ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ছোটগল্প || নদীনামা

রুখসানা কাজল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটগল্প || নদীনামা

|| রুখসানা কাজল ||

সাজেদালি কারওয়ান বাজারের মিন্তি। থাকে বাজারের পাশে রেলবস্তির ঘরে। প্রতিদিন ভোর ভোর আজানলগ্ন সময়ে বেরিয়ে পড়ে। হোটেলে হোটেলে তরকারি পৌঁছে দিয়ে গামলার মত বড় মগভর্তি চা আর দশ বারোটা পরোটা নিয়ে খেতে বসে ঠিক অনুপম গার্মেন্টেসের বিপরীতে জব্বার মোল্লার তালাচাবি, ছুরি-কাঁচির দোকানে। ওর এক সময়ের বউ সাফিনা কাজ করে এই অনুপম গার্মেন্টসে।

মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায়। কখনো চোখে চোখ পড়তেই চকিতে মুখ নামিয়ে বান্ধবীদের মাথার পেছনে লুকিয়ে পড়ে সাফিনা। আর সাজেদালির রোমজুড়ে বেজে ওঠে, ‘বকুলফুল বকুলফুল সোনা দিয়া...’ 

গেলো দশ বছর ধরে এভাবেই চলছে। সাজেদালি কখনো কোনো দিন সাফিনার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেনি। ইচ্ছে করে তাকিয়েও দেখেনি। মাঝে মাঝে কিছুদিনের জন্যে উধাও হয়ে যায়। ফিরে যখন আসে, তখন ওর গায়ে থাকে নদীজলের গন্ধ, শাপলাফুলের রেণু লাগা স্বপ্ন আর দূর দূর সাগরের সুর। চেনাজানা সবাই আপনজনের মত সস্নেহে জানতে চায়- মিয়ার বেটা তাইলে ফিরলা? কই কই যে হারায়ে যাও! শরীরটা ভালো আছে তো তোমার?

সাজেদালি হাসে। হেসে হেসেই শ্বাস নেয় মহানগররের ধূলি ওড়া বাতাসে। নাক জ্বলে যায়। বুক ভরে ওঠে কুগন্ধে। বৃদ্ধ জব্বার মোল্লা আপনজনের মত জানতে চায়- বাড়িত গেছিলি নাকি মনা?  ঠিকঠাক আছে তো সবকিছু?  সাজেদালি মাথা নাড়ে, ঠিকঠাক নাই গো কাগা ! ঠিকঠাক নাই। আমাগের গাঙ যে সাগর হয়ি যাতিছি দিনকে দিন। মন কয় ঘরবাড়ি ভিটেমাটি এবার থাকবি নানে। ভাসি যাবেনে গাঙে।

ভাই ভাই রেস্তোরাঁর সাফায়েত নামের কিশোর ছেলেটা ছুটে আসে। দুটি পরোটা বেশি দিয়ে চুপিচুপি জানতে চায়- ও সাজেদালি কাগা, নতুন কি গান বান্ধিছ? আমারে শিখাইবা তো কাগা?

সাজেদালির বুক থইথই করে ওঠে স্নেহে। শ্যামাকোলা ফুলের মত নরম মন ছেলেটার। সাজেদালির জন্যে কি যে মায়া ধরে রাখে অন্তরে!  মনে মনে বলে, শিখামু রে বাজান। তোরেই শিখামু। কিন্তু তার আগি যে সংসারের সাথে বান্ধা তোর নাড়ি কাটি ফেলতি হবিনে সোনা! পারবিনি বাজান! তুই কি পারবিনি ও সাফায়েত?

সাজেদালির মন আজ বড় উতল। সাফিনার সাথে কথা বলতে হবে। খুব দরকার। আজ না হলে এ জীবনে আর কখনো দেখা হবে না। সে চলে যাচ্ছে উত্তরে, আরো উত্তরে। সেখানে জলের ঢল নেমেছে। বানের পানির সাথে বইছে শোঁ শোঁ  মারমুখী বাতাস। হঠাৎ ফণা তুলে ঢেউ নাচাচ্ছে বহতা পানি। সেই ঢেউ আবার নেচে নেচে বয়ে যাচ্ছে মানুষের ঘরবাড়ি, ফসলের জমি ভাসিয়ে কোন অজানাতে। সেই প্লাবিত উদীচীর বাহু ছুঁয়ে সাজেদালি ভেসে যাবে। নিজেকে ডুবিয়ে দিবে জল আর গানের সুরের মর্মতে।

গহন জলের অতল গভীর থেকে ডাক এসেছে। চঞ্চলা হয়ে উঠেছে ওর মন। ভেসে যাচ্ছে প্রাণ। জলজ সুরে ভিজে যাচ্ছে ওর মন, হৃদয়, স্বস্তি শান্তি। মহা জলের প্লাবন ওকে ডাকছে, ওরে ও জলপুত্র আয় সখা আয় আয়!

এসব ভাবলে উড়াল উড়াল পাখি হয়ে উঠে সাজেদালি। পরাণের ভেতর কুঠরিতে পূর্ণস্থিত থাকে যে পরাণ, যার নাম অন্তরাত্মা, তাতে সুর ভর করে। খুসখুস কর ওঠে ওর গলা। ইচ্ছে করে গলা ছেড়ে গান গায়- নিধুয়া পাথারে নেমেছি বন্ধুরে, ধরো বন্ধু...

চা পড়ে থাকে মগে। পরোটা শুকিয়ে কাগজ হয়ে যায়। সাজেদালি অন্যমনস্ক। অনুপম গার্মেন্টসের গেট  ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে সুরের ধৌত মায়ায় ভর দিয়ে। মাথার ভেতর নদী থইথই তাথৈ। মাঝে  মাঝে স্রোতে ভাসে সাফিনার সুর। কে সাফিনা- জল নাকি স্থল? না কি নিধুয়া অতল  বিলাবল বোল! কেবলই হাতছানি দিচ্ছে। কেবলই আর্ত আহবান করছে। কেবলই বুক খুলে অমল সুরে ডাকছে, আয় আয় ওরে চলে আয়  জলকুমার।

দুদিন পর হামিদ এসে ডাক দেয়- মিয়াভাই শোনেন তো দেখি!

হামিদের গলায় উষ্মা। সাজেদালির চমক ভাঙ্গে। হামিদ তার ফুপাত ভাই। প্রায় তিন বছরের ছোট। জন্ম এতিম। কোন এক ফ্যাক্টরির যেনো সুপারভাইজার। এখন সাফিনার স্বামি। ভালো আছে দুজনে।  শুকসারির মত একাত্ম।  

সাজেদালির মনে পড়ে, আচ্ছা সে তো হামিদকেও বলতে পারত তার আর্জেন্ট কথাডা!

কিরে হামিদ,  কেমন আছিস তোরা? সবাই ভালো ত?

হামিদ ভাবে সাফিনার কথা জানতে চাইছে সাজেদালি। রাগ রাগ গলায় সে বলে, কাজটা কি ভালো করতিছেন আপনি? আপনার জন্যে সাফিনা কাজে আসতি পারতেছে না। কতবার কইছি একটা বিয়ে করে ফেলেন মিয়াভাই!

সাজেদালির বুকের ভেতর ঢেউ খেলে যায়। হু হু করে বান ডাকে। উথাল পাথাল নেমে আসে পুরনো বানের পানি। দশ বছর আগের পানি ছইছই সেই ভাঙ্গন। ধান গেল, পুকুর উজালা হয়ে মাছ ভেসে গেল, নদী ভেঙ্গে ডুবিয়ে দিলো ওদের বসতবাড়ি। কেবল দুই শতাংশ বাগান পড়ে রইল কিছু গাছপালা নিয়ে। সাফিনা বাঁচার জন্যে পালিয়ে এলো পাকা ইটের শহরে। তখনও সাথে ছিল সাজেদালি। সাফিনার প্রিয় গাতক!

প্যান্টের গোপন জায়গা থেকে একটি টিস্যু প্যাকেট বের করে সাজেদালি। গুণে গুণে সাত হাজার টাকা হামিদের হাতে তুলে দিয়ে হাসে- ধুর বলদ! মেয়েমানুষ বিয়ে করার মেলা ঝামেলা। নে ধর, সাফিনারে দিস। ওর লাগানো গাছটা আর রাখা গেলো না। আমাদের বাড়ি আবার ভাঙ্গনে পড়ছে। কথা ছিল গাছ বিক্রির টাকার অর্ধেক পাবে সাফিনা।

সাজেদালি চলে যায়। সুরে ছেয়ে গেছে ওর মন। এই বৃষ্টি নামে তো, এই রোদ। শিউরে শিউরে কাঁপছে শরীর। সুর জাগছে ঢেউ তুলে। মীড় ডাকছে না সুরে। গমকে ধমক দিচ্ছে, দেরি কেন! আয় আয় না পাগলা ! ক্ষুধা, আর্ত, বঞ্চিত শরীর মন ভেসে যাচ্ছে সুরের মায়া জলে।

তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, যমুনা, দুধকুমার নদ গাইছে- কথা ছিল মনে মনে প্রেম করিব তোমার সনে, তোমায়  নিয়ে...

হামিদ সাত থেকে চার হাজার টাকা সরিয়ে রাখে। কথা দিলেই যে সব কথা রাখতে হবে এমন কোনো কথা নেই এই ভূ-ভারতে। সংসারও এক গহীন সমুদ্র্। বানের জলের মত টাকা লাগে নির্বাহ করতে। ওর কিছু বন্ধু বানভাসিদের গরু ছাগল সস্তা দামে কিনে রাখছে। কুরবানীর ঈদ আসছে সামনে। হাটে  চড়া দামে বিক্রি করে ফাটকা লাভ তুলে নেবে। হামিদও আছে এই ফাটকাবাজ বন্ধুদের সাথে।

তাছাড়া মেয়েমানুষ হচ্ছে বানের পানিতে ভেসে আসা পলিমাটি। বড় বাড়ন্ত । দশ বছরে হামিদের বিছানা বড় হয়েছে, দুই মুখ চার হয়েছে। গ্রামে বাড়ি হয়েছে। বাড়ির পাশে আম্রপালি গাছে আম ধরেছে, সেই আমের আঁটিতে নতুন গাছ জন্মেছে। হামিদ এখন আর এতিম হামিদ নাই। সাফিনা তাকে ভরে দিয়েছে। এই ভরভরন্ত সংসার টিকিয়ে রাখতে তার এখন টাকা চাই!

বন্ধুদের টাকা পাঠাবে বলে হামিদ বিকাশ করার দোকান খুঁজতে থাকে।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়