাথাও ছাগলের মতো, দাঁতগুলো বেশ লম্বা আর একটি লেজও আছে। ওর এসব কথা শুনে লেজ ধরে হ্যাঁচকা টান মারতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু আমি ময়দার বস্তা থেকে গড়িয়ে পড়ে গেলাম। একটুর জন্য পাঁজরের হাড়গুলো ভাঙল না। উঠে দাঁড়িয়ে ময়দার সেই বস্তায় মুততে শুরু করলাম। ময়দাও মুতে ভিজে ফুলেফেঁপে উঠলো। যদি সব কথা সংক্ষেপে বলতে হয়, তো বলবো যে আমি শয়তানের কথা মতোই কাজটা করলাম।

                ভোরে শিক্ষানবিশ ছোকরা এলো। আমরা ময়দা মাখালাম। তাতে মিশিয়ে দিলাম সুগন্ধি মশলা, তারপর শুরু হলো রুটি বানানো। শিক্ষানবিশ ছোকরাটি চলে গেলে চুল্লির কাছের নালার ধারে বসে বসে ভাবতে লাগলাম- বেশ করেছ তো গিম্পেল, আজীবন ওরা তোমায় লজ্জা দিয়েছে, এবার তার শোধ নিলে।

                বাইরে কুয়াশার ফণা ঝিলমিল করছে, এদিকে চুল্লির কাছে গরমের আরাম। মুখের সামনে দাউদাউ আগুন নেচে চলেছে। আমার ঝিমুনি এলো। তন্দ্রার ঘোরে স্বপন দেখলাম- তুমি কি করে পারলে গিম্পেল?

সব তোমার কারণে।

আমি কেঁদে উঠলাম।

হায় রে বোকা গিম্পেল! আমি মিথ্যে বলেছি বলে তুমিও কি ধরে নিবে যে সব কিছুই মিথ্যে? নিজেকে ছাড়া আমি কাউকে ঠকাইনি গিম্পেল, আজ আমি সবকিছুর দাম দিচ্ছি, মৃত্যর পরের দুনিয়ায় কেউ কাউকে এতোটুক ছাড় দেয় না।

এলকার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। মুখটা নিকষ কালো।

আচমকা ঘুম ভেঙে গেল। উপলব্ধি করলাম যে দুনিয়ার সমস্ত কিছু একটি সূক্ষ্ম সুতায় ঝুলে আছে। এখানে আমি যদি এতোটুকুও ভুল করি তাহলে অনন্ত জীবনের মধু থেকে বঞ্চিত হবো। তখনই ঈশ্বর আমার কাছে এলেন। দুজনে মিলে তুষারঢাকা মাটিতে গর্ত করলাম। দেখলাম শিক্ষানবিশ ছোকরাটি ফিরে এসেছে। কাণ্ড দেখে তার মুখ ফ্যাকাসে- কী করছো?

কী করছি তা আমি ভালোই জানি।

ওর চোখের সামনেই রুটিগুলোকে গর্তে পুঁতে ফেললাম।

                তারপর বাড়ি ফিরে গেলাম। গোপন জায়গা থেকে সারাজীবনের জমানো টাকা বের করে ছেলেমেয়েদের ভাগ করে দিলাম। তাদের বললাম- রাতের স্বপ্নে তোমাদের মাকে দেখেছি। একদম কালো হয়ে গেছে।

                কথাটা শুনে ওরা এতোটা অবাক হলো যে সহসা বলবার মতো কথা খুঁজে পেল না।

                তোমরা ভালো মানুষ হও রে। বোকা গিম্পেল নামের কেউ কোনওদিন ছিল- এটা মনেও রেখো না।

                কথাগুলো বলতে বলতে ছোট্ট জোব্বাটা গায়ে দিলাম, পায়ে পরলাম বুট, তারপর এক হাতে নিলাম সেই থলেটা যার ভিতর আছে প্রার্থনার সময় গায়ে জড়াবার শাল, অন্য হাতে লাঠি, তারপর পবিত্র চিহ্ন মেজুঝায় চুমু খেলাম। রাস্তায় তো আমাকে দেখে সবাই অবাক- গিম্পেল, চলেছ কোথায়?

                আমি পৃথিবীর কাছে যাচ্ছি, ফ্র্যামপোলে আর ফেরা হবে না।

                কতো দেশ প্রান্তর দেখা হলো, ভালো মানুষরা কেউ আমাকে অবহেলা করলো না। বহু বছর পর আমিও বুড়ো হলাম, চুল বাল পেকে শাদা হলো। দীর্ঘ জীবনে আমি এতো এতো মিথ্যে কথা শুনেছি, এত মিথ্যে, আর যতো দীর্ঘ দিন আমি বেঁচেছি ততোই উপলব্ধি করতে পারছি যে পৃথিবীতে মিথ্যে বলে কিছুই নেই। একজনের জীবনে যা কখনওই ঘটেনি, অন্যজনের জীবনে তাই ঘটে। যা আজ পর্যন্ত ঘটেনি, তাই কাল ঘটবে। কাল যা ঘটবে না তা হয়তো এক শতাব্দী পরে ঘটবে। তফাতটা কোথায়? কত কথা, কত আখ্যান শুনেছি, শুনে বলেছি- এ অসম্ভব, এরকম হতেই পারে না, অথচ বছর না যেতেই এরকম ঘটনা কোথাও না কোথাও ঘটে গেছে!

                দেশে দেশে পথে প্রান্তরে ঘুরতে ঘুরতে, অচেনা মানুষের অতিথি হয়ে হয়তো খেতে বসেছি, তখন তাদের গল্প বলেছি-অসম্ভবের গল্প, যা হয়তো কোনও কালেও ঘটবে না- অশুভ আত্মা, প্রেত, কুহকী, জাদুকর, হাওয়াকল ইত্যাদির গল্প। বাচ্চা ছেলের দল আমার পেছনে ছুটতে ছুটতে বলে, দাদুবুড়ো, গল্প বলো। মাঝেমাঝে তারা বিশেষ কোনও গল্প শুনতে চাইতো। আমি তাদের খুশি করার চেষ্টা করতাম। একদিন এক ননীরপুতুল ছেলে আমায় বলে বসে- দাদু, এই গল্প তো আগেও বলেছ। দুষ্টু ছেলেটা ঠিকই ধরে ফেলেছে!

                স্বপনের ব্যাপারটিও একই রকম। বহু বছর হয় ফ্র্যামপোল ছেড়েছি কিন্তু চোখ বুজলেই সেখানে চলে যাই। তখন কাকে দেখবো বলে ভাবি? এলকাকে। চৌবাচ্চাটির পাশে দাঁড়িয়ে থাকে এলকা, ঠিক প্রথমবার যেমন সেখানে তাকে দেখেছিলাম- মুখটি চকচক করছে, চোখে তার সন্তের চোখের মতো আশ্চর্য দ্যুতি। সে অচেনা ভাষায় কথা বলে, কী সব অদ্ভুত কথা। ঘুম ভেঙে গেলে সেসব কথা আমার মনে থাকে না, ভুলে যাই কিন্তু স্বপনটি যতক্ষণ ধরে দেখি, ততোক্ষণই শান্তি। এলকাকে ইচ্ছেখুশি প্রশ্ন করি- সে সব প্রশ্নের উত্তর দেয়। তখন মনে হয়- সব ঠিক ঠাক আছে। আমি কেঁদে ফেলি আর তাকে অনুনয় করি- আমাকে তোমার কাছে থাকতে দাও। সে আমাকে সান্ত্বনা দেয়। ধৈর্য ধরতে বলে। আমার সময় ফুরিয়ে আসছে যতো, এলকাও ততোই কাছে আসছে। সময় দূর থেকে নিকটতম হয়। কখনও সে আমাকে আঁকড়ে ধরে, চুমু খায়, আর মুখে মুখ লাগিয়ে কাঁদে। ঘুম ভাঙতেই আমি তার তপ্ত ঠোঁটের ছোঁয়া অনুভব করি, তার চোখের জলের নোনতা স্বাদ পাই।

                এ ব্যাপারে আজ আমার আর কোনও সন্দেহ নেই যে আমাদের এই পৃথিবীটার পুরোটাই হচ্ছে এক কল্পনার পৃথিবী যা শুধু একটি বারের জন্য সত্য পৃথিবী থেকে হারিয়ে যায়। সত্য পৃথিবী আছে কাছেই কোথাও।

                যে নড়বড়ে কুটিরে আমি শুয়ে আছি, তার দরজার সামনেই আছে একখানা তক্তা, যাতে করে শবদেহগুলোকে কবরে বয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। যে-ইহুদি কবর খুঁড়ে, তার কোদালখানাও তৈরি হয়ে আছে। কবরের মাটিও অপেক্ষা করছে আর কৃমিকীটেরাও ক্ষুধার্থ, শাদা কাফনও বানানো হয়ে গেছে, আমার ভিক্ষার ঝুলিতেই সেটা আছে। অন্য একজন ঈদিশ ভিক্ষুক হয়তো অপেক্ষায় আছে আমার খড়ের কুঁড়েটি বুঝে নিতে। আমার সময় থমকে দাঁড়াবে, আমি আনন্দের সঙ্গে যাবো। সেখানে যাই থাকুক, সমস্তই বাস্তব আর বাড়তি কোনও জটিলতাও নেই, কোনও ঠাট্টা বিদ্রূপ নেই, কেউ কাউকে ঠকায় না। ঈশ্বরের প্রশংসাই করবো- এমনকি সেখানে বোকা গিম্পেলের সঙ্গে প্রতারণাও করা যাবে না।

লেখক পরিচিতি:

আইজাক বাশেভিস সিঙ্গারের জন্ম পোল্যান্ডে, ওয়ারশ’র কাছে এক গ্রামে, ১৯০৪ সালে। বেড়ে উঠেছেন শহরের ঈদিশভাষী ইহুদি পাড়ায়। সবাই মনে করত তিনিও তার বাবার মতো ইহুদি আইনের শিক্ষক হবেন, কিন্তু বিশ বছর বয়সেই সিঙ্গার ধর্ম বিষয়ক জ্ঞানচর্চা বাদ দিয়ে লেখালেখিকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। ১৯৭৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান এই ঈদিশভাষী লেখক। যদিও তাঁর বেশ কয়েকটি উপন্যাস, শিশুসাহিত্য, স্মৃতিকথা ও প্রবন্ধের বই বেরিয়েছে, তবু গল্পকার হিসেবেই তিনি সুপরিচিত।

সিঙ্গার প্রতিদিনের লেখালেখির কাজ করতেন তাঁর লিভিং রুমে, ছোট্ট একটা ডেস্ক-এ বসে। এখানে বসে প্রতিদিন তিনি লিখতেন, শুধু দিনের বিশেষ কয়েকটি ঘণ্টা বাদে, কারণ এই সময়টুকু তিনি বরাদ্দ করে রেখেছেন বাইরে যাওয়ার জন্য, সাক্ষাতকারী ও প্রয়োজনীয় দূরালাপনের জন্য। সিঙ্গারের নামটি এখনও ম্যানহাটনের টেলিফোন ডাইরেক্টরিতে রয়ে গেছে, আর এরকম দিন তাঁর জীবনে খুব কমই এসেছে যেদিন লেখা পড়ে অচেনা অদেখা পাঠক তাঁকে কল করেনি, তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চায়নি!

সিঙ্গার তাঁর গল্প আর উপন্যাসগুলি লিখতেন লাইনটানা নোটবুকে, প্রায় অস্পষ্ট টানা হাতে, ঈদিশ ভাষায়। যা কিছু লিখেছেন, তার বেশির ভাগ লেখাই প্রথম প্রকাশিত হয় জুইশ ডেইলি ফরওয়ার্ড-এ, আমেরিকা'র সবচে বড় ঈদিশভাষী দৈনিকটি নিউইয়র্ক সিটি থেকে প্রকাশিত হয়। তাঁর সেই লেখা পরে ইংরেজিতে অনুবাদের ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেয়, এজন্য তিনি তাঁর অনুবাদকদের সঙ্গে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করতেন। বোকা গিম্পেল গল্পটি অনূদিত হয়েছে তার ‘গিম্পেল দ্য ফুল এন্ড আদার স্টোরিজ’ বইটি থেকে, বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালে; গল্পটি এই সংকলনের প্রথম গল্প, প্রথম প্রকাশ ১৯৫৩য়, এ বছরই গল্পটি ইংরেজিতে অনূদিত হয়, অনুবাদক বিশ্বখ্যাত কথাশিল্পী সল বেলো।


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ আগস্ট ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়