ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

‘সাহিত্যে স্থানিকতা জরুরি, তাকে আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে মেলাতে হবে’

অলাত এহ্‌সান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৪, ১০ নভেম্বর ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘সাহিত্যে স্থানিকতা জরুরি, তাকে আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে মেলাতে হবে’

শাহাদুজ্জামান

নিরীক্ষাধর্মী সাহিত্যের জন্য সমাদৃত শাহাদুজ্জামান। গল্প-উপন্যাস তাঁর প্রধান ক্ষেত্র। প্রবন্ধ, অনুবাদ, ভ্রমণ ও গবেষণায় তাঁর মননশীল বইয়ের সংখ্যা এক কুড়ি। দীর্ঘ এই সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আন্তরিক সাড়া দেন। সাক্ষাৎকারটি আবর্তিত হয়েছে মূলত ছোটগল্প নিয়ে। পাশাপাশি কথা বলেছেন সাহিত্যের নানা দিক, দেশে সাহিত্য চর্চা, সাহিত্যে সমসাময়িক সুহৃদ, শ্রদ্ধাস্পদ অগ্রজ, লিটলম্যাগ, মঞ্চনাটক, অনুবাদ ইত্যাদি বিষয়ে। শাহাদুজ্জামানের সঙ্গে দীর্ঘ এই কথোপকথনে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তরুণ গল্পকার অলাত এহ্‌সান।

অলাত এহ্‌সান: সাক্ষাৎকার নেয়া ও দেয়ার সংখ্যা আপনার কম নয়। ঠিক কোথা থেকে শুরু করা যায়?

শাহাদুজ্জামান: শুরু তো হয়েই গেল। আপনি আমার সঙ্গে যোগাযোগের সময় বলেছিলেন, সাক্ষাৎকারকে আপনি বিকল্প আত্মজীবনী মনে করেন। কথাটা পছন্দ হয়েছে আমার। তেমন সাক্ষাৎকার দিতে ভালো লাগে যেখানে কথা বলতে বলতে নিজের ভেতরের নানা চোরাগোপ্তা প্রান্তে আলো ফেলা যায়।

অলাত এহ্‌সান: আপনার সঙ্গে গল্প নিয়েই কথা বলতে চাই। গত বইমেলায় আপনার পঞ্চম গল্প সংকলন প্রকাশ হয়েছে। প্রথম গল্প সংকলন প্রকাশ হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। মাঝে ১৫ বছর। নিজের গল্পে বদল কেমন দেখতে পাচ্ছেন?

শাহাদুজ্জামান: পেছন ফিরে আমার গল্পগুলোর দিকে তাকালে সেগুলোকে যেমন অনেকটাই এক সুতায় বাঁধা দেখতে পাই, আবার এদের ভেতর বদলও দেখতে পাই। আমার গল্পের উপস্থাপনায়, আঙ্গিকে একটা নিরীক্ষা প্রবণতা সবসময় ছিল, এখনও আছে। তবে গল্পের বিষয়ে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। নব্বই দশকের গোড়ায় আমি যখন গল্প লিখতে শুরু করি তখন পৃথিবীর একটা বড় রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে গেছে। সমাজতান্ত্রিক পৃথিবীর ভাঙন ধরেছে, স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়েছে, পৃথিবী দ্রুত বিশ্বায়নের দিকে ঝুঁকেছে। বাংলাদেশে বসে সে চাপ আমরা অনুভব করছি তখন। আমি নিজে বাম রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলাম। আমার সে সময়ের গল্পে এই ভাঙনের থিমগুলো ঘুরে ফিরে এসেছে। গল্পের চরিত্রগুলো একধরনের দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ভেতর থেকেছে। আমার প্রথম গল্পের বইয়ের নাম  ছিল ‘কয়েকটি বিহ্বল গল্প’। বিহ্বলতা, দ্বিধা আমার গল্পগুলোর একটা প্রধান থিম। সেসময়ের অনেক গল্পে এই বিহ্বলতার উৎস হয়তো রাজনৈতিক স্বপ্নভঙ্গ। তবে সময় বদলালেও এই বিহ্বলতার থিম কিন্তু আমার গল্পে এখনও আছে। তার উৎস অবশ্য ভিন্ন। মানুষের বেঁচে থাকার ভেতর নাজুকতা আছে। ব্যক্তি মানুষ মাত্রই বিরাট, জটিল বাস্তবতার কাছে নাজুক। আমাদের জীবন তো নানা আকস্মিকতায় আর দুর্ঘটনায় ভরা। অনিবার্য মৃত্যুর বিপরীতে এই বেঁচে থাকা, স্বপ্ন দেখার ব্যাপারটাও তো অদ্ভুত। আমাদের জীবনে আনন্দের ভেতর সবসময় চোরাগোপ্তা লুকিয়ে থাকে একটা বেদনার আশঙ্কা। এসব কিছু মিলিয়ে জীবন বিস্ময়কর। আমার গল্পগুলোর ভেতর এই বিস্ময়বোধ সবসময় থাকে। তার বিশেষ বদল হয়নি।    

অলাত এহ্‌সান: আপনার প্রথম বইয়ের সূচনা গল্পটি গল্প নিয়ে। সর্বশেষ গ্রন্থ ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখি’ বইয়ের সূচনা গল্পটিও গল্প নিয়ে। আপনি অনেকবারই গল্প নিয়ে কথা বলতে চেয়েছেন।

শাহাদুজ্জামান: আমার প্রথম বইয়ের প্রথম গল্পের নাম ‘এক কাঁঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার গল্প’। এই গল্পের মূলভাব জীবনের ওই নাজুকতা আর আকস্মিকতা। এটি বন্ধুত্বের গল্প। তাদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা সত্ত্বেও সেই বন্ধুত্ব যে টিকলো না, তার জন্য তারা দু’জনের কেউ দায়ী নয়। আমরা স্বপ্ন দেখি আর সেই স্বপ্নগুলো ভাঙবার জন্য কোথায় কে অদৃশ্য হয়ে বসে আছে, এই বোধ নিয়ে শুরু হয়েছিল আমার সেই গল্পের বই। আমার সর্বশেষ ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখী’ বইয়ের শেষ গল্পের নাম ‘নাজুক মানুষে সংলাপ’, জীবনের ওই নাজুকতা আর আকস্মিকতা নিয়েই এই গল্প। একজন জ্যেষ্ঠ আর একজন কনিষ্ঠ সংলাপের মাধ্যমে জীবনের এই হাত ফসকে যাবার প্রবণতা নিয়ে কথা বলছে। ফলে পনেরো বছর আগের আর পরের এই গল্প দুটোকে একটা ব্রাকেটে এনে ফেলা যায়। তবে ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখী‘ বইটার প্রথম গল্প ‘জনৈক স্তন্যপায়ী যিনি গল্প লেখেন’র থিম খানিকটা ভিন্ন। এই গল্পটা বরং বলা যায় আমার এতদিনের গল্প লেখা বিষয়ক ভাবনারই নির্যাস।

অলাত এহ্‌সান: সেই যে ‘এক কাঁঠাল পাতা আর মাটির ঢেলার গল্প’-এ শ্রোতা কারা তা খোঁজা হচ্ছে। আর এবার দেখলাম একটা গল্প লেখায় তাড়িত লেখক গল্পের নানা ধারণা নিয়ে আলোড়িত হচ্ছে। এটা কি নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া?

শাহাদুজ্জামান: ঠিকই বলেছেন। এই গল্পগুলোতে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার ব্যাপার আছে, আর আছে আমার গল্প বিষয়ক ধারণার প্রকাশ। বলতে পারেন গল্প লেখা নিয়ে একটা গল্প। এটা প্রবন্ধ হতে পারতো। আমি বরং একটা প্রবন্ধকে গল্পে রূপান্তরিত করলাম। এটা আমার গল্পের নিরীক্ষা প্রবণতারই ধারাবাহিকতা। আমি ওই গল্পে একজন গল্পকারের কথা বলছি যে বানিয়ে তোলা গল্পের বদলে হয়ে ওঠা গল্প লিখতে চেষ্টা করছে।

অলাত এহ্‌সান: একজন চিকিৎসা নৃ-বিজ্ঞানীর ব্যস্ততা অন্য অনেক পেশার চেয়ে আলাদা। কর্মস্থল প্রবাসে হওয়ার কারণে তা হয়তো আরো আলাদা।

শাহাদুজ্জামান: আমি ডাক্তারি পাশ করলেও প্রচলিত অর্থে রোগীর চিকিৎসা করবার পেশা আমি গ্রহণ করিনি। আমি চিকিৎসা নৃ-বিজ্ঞানে (নেদারল্যান্ডসের আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে) পিএইচডি করে অধ্যাপনা এবং গবেষণাকে আমার পেশা হিসেবে নিয়েছি। শিল্প সাহিত্য অঙ্গনে আমার বিচরণ সহজ করবার জন্যই আমি এ পেশা বেছে নিয়েছি। অধ্যাপনা এবং গবেষণার সঙ্গে থাকার কারণে আমার সময় অনেকটাই নিজের মতো সাজিয়ে নিতে পারি। তবে পেশাগত এই সিদ্ধান্ত নেয়াটা সহজ ছিল না। প্যাসন আর পেশার ভারসাম্য রাখা কঠিন কাজ, সেই কঠিন পথটা এখনও পাড়ি দিতে হয় আমাকে। আমার পেশার অভিজ্ঞতাকে লেখার কাজেও ব্যবহার করার চেষ্টা করি। আমি এখন বৃটেনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা, গবেষণা করছি। বিশ্বস্বাস্থ্য বিষয়ক কাজ করার সুবাদে পৃথিবীর নানা প্রান্তে যাবার সুযোগ ঘটে আমার, সেসব অভিজ্ঞতা আমার লেখাতেও কাজে লাগে। সে হিসেবে পেশাগত জীবনকে আমি যথাসম্ভব আমার সাহিত্যিক জীবনের সহযোগী করে তুলবার চেষ্টা করি। প্রবাস জীবনের অনেক দোলাচল থাকে। সেখানে হারানোর বেদনা আছে, পাওয়ার আনন্দও আছে। নিজের দেশ, সংস্কৃতি থেকে দূরে থাকার কারণে নিজেকে, নিজের দেশকেও নতুন করে চেনা যায়। কিন্তু দেশান্তরের ব্যাপারটার ভেতর একটা চাপা হাহাকার আছে সবসময়। আমি অবশ্য নিয়মিতই দেশে যাওয়া-আসা করি। ফলে নানা মিশ্র অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে প্রবাসে বসবাস করি এবং মনের এই নাগরদোলাকে বরং আমার লেখায় কাজে লাগাতে চেষ্টা করি।

অলাত এহ্‌সান: এর মধ্যে আপনার লেখার রুটিন কী রকম? মানে রুটিন করে লেখেন কি না?

শাহাদুজ্জামান: আমি সাধারণত রাতে লিখি। প্রবাসে অবিরাম সামাজিকতার কোন দায় থাকে না বলে, প্রতি রাতেই পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর পর আমি কিছু সময় ব্যয় করি লেখায়। লেখা আমার রাতের পেশা। বিশেষ কাজ না থাকলে ছুটির দিনগুলোতে দিনের বেলাতেও লিখি। আবার সুযোগ পেলে কাজের ফাঁকেও চুরি করে লিখি। বিশেষ কোন বই লেখার মাঝখানে যখন থাকি তখন যতটুকু সময় পাই একেবারে আকণ্ঠ ডুবে থাকি সে লেখায়। ‘একজন কমলালেবু’ যখন লিখেছি তখন ছুটির দিনগুলোতে টানা আট-দশ ঘণ্টা লিখেছি। তাছাড়া আগে যেমন বলছিলাম কাজের সূত্রে আমাকে পৃথিবীর নানা দেশে ভ্রমণ করতে হয়। প্লেনে আমাকে ছয় সাত ঘণ্টা থাকতে হয়। এসময় আমার তো প্লেনে বসে থাকা ছাড়া আর কাজ নেই। আবার বৃটেনের ভেতর বেশ লম্বা ট্রেন জার্নি করতে হয় আমাকে। আমি এই সময়গুলো কাজে লাগাই। আমি অনেক গুরত্বপূর্ণ বই পড়েছি প্লেনে, আমার অনেক গল্প লিখেছি প্লেনে, ট্রেনে। জীবনের ব্যস্ততার ফাঁক-ফোকরে যখনই চোরাগোপ্তা সময় পাই, তা লেখার কাজে লাগাই।

অলাত এহ্‌সান: সেক্ষেত্রে আপনি লেখার সব উপাদান জোগাড় করে লিখতে বসেন, নাকি লিখতে লিখতেই উপাদানগুলো জড়ো হয়, আপনি তাতে সাড়া দেন মাত্র?

শাহাদুজ্জামান: লেখার মূল ভাবনা, চরিত্র ইত্যাদিগুলো মোটামুটি ঠিক করেই লিখতে বসি। লেখার পুরো চেহারাটা মাথায় থাকে না, তবে একটা অবয়ব থাকে। লিখতে লিখতে রূপটা স্পষ্ট হয়।

অলাত এহ্‌সান: ‘একজন কমলালেবু’ উপন্যাস প্রকাশের পর আপনি বিচিত্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলেন, তাই না?

শাহাদুজ্জামান: বইটা প্রকাশের পর যে প্রতিক্রিয়া পেয়েছি তাকে বিচিত্র বলা যায়। ২০১৭ সালের গ্রন্থমেলায় বইটা প্রকাশের পর, মেলার ভেতরই চারটি মুদ্রণ শেষ হয়ে যায়। এরপর ধারাবাহিক মুদ্রণ চলছে। অনলাইনে, পত্রপত্রিকায় নানা আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে বইটি নিয়ে সেটা লক্ষ্য করেছি। জীবনানন্দের সাথে শিক্ষিত বাঙালির অল্প বিস্তর সবারই পরিচয় আছে। তাকে কেন্দ্র করে একটা উপন্যাসের ব্যাপারে  কৌতূহল তৈরি হবারই কথা। বহু পাঠক-পাঠিকা এই বইয়ের মাধ্যমে নতুন করে জীবনানন্দকে আবিষ্কার করেছেন জানিয়েছেন। ই-মেইলে, ফেইসবুক মেসেঞ্জারে, ব্যক্তিগতভাবে নানা রকম আবেগাক্রান্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তার ভেতর বিচিত্র, নানারকম প্রতিক্রিয়াও থাকে। একজন পাঠক আমাকে ই-মেইল করে জানিয়েছেন, এই বই পড়ার পর থেকে তিনি কমলালেবু খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। কমলালেবু খেতে গেলেই নাকি তার মনে হয় তিনি বোধহয় জীবনানন্দকেই খেয়ে ফেলছেন। লোকালয় থেকে বাইরে গিয়ে একজন পুরো বইটা পড়েছেন গাছের উপর চড়ে- এইসব নানা রকম প্রতিক্রিয়া। অনেকে বইটার নাম নিয়ে বিভ্রাটে পড়েছেন। একজন কমলালেবুকে ভেবেছেন একডজন কমলালেবু। তবে জীবনানন্দের মতো অনেক পরিচিত একজনকে নিয়ে বই লেখার বিপদও আছে। জীবনানন্দ বিষয়ে যারা নিজেদের বিশেষজ্ঞ মনে করেন তাদের অনেকের ভেতর জীবনানন্দকে কেন্দ্র করে এক ধরনের অভিভাবকত্ব তৈরি হয়। তারা যেভাবে জীবনানন্দকে বুঝেছেন সেটাই চূড়ান্ত ধরে নিয়ে অন্য যে কোনো ব্যাখ্যা বা উপস্থাপনকে তারা নাকচ করেন। এমন কিছু জীবনানন্দ অভিভাবকের বিরূপ প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। একটা বই সবার পছন্দ হবে না। কিন্তু কারো কারো উদ্ধত এবং রুচিহীন মন্তব্যে মর্মাহত হয়েছি। তবে ‘একজন কমলালেবু’ নিয়ে বেশ কিছু মেধাবী আলোচনাও দেখেছি যেখানে এই বইয়ের শক্তি এবং সীমাবদ্ধতা নিয়ে চমৎকার আলোচনা করা হয়েছে। এই বইটা নিয়ে বিশেষভাবে বিতর্ক হতে দেখেছি বইটা উপন্যাস না জীবনী এই নিয়ে।     

অলাত এহ্‌সান: এটা কেন হলো?

শাহাদুজ্জামান: এই বিতর্ক নিয়ে আমি অন্যত্র কথা বলেছি। আমি বলেছি, উপন্যাসের সংজ্ঞা কালে কালে পাল্টেছে। কোথায় উপন্যাসের সীমা শেষ আর জীবনীর সীমা শুরু সেটা নির্দিষ্ট করা কঠিন। আমি সাহিত্যের নানা শাখার দেয়াল ভেঙে ফেলার আগ্রহের কথা বিভিন্ন সময় বলেছি। উপন্যাস একটা বিশেষ পাঠ অভিজ্ঞতা। বহু পাঠক এই বইটাকে উপন্যাস হিসেবেই পড়েছেন। কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রচেত গুপ্ত বইটা নিয়ে একটা লম্বা লেখা লিখেছেন। তিনি এই বই উপন্যাস না জীবনী এই বিষয়ক বিতর্ক নিয়ে বেশ ভালো ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং তিনি এই বইটাকে উপন্যাস হিসেবেই পাঠ করেছেন। আমি আমার একটা লেখায় মিলান কুন্ডেরাকে উদ্ধৃত করেছিলাম, যিনি উপন্যাসকে বলেছিলেন ‘ডিসকভারি অফ প্রোজ’, যার ভেতর কবিতা, দর্শন, প্রবন্ধ, সবই একাকার হয়ে যেতে পারে। যাহোক এই বইটাকে উপন্যাস না জীবনী কি লেবেল দেয়া হবে তা নিয়ে আমি বিশেষ চিন্তিত নই। বইটাকে একটা সাহিত্যকর্ম হিসেবেই সবাই পাঠ করুক সেটাই আমি চাই। আমি নিজে কোনো জীবনী লেখার ভাবনা থেকে বইটা লিখিনি। ‘একজন কমলালেবু’তে আমি আমার মতো করে জীবনানন্দকে পুনঃনির্মাণ করেছি। এই বইটা যতটা জীবনানন্দকে নিয়ে ততটাই জীবনানন্দের দিকে আমার তাকানো নিয়ে এবং এ বই শুধু জীবনানন্দের গল্প না, আমারও গল্প।

অলাত এহ্‌সান: আপনার পঞ্চম গল্পগ্রন্থ প্রকাশের পরও পাঠকদের মধ্যে বিচিত্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করেছিলাম। এই দু’টি বই প্রকাশের পর কয়েকজন সুহৃদ লেখকের সঙ্গে কথাও বলেছিলাম। আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?

শাহাদুজ্জামান: আগেই বলেছি, একটা বই প্রকাশিত হয়ে যাবার পর তা পাঠক-পাঠিকার সম্পত্তি। যার যার মতো বইটাকে গ্রহণ-বর্জনের স্বাধীনতা আছে। সেখানে আমার কোনো বক্তব্য নাই। তবে আমার শেষ গল্পের বই ‘মামলার সাক্ষী ময়না পাখী‘ নিয়ে এযাবৎ তো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়াই পাচ্ছি। আমি এটুকু বলতে পারি যে, এই বইয়ের গল্পগুলো লিখে খুব আনন্দ পেয়েছি।

অলাত এহ্‌সান: অনেকের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখেছি, এবারের গল্পগুলো ‘শাহাদুজ্জামানীয়’ হয়ে ওঠে নাই। আপনার কাছে কী মনে হয়?

শাহাদুজ্জামান: গল্পগুলো যে চরিত্র দাবি করে সেগুলো সেভাবেই লেখা হয়েছে বলে আমি মনে করি। আমার সারা জীবনের গল্প লেখার যাত্রা লক্ষ্য করলে দেখবেন সেখানে বরাবর নিরীক্ষার প্রবণতা আছে। আমি সব সময় নতুন নতুন পথ খুঁজেছি। এই বইতেও সেই চেষ্টা আছে। ‘শাহাদুজ্জামানীয়’ হয়ে ওঠে নাই বলতে ঠিক কী বোঝায় আমি জানি না।

অলাত এহ্‌সান: আমার মনে হয়েছে, আগের গল্পে আপনি চিন্তার সংকট-সীমাবদ্ধতার দার্শনিক সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন, আর এবার গল্পগুলোয় ব্যক্তির নান্দনিক সমস্যা-সৌন্দর্য নিয়ে কথা বলছেন। এই বিষয়গুলো নিয়ে পূর্ববর্তী লেখকগণ অনেক কথা বলেছেন। বহুল চর্চিত বিষয় পাঠক আশা করেন না।

শাহাদুজ্জামান : আমি মনে করি না, এই বইয়ের গল্পগুলো নান্দনিক সমস্যা-সৌন্দর্য নিয়ে। আগেই বলেছি, এই গল্পগুলো মূলত মানুষের অস্তিত্বের নাজুকতা এবং জীবনের আকস্মিকতা নিয়ে। এই বইয়ের গল্পে আমি জীবনের উপরতল থেকে ঝাঁপ দিয়ে ডুব দিতে চেয়েছি গভীরে, সেখানে ঠিক থই পাওয়া যায় না। আমাদের অস্তিত্বের গভীরের সেই তলটাতে অনেক অন্ধকার। আমরা সেখানে যেতে ভয় পাই। আমি সেই অন্ধকার কুঠুরিতে ঢোকার চেষ্টা করেছি এই গল্পগুলোতে। এখানে ডার্ক হিউমার আছে। এসব বহুল চর্চিত কোনো বিষয় বলে আমি মনে করি না।

অলাত এহ্‌সান: আপনার গল্পে পাঠের একটা প্রভাব আছে। ‘আন্না কারেনিনার জনৈকা পাঠিকা’, ‘অন্য এক গল্পকারের গল্প নিয়ে গল্প’-তে যেমন দেখি...

শাহাদুজ্জামান : হ্যাঁ, তা ঠিক। পঠন-পাঠন আমার অভিজ্ঞতারই অংশ। আমি প্রায়ই আমার পাঠের অভিজ্ঞতাকেও গল্পের বিষয়ে পরিণত করি।

অলাত এহ্‌সান: আপনার গল্পে লোকগল্প ও প্রবচনের ব্যবহার আছে। কোনো কোনো গল্প দাঁড়িয়েছে সেগুলো অবলম্বন করেন।

শাহাদুজ্জামান : আমার লেখালেখির মূল প্রণোদনা- জীবন জিজ্ঞাসা। এর উত্তর খুঁজতে আমি আমাদের লোকসাহিত্যের দ্বারস্থ হই। অনেক অসাধারণ ভাবনার উপকরণ সেখানে আছে। লোকগল্প, প্রবচন আমার অনুপ্রেরণা, ফলে আমি সুযোগ তৈরি হলে সেগুলো ব্যবহার করি।

অলাত এহ্‌সান: অনেকে মনে করেন, লোকগল্প ও উপকথার আদলে গল্প বলতে পারলে বাংলা গল্পের নিজস্ব স্বাক্ষর তৈরি হবে।

শাহাদুজ্জামান: আমাদের এই অঞ্চলের মানুষের জীবন ভাবনার, জীবন যাপনের নানা সূত্র লুকিয়ে আছে আমাদের লোকসাহিত্যে। লোকসাহিত্যে বিষয় এবং আঙ্গিকেরও বৈচিত্র্য আছে। ফলে সেই ভাণ্ডার ব্যবহার করতে পারাটা আমি প্রয়োজনীয় মনে করি। কিন্তু কীভাবে সে কাজটা করা হবে এটা সহজ প্রশ্ন না। সাহিত্যে স্থানিকতা জরুরি, কিন্তু তাকে আন্তর্জাতিকতার সঙ্গে মেলাতে হবে। লোকগল্পের আদলে একটা গল্প বলতে পারলেই তাতে বাংলা গল্পের নিজস্ব স্বাক্ষর তৈরি হয় না। এই বিশ্বায়নের যুগে আধুনিক ভাবনা, আধুনিক জীবনের সঙ্গে আমাদের লোকসাহিত্যের উপাদান সৃজনশীলভাবে ব্যবহার করার সুযোগ আছে। লাতিন আমেরিকার লেখকরা তাদের লোকসাহিত্য, স্থানিক ভাবনা সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন। আমি অন্যত্র বলেছি- আমি কীভাবে রাস্তার ধারের ওষুধ বিক্রেতাদের গল্প বলার ধরন দিয়ে প্রভাবিত হয়েছি। গল্প নির্মাণের অসাধারণ ক্ষমতা আছে তাদের। একসময় আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে তাদের পারফরম্যান্স দেখতাম।

অলাত এহ্‌সান: ‘জ্যোৎস্নালোকের সংবাদ’, ‘শিং মাছ, লাল জেল এইসব’, ‘চীনা অক্ষর অথবা লংমার্চের গল্প’ পড়ে মনে হচ্ছিল আপনি নির্দিষ্ট বিষয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পরে আমরা ‘আধো ঘুমে ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে’ বইটা পেলাম। আপনার জীবনানন্দ দাশ পাঠের একটা প্রকাশ পেলাম। এমন আর কিছু নিয়ে ভাবছেন?

শাহাদুজ্জামান : ‘জোৎস্নালোক...’ থেকে ‘আধোঘুমে...’ যে গল্পগুলোর কথা বললেন তা মূলত একটা প্রজন্মের সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গের যে ইতিবৃত্ত সেসব বিষয়গুলোকে নিয়ে লেখা। আগেই বলেছি- সেটা আমার প্রথম দিককার অনেকগুলো গল্পের থিম ছিল। জীবনানন্দ দাশের পাঠের ব্যাপারটা এ থেকে ভিন্ন।

অলাত এহ্‌সান: মুক্তিযুদ্ধের গল্প লিখতে গেলে আমাদের দেশের লেখকরা প্রায়ই যুদ্ধকালীন বর্ণনায় চলে যান। অনেক সময় বোঝা যায়, এটা কষ্ট কল্পনা। এ দিক দিয়ে আপনার ‘অগল্প’ আলাদা। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাহীন উত্তর প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের গল্প লেখা নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?

শাহাদুজ্জামান: কোনো ঘটনা নিয়ে লেখার জন্য প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা যদি জরুরি হতো তাহলে তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক ছাড়া এ নিয়ে আর কেউ লিখতে পারতো না। বহু প্রজন্ম পর- এখনও বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে উপন্যাস, চলচ্চিত্র হচ্ছে। তলস্তয় যে যুদ্ধ নিয়ে ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ লিখেছেন, সে যুদ্ধ ঘটেছে তার জন্মেরও আগে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখবার জন্য প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার দরকার নেই, যা দরকার তা হচ্ছে সাহিত্যিক কল্পনার ক্ষমতা।

অলাত এহ্‌সান: আপনার অবাধ লেখাচর্চা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে পড়াকালে শুরু হয়েছিল। সে সময় সাহিত্যিক কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরও ছিলেন সেখানে। শিল্পী ঢালী আল মামুনও ছিলেন। আর কেউ কি ছিলেন?

শাহাদুজ্জামান: সেখানে আমার নিয়মিত যাদের সঙ্গে আড্ডা হতো তাদের মধ্যে যারা ছিলেন তাদের প্রায় সবাই মেডিকেল চত্বরের বাইরের এবং বয়সে আমার চেয়ে কিছুটা বড়। আমরা তিন-চারজন অসমবয়সি ছিলাম যারা বলতে গেলে নিয়মিত আড্ডা দিতাম। তাদের মধ্যে ছিলো ঢালী আল মামুন চিত্রশিল্পী, মিলন চৌধুরী ‘অঙ্গন থিয়েটার’ পরিচালনা করতেন, বাংলাদেশে প্রথম পথ নাটক পরিচালনা করেছিলেন; সুচরিত চৌধুরী একসময়ের তুখোর লেখক, সঙ্গীতজ্ঞ; ডা. মোহাম্মদ আলী বাবু যিনি পেশায় ডাক্তার কিন্তু লেখালেখি করতেন, তারা নানা বিষয়ে ব্যাপক পঠন-পাঠন ছিল। আমার বেশি সময় কেটেছে মিলন চৌধুরী সাথে। লেখালেখির ব্যাপারে তিনি আমাকে খুবই অনুপ্রাণিত করেছেন। ঢালী বেশ অনেকদিন আমার হোস্টেলে আমার রুমেই থেকেছে। কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর আমার সাথে একই ব্যাচে মেডিকেলে পড়লেও মেডিকেলে পড়বার সময় ওঁর সাথে অতটা ঘনিষ্ঠতা ছিলো না। জাহাঙ্গীর সেসময় কবিতাচর্চা করতো মূলত, পরে সে কথাসাহিত্যে আসে। মেডিকেল থেকে বের হবার পর বরং ওর সাথে ঘনিষ্ঠতা হয় ওঁর ‘কথা’ পত্রিকার সূত্র ধরে। আমি সেসময় চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটারের সাথে যুক্ত ছিলাম, আমি চিটাগাং ফিল্ম সোসাইটির জেনারেল সেক্রেটারিও ছিলাম। ফিল্ম সোসাইটির সাথে যুক্ত ছিল আলম খোরশেদ, শৈবাল চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন পিন্টু। ওদের সাথে আড্ডা হতো। মামুনের সূত্রে পরিচয় হলো ওয়াকিল, শিশির, নিসারের সাথে। মেডিকেলে আমি গান বাজনা আবৃত্তি, বিতর্ক এসবের সাথে যুক্ত ছিলাম। সেইসূত্রে ঘনিষ্ঠ ছিলাম হিউবার্ট ডি ক্রজ, সেলিম রেজা, মালবিকা সরকার এদের সাথে। আমাদের কাছাকাছি প্রজন্মের অনেক ডাক্তারই সেই আশি, নব্বই দশকে সিরিয়াসভাবে লেখালেখি চর্চা শুরু করে। উত্তরবঙ্গের মামুন হুসাইন, জাকির তালুকদার, ময়মনসিংহে তসলিমা নাসরিন। মামুন, জাকিরের সাথে সেই নব্বই দশক থেকেই যোগাযোগ ছিল। তসলিমার সাথে কখনো যোগাযোগ হয়নি।

অলাত এহ্‌সান: সে সময় আপনি পছন্দের লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, শিল্পী এস এম সুলতানের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। অনেকে আপনাকে তাদের উত্তরসূরী হিসেবে বলেন। আপনি কি সাহিত্যের উত্তরাধিকার ধারণা বহন করেন?

শাহাদুজ্জামান: তারুণ্যে আমি যাদের লেখক শিল্পী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। যাদের নাম বললেন, শিল্প-সাহিত্যের জেনুইন ক্রিয়েটিভ মানুষ হিসেবে তাদের কাছ থেকে দেখবার বুঝবার চেষ্টা করেছি। হাসান ভাইয়ের কিছু কর্মকাণ্ডে নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। সেটা দুঃখজনক। আমি যখন তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি আমার নিজস্ব শিল্পযাত্রায় আমি তাদের প্রাসঙ্গিক মনে করেছি। তবে আমার নিজস্ব একটা শিল্পযাত্রা আছে সেখানে তাদের সাথে আমার ভিন্নতাও আছে। সাহিত্যে পরম্পরার একটা ব্যাপার তো আছেই। উত্তরাধিকারের প্রাসঙ্গিকতাও আছে। পরম্পরার ধারণা ভাবনায় রেখেই নিজের পথটা কেটে নিতে হয়।

অলাত এহ্‌সান:  আপনার ‘কথা পরাম্পরা’ বইয়ের উৎসর্গে বলেছেন, ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াস/ প্রাজ্ঞ পূর্বসূরি’।

শাহাদুজ্জামান: আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমার প্রিয় লেখক তো বটেই, প্রিয় মানুষও। তিনি ছিলেন অনেকটা আমার অগ্রজ বন্ধুর মতো। তার সঙ্গে অনেক চমৎকার সময় কাটাবার স্মৃতি আছে আমার। তার অকাল মৃত্যু আমাকে খুবই মর্মাহত করেছিল। তাকে স্মরণ করেই আমার ‘কথা পরম্পরা’ বইটা উৎসর্গ করেছি। তাকে নিয়ে বেশ কিছু লেখা লিখেছি আমি।

অলাত এহ্‌সান: ওই প্রশ্নে শহীদুল জহিরকেও আপনাদের গোত্রভূক্ত করেন। মানে বলা হয় সিরিয়াস সাহিত্য। আপনি শহীদুল জহির সম্পর্কে একাধিক বক্তৃতা করেছেন। তার সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল?

শাহাদুজ্জামান: শহীদুল জহিরকে আমি বাংলাসাহিত্যের গুরত্বপূর্ণ লেখক মনে করি। যেসব লেখক শুধুমাত্র পাঠক-পাঠিকার প্রচলিত রুচিকে পুঁজি করে লেখেন না, বরং পাঠক-পাঠিকাকে তার লেখার ধরনের সাথে প্রস্তুত করেন, সাহিত্যের নতুন নন্দনতত্ত্ব তৈরি করেন তারা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। অনেক লেখককেই দেখেছি তারা ভাষায়, বিষয়ে আগের প্রজন্মের প্রতিষ্ঠিত লেখকদের একধরনের পুনরুৎপাদন করেন। কিন্তু শহীদুলের পৃথিবীকে দেখবার চোখ, তাকে প্রকাশ করবার ধরন একেবারেই নিজস্ব। তার সঙ্গে আমার বহুদিনের যোগাযোগ ছিল, সাহিত্য নিয়ে অনেক আড্ডা হয়েছে। তবে তিনি খুব ভেতর গোটানো মানুষ ছিলেন। কথা বলতেন কম, একাকী থাকতেন।

অলাত এহ্‌সান: আরেক অকাল প্রয়াত কায়েস আহমেদ-এর সঙ্গেও তো আপনার যোগাযোগ ছিল।

শাহাদুজ্জামান: ইলিয়াস ভাইয়ের বাসায় কায়েস আহমেদের সাথে আমার দেখা হতো, গল্প হতো। তবে তার সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিলো না। তিনি পরে আত্মহত্যা করলেন। যেদিন আত্মহত্যার খবর এলো আমি সেদিন ইলিয়াস ভাইয়ের বাসায়। ইলিয়াস ভাই ডেডবডি দেখতে গেলেন। আমি যাইনি।

অলাত এহ্‌সান: আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আপনার, মামুন হুসাইনের সাহিত্য নিয়ে কথা বলেছেন। এখন অগ্রজদের কাউকে কম দেখি নির্মোহ থেকে অনুজের সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে। আপনাদের সময়ে অগ্রজ-অনুজের মধ্যে স্নেহ-শ্রদ্ধার সেতু ছিল। এখন তা ভেঙে গেছে।

শাহাদুজ্জামান: ইলিয়াস ভাই আমাকে লেখার ব্যাপারে খুবই অনুপ্রাণিত করতেন, সবসময়। কোথাও ছাপাবার আগে আমার প্রথম গল্পগুলো আমি তাকে দেখাতাম। গল্প নিয়ে নানারকম পরামর্শ করতাম তার সঙ্গে। সাহিত্য পৃথিবীতে ইলিয়াস ভাইয়ের মতো এমন আশ্চর্য নিরহঙ্কার মানুষ চোখে পড়েনি। এছাড়া মনে আছে আমার প্রথম কি দ্বিতীয় গল্প ‘অগল্প’ যখন প্রকাশ হলো, তখন গল্পটা পড়ে সৈয়দ শামসুল হক ‘সংবাদ’ পত্রিকায় প্রকাশিত তার ‘হৃদকলমের টানে’ কলামে বেশ লম্বা আলোচনা করেছিলেন। আমি তখন একেবারেই অখ্যাত এক লেখক। তার সঙ্গে আমার পরিচয়ও নেই। কিন্তু স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তিনি এই গল্পটার প্রশংসা করেছিলেন। সেটা আমার জন্য সেই সময় খুবই অনুপ্রেরণার ব্যাপার ছিল।

অগ্রজ-অনুজের মধ্যে স্নেহ-শ্রদ্ধার সেতু ভেঙে গেছে- ব্যাপারটা একেবারে সাধারণীকরণ হয়তো করা যাবে না, তবে কিছুটা সত্য। আজকাল অনুভব করি, অগ্রজ-অনুজ নানা দিকেই নানা রকম ইগোর ফোলানো বেলুন। নানা রকম গোষ্ঠী প্রবণতা। এসব আগেও যে ছিলো না তা নয়। তবে তার তীব্রতা বেড়েছে বলে মনে হয়। অনেক ক্ষেত্রে কোনো কোনো অনুজ লেখকদের ভেতর স্বীকৃতি পাওয়ার এক আগ্রাসী প্রবণতাও লক্ষ্য করেছি। সেই স্বীকৃতি পাওয়ার বাহন হিসেবে অগ্রজদের ব্যবহার করার প্রবণতাও দেখেছি। অগ্রজের দিক থেকেও অনুজদের ব্যবহার করার ব্যাপার হয়তো আছে। এইসব আগ্রাসী প্রচারের কালে অগ্রজ-অনুজের সম্পর্কের উষ্ণতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা রাখা কঠিন হয়ে পড়ে অনেক সময়। আমি ব্যক্তিগতভাবে তরুণ লেখক-লেখিকাদের ব্যাপারে সবসময় আগ্রহী। যেখানে মেধার পরিচয় পাই, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করি।

অলাত এহ্‌সান:  চট্টগ্রামে থাকাকালে আপনি চলচ্চিত্র আন্দোলনের যুক্ত হয়েছিলেন। সে সময় চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে একটা লেখা পরবর্তীতে বই হয়েছে। চলচ্চিত্র দেখা ও বুঝা কি আপনার গল্পকে প্রভাবিত করেছে?

শাহাদুজ্জামান: হ্যাঁ, চলচ্চিত্র তো আমার সবসময়ের প্যাশন। একসময় সক্রিয় ছিলাম চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনে। চলচ্চিত্র নির্মাণে যুক্ত ছিলাম। একসময় টিভিতে চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব নিয়ে অনুষ্ঠান করেছি। চলচ্চিত্র নিয়ে লেখালেখি তো করেছিই। চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট লিখেছি। আমার গল্প নিয়ে বেশ কিছু চলচ্চিত্র হয়েছে। চলচ্চিত্র আর সাহিত্য দুটো ভিন্ন ভাষাভঙ্গির শিল্প, তবে এর ভেতরকার একটা সম্পর্ক তো আছেই। আমার গল্পে ইমেজের ব্যাপার থাকে। আমি যখন গল্প লিখি তখন তার দৃশ্যরূপটা আমার চোখের নিচে ফুটে থাকে। অনেক পাঠকই বলেছেন- আমার গল্প পড়তে পড়তে তারা গল্পটাকে দেখতে পান। এটা সম্ভবত আমার চলচ্চিত্র চর্চা থেকেই হয়েছে। গল্প বলার যে ন্যারেটিভ ভঙ্গি অনেক চলচ্চিত্রকার সেটাকে ভেঙেছেন, সেসব চলচ্চিত্র আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। তারকোভস্কির চলচ্চিত্রে কাব্যিকতা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। ইরানি চলচ্চিত্রের আটপৌরে ঢঙে গল্প বলা কিংবা সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিক, আমাদের জহির রায়হানের চলচ্চিত্রের বর্ণনাভঙ্গি থেকেও অনুপ্রাণিত হয়েছি। চ্যাপলিনের চলচ্চিত্র আমাকে বরাবর মুগ্ধ করে। লেখার সময় চেতনে-অবচেতনে এদের প্রভাব হয়তো থাকে।

অলাত এহ্‌সান: তবে অনেক বড় লেখকই বলেন, ভালো সাহিত্য চলচ্চিত্রায়ন করলে অনেক সময় তার স্বাদ হারিয়ে যায়।

শাহাদুজ্জামান: চলচ্চিত্রের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে- তা দর্শকের নিজস্ব কল্পনার মাত্রা সীমিত করে। একটা উপন্যাস পড়ে পাঠক-পাঠিকা নিজের মতো করে এর চরিত্র, দৃশ্যপট ভেবে নিতে পারেন, কিন্তু চলচ্চিত্র তাকে সে সুযোগ দেয় না। সে নিজেই নির্ধারিত দৃশ্যপট, চরিত্র নিয়ে হাজির হয়। বুদ্ধদেব বসু এ কারণে চলচ্চিত্রকে সাহিত্যের নিচে স্থান দিতেন। মার্কেজ তার ‘হান্ড্রেড ইয়ার্স অব সলিচুড’কে চলচ্চিত্রায়নের অনুমতি দেননি। তিনি উপন্যাসটি নিয়ে পাঠক-পাঠিকার নিজস্ব জগতকে তার মতো অটুট রাখতে চেয়েছেন।

অলাত এহ্‌সান:  আপনি মঞ্চেও আগ্রহী ছিলেন। আপনার ‘ক্রাচের কর্নেল’ উপন্যাসটি নিয়ে মঞ্চ নাটক হয়েছে। আপনি দেখেছেন?

শাহাদুজ্জামান: হ্যাঁ, চট্টগ্রামে গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আশি-নব্বই দশকে ঢাকার মঞ্চের এমন কোনো নাটক সম্ভবত নেই, যা আমি দেখিনি। নাটক দেখার জন্য কলকাতা চলে গেছি নিয়মিত। নাটক নিয়ে লেখালেখি করেছি। আমার ‘ইব্রাহিম বক্সের সার্কাস’ এবং ‘ক্রাচের কর্নেল’ অবলম্বনে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। বটতলা প্রযোজিত ‘ক্রাচের কর্নেল’ নাটকের ঢাকা এবং পশ্চিমবঙ্গে অনেকগুলো মঞ্চায়ন হয়েছে, এখনও চলছে। এই বই যখন লিখেছি তখন এ থেকে নাটক হতে পারে ভাবিনি। অনেক বড় ক্যানভাসের উপন্যাস, একে মঞ্চে আনা সাহসের ব্যাপার।

অলাত এহ্‌সান: চলচ্চিত্রকে বলা হয়, শিল্পের সব মাধ্যমের সমন্বয়। মানে শব্দ, সুর, টেক্স, ইমেজ- এর ব্যবহার থাকে। চলচ্চিত্র এখন বিশ্বের শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পাঠিকারা এখন সিনেমা, টিভি সিরিয়ালের পোকা। এখানে সাহিত্য অবস্থান হারাচ্ছে।

শাহাদুজ্জামান: চলচ্চিত্রের বয়স তো একশ বছরেরও উপর, তাতে সে তো এতদিনেও সাহিত্যের জায়গা দখল করে নেয়নি। টেলিভিশন যখন এসেছিল তখন ভাবা হয়েছিল চলচ্চিত্রের বুঝি মৃত্যু হলো, কিন্তু তারা বহাল তবিয়তে আছে। চলচ্চিত্র না, বরং কম্পিউটারের সূত্রে নানা অনলাইন বিনোদনের কারণে সাহিত্যের অবস্থানে বেশ একটা ধাক্কা এসেছে সন্দেহ নাই। তবে সাহিত্যের মৃত্যু খুব সহসা হচ্ছে বলে মনে হয় না।

অলাত এহ্‌সান: আপনার একাধিক গল্প থেকে তথ্যচিত্র হয়েছে। মঞ্চ নাটকও হলো। এগুলো নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

শাহাদুজ্জামান: ‘কমলা রকেট’ তো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, এছাড়া আমার গল্প নিয়ে বেশ কিছু শর্ট ফিল্ম হয়েছে। ‘কমলা রকেট’ সিনেমায় চলচ্চিত্র ভাষার ভালো প্রয়োগ আছে বলে মনে করি। রবিউল রবি আমার ‘ঠাকুরের সঙ্গে‘ গল্পটা নিয়ে ‘একই পথে’ নামে যে ছবিটা বানিয়েছে সেটাও আমার পছন্দ হয়েছে। প্রজন্ম টকিজের ব্যানারে সেই ছবি তো ইউটিউবে প্রচুর ভিউ হয়েছে। তবে আমার গল্প নিয়ে আরো যে বেশ কিছু টেলিফিল্ম হয়েছে সেগুলো আমার পছন্দ হয়নি বিশেষ।

অলাত এহ্‌সান:  আপনার সাহিত্যে সমাজের প্রতি পক্ষপাত আছে, মানে নিরপেক্ষ নন। এই পক্ষপাত রাজনৈতিক। এখন অনেকে রাজনীতি থেকে দূরে থাকাকে সমর্থন করেন। আপনার ব্যাখ্যা কী?

শাহাদুজ্জামান: নিরপেক্ষ থাকার ভাবনা একটা মায়া। রাজনীতি থেকে দূরে তো কেউ থাকে না, থাকতে পারে না। কেউ মনে মনে ভেবে আনন্দ পেতে পারে যে- সে রাজনীতির সাতে-পাঁচে নাই, কিন্তু সত্য কথাটা হচ্ছে রাজনীতি ছাড়া হাঁড়ির ভাতও রান্না হয় না। অবশ্য রাজনীতি বলতে আপনি কী বুঝেছেন সেটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। আমি কোনো দলীয় রাজনীতির কথা বলছি না। রাজনীতির সংজ্ঞাটাকে টেনে লম্বা করলে এর ভেতর সবকিছুই পড়ে। সমাজ, রাষ্ট্র নিয়ে লেখকের তো একটা দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে হবে, না হলে সে লিখবে কী করে? সেই দৃষ্টিভঙ্গিই রাজনীতি।

অলাত এহ্‌সান: আমাদের দেশের লেখকদের রাজনৈতিক দর্শন চর্চার চেয়ে দলীয় চর্চার প্রবণতা বেশি। তথাকথিত ‘তৃতীয় বিশ্বে’ এটা বেশি প্রবল। অনেকে মনে করেন, এটা সাহিত্যের জন্য ক্ষতি ঘনিয়ে এনেছে।

শাহাদুজ্জামান: দলীয় রাজনীতি লেখকের জন্য অবশ্যই ক্ষতিকর। লেখককে এমন জায়গায় দাঁড়াতে হয়, যেখান থেকে অবাধে সে কোনো কথা বলতে পারার ক্ষমতা রাখে। দলের ভেতর থাকলে তো সেই স্বাধীনতা থাকবার কোনো উপায় নেই। একসময় বাম দলগুলো লেখক শিল্পীকে দলীয় কাঠামোর ভেতর আনতে বাধ্য করতে চাইতো। এ নিয়ে বাম রাজনৈতিক দল আর লেখক শিল্পীদের ব্যাপক বিরোধ হয়েছে।

অলাত এহ্‌সান: আপনাদের লেখালেখির সূচনাকালে; তখন বিস্তর সোভিয়েত-রুশ সাহিত্য অনুবাদ পাওয়া যেত। অনেকে মনে করেন, এই সাহিত্যগুলো ওই সময়ের সাহিত্য মানসে বড় প্রভাব রেখেছিল।

শাহাদুজ্জামান: তা ঠিক। আমাদের শৈশব-কৈশোর কেটেছে রুশ সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ পড়ে। তখন সেসব বই বিনামূল্যে বিতরণ করা হতো। রুশদেশের উপকথা কৈশোরে আমার নিত্যসঙ্গী ছিল। পরবর্তীকালে ননী ভৌমিকের অনুবাদে লিও তলস্তয়, আন্তন চেখভ, ম্যাক্সিম গোর্কি, ইভান তুর্গেনেভ, ফিওদর দস্তোয়েভস্কির লেখা সব বাংলায় পড়েছি বুঁদ হয়ে। রুশ সাহিত্যের নানা চরিত্র, রাশিয়ার ল্যান্ডস্কেপ আমার মাথার ভেতর গাঁথা হয়ে গিয়েছিল। এই সাহিত্যগুলো আমার সাহিত্য মানসে যে বড় প্রভাব ফেলেছে তাতে সন্দেহ নাই।

অলাত এহ্‌সান: আপনি লিখতে শুরু করেছিলেন লিটল ম্যাগাজিনে। তারপর আপনি কয়েকজনের সঙ্গে ‘প্রসঙ্গ’ নামে ম্যাগ প্রকাশ করেছিলেন। সে সময় চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জায়গা থেকে ভালো লিটল ম্যাগ প্রকাশ হতো। এর মধ্যে কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীরের ‘কথা’ পত্রিকাও আছে। এ সময় আর কী কী ছিল?

শাহাদুজ্জামান: সেই আশির দশকে সাহিত্যচর্চায় লিটল ম্যাগাজিনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। সেই অর্থে প্রতিষ্ঠিত বিশেষ কোনো সাহিত্য পত্রিকা তখন ছিল না। দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য পাতার পরিসর ছিল কম। ফলে অনেক নতুন লেখক, নতুন চিন্তার বাহন ছিল লিটল ম্যাগাজিন। সেসব লিটল ম্যাগাজিনের আয়ুও হয়তো বেশি ছিল না। তবু সেখানে অনেক নবীন লেখকদের ভালোবাসা, শ্রম জড়িয়ে থাকতো। নিজেদের মতো নানা সাহিত্যিক নিরীক্ষা সেখানে করা যেত। আমার জীবনের প্রথম লেখা ছাপা হয়েছে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত একটা লিটল ম্যাগাজিনে। ‘প্রসঙ্গ’ করবার আগে আমি জড়িত ছিলাম ‘চর্যা’ নামে আরেকটা লিটল ম্যাগাজিনের সাথে। নিজের নাম প্রথম ছাপা অক্ষরে দেখি ওখানেই। এরপর আমরা চট্টগ্রামের কয়েকজন মিলে ‘প্রসঙ্গ‘ নামে একটা লিটল ম্যাগাজিন করি। আমরা তখন অনুভব করতাম যে, নানা শিল্পমাধ্যমের ভেতর পারস্পরিক যোগাযোগ দরকার। পেইন্টারদের ফিল্ম সম্পর্কে জানা দরকার, তেমনি সাহিত্যিকদের পেইন্টিং বিষয়ে জানা দরকার। এরকম একটা ভাবনা থেকে আমরা ‘প্রসঙ্গ’ নামে একটা মাল্টিডিসিপ্লিনারী পত্রিকার কথা ভাবি। প্রতি সংখ্যায় আমরা সাহিত্য, নাটক, সংগীত, চলচ্চিত্র, চিত্রকলা বিষয়ক একটা করে তাত্ত্বিক নিবন্ধ ছাপাতাম। এ ধরনের কোনো পত্রিকা তখন বাংলাদেশে ছিল না। বেশ প্রশংসিত হয়েছিল সে পত্রিকা। পাঁচটা সংখ্যা প্রকাশ হয়েছিল। সেসময় চট্টগ্রাম থেকে আরো কিছু লিটন ম্যাগাজিন বের হতো : লিরিক, স্পার্ক জেনারেশন, লিটল ম্যাগাজিন নামেও একটা পত্রিকা বের করতেন মহিবুল আজিজ। জাহাঙ্গীর ‘কথা’ বের করেছে অনেক পরে।

অলাত এহ্‌সান: এখন দেশে অনেক লিটলম্যাগ প্রকাশ হয়। তাদের মান ও লিপ্ততা নিয়ে কথা বলা যায়। এদের নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?

শাহাদুজ্জামান: এখনও লিটল ম্যাগাজিন নতুন লেখকদের বিকল্প একটা পাটাতন। কিংবা পুরনো লেখকরাও তাদের নতুন ভাবনা লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশ করেন। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের সেই আগের ভূমিকা এখন সম্ভবত নেই। বিশেষ করে ওয়েব পত্রিকার সুযোগ তৈরি হবার পর বিকল্প সাহিত্য চর্চার ব্যাপক পরিসর তৈরি হয়েছে। সেখানে ছাপার অক্ষরের লিটন ম্যাগাজিনের সেই আগের ভূমিকা আর আছে বলে মনে হয় না।

অলাত এহ্‌সান: বিশ্বেই কিন্তু এখন লিটল ম্যাগ চর্চা কমে গেছে। ষাটের দশকের সেই ঢেউ এখন স্তিমিত। এখন তারা সাহিত্যের একটা স্রোত তৈরিতে ভূমিকা রাখছে? এখান থেকে কি লেখক তৈরি হচ্ছে বলে মনে করেন?

শাহাদুজ্জামান: ওয়েব ম্যাগের কারণে সাহিত্যে নতুন স্রোত তৈরির ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগাজিনের ভূমিকা কমে এসেছে। তবু বেশ কিছু লিটন ম্যাগাজিন নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে দেখতে পাই। এখনও বইয়ের দোকানে গেলে আমি আগে লিটন ম্যাগাজিনের কর্নারে যাই। লিটল ম্যাগাজিনের উদ্যোগে ভালো কিছু বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছে দেখেছি। সেখান থেকে লেখক তৈরি হচ্ছে কিনা সেটা বলা কঠিন, তবে নবীন লেখকদের জন্য লিটল ম্যাগাজিন এখনও একটা বিকল্প পাটাতন।

অলাত এহ্‌সান: এখন ওয়েব ম্যাগ, ওয়েবজিন তৈরি হচ্ছে। ব্লগ তো এখনও আছে।

শাহাদুজ্জামান: গত দশ-পনেরো বছরে অনলাইন জগত মানুষের চিন্তা, জীবনযাপনের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। আগে লিটল ম্যাগাজিন অবাধ চিন্তা প্রকাশের যে কাজটা করতো এখন সে জায়গাটা নিয়েছে অনলাইন পত্রিকা বা ব্লগগুলো। প্রকাশের এই গণতন্ত্রায়নের তো একটা ব্যাপক ইতিবাচক ভূমিকা আছে।  পৃথিবীজুড়ে বেশ বড় বড় আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে এখন অনলাইনের মাধ্যমে, ব্লগের মাধ্যমে, নতুন ভাবনা তৈরির মাধ্যমে। আমাদের শাহবাগ আন্দোলন অনেকটাই অনলাইন এক্টিভিজমের ফল। তবে স্বাধীনতা মানে তো আর সবসময় উৎকর্ষ না, স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারও জন্ম দিতে পারে। এই অবাধ স্বাধীনতা আমি কীভাবে ব্যবহার করছি সে প্রশ্ন সবসময় প্রাসঙ্গিক থাকবে। মেধা না থাকলে শুধু অবাধ প্রকাশের সুযোগ দিয়ে তো কাজ হবে না। আগে একটা লেখাকে পাবলিক পরিসরে আসবার জন্য নানা মনিটরিংয়ের হাত ঘুরে আসতে হতো। এখন এই স্বাধীনতার সুযোগে অনেক নিন্মমানের লেখাও দেখতে পাই। লেখার এই সহজ প্রকাশ এক ধরনের ছদ্ম আত্মতৃপ্তি তৈরি করতে পারে। ওয়েবে একটা লেখার লাইক, শেয়ার ইত্যাদির হিসাব দিয়ে তো আর লেখার মান বিচার হবে না। নতুন লেখা সেটা পত্রিকা, বইয়ে আর ওয়েব ম্যাগাজিন যেখানেই প্রকাশ পাক না কেন তাকে সাহিত্যের পরম্পরার ইতিহাসে দাঁড়িয়েই নিজেকে যাচাই করে নিতে হবে।

অলাত এহ্‌সান: নানাভাবেই আমরা বলি- বাংলা সাহিত্যের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি নেই। বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে আপনার কী মূল্যায়ন?

শাহাদুজ্জামান: সাহিত্যের অগ্রগতির মাপকাঠি তো খুব সহজ না। আর বিশ্বসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতে সে মাপামাপি আরো কঠিন। সেখানে প্রথম প্রশ্নই জাগে ভাষা নিয়ে। আমার ভাষার লেখা যদি অন্য ভাষায় অনূদিত না হয় তাহলে সেই তুলনামূলক বিচার অন্যেরা করবে কী করে। কিন্তু বিশ্বসাহিত্য পাঠ থেকে এটুকু বুঝি- বাংলা সাহিত্যে বিশ্বমানের বহু লেখক, কবি রয়েছেন। অনুবাদের মাধ্যমে আমাদের সাহিত্য বিশ্ব পাঠকের কাছে পৌঁছালে ভালো। কিন্তু আমি মনে করি আমার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিৎ আগে আমার নিজের ভাষার পাঠক-পাঠিকার কাছে পৌঁছানো।

অলাত এহ্‌সান: এই সময়ে দেশে যে অনুবাদ হচ্ছে, তা কি সাহিত্যের গুণগতমান পরিবর্তন করবে?

শাহাদুজ্জামান: অনুবাদ পরিশ্রম এবং মেধার কাজ। বিশ্বচিন্তা, বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য অনুবাদ জরুরি। একটা ভালো লেখা অন্যদের সাথে শেয়ার করার জন্য কিংবা সে লেখাটাকে আরো নিংড়ে বোঝার জন্য একসময় অনুবাদ করেছি। নিজের মৌলিক লেখার চাপ যখন বেড়েছে তখন অনুবাদ কমিয়ে দিয়েছি। তবু অনুবাদ সাহিত্য চালু রাখা জরুরি। আমাদের দেশে ভালো অনুবাদের উদাহরণ আছে। তারা সংখ্যায় খুব কম। আবার যারা বাংলা থেকে ইংরেজি করে তারা যেন যারা ইংরেজি থেকে বাংলা করেন তাদের চেয়ে বেশি মর্যাদা পান। এই প্রবণতার বদল দরকার। বিশ্বসাহিত্যের কোনো বিখ্যাত বই তাড়িঘড়ি করে বাজেভাবে অনুবাদের অনেক নমুনা আছে। সেগুলো অত্যন্ত অন্যায়। এ ধরনের অনুবাদের মাধ্যমে মূল লেখককে অপমান করা হয়।

অলাত এহ্‌সান: এখন একটা মারাত্মক প্রবণতা শুরু হয়েছে, এ দেশের সাহিত্য অন্যভাষায় অনুবাদ করে বিদেশে সরবরাহ করা। এরা কিন্তু মানোত্তীর্ণ সাহিত্য অনুবাদ করছেন না, করছেন নিজের সাহিত্য। বিদেশী প্রকাশনী আগ্রহ না দেখালেও গাঁটের পয়সা খরচ করে অনুবাদ করা হচ্ছে। যখন স্বীকার করে নিচ্ছি, আমরা সাহিত্যের নিস্তরঙ্গ সময় পাড় করছি, তখন এই উদ্যোগ কি ফল বয়ে আনবে বলে আপনি মনে করেন?

শাহাদুজ্জামান: কোন বাংলা বই ভিন্ন ভাষায় অনূদিত হবে, কিংবা ভিন্ন ভাষার কোন বই বাংলায় অনুবাদ করা দরকার সেটা একটা নির্দিষ্ট পরিকল্পনা, গবেষণার মাধ্যমে না করে এইসব কাণ্ডকারখানা করলে সাহিত্যের ক্ষতি ছাড়া লাভের কিছু নাই।

অলাত এহ্‌সান: পুরস্কার নিয়ে বেশি কথা নয়, একটা প্রশ্ন: পুরস্কারগুলো আমাদের দেশের সাহিত্যে কোনো অবদান রাখছে কী?

শাহাদুজ্জামান: এখন তো বিবিধ পুরস্কারের চল হয়েছে দেখি। পুরস্কার তো কাজের একধরনের স্বীকৃতি, তার একটা ইতিবাচক ব্যাপার আছে। একটা নিরপেক্ষ মর্যাদাবান পুরস্কার লেখককে অনুপ্রেরণা দিতে পারে; কিন্তু পুরস্কার যদি নানারকম গোষ্ঠী রক্ষা, গোষ্ঠী তৈরির বাহন হয় সেগুলোর তো কোন মূল্য নাই। 

অলাত এহ্‌সান: আপনাকে মনে হয় প্রতিবছরই দেশে যেতে হয়, অন্তত একবার। সচরাচর এই দেশে যাওয়াকে বলছেন ‘দেশে ফেরা’। জীবননান্দ দাশ বলছেন, ‘সব পাখি ঘরে ফেরে’। আপনার কাছে কী- ঘরে আসা, না ঘরে ফেরা?

শাহাদুজ্জামান: আমার শরীরটা প্রবাসে থাকলেও মননে, আবেগে আমি তো বরাবর দেশেই থাকি। একবার না, আমি বছরে একাধিকবার দেশে আসি; বা বলতে পারেন দেশে ফিরি হয়তো ওই পাখির মতো। দেশে না ফিরলে বিদেশেও উড়বার শক্তি পাই না। সেই শক্তি সঞ্চয় করতেই নিয়মিত দেশে আসি।


ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়