ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

পূজার গল্প || সিঁদুর খেলা

সোমঙ্কর লাহিড়ী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:০৪, ৪ অক্টোবর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পূজার গল্প || সিঁদুর খেলা

অলঙ্করণ : গৌতম ঘোষ

একটা খাপে দুটো তলোয়ার রাখা যায়?

যায় হয়ত, কিন্তু খাপের হাল যে তাতে খুব সুবিধের হয় এমন বলা যাবে না। ঠিক তেমনি এক পাড়ায় যদি চার-চারটে খাণ্ডার গিন্নী থাকে তবে সে পাড়ায় বারোয়ারি পুজোর যে বারোটা বেজে যাবে তাতে সন্দেহ থাকা উচিত নয়।

আচ্ছা বলুন দেখি, বারোয়ারি পুজোর সবচেয়ে শক্ত কাজটা কী?

চাঁদা তোলা?

না। যদি পাড়া ফিলিংসটা থাকে আর বাসিন্দারা সচ্ছল হয় তবে সেটা খুব একটা প্রবলেম নয়, কয়েকটা ছ্যাঁচড়া কিপ্‌টে সব পাড়ায় থাকে, তাদের সামলানো খুব বড় একটা অসুবিধাও নয়।

তাহলে খাটা খাটনি?

না, সব পাড়ায় কিছু কমবয়েসি ছেলে থাকে, যারা মনে করে হুমদোর মত চেহারা নিয়ে পুজোর সময় টাইট গেঞ্জি আর গলি দেখান জিন্স পড়ে ঠাকুর তোলাই পাড়াই এসব মজদুরি কাজ আসান করলেই ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় ঝুমকি পটে যাবে এবারের পুজোর জন্য।

তবে কি বিসর্জন?

না, আপনাদের দিয়ে হবে না। সবচেয়ে শক্ত কাজ হলো- পাড়ার বারোয়ারি পুজোর ভোগ ইত্যাদি কোথায় হবে, আর কে তাতে কতটা মোড়লি করতে পারবে তার দখলদারি। কারণ কন্ট্রোল করতে গেলে হেঁসেল হলো সেরা জায়গা।

এ পাড়ায় চার-চারটে খাণ্ডার গিন্নী আছে- ব্যানার্জী, রায়, দত্ত আর পাল। ব্যাকগ্রাউন্ড জেনে রাখা ভালো। ব্যানার্জী হলো চাটার্ড, রায় জজ, দত্ত বুলিয়েন মার্চেন্ট (স্যাকরা বললে মানহানি), পাল লোকাল কাউন্সিলার। ভাবছেন বাব্বা! এতো তালেবর ব্যাপার! না, তালেবর হলো তাদের বউ! বরেরা ছোট বেলার বন্ধু। এখন বউয়ের ভয়ে মাল খেতে লুকিয়ে দীঘা, মন্দারমণি পালায়। বাড়িতে বলে- মিটিং।

এপাড়ায় যখন দুর্গাপুজো শুরু হয় তখন এই বউগুলো এত খাণ্ডার হয়ে ওঠেনি। সব ক’টার শাশুড়ি বেঁচেবত্তে ছিল আর নিজেদের ছেলেপুলেগুলোও সব পড়াশোনা করত। তাই বারোয়ারি ছিল বারোয়ারির মত। জোগাড় জাগাড়ে পাড়ার অন্য বাড়ি থেকেও যেমন বৌয়েরা আসত, এই চার বাড়ি থেকেও বউমারা যেত শাশুড়িদের সাথে। আর ক্লাব ঘরেই ভোগ ইত্যাদি হতো। সবাই বাড়ি থেকে কৌটো নিয়ে গিয়ে ভোগ এনে নিজেদের বাড়িতেই খেত। ২০০০ সালের পর থেকেই তালগোলটা পাকালো। এদের শাশুড়িরা চারজনেই কয়েক মাসের আড়াআড়ি স্বর্গবাসী হলেন। বরেরা সব হাসব্যান্ড হয়ে গেল। আর তাঁদের টাকাকড়ি প্রভাব প্রতিপত্তি সবই ধাঁ ধাঁ করে বেড়ে গেল। চারটে পরিবারের চারটে ছেলেমেয়ে লেখাপড়া শেষ করে রোজগেরে হলো। ফলত এই চারজন নিজেদের অজান্তেই একটা পাওয়ার প্লেতে জড়িয়ে গেল। ছিলেন ডেপুটি গিন্নী, হলেন ফুল ফ্লেজেড গিন্নী। আর জনসমক্ষে মিসেস অমুক, মিসেস তোমুক। আর বর রোজগেরে স্বাভাবিক, কিন্তু আইবুড়ো মোটা রোজগেরে ছেলে! সে হলো গে উরিঃ ব্বাবা!

২০০৩ সালে ক্লাবঘরের টিনের চাল বদলে ঢালাই ছাদ হবে বলে ঠিক হলো। সেই মত কাজও শুরু হলো। কিন্তু পুজোর আগে তা শেষ হলো না। কোথায় হবে পুজোর ভোগ রান্না আর অন্য সব জোগাড়? রায় গিন্নী বামুনের তাসটা খেললেন, আর মায়ের পুজোর সব ব্যাপার নিজের বাড়িতে টেনে নিলেন। পুজোর কাজেকর্মে সবই ঠিকঠাক ছিল কিন্তু নিজের বাপের বাড়ি তস্য আত্মীয় সবাইকে মাঠে নামিয়ে এমন শোরগোল ফেলে দিলেন যে আর কহতব্য নয়! পাড়ার অন্য বউঝিয়েরা গ্যালারিতে। এদিকে পাকালো অন্য জায়গাতে, রায় সাহেবের বড় শালার মেয়েকে দেখে, সৌগত দত্তের পালে প্রেমের হাওয়া লাগল- একটুসখানি! ও সব পুজোতেই একটু-আধটু হয়; মা জলে পড়ে, সাথে প্রেমও। কিন্তু এই দুই মিয়া বিবি পুজো পার করেও দেখা সাক্ষাত চালাতে লাগল। জাতধম্মের ক্যাচাল না পাড়লে সৌগত আর মিলির বিয়েটা খুব একটা খারাপ হওয়ার নয়। কিন্তু একে জজসাহেব, তায় জাতে বামুন, তার শালার মেয়ে বলে কথা। সে কি না... তা আমাদের রায় গিন্নী রেগেমেগে সৌগতের মাকে ডেকে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দিলে সাত কথা শুনিয়ে।

পরের বছর শোধ তুললেন দত্ত গিন্নী। পুজোর মিটিঙে কে কত টাকা দেবে এই সব যখন চলছে সৌমেন দত্ত ঘামতে ঘামতে বললেন, তিনি দিবেন ৫১ হাজার ১ টাকা। তখনো থিমে থমথমে পুজো আমাদের এখানে সেভাবে চালু হয়নি। ৫১ শুনে তো পাড়ার ছেলেদের জীভে জল চোখে R.C.। কিন্তু টোপের পিছনে ছিল বঁড়শি। পুজোর বাকী সব কাজকর্ম হবে ব্যানার্জী গিন্নীদের বাড়ি। ক্লাব কিন্তু ততদিনে পাকা ছাদের হয়ে গেছে। কিন্তু ক্লাবের বাকীরা ভাবল- এই সব সাত্বিক ব্যাপার বামুন বাড়িতেই হওয়া উচিত। ক্লাবঘর ফর তামসিক ক্লাব এক্টিভিটিজ। মানে একটু... ঐ আর কি, আপনাদের আর বেশী কি বলব!

তা সৌমেন দত্তকে তাঁর বাকী বন্ধুরা মিটিং করতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুই মরতে ৫১ হাজার কবুল করতে গেলি কেন? ঘামছিলি তো বলতে গিয়ে।

সৌমেন দত্ত গ্লাসের মাল একঢোকে গলায় চালিয়ে হতাশ ভাবে বলল, কবুল করেছিলাম কি আর সাধে? বলে কি একটা শাড়ির দোকান না বুটিক কি একটা বানাবে, তার জন্যে সাড়ে তিন লাখ টাকা দিতে হবে। তাও আবার কোন মাসশাশুড়ির সাথে পার্টনারশিপ। আমি বাবা শ্বশুরবাড়ির সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্কের বিরোধী তাই গাঁইগুঁই করছিলাম। তখন বলে কি পাড়ায় মা দুর্গার পুজো ধুমধাম করে করবে? ছেলে অত ভালো একটা কাজ পেল তার জন্যে। তা মায়ের পুজো- কি আর বলি বল?

পাড়ায় দজ্জাল গিন্নীদের মধ্যে একটা বিভেদ গড়ে উঠতে সময় লাগল না। এবারে ভোগের ব্যবস্থা ব্যানার্জী বাড়িতে সহকারী তথা পরামর্শদাত্রী দত্ত গিন্নী। পাড়ার মেয়ে বউরা আবার গ্যালারি থেকে মাঠে। রায়বাড়ি তো আর পাড়ার পুজো ত্যাগ করতে পারে না, কিন্তু মুখ তোম্বা। কারণ নতুন দলের হাতে লাগাম।

রায়বাড়ি যখন প্রায় একা হতে বসেছে নিজে নিজে, কারণ পাড়ায় তো আর কেউ তাদের নিজে থেকে আলাদা করে দেয় নি, তখন তাকে লাইফলাইন দিল আরো এক খাণ্ডার শ্রমতী পাল। তিনি দুবছর ধরে কিছুতেই আর নিজের পালে হাওয়া টানতে পারছিলেন না। এবারে গোলমালের গন্ধে নিজেই গিয়ে আঁতাত করে নিলেন রায় বাড়ির সঙ্গে।

তোমার বাড়িতে গতবছর যখন ভোগ ইত্যাদি হয়েছিল তখন যাই বলো দিদি একটা বেশ বাড়ির পুজো, বাড়ির পুজো মত ব্যাপার ছিল। কিন্তু এবারে দত্তদি যেটা করল সেটা তো টাকার জোর দেখিয়ে পুজোটা ছিনতাই করে নেওয়া বলা চলে, তাই না? বল?

আমি ভাই ওসবের মধ্যে নেই। দত্ত গিন্নীর টাকা হয়েছে দেমাক দেখাচ্ছে, আমি ঐসব ছোটলোকামির মধ্যে যেতে রাজী নই। পুজোয় যদি শুদ্ধাচার না থাকে সে পুজোর মধ্যে থাকার মানে হয় না। আর পুজো হলো মনের ব্যাপার, ওর মধ্যে আবার টাকা দেখানোর কি আছে! টাকা কি তোর দাদার বা তোর বরের কম আছে, তার উপরে আছে ক্ষমতা। আরে জজ সাহেব নেমন্তন্ন করলে অনেক আচ্ছা আচ্ছা মিয়া আসতে ছটফট করবে। তাই না? বল?

যা বলেছ দিদি। দেবো তোমার ভাইকে দিয়ে ঘোঁট পাকিয়ে?

না না ওসব করতে নেই। আমরা কী ওদের মতো নাকি?

ব্যানার্জী গিন্নী এবারে চালে ভুল করে ফেলল। দশমীর দিন বিকেলে যখন বরণ শুরু হবে হবে এমন সময় তিনি ফতোয়া দিলেন- অব্রাহ্মণরা মাকে বরণ করতে পারবে না। ব্যাস সেমসাইড গোল আর কাকে বলে। যে দত্ত গিন্নীর পিঠে চেপে তিনি রাজত্ব শুরু করতে যাচ্ছিলেন, নিজের ভুলে সেখানেই ছুরি।

সমীকরণ বদলাতে সময় লাগল না বেশীক্ষণ। পাড়ার মধ্যে তখন ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণদের একটা পাঁচিল উঠবো উঠবো করছে। পাল, দত্ত, দাস, ঘোষ একদিকে ব্যানার্জী রায় অন্যদিকে ভট্টাচার্য। পাড়ার যে সব মহিলারা বরণে সাধারণত অংশগ্রহণ করেন না তাঁরাও হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করে দিলেন। সে এক যাচ্ছেতাই অবস্থা!

সুরজিত ও সরমা পালের মেয়ে পরমা, যেমন নাম সেই রকম রূপ। সে যে কখন গুটি কেটে প্রজাপতি হয়েছে সেটা দত্ত গিন্নীর কাছে খবর ছিল না। কিন্তু পাড়ায় এই বেখাপ্পা ফতোয়া আর তাতে পুরোহিতের সায় দুই মিলে তার অবস্থা খুবই খারাপ করে দিয়েছিল। এমত মনের অবস্থায় তিনি পরমা আর তার মাকে দেখে আর থাকতে পারলেন না। তৃতীয় ফ্রন্টের জন্যে আরো একবার ঝাঁপালেন।

ওমা পরি! তুই তো মা আমাদের পরি রানি হয়ে গেছিস রে! কি সুন্দর হয়েছিস রে তুই! লক্ষই করিনি, এই বলে চিবুক ধরে মুখটা তুলে ধরে সেই হাত মুখে ঠেকিয়ে চুমু খেলেন আর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিলেন। ও সরমা তোমার পরি রানিকে আমি আমার বাড়িতে নিয়ে যাব কিন্তু!

কিছুক্ষণ আগেই সমীকরণ গেছে বদলে। রায়দি ব্রাহ্মণত্বের গর্ব দেখাতে ব্যানার্জী গিন্নীর দিকে। সরমা এই সুযোগ লুফে নিল। মেয়ে তো তোমাদেরই দিদি, ও আর আমাকে বলার কি আছে? নেহাৎ ঠাকুর বিসর্জনের কাজটা পাড়ার হুমদো মার্কা ছেলেরা করে, না হলে সেই দশমীতে পাড়ার যা হাল করেছিল বৌয়েরা, মায়ের আর কৈলাশে ফেরা হতো না।

এবারে একটা সমীকরণ বুঝে নেওয়া যাক। সুদর্শন ব্যানার্জীর ছেলে সন্দীপ পেশায় বাবার মত চাটার্ড আর বাবার চেয়েও সুদর্শন। সৌমেন দত্ত সোনার ব্যবসায়ী ছেলে সেই ব্যবসা আরো বাড়িয়েছে, দেখতে খুব ভালো না হলেও কুচ্ছিত নয়। বিমল রায় হাইকোর্টের বিচারপতি ছেলে সফটওয়্যারের চাকরি সূত্রে কলকাতার বাইরে। আর বেজায় পণ্ডিত। আর সুরজিত পাল পার্টি পলিটিক্স করে কলকাতা করপোরেশনের মেয়র পরিষদের মেম্বার টেম্বার অনেক কিছু, বউ একটা মেয়েদের হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের টিচার। মেয়ে পরমা সুন্দরী।

মায়েরা ঘনঘন সমীকরণ বদলালে কী হবে বাবাদের মিটিং ঠিক আছে, আর তারপরের প্রজন্মের মধ্যে আর পাঁচটা সাধারণ ছেলেমেয়েদের মত দাদা, ভাই, বোন, বন্ধু, প্রেমিক, প্রেমিকা এই সব সম্পর্কই আছে। যথারীতি মিটিঙে সুরজিত সৌমেন দত্তকে জিজ্ঞাসা করল, কিরে তোর বউ তো পরমাকে সৌগতর বউ করবে বলে ক্ষেপেছে, তোর কি মত?

দত্তর ৫১ হাজার গেছে পুজোয়, তার উপরে বউ পাড়াতে গুছিয়ে দজ্জালপনা দেখাতে পারেনি বলে বাড়িতে বরের উপরে খামোকা চোটপাট করছে। সব মিলিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা! আর এখানে মাল খাওয়ার সময় আবার তার ইচ্ছের কথা উঠেছে, হুইস্কির নেশা ফিকে হয়ে যাওয়ার উপক্রম। হতাশ বিরক্ত গলায় বলল, দ্যাখ সুরজিত আমি বিয়ে করছি না। আমার বউ বিয়ে দিচ্ছে আমার ছেলের। শালা তাদের জিজ্ঞাসা করতে পারছিস না? আমার পিছনে কেন রে ভাই। একটু খাচ্ছি মাইরি তাতেও কাটি? যা শালা ওদের জিজ্ঞাসা করগে যা। আমাকে জ্বালাবি না।

বাকি দুজন দত্তকেই সাপোর্ট করল।

সৌগতকে তার মা বলল, আমি তোমার বিয়ে দেওয়ার জন্যে পরমাকে ঠিক করেছি। তোমার কোন আপত্তি আছে?

আপত্তি মানে? পরুকে আমি বিয়ে করতে পারব না।

কেন তোমার কি বাবা মায়ের পচ্ছন্দের উপরে কোন আস্থা নেই?

তা থাকবে না কেন? কিন্তু আমি ছোটবেলা থেকে যাকে নিজের ছোট বনের মত দেখে এসেছি তাকে নিজের বউ ভাবতে পারব না। সেটা তুমি বললেও না, বাবা বললেও না বা কাকু কাকীমা বললেও না। আর তাছাড়া আমি কমিটেড একজনের প্রতি। সেটা তুমি নিশ্চই জানো?

ওই মি. রায়ের শালার ধিঙ্গী ধুচুনি ময়েটা? কি যেন নামটা? শ্রদ্ধা না শ্রাদ্ধ?

মা তোমার পছন্দ না হতে পারে কিন্তু ওর বাপ মায়ের দেওয়া নামটা বিকৃত করছ কেন?

ঈইইই... বিয়ে না হতেই এই... বিয়ে হলে তো নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে ঐ মেয়ে।

যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা, এই বলে সৌগত চলে যায়। বরের কাছে ছেলের নামে নালিশ করতে গিয়ে বিশেষ সুবিধা হয় না। তিনি শুধু বলেন- ওটা ওর জীবন ডিয়ার। আমার নয়। আর যতক্ষণ না ও আমার ব্যবসার কোন ক্ষতি করছে ওর জীবনে আমি ঢুকতে নারাজ।

পরমা তার মাকে জানিয়ে দিল, সে সন্দীপ ব্যানার্জীকে ভালবাসে আর সেটা অনেকদিন ধরে। বামুন নই বলে দেখলি না আমাদের বরণ করতে দিল না এত কুচুটে মেয়েছেলে। তোকে ছেলের বউ করবে ভেবেছিস। আর যদিও করে পায়ের তলায় জুতো করে রাখবে বলে দিলাম। মুখে হম্বিতম্বি যতই করুক না কেন, সরমা নিজের মেয়ের পছন্দকে তারিফ না করে পারল না। সন্দীপ দেখতে অসাধারণ। আর কোন শাশুড়িই বা না চায় যে তার জামাই সুন্দর হোক। আরো একটা ব্যাপার আছে, এবার নিজের ছেলের বউই তো অব্রাহ্মণ বাড়ির মেয়ে, উচিত শিক্ষা দেবেন এবারে ভগবান।

ব্যানার্জী গিন্নির মাথায় বাজ পড়ল! পরমা সুন্দরী কিন্তু ব্রাহ্মণ নয়। তাদের সমাজে একটা মান মর্যাদা আছে সেটা তো নষ্ট হয়ে যাবে। ছেলেকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলেন, কিন্তু সন্দীপের সোজা সাপ্টা কথা- আমি জাতপাত মানি না, ব্যাস। বিমল রায়ের ছেলে বিজন রায় কর্মসূত্রে ডেট্রয়েটের বাসিন্দা। সেখান থেকে সে তার বাবা-মাকে জানাল যে, সে তারই এক সহকর্মীনিকে বিয়ে করতে চলেছে। যার নাম চিত্রিতা ওফেলিয়া কুট্টি। দুমাস বাদে জানা গেল একটা পথ দুর্ঘটনায় তারা দুজনেই আহত। তারপর তাদের বিয়ের ছবি পাঠাল পাত্রী হুইল চেয়ারে আর পাত্র চোখে কালো শেডস পরা।

পরিস্থিতি চার খাণ্ডারনিকে একেবারে রোলারের তলায় ফেলে দিয়েছে। তাদের আর কোনো উৎসাহ নেই পাড়ার পুজোর ব্যাপারে নাক গলাতে। মিটিং এ তাদের বরেরা স্বস্তিতে। পাড়ার পুজো দুবছর বাড়ির কুক্ষীগত হওয়ার পরে আবার বারোয়ারি। ক্লাবের মেম্বাররা ঠিক করেছে তামসিক পুজো গভীর রাতেই হবে। দিনে ক্লাবঘরেই ভোগ যোগ সবকিছু।

সিদুঁরের ইতিহাস নাকি অনেক পুরনো। আর তা পুরুষতান্ত্রিক্তারই একটা চিহ্ন মাত্র। কিন্তু সত্যিই কী তাই? কে জানে? সপ্তমীর রাতে বিজন বাড়ি ফিরেছিল ডেট্রয়েট থেকে। রায় গিন্নী তাঁর হুইল চেয়ারে বসা নিম্নাঙ্গে প্যারালিসিস হওয়া ‘অপয়া’ মালয়েলি ক্রিশ্চান ছেলের বউকে পাড়ায় বার হতে দেননি। যদি জজ সাহেবের সম্মান হানি হয়। ছেলের কালো চশমার কারণ যখন জানতে পারলেন তখনই ঐ ‘অপয়া’ উপাধীটা দেয়া। মুখটা আরো পুড়িয়েছে ভাইঝি, নীচু জাতের ছেলেকে বিয়ে করে।

দত্ত গিন্নী কাকে দোষ দেবেন ঠিক করতে পারছিলেন না। ছেলে যাকে বিয়ে করে আনল সে উঁচু জাত কিন্তু পরমার মত সুন্দরী নয়। কিন্তু কাজে কর্মে একেবারে দশভূজা। শ্বশুরের চোখের মণি হয়ে উঠেছে দুমাসেই। লাবণ্য ব্যানার্জীর দোলাচল আর কাটছে না। পরমা তো এখন ছেলের বউ, মানে তাদেরই গোত্র তবে কি বরণ করা চলে? হাজার হোক ব্রাহ্মণ বংশে তো আর জন্ম নয়, নীম্নবর্ণ কী যে অকল্যাণ হবে পরিবারে, ভগবানই জানেন।   

ঠাকুর নামানো হয়েছে বেদী থেকে। পাড়ার মহিলারা বরণডালা, শাঁখ সিঁদুর, মিষ্টি, পান সুপারী দিয়ে মেয়েকে আবার তার বরের ঘরে পাঠানোর জন্যে তৈরি। ঢাকিরা তাদের কাঠি ঢাকের ছাঁওয়ের উপরে বাড়ি দিয়ে শুরু করল বিসর্জনের বাজনা। বরণ শুরু হলো। বিশ্ব মাতৃকার আজ কন্যার রূপ। এয়োস্ত্রীরা বিশ্বজননীর মাথার সিঁদুর একে ওপরের মাথায় লাগিয়ে দিয়ে তাঁদের সিঁথির সিঁদুরকে অক্ষয় করার প্রার্থনা জানাচ্ছেন। ধুনুচি নিয়ে পাড়ার কয়েকজন ঢাকের তালে নাচছে।

এমন সময় এক স্বর্গীয় মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে গেল চারপাশের লোকজন- কি হয়েছে দেখতে গিয়ে ঢাকিরা তালে ভুল করে ফেলল, কাঁসি থমকে গেল। দেখা গেল হুইল চেয়ারে চিত্রিতা ওফেলিয়া রায়কে লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরিয়ে নিয়ে আসছে পরমা ব্যানার্জী। তার এক পাশে হাঁটছে বিদীপ্তা দত্ত, পিছনে হাঁটছে তার বাবা, শ্বশুরমশাই, বিমলকাকু আর সৌমেনকাকু। তারও পিছনে আসছে সন্দীপ, বিজন আর সৌগত।

চিত্রিতার উপস্থিতি যে রায় গিন্নীর মনঃপুত হয়নি সেটা তাঁর মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া দেখেই বোঝা গেল। কিন্তু চিত্রিতা যতোই মাথা নিচু করে নিজেকে অদৃশ্য প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করুক না কেন সেটা তো বাস্তবিক আর হবার নয়। মায়ের সামনে তার হুইলচেয়ারটা দাঁড় করিয়ে দিয়ে বরণ ডালা থেকে এক মুঠো সিঁদুর তুলে তার দুগালে আর সিঁথিতে দিয়ে দিল পরমা। তারপর দিল বিদীপ্তা, আর তারপর তার হাতের কাছে বরণডালা আর নিজেদের মুখটা নিয়ে গেল দুজনে, তার হাত থেকে সিঁদুর মাখবে বলে।

বিজন, তার স্বামী, তার এই একসিডেন্টের পরে প্যারালিসিস হয়ে যাওয়া নিম্নাঙ্গ নিয়েই তাকে বৌয়ের মর্যাদা দিয়েছিল। তার স্বামীর এক চোখ একসিডেন্টের পরে অন্ধ হয়ে যাওয়া তার বাবা মায়ের কাছে বুক ভেঙে দেওয়া একটা অনভূতি হওয়া সত্ত্বেও তার শ্বশুরমশাই তাকে ছেলের বউ হিসাবে মেনে নিয়েছিলেন বা নিতে বাধ্য হয়েছিলেন কি না ঠিক জানে না সে। তার শাশুড়িমা তাকে মেনে নিতে পারেননি। অনেক অনেক কারণে যেগুলো সে নিজেও বুঝতে পারে। যে কারণে কুণ্ঠিত হয়ে থাকে মনেমনে। কিন্তু আজ এই সিঁদুর মাখানো লাল মুখ তার যাবতীয় লজ্জা কুণ্ঠা দ্বীধা সবকিছু ঢেকে দিয়ে তাকে একটা বিরাট পরিবারের মধ্যে টেনে নিল। এই অনুভূতি তাকে সব কিছু ভুলিয়ে দিল। সে নিজে তার হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে নিয়ে এগিয়ে গেল তার শাশুড়ি মায়ের কাছে। সামনে দাঁড়াল সিঁদুর সমেত, হাতটা উপরে তুলল। এবার আর রায় গিন্নী থাকতে পারলেন না। মাথাটা নামিয়ে গালটা, কপালটা এগিয়ে দিলেন চিত্রিতার সামনে। মায়ের মাথার সিঁদুর নিয়ে চিত্রিতার সিঁথিতে দিয়ে ছেলের মঙ্গল কামনা করে জড়িয়ে ধরলেন তাকে।

 

কলকাতা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়