ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

মুখোশের আড়ালে

মঞ্জু সরকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৮, ১০ জুলাই ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
মুখোশের আড়ালে

লকডাউনে পাবলিককে ঘরে থাকার কথা বলে সরকার রাস্তায় যখন পুলিশের পাশে আর্মিও নামায়, উমর তখনো তার রিকশা নিয়ে ঢাকার রাস্তায় করোনা-বিমারিটা বোঝার চেষ্টা করছে। রাজধানীর যেসব মেইন রোডে তিন চাকার রিকশা-ভ্যান নিষিদ্ধ এবং একদিন যে রাস্তায় ভুলে রিকশা তোলায় রিকশার পশ্চাতদেশে ট্রাফিক পুলিশের ফুটবল-কিক উমরের পাছাতেও ঝনঝনানি তুলেছিল, সেই রাস্তাগুলো এখন যেন ধু-ধু ফাঁকা মাঠ। গণপরিবহন তো আগেই বন্ধ হয়েছে, প্রাইভেট কারও চলে না। ক্কচিত দুই-একটা স্কুটার বা মোটরসাইকেল আর উমরের মতো কিছু নিরুপায় লোকের দেখা মেলে।  এক সওয়ারি বেশি ভাড়া ও সাহস দিয়ে উমরকে নিষিদ্ধ রাস্তায় তুলে তীরের মতো ছুটিয়ে গন্তব্যে নেমে গেছে। এখন ফাঁকা রাস্তায় খালি রিকশা টানতে গিয়ে মনে হয়, যেনবা অচেনা কোনো পরিত্যক্ত শহরে স্বপ্নের মধ্যে রিকশার প্যাডেল ঘোরাচ্ছে সে। ট্রাফিক পুলিশের লাথির চেয়েও অদৃশ্য শত্রুর কাছে বড় আঘাত পাওয়ার ভয়ে দিনের মধ্যেও গা ছমছম করে। রাস্তায় একটা মিলিটারি-ভ্যান ছুটে আসতে দেখে ভয়টা আরো বাড়ে। পুলিশ, সশস্ত্র মিলিটারি, সাহেব-সুবো পথচারী সবার মুখেই মুখোশ, নাকমুখ বাঁধা ছোট বস্ত্রটির সুতো দুই কানে বাঁধা। উমরও কিনেছিল একটা। কিন্তু আজ মাস্ক ছাড়াই উদম মুখে রিকশা চালাচ্ছে! কারণ জিজ্ঞেস করলে নিজের বেআইনি কামের পক্ষে কী সাফাই গাইবে? করোনাদেবি তার মাস্ক ও মোবাইলটা চুরি করল কীভাবে, সেই সত্য ঘটনা বলবে অবশ্যই, কিন্তু শোনার ধৈর্য আর সময় হবে তাদের? আর শুনলেও বিশ্বাস করবে?

আর্মির গাড়িটার সঙ্গে দূরত্ব বাড়াতে উমর রাস্তার সাইডে গিয়ে নিজেও চালকের আসন থেকে নামে। বাক্স খোলার মতো রিকশার সিট তুলে পাবে না জেনেও হারানো মেবাইল আর মাস্কটা খোঁজে। একটা পলিথিনের ব্যাগে উমরের আইডিকার্ডসহ কিছু জামাকাপড় আাছে, এ সপ্তাহের জমানো টাকাসহ মানিব্যাগটাও আছে। এসবের মধ্যে লুকানো রাজকন্যার মতো মুখোশপরা ফোনটা যদি লুকিয়ে থাকত আহা! এর আগেও তো ফোনটা কয়েকবার লুকোচুরি খেলে হারিয়ে যাওয়ার ভয় জাগিয়েছিল। কিন্তু এবার ভয় নয়, করোনাদেবি রাস্তায় প্রাকাশ্য দিবালোকে তার ফোন ও মাস্ক কেড়ে নিয়েছে। সাক্ষী আছে রাস্তার দুই পুলিশ। এরপর পঞ্চাশ টাকায় নতুন মাস্ক ও দু’ হাজার টাকায় নতুন ফোন কিনলে উমর সিটের নিচেই লুকিয়ে রাখবে। আর নতুন মাস্ক না কেনা পর্যন্ত, আপাতত গামছাখানা বের করে মুখোশের মতো মাথায় জড়িয়ে নাক-মুখ ঢাকে। গামছা ভেদ করেও করোনার বিষ শরীরে ঢোকা সহজ হয়, কারণ বাতাসও বেশ কষ্ট করে নাকে ঢুকছে। তাছাড়া পুলিশ মিলিটারি দেখলেও তার স্বনির্মিত করোনা-মাস্ক অপছন্দ করবে না নিশ্চয়।

২.

জ্যাম ও  যাত্রীবিরল ফাঁকা রাস্তায় খালি রিকশায় বসে সিগারেট টানছিল উমর, হঠাৎ একটা কাশি হওয়ায় করোনার ভয়টা ভিতরে চলকায়। রোগের বীজটাকে গ্যারেজের টিভিতে দেখেছে সে। কাঁটাযুক্ত বিষফলের মতো, খালি চোখে দেখা যায় না বলে ভাইরাসটি শরীরে ঢুকলেই প্রথমে জ্বর বা কাশি হবে, তারপর শ্বাসনালি সাঁড়াশির মতো টিপে ধরবে। তখন হাসপাতালে যন্ত্র দিয়ে নাকেমুখে অক্সিজেন দিলেও শেষরক্ষা সবার হবে না। উমরের নর্মাল কাশি যে করোনার কাশি নয়, সেটা প্রমাণের জন্য ইচ্ছেকৃত আরো দু’একটা কাশি দেয় সে। গলাটা পরিষ্কার করতে এরকম কাশি প্রায় কাশে উমর। তারপরও সিগারেট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে শেষ টান দিতে থাকে। অদৃশ্য ঘাতক-ব্যধি সারা দুনিয়ার মানুষকে ভয় দেখিয়ে উল্টোপাল্টা করে দিয়েছে সবকিছু। উমরের স্বপ্নের ঘরটা পর্যন্ত লকডাউন করে দিয়েছে, এখন জ্বর-কাশিতে রিকশার চাকা ঘোরা বন্ধ হলে উমর যে কী করবে, কোথায় যাবে- নিজেও কোনো দিশে পায় না।

করোনা না বুঝলেও কলেরা-বসন্ত-ম্যালেরিয়ার মতো মহামারি মোকাবেলার জ্ঞান গ্রামে থাকতেই কিছুটা হয়েছিল উমরের। লোকজনের কাছে এসব মড়কের গল্প শুনেই ভয়ে পিলে কাঁপত। তাদের গ্রামেই ছিল কসের বুড়ো, সারা মুখে বসন্তের গর্ত এবং এক চোখ অন্ধ। কানা কসের বুড়োর কৈশোরে গ্রামে গুটি বসন্তের  অপদেবতা গ্রামে উড়ে এসেছিল একবার। অনেক লোকের প্রাণ সংহার করেছে, কিন্তু কিশোর কসের বসন্তদেবির বিরুদ্ধে লড়াই করে এক চোখ হারিয়েছিল সত্য, কানা টাইটেল আর সারামুখে বসন্তের দাগ নিয়ে বেঁচে ছিল খুনখুনে বৃদ্ধ বয়সেও। ছেলেবেলায় দেখেছে উমর গ্রামের কসের বুড়োকে। গুটি কি জল বসন্ত রোগের কথা উঠলে কসের বুড়োর কথা মনে পড়ে। আর পুরনো কালের কলেরা মহামারিকে হাড়েমজ্জায় অনুভব করেছে নিজেরও দু’বার কঠিন ডায়েরিয়া হওয়ার সময়। তাছাড়া মাত্র বছর বিশেক আগে বালক বয়সে কলেরা তথা ওলাওঠা দেবিকে মোকাবেলার যুদ্ধে গ্রামবাসীর সঙ্গে শরিক হয়েছিল উমর নিজেও।

উমরদের গ্রামে তার বাপ ছাড়াও বয়স্ক গ্রামবাসী অনেকেই জানে, একদা কলেরা তথা ওলাওঠা দেবিকে আপন গরু গাড়িতে চড়িয়ে রাতের বেলা অন্য গ্রামে চালান করেছিল উমরের আপন দাদার বড়ভাই। সেই আমলে ভাড়ায় গরুর গাড়ি চালাতো সেই বড় দাদা। নাম ছিল গাড়িয়াল ওকিজ। একবার ছইঘেরা  গরুগাড়িতে নাইয়োরি নিয়ে দূরের গাঁয়ে গিয়েছিল। গন্তব্যে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামতেই ভেদবমি শুরু হয়েছিল নাইয়োরির। জানটা বেরিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত সেই বমি আর থামেনি। বাড়িতে কান্নাকাটির রোল উঠলে ভয়ে গাড়োয়ান দাদা তৎক্ষণাত গাড়ি হাঁকিয়েছিল নিজ গ্রামে পৌঁছার জন্য। কিন্তু শনির আখড়া নামক জায়গার বটগাছতলায় আসার পর  গাড়ি আর চলে না। মনে হয় কে যেন গাড়ির পেছনে অসম্ভব চাপ দিয়ে, গরুর ঘাড় থেকে জোয়াল শূন্যে তুলে নিচ্ছে। গাড়িয়াল দাদা পেছনে তাকিয়ে দেখে গাড়িতে ছইয়ের ভেতরে উঠে বসেছে বোরখা ঢাকা এক নারী যেন, কিন্তু অন্ধকারেও তার গায়ে অসংখ্য চোখ ভাটার মতো জ্বলে। গায়ে মাছি ভনভন উড়ছে। ওলাওঠা দেবিকে চিনতে মুহূর্ত দেরি হয়নি অভিজ্ঞ গাড়োয়ানের। বড় সাহসী ছিল মানুষটা। গাড়ি থেকে এক লাফে নেমে, গাড়ির জোয়াল থেকে গরু দুটিকে মুক্ত করে হাতের প্যান্টি উঁচিয়ে গরুসহ ছুটতে শুরু করেছিল। গাড়িখানা রাস্তাতেই পড়ে ছিল সারারাত।

রুদ্ধশ্বাসে গ্রামে ফিরেই প্রথম মাতবরের কাছে খবরটা দিয়েছিল দাদা। পাশের গাঁয়ে ওলাওঠা দেবির আক্রমণের খবর মাতবর আগেই শুনেছিল। নিজের গ্রামেও যাতে দেবি কোনো বাড়িতেই উড়ে আসতে না পারে, সে জন্য সবাইকে বাদ্য বাজিয়ে আওয়াজ করতে বলেছিল। মাতবরের হুকুম শুনে লোকজন কাঁসার থাল-বাসন-বাটি ও ঘরের টিনে আওয়াজ তুলতে শুরু করেছিল। হাতের বাদ্য যথেষ্ট না হওয়ায় অনেকে মুখেও আওয়াজ তুলেছিল। গ্রামবাসীদের সম্মিলিত প্রতিরোধ-ধ্বনি বাতাসে এমনভাবে ছড়িয়েছিল, ওলাওঠা দেবি কিংবা তার শরীরের একটা মাছিও কোনো বাড়িতে ঢুকতে সাহস পায়নি। অথচ আশপাশের কয়েক গ্রামে সেই বছর সাতশ মানুষের জীবন মাত্র তিনদিনেই হরণ করেছিল কলেরা দেবি। এক বাড়িতে বাপকে দাফন করে ছেলে বাড়িতে এসে দেখে মা মরেছে, মায়ের কবর খুড়তেই বউ, বউয়ের পর দুই বাচ্চা- এভাবে বাড়ির সবাইকে যখন কবরে শুইয়ে দিয়ে সে নিজে অসুস্থ হলো, তখন তাকে মাটি দেয়ার জন্য ভয়ে এগিয়ে যায়নি কেউ। কুত্তা-শিয়াল খেয়েছে দুর্গন্ধ লাশ।

এটা যে গল্প নয়, কলেরার মড়কে সত্যি সত্যি ঘটেছিল এরকম, নিজের শৈশবেও তার প্রমাণ পেয়েছিল উমর। গ্রামসমাজে বিপদে-সংকটে সহজে একতাবদ্ধ হয় মানুষ। কোনো বাড়িতে ডাকাত পড়লে কিংবা আগুন লাগলে নিশুতি রাতের স্তব্ধতা চিরে মানুষ আওয়াজ দেয়, তারপর শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে জোট বেঁধে লাঠিসোঁটা হাতে হইরই করে ছোটে সবাই। তেমনি একবার ওলাওঠা দেবির আবির্ভাবের গুজব শুনেই গাঁয়ের পুরনো রীতি স্মরণ করে গ্রামবাসী সবাই বাদ্য বাজাতে শুরু করেছিল। উমরদের বাড়িতে ঘরের টিনের চাল বাজিয়েছে তার বাবা-মা, বালক উমর বাজিয়েছিল নিজের থালখানা, আর তার বড় ভাই উজির, যে এখন পুলিশ হয়েছে, সে একটা খালি টিন ঢোলের মতো বাজিয়ে চিড়েচ্যাপ্টা করে দিয়েছিল। কলেরা ভাইরাসের  চেয়েও করোনাভাইরাস নিঃসন্দেহে ওলাওঠা দেবির  চেয়েও ভয়ঙ্কর, যার ভয়ে দুনিয়ার মানুষ সবাই ঘরে গিয়ে লুকাচ্ছে। কিন্তু বাড়িঘর-স্বজনদের ছেড়ে লকডাউনের শহরে একা উমর ভয়ঙ্কর করোনা দেবিকে কীভাবে মোকাবেলা করবে? ফাঁকা রাস্তায় চলতে গিয়ে কলেরা মহামারিকে ঠেকানোর জন্য  গ্রামের মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের ঐকতান এখনো কানে বাজে উমরের। আবার মাঝে মধ্যে চোখ নিজের বাহনের সিটের দিকেও ফেরায়, প্যাসেঞ্জার বেশে করোনা দেবির ভয়ঙ্কর চেহারা হঠাৎ দেখে ফেলে যদি! গাড়োয়ান দাদার মতো রিকশা রেখে কোথায় পালাবে সে?

৩.

লকডাউনের রাস্তায় মোবাইল ফোন আর মাস্কটা যেদিন উমরের হাত থেকে উড়াল দেয়, সেদিন উমরের রিকশায় গ্রাম থেকে তার বউ পরির মতো উড়ে এসে বসেছিল স্বামীর কোলে। আবার তন্দ্রালু চোখ মেলতেই সাক্ষাত করোনাদেবিকে দেখেই যেন, ভয়ে অন্তরাত্মা কেঁপেছিল তার। ঢোক গেলার সময় শ্বাসনালিতে করোনার কাঁটাও অনুভব করেনি কি? অবিশ্বাস্য ঘটনাটা মনে হলে এখনো ধন্ধ জাগে।

সেদিন ফোনে হোটেলওয়ালি খালাকে মাছভাতের অর্ডার দিয়ে দুপুরবেলা তার ইটালি-হোটেলে গিয়েছিল খেতে। ফুটপাতের হোটেল ভেঙে দিয়েছে পুলিশ, কিন্তু খালা মোবাইলে ব্যবসা করে যাচ্ছে এখনো। টাকি মাছের ঝোল আর মিষ্টি কুমড়ার ভর্তাভাত খেয়ে বেশ তৃপ্তি হয়েছিল। তাছাড়া খালা নিজের বস্তিতে ঘর খালি হওয়ার সুখবরটা জানিয়ে সাহস দিয়েছিল, এই মাসেই লইয়া আয় বউরে। দ্যাশে করোনা-কলেরা যাই আহুক, কাম কইরাই খাওন লাগব আমাগো। একটা না একটা কাম জুটবই।

সুখবরটা বউকে দেওয়ার জন্যই খালি রিকশা নিয়ে রাস্তার নির্জনে একটি গাছতলায় গিয়েছিল উমর। এই শহরে মাথা গোঁজার মতো তার ঘর নেই, আগের বারের মতো মেস-এ সিট ভাড়াও নেয়নি উমর। দুই বেলার জন্য রিকশা নেয় বলে পরিচিত রিকশা-মহাজন গ্যারেজেই বিছানা পাতার জায়গা দিয়েছে। গ্যারেজের গ্যাঞ্জামে আরো পাঁচজনের সঙ্গে ঘুমাতে হয়, তার ওপর মাঝরাতের আগে ঘুমানোর উপায় নেই। বউয়ের কথা ভাবারও সময় পায় না সেখানে। উমর তাই স্ত্রীর সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার জন্য রাস্তার নির্জনতা খোঁজে। সময়-সুযোগমতো এভাবে জরুরি স্ত্রীসঙ্গ করার জন্যই ঢাকায় আসার আগে নতুন ফোন কিনে দিয়েছে আছিয়াকে। স্বামীর ফোন পাওয়ার আশায় মোবাইল সারাক্ষণ কোমরে গুঁজে রাখে আছিয়া। স্বামীর ফোন পেলে নাকি পেটে গুঁতো খাওয়ার মতো আনন্দ হয়, উমরও তাই গুঁতো দেয়ার সুখ খোঁজে। তারচেয়েও বড় কথা  ফোনটা কিনে দিয়েছে বলে বউকে চারবার বিকাশে টাকা পাঠানো সহজ হয়েছে। দিনে দিনেই পাঠানো টাকা ঠিকঠাক হাতে গেছে আছিয়ার।

সেদিনও ফাঁকা রাস্তার ধারে কড়ুই গাছের ছায়ায় উমর নিজেই সওয়ারির আসনে  হেলান দিয়ে বসে সিটে পা মেলে বউকে কল দিয়েছিল। কিন্তু অসময়ে কোমরে স্বামীর সুড়সুড়ি কিংবা ঢাকায় নিজেদের স্বপ্নের সংসার হওয়ার সুখবর শুনেও খুশি হয়নি আছিয়া। ভয়-কাঁপা গলায় বলেছিল, তোমারে করোনা ব্যারামে ধরলে ঢাকা যায়া মুই কার বাল ফেলাইম? ঢাকায় টাকা ধরার নেশা ছাড়ি দিয়া বাড়ি আসতেছে সবাই। গার্মেন্টস-এর শিরিন-হবিরাও আইল, তুমিও আস তাড়াতাড়ি,  মোর খালি ভয় লাগে  গো!

উমর বরাভয় দিয়েছে,  মুখে মাস্ক বাঁধিয়া গাড়ি চালাই। আর কয়টা দিন সময় দে, লকডাউনে ভাও বুইঝা আরো কিছু কামায় লই। তোর আর উম্মির জন্যে শখের জিনিসটা কেনার পর দুই-এক মাস ঘরে বসিয়া খাওয়ার মতো পুঁজি হইলেই, তোরে ঢাকা নিয়া আসুম। তারপর দিনদুপুরেই ঘরের দরজা বন্ধ কইরা লকডাউন- কোয়ারেন্টিন করুম। বুঝিস এইসব নতুন  করোনার আইন?

করোনায় গোটা দুনিযা উলটপালট হলেও ঢাকায় নিজস্ব ঘর-সংসার হওয়ার স্বপ্নটা এখনো ভোলেনি আছিয়া। কারণ উমরের বাপের ভিটায় শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাসুর-জা-ননদ পরিবেষ্টিত হয়ে নিজেদের ছাপরা ঘরের দরজা দিনে লাগানো দূরে থাক, রাতে শুয়েও শান্তি হয় না। সেই তুলনায় ঢাকায় স্বপ্নের ভাড়াঘরেও বসবাসের স্বাধীনতা বেশি, সুখও বেশি হবে অবশ্যই। স্ত্রীর এই মতের সঙ্গে শতভাগ একমত হয়েই উমর এবার ঢাকায় এসেছে। স্বপ্নের ঘরে দিনদুপুরে দরজা লাগানোর মতলব দেখে খুশি হয়েই বউ ভেংচি কেটে বলেছিল, শখ কতো! শোনো, বাড়িতে আইসার সময় আমার আর উম্মির জন্য দুইটা মাস্ক আইনো। মাস্ক পইরাই ঢাকা যামো হামরা। এলায় অকামের আবাল্য-বাহাল্য কইরা ফোনের বিল বাড়াইও না।

বড্ড হিসেবি বউ তার। গ্রামে ছাপরা ঘরে  মেয়েকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে স্বামীর পাঠানো টাকা জমায় ঢাকা আসার জন্যে। ঢাকায় অস্থায়ী সংসার করলেও নতুন করে অনেক কিছু কিনতে হবে। বউকে বিকাশে টাকা পাঠিয়েও তাই ব্যাংকে টাকা জমানোর মতো নিশ্চিন্ত হয় উমর।

৪.

স্ত্রীর স্বপ্ন মনে সংক্রমিত হয়েছিল বলেই বোধহয় উমর ঢাকার রাস্তায় চোখ বুজলেও আছিয়া স্বপ্নে পরির মতো উড়ে এসে স্বামীকে সঙ্গ দেয়। সেদিনও বউয়ের উপস্থিতি উমরের শরীরে শিহরণ জাগিয়েছিল, ঠিক তখন সহসা রিকশার হোগায় পুলিশের রাইফেলের গুঁতো খেয়ে পুরো রিকশাতেই ভূমিকম্প এসেছিল যেন, মুহূর্তেই স্বপ্ন ও তন্দ্রাঘোর কেটে যায় উমরের।

সরকার লকডাউন দিছে কি তোরে রাস্তায় ঘুমানোর লাইগা? যা চোদনার পুত, ঘরে গিয়া যত খুশি নিদ্রা দে।

উমর চোখ মেলে পুলিশকেও যেন চিনতে পারে না, কারণ মুখে তাদের মাস্ক। একজনের মাস্কে দুটি নাক, আর একজনের মাস্কের উপরে চারটি চোখ। ভয়ে এক লাফে রিকশা থেকে নেমেই উমর দেখে তার হাত খালি। হাতে ধরা মোবাইল-মুখোশ ঘুমের ঘোরে হাত থেকে রিকশায় কি রাস্তায় পড়ে গেছে ভেবে খুঁজতে থাকে।
সশস্ত্র শাসককে উপেক্ষা করে রাস্তায় পাগলের মতো কিছু খুঁজতে থাকায় পুলিশ তাকে সত্যই পাগল ভেবেই সম্ভবত আরো ক্ষেপে যায়,  কী বিছড়াস রে তুই? হালায় পাগল নাকি! মাস্ক ছাড়া রিকশায় ঘুমায়।

মোবইলটা ধরতে উমরের চোখ শূন্যে সাঁতার কাটছিল যেন, এবার পুলিশের দিকে তাকালে সন্দেহ চলকায়। পুলিশের সঙ্গে তার ভাই- বেরাদারের মতো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, সম্পর্কটা মধুর করতে সুন্দরগঞ্জ থানায় ডিউটিরত আপন বড়ভাইয়ের রেফারেন্স নয় শুধু, বিশ্বাস করানোর জন্য অনেক সময় ফোন টিপেও কথা বলিয়ে দেয়। তাতে দু’একবার বিপদ থেকেও রক্ষা পেয়েছে উমর। কিন্তু বিপদের বন্ধু ও সার্বক্ষণিক সাথী মোবাইল হারিয়ে উমরের এমন দশা, পুলিশকে বড়ভাই মর্যাদা দিয়েও সন্দেহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে যথাসম্ভব বিনয়ের সঙ্গে অভিযোগটি করে, বুঝছি, আপনারাই আমার ফোন হাতাইয়া মস্করা করতেছেন বড়ভাই! ত্রিশ টাকায় মাস্কটা কিনছি হেইদিন। আর দুই হাজার টাকায় নোকিয়া মোবাইল, বউয়ের লগে কথা কইয়া একটু ঝিমুনি ধরছিল। কী করমু বড়ভাই, ঢাকা শহরে অহনো ঘরভাড়া লইতে পারি নাই। লকডাউনে কই যাই?

এই বেটার মাথা খারাপ নাকি! কে তোর ফোন লইছে?

পুলিশকে চোর-ছিনতাইকারি হিসেবে সন্দেহ করায় এক পুলিশ রেগে গিয়ে বলে, লকডাউনে রাস্তায় ঘুমাস, আবার তোর বাপরে সন্দেহ করস! ক দেখি তোর ফোন নাম্বার কতো?

আইডি কার্ড দেখিয়ে সীমটা কিনেছিল, একমাত্র নিজের নাম্বারটা ইংরেজিতে নির্ভুল মুখস্থ করতে পেরেছে উমর। পুলিশকে তা গড়গড় করে জানায়। পুলিশ তার নিজের ফোন বের করে উমরের দেওয়া ফোন নাম্বারে কল দেয়, ফোন বন্ধ, সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়। পুলিশ তার ফোন উমরের কানে ধরে বলে, তোর এই নাম্বার তো অচল।

কী কন স্যার, আমি একটু আগেই দেশে বউয়ের লগে কথাবার্তা বলিয়া  ফোন হাতে নিয়াই তন্দ্রা গেছিলাম।

উমর আবার নতুন করে রিকশা ও রাস্তার মধ্যে ফোনটা খোঁজে। পুলিশ মন্তব্য করে, বুঝছি করোনার লকডাউনে কামকাজ হারাইয়া সব বেটা মুখোশ পইরা রাস্তায় নাইমা লুটপাটের ধান্ধা করতাছে। সিম খুইলা সেট পাঁচশ টাকায় বেচলেও লাভ। ফের যদি  লকডাউনে রাস্তায় ঘুমাইবি. রিকশাশুদ্ধা তোরেই আগে থানায় চালান কইরা দিমু।

রাস্তায় ডিউটিরত পুলিশ সামনে হাঁটতে শুরু করলে উমর তাদের পেছনের পকেট পর্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। না, পুলিশ মস্করা করে বা ঘুষের নেশায়  উমরের ফোন নিশ্চয় ছিনিয়ে নেয়নি। নিজের ফোন থেকে উমরের মোবাইলে কল দিয়ে ফোনটা না খুঁজলে, পুলিশকেই  হয়তো বাকি জীবন মোবাইলচোর সন্দেহ করত এবং এ কারণে আপন বড়ভাই পুলিশের উপরেও ঘৃণাটা তীব্রতর হতো। পুলিশের মন্তব্যই হয়তো সত্য, রাস্তার কোনো হাইজ্যাকার সুযোগ বুঝে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। উমর তার হারানো মাস্কটার মতো মাস্ক পরে এবং উমরের  মোবাইলের মতো দেখতে ফোনে কথা বলতে বলতে এক ভদ্রলোককে হাঁটতে দেখে চমকে ওঠে। কিন্তু মুখোশের আড়ালে কে সাধু আর কে চোর-বদমায়েশ, কী করে ধরবে সে?

করোনার লডকডাউন আসার পরে শহরের চেনা রাস্তাগুলো যেমন তার কাছে অচেনা হয়ে গেছে, তেমনি ফোনটা হারানোর পর নিজের  গোটা জগত-সংসারই হারিয়ে যাওয়ার শূন্যতা জাগে। একমাত্র নিজের নাম্বারটি ছাড়া বউয়ের নাম্বারও মুখস্থ নেই  তার। অন্তত পঞ্চাশটা নাম্বার নিজের মতো করে ভুলভাল ইংরেজিতে সেভ করে রেখেছিল।  ইংরেজি এ মানে আছিয়া। আর আছিয়ার ফোনে নিজেকে নাম্বার ওয়ানে হিসেবে সেভ করে দিয়েছিল। ওয়ান টিপলে স্বামীকে পেত আছিয়া। এখন জরুরি প্রয়োজনে শতবার ফোন টিপেও স্বামীকে না পেলে মাথা ঠিক থাকবে তার?

ফোন ছাড়া বিদেশ-বিভূঁয়ে একা বাস করা যে কতো কঠিন, সেটা ফোন হারানোর পর সারাক্ষণই মর্মে মর্মে বুঝতে থাকে উমর। সিদ্ধান্ত নেয়, টাকা জমিয়ে বউকে বিকাশ করার বদলে নতুন ফোনই কিনতে হবে একটা।

৫.

খাওয়ার জন্য হোটেলওয়ালি খালাকে ফোনেই অর্ডার দিত উমর। করোনার আগে এই শহরের ফুটপাতে ছিল হাজারো ব্যবসা ও দোকানপাট। ফুটপাত বাণিজ্যে চা-নাস্তা ও ভাতরুটি খাওয়ার অস্থায়ী হোটেলও কম ছিল না। ফরিদুপুরি খালা ফুটপাতে বসে রুটি বানায়, লাকড়ির চুলা জ্বেলে গরম রুটি সেঁকে আর নানারকম চাটনি ও ডিমের মামলেট খদ্দেরদের পরম যত্নে খাওয়ায়। শীতকালের বিকেলে চিতই ও ভাপা পিঠাও করে। এ ছাড়া বাসা থেকে ভাত ও তরকারি রেঁধে আনে। খালার হাতের রান্না ভালো, বেশ পয়পরিষ্কার। দামে যেমন পর্তা পরে, খেয়েও তৃপ্তি। কাস্টমারদের বসার জন্য আলাদা বেঞ্চি ছিল না খালার হোটেলে। পুলিশকে বেশি ঘুষ দিয়ে অন্যদের মতো পলিথিনের ছাদও দিতে পারেনি। তারপরও ইটের উপর কিংবা নিজ রিকশার উপর বসে খাওয়া খদ্দেরের অভাব ছিল না তার। উমর তিন বলো  খেত বলে সম্পর্কটা নিছক বাণিজ্যিক নয়, আপন খালা-ভাগ্নের মতো হয়ে গিয়েছিল। খালার নিজের মেয়ে জামাই-গার্মেন্টেস চাকরি করে, ছেলে গ্রিল কারখানার মিস্ত্রী। উমরের বউকে গার্মেন্টস-এর চাকরি, নিদেনপক্ষে তিন-চার বাসায় কাম নিয়ে দিয়ে মাসে পাঁচ হাজার টাকা কামানোর গ্রান্টিসহ নিজ বস্তিতেই সুপ্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব নিয়েছিল খালা।

লকডাউনে সরকার অফিস-আদালত, সুপারমার্কেট ও সবরকম ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়েছে। পুলিশ ফুটপাতে একটা দোকানও বসতে দেয় না আর। দোকান ভেঙে ঘরে নেয়ার পরও, ঘর থেকেই হোটেল চালাবার চেষ্টা করছে খালা। উমরসহ বেশ কয়েকজন চেনা কাস্টমারের ফোন নাম্বার নিয়েছে নিজের ফোনে, ফোনে অর্ডার পেলেই রান্না করে ফুটপাতের গাছতলায় এসে বসে থাকে। বাড়িতে বউকে প্রতিদিন ফোন না করলেও খাওয়ার প্রয়োজনে খালাকে রোজ  ফোন করতে হতো উমরকে। কিন্তু ফোন হারিয়ে কীভাবে খালার সঙ্গে যোগাযোগ করবে সে? আর খাবেই বা কোথায়?  খালার বাসার ঠিকানাও তো সে জানে না।

প্যাসেঞ্জার নিয়ে কিংবা প্যাসেঞ্জারের আশায় খালি রিকশা নিয়ে ঘোরে যখন, চেনা-অচেনা গলিতে নতুন খাওয়ার দোকান খোঁজে উমর। মহল্লায় মুদি দোকানের পাশে কিছু চায়ের দোকানও আছে। খালাকে না পেলে এরকম দোকানে খেয়েই টিকতে হবে। তৃতীয় দিনে ভাঙা হোটেলের কড়ুই গাছতলায় খালার মতো একজনকে বসে থাকতে দেখে খুশিতে এগিয়ে যায় উমর। এর আগেও খাওয়ার সময় একদিন খুঁজে গেছে, পায়নি। কাছে গিয়েও বিভ্রম জাগে। খালা তো? অনেক মহিলা এখন ভিক্ষা করতে শুরু করেছে।  সঙ্গে খাদ্যসামগ্রী কি পানির জ্যারিকেন নেই, আর মহিলার গায়ে একটি কালো বোরখা। মুখোশ ও রেখাব ঢাকা মুখে  চোখ জ্বলজ্বল করছে। কলেরা দেবির মতো করোনা দেবিকে দেখার ভয় নিয়ে উমর যখন থমকে দাঁড়ায়, খালাই কথা বলে প্রথম।

উম্বর আলী না? তোরে ফোন কইরা পাই না! ব্যাপারডা কী তোর? করোনায় ধরল নাকি?

উমরের জন্য খালাই যেন বেশি উদ্বিগ্ন ছিল। ফোন হারিয়েছে শুনে নতুন করে সিগারেটের কাগজে লেখা নিজের নাম্বার এগিয়ে দেয়। অন লাইন হোটেল ব্যবসা শুরুর পর ভিজিটিং কার্ডের মতো  বেশ কিছু কাগজে নিজের ফোন নাম্বার কারো  দ্বারা লিখিয়ে নিয়েছিল। সেই কার্ড উমরকে  এগিয়ে দিয়ে নিজের দুঃসংবাদ জানায়। ফোনে অর্ডার নিয়ে আর কাষ্টমারদের সেবা করতে পারবে না সে। তাদের বস্তিতে একজনের করোনা হইছে। মেয়ে-জামাইয়ের গার্মেন্টস বন্ধ,  বেতনও বন্ধ। ছেলেরও গ্রীলকারখানা বন্ধ। দেশে চলে যাবে তারা। মাকেও নিয়ে যাবে ছেলে। সবাই কয়, আল্লায় দিছে করোনা আর গরমেন্ট দিছে লকডাউন, ঢাকা টাউনের গরিবরা এবার কবরের মাটিও পাইব না। তুইও দেশে যা উম্বর আলী, দিনকাল ভালো হইলে আমারে ফোন দিস।

উমর সিদ্ধান্ত দেয়, আমাগো মহাজনও তার রিকশা ভাড়া দেয়ার মানুষ পায় না। মাগনা দিলেও আমিও আর রিকশা চালামু না খালা। নতুন একটা ফোন আর বউ-বাচ্চার জন্য দুইটা দরকারি জিনিস কেনার টাকা হইলেই দেশে রওনা দিমু। দোয়া কইরেন।

খালার কাছে বিদায় নিয়ে খালি রিকশা নিয়ে বড় রাস্তার মোড়ে উঠতেই উমর একটি বড় ক্ষেপের প্রস্তাব চায়। সিএনজি বা ট্যাক্সি না পেয়ে এক ভদ্রলোক রিকশায় চেপেই গুলশানে যেতে চায়। উমর সুযোগ বুঝে চারশ টাকা ভাড়া চাইলে বিনা দ্বিধায় উঠে বসে সে। এরকম কিছু মোটা ক্ষেপ ধরতে পারলে উমরের  ফোন কিনতে কয়দিন লাগবে?

৬.

দুই সপ্তাহের মধ্যে টাকা জমিয়ে  এক মার্কেট খোলা পেয়ে বউয়ের জন্য চোখে ধরার মতো রঙচঙা থ্রি-পিস জামা আর মেয়ের জন্য লাল জামা-প্যান্ট কেনে প্রথম। ঢাকায় আসার পর গার্মেন্টস-কর্মী মেয়েদের দেখে বউয়ের জন্য এরকম জামা পছন্দ করেই রেখেছিল। আর শখের থ্রিপিস পোশাকের রঙ ও মাপজোখ  বাড়িতে থাকতেই আছিয়া স্বামীকে বলেছিল অনেকবার, ফোনেও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। টাকা একটু বেশি গেলেও স্ত্রী-কন্যার জন্য মনমতো কেনাকাটা করতে পেরে খুশি উমর। 

ফোন কেনার জন্য খোলা দোকানও খুঁজে পায় একটা। আইডি কার্ডটা সঙ্গে ছিল বলে রক্ষা। হারানো ফোনের নাম্বারসহ নতুন একটা সেট কিনতে মোট খরচ হয় দুই হাজার সাতশ পঞ্চাশ টাকা। পনেরো দিন ধরে বাড়ির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। ভাগ্য ভালো যে, আইডি কার্ডের ফটোকপিতে গ্রামের বিকাশ-এজেন্ট ও মামাতো ভাই মোকসেদের ফোন নাম্বারটা লেখা ছিল। তাকে ফোন করে আছিয়ার নাম্বারটা জোগাড় করে উমর। আছিয়া এতদিন স্বামীর সঙ্গে ফোনে যতবার সংযুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছে, ততবারই যেন বুকখানা ধকধক আওয়াজ দিয়েছে উমরের। বউয়ের হাত ধরার মতো নতুন ফোনটা হাতে নিয়ে নির্জন স্থান খোঁজে উমর। পনের দিন পর আছিয়ার ফোনের চেনা বাজনা বুকেও খুশির শিহরণ জাগায়। কিন্তু আছিয়ার কণ্ঠের বদলে ফোনে তার বাপের চেনা গলা, কীডা রে! কাঁয় হে ফোন দিছো তুমি?

বাবার কণ্ঠে ভয় ও উত্তেজনার কারণ জানতেও দেরি হয় না উমরের। মাত্র পনের দিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় গ্রামে রটে গেছে, ঢাকায় করোনায় মরে গেছে উমর। সংযোগ দিতে অক্ষম উমরের মরা ফোনই বড় প্রমাণ ছিল। কান্নাকাটি করে বৈধব্য শোক প্রকাশ ছাড়া কিছু করার ছিল না আছিয়ার।

উমর ফোনটা বউকে দিতে আদেশ দিলে, বাপ শক্ত কণ্ঠে জানায়, না ফোন বউকে আর দেয়া যাবে না। আজ পর্যন্ত ফোনে বউরে কত টাকা পাঠাইছিস তুই? সেই টাকা কী করল সে, তার কোনো হিসাব নাই। স্বামীরে করোনায় মারিয়া আমার বাড়িতে থাকিয়া দিনরাইত ফোনে কার সাথে গুজগুজ ফিসফাস করে সে? উমরের বুঝতে বিলম্ব হয় না, সে সত্যি সত্যি মরে গেলে বাড়িতে বউকে যে ধরনের গঞ্জনা-লাঞ্ছনা ভোগ করতে হবে, জীবীত থাকতেই তা অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। আর কিছু না পেয়ে হয়তো ফোনটাই কেড়ে নেয়া হয়েছে তার কাছে।

উমর পিতাকেও ধমক দেয়া গলায় হুকুম দেয়, ফোনটা কি আমি কারো বাপের টাকায় কিনছি? উম্মির মায়েরে ফোনটা দেন আগে।

বাপও কম যায় না, আরো দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করে, না এই ফোন আর সে পাবে না। তোর উম্মি হামার ঘরে খায়, টাকার তেজ দেখাস! টাকা পাঠাইলে আমার কাছে পাঠাবি। আর বাঁইচা আছস যদি, বাড়িতে অক্ষণ আসিস না। গ্রামের অবস্থা খুব খারাপ, করোনায় ধরলে গ্রামে তার দাফনকাফনও হইব না কইলাম।

বাপের কাছে বাড়ির খবর শুনে মেজাজ বড় ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বউ-বাচ্চা নিয়ে ঢাকায় থাকার সিদ্ধান্ত তো বাড়িতে থাকতেই পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছিল। বাপের কথা শুনে, শুধু জন্মদাতা বাপ-মা নয়, পৈতৃক সম্পত্তি ও জন্মভূমির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার জন্যই গ্রামে ফেরাটা জরুরি হয়ে ওঠে। যত শিগগির সম্ভব, স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরবে সে।

৬.

অবশেষে ভুতুড়ে শহর ছেড়ে উমর যেদিন গ্রামে রওয়ানা হলো, বাড়ি পৌঁছতে পারাটা হয়ে উঠল বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ বাস-ট্রেন-লঞ্চ তো বন্ধ, আকাশপথে উড়োজাহাজও বন্ধ। রাস্তা খোলা আছে বটে, সেই রাস্তায় কিছু প্রাইভেট কার, মালপত্র নিয়ে ট্রাক ও কভার্ড ভ্যান। অন্যদিকে ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার জন্য আতঙ্কিত হাজার হাজার কর্মহারা মানুষ। পণ্যবাহী ট্রাক-ভ্যানে পাবলিক দেখলেই রাস্তায় পুলিশ আটকায়। সুযোগ বুঝে কিছু প্রাইভেট কার মাইক্রোবাস ক্ষেপ মারতে চাইলে, হুড়োহুড়ি পাড়াপাড়ি শুরু হয়ে যায়।  একটু একটু করে এগোনোর জন্য ডবল ভাড়ায় অটোতে উঠে বসে অনেকে। আবার পায়ে হেঁটেও ছুটছে দলে দলে।

দু’আড়াইশ মাইল পথ পায়ে হেঁটে যাওয়া সম্ভব নয় বলেই উমর ভাঙা যাত্রায় সাভার পর্যন্ত পিকাপ ভ্যানে যায়। সাভারে গিয়ে উপায় খুঁজতে গিয়ে. বগুড়া পর্যন্ত একটি মালবাহি ট্রাকের সন্ধান মেলে। চোরাগোপ্তা কায়দায় ট্রাক ছাড়বে রাতে, প্যাসেঞ্জারকে মালের মতো ত্রিপলে ঢেকে নিয়ে যাবে। প্রতিজনে ভাড়া নেবে তিনশ টাকা। বগুড়া পর্যন্ত গেলে বাকি পথ ভাঙা যাত্রায় রিকশা-অটোতে এবং পায়ে হেঁটেও বাড়িতে পৌঁছতে পারবে উমর। অতএব ট্রাকের প্যাসেঞ্জার হওয়ার জন্য সাভারেই সদলবলে অপেক্ষা করে ।

বাড়ি ও স্বজন ছেড়ে প্রবাস জীবনে একলা থাকার কষ্ট এবারই প্রথম ভোগেনি উমর। বাড়ি রওয়ানা দিলে ঘরে ফেরার আনন্দে পথের কষ্ট মুহূর্তেই উবে যেত।  কিন্তু এবারে করোনা মহামারি মানুষের প্রাণ কাড়ার আগে, সব মানুষেরই ঘরে ফেরার এবং ঘরে থাকার আনন্দ কেড়ে নিতে শুরু করেছে। একা উমর নয়, যমুনা ব্রিজ পেরিয়ে ঘরে ফেরার জন্য অন্তত পঞ্চাশ জন মানুষ একটি ট্রাকে চালের বস্তার উপর নিজেরাও বস্তার মতো গাদাগাদি করে বসে। একটা কালো প্লাস্টিকের ত্রিপলে ট্রাক ঢেকে রাত দশটায় যাত্রা শুরু হয়। ভোররাতে মাল নামানোর মতো যখন গন্তব্যে যাত্রীদের নামানো হয়, শারীরিকভাবে অসুস্থ বোধ করে উমর। ত্রিপলের নিচে বেজায় ঘেমেছে, মুখোশ খুলে শ্বাস নিয়েছে, আবার কখনোবা হু-হু খোলা বাতাসে ঠাণ্ডাও লেগেছে। বাকি রাতটা একটা দোকানের বারান্দায় শুয়েবসে কাটিয়ে দেয়। সকালে আলো ফোটার সঙ্গে শরীরে জ্বর এবং সেই সঙ্গে খুক-খুক কাশিটাও ফোটে। এসব করোনার লক্ষণ বলেই মনে ভয়টা জাগে আরো বেশি। তারপরও অসুস্থতাকে পাত্তা না দিয়ে উমর বাকি পথ ভাঙার জন্য একটা লেগুনায় উঠে বসে।

একবার ঈদের সময় প্রচণ্ড ভিড়ের বাসে উঠে সারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মাথা ঘোরানোর ফাঁক পর্যন্ত পায়নি, মানুষের গায়ের ঘাম ও পাদের দুর্গন্ধে নিঃশ্বাস  নিতে কষ্ট হয়েছে। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে মুক্ত বাতাসে বুকভরা শ্বাস নিয়ে মুহূর্তেই ভুলে গেছে সব দুর্ভোগ। কিন্তু এবারে ঢাকা থেকে রওয়ানা দেবার দেড়দিন পর যখন গাঁয়ের চেনা বাজারে নামে, তখন জন্মভূমির বাতাসও শরীর কাঁপিয়ে দেয়। অতি চেনা বাজারটাকেও সন্ধ্যাবেলায় অচেনা ভুতুড়ে জায়গা মনে হয়। বাজারে নিজের জন্য জ্বর-কাশির কয়টা ট্যাবলেট আর মেয়ের জন্য একটা বিস্কুটের ঠোঙা কিনতে গিয়ে ধরা পড়ে উমর।

অচেনা অষুধের দোকানেও গ্রামের চেনা মজিবর উমরকে দেখে আঁতকে ওঠে লোক জড়ো করে।

আরে তুই না করোনায় মরছস শুনলাম। সরকারি লোক জানাজা ছাড়াই তোরে মাটিতে পোঁতায় রাখছে। এখন বাজারে আইসা করোনার ওষুধ কিনিস, ব্যাপারডা কী?

উমর হাসিমুখে নিজের সামান্য অসুস্থতার জন্য ঢাকার পরিস্থিতি, ফোন হারানো ও রাস্তার দুর্ভোগকে দায়ী করে দুদিনেই সুস্থ হওয়ার কথা বলে জোরগলায়। কিন্তু ততক্ষণে ঢাকা থেকে উমরের করোনা নিয়ে আসার খবর বাজারে দু’কান থেকে দশ কানে রাষ্ট্র হয়েছে, মোবাইলে উমরের বাপ-ভাইয়ের কানেও গেছে সে খবর। বাজারে থাকতেই স্ত্রীর ফোন  থেকে বাপের ক্ষুব্ধ কণ্ঠ আসে আবার, তোরে কই নাই, বাড়িতে অহন আসিস না। গ্রামের অবস্থা খুব খারাপ। তুই বাড়িতে আইলে বাড়ি লকডাউন কইরা আমাগো একঘরে কইরা দেবে সগাই। তুই উজিরের সাথে কথা ক আগে।

বাপের কথা শেষ হতে না হতেই পুলিশ বড়ভাই উজিরের ফোন আসে। উমরের সমস্যা নিয়ে সে গাঁয়ের মেম্বারের সঙ্গে কথা বলেছে। বাড়ি যাওয়ার আগে মেম্বারকে জরুরি ফোন করতে হবে উমরকে। গাঁয়ের চেনা মেম্বার ভাই ফোনেই সমাধান দেয়। সমাধানটা এরকম: গ্রামের আর একটাও চেনা-অচেনা মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার আগে উমর গ্রামের ফাঁকা প্রাইমারি স্কুলে যাক। সেখানেই চৌদ্দদিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। তার বাপকে বলে দিয়েছে মেম্বার, বাড়ি থেকে খাবার-পানি দরকারি বিছনাপত্র স্কুলের গেটে পৌঁছে দেবে তারা।

৭.

কোয়ারেন্টাইন-আইসোলেশন না বোঝার মতো বেকুব নয় উমর। কিন্তু গ্রামে এসেও এরকম পরিস্থিতিতে পড়ার কথা কল্পনাও করেনি সে। গ্রামেও করোনা সংক্রমণের দায় থেকে মুক্ত থাকার জন্য সন্ধ্যার আঁধারে গা ঢাকা দিয়ে চেনা স্কুলটায় যায়। এই স্কুলেই ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে উমর। দুটি তালাবদ্ধ রুম নিয়ে স্কুলবিল্ডিংটা অন্ধকারে ভূতের বাড়ির মতো ফাঁকা সুনশান। মোবাইলের আলো ফেলে একটা ফাঁকা ঘরে কয়েকটা বেঞ্চি, কালো ব্লাকবোর্ড আর বেতসহ মৌলবি মাস্টারকেও যেন দেখতে পায় সে। ক্লাস ফাইভ পাশ করার আগে যে স্কুলটির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেছিল, সংকটকালে  সে আশ্রয় দিয়ে আজ আবার কী শিক্ষা দেবে? উমর ভেবে পায় না। তবে নির্জন স্কুল-ঘরে ওলাওঠা দেবির মতো করোনার রোগী হিসেবে উমর অবস্থান নেয়ায়, গ্রামবাসী দূরে থাক, কাকপক্ষীও স্কুলের ধারে ঘেঁষবে না। বাবাকে ফোন করে সে বিছানাপত্র ও রাতের খাবার পাঠানোর জন্য বউকে হুকুম দেয়।

আশা ছিল উমরের খাবার নিয়ে স্ত্রী-কন্যাই হয়তো আসবে। কিন্তু ফোন করে বাপ তার কাঁথাবালিশ ও ভাত-তরকারি স্কুলের দরজা থেকেও দশহাত দূরে রেখে গেছে। উমরকেই উঠে গিয়ে আনতে হয় সব। বহুদিন পর স্ত্রীর হাতের রান্না খেয়ে ও তার পাঠানো কাঁথাবালিশে শুয়ে রাতটা ভালোভাবেই কাটে উমরের।

পরদিন কাশি ও জ্বরও কম বোধ হয়। রাতে আসেনি, দিনে হয়তো আছিয়া মেয়েসহ স্বামীর জন্য খাবার নিয়ে আসবে। দূর থেকেও বউ-মেয়েকে এক নজর দেখলে মন ভরে যাবে উমরের। অবশিষ্ট টাকা ছাড়াও ঢাকা থেকে আনা উপহার-সামগ্রী আছিয়ার হাতে দিতে পারবে। বাপকে ফোন করে সরাসরি বলেও উমর, উম্মিরে কতদিন দেখি না! দুপুরের খাবার লইয়া ওদের আইতে কইয়েন।

দিনে স্কুলঘর থেকে বাইরে বের হয় না উমর। তার উপর রাস্তা থেকে পরিচিত কণ্ঠে হুঁশিয়ারি দেয়, ও উমর, স্কুলঘর হইতে বাইর হইলে লোকেরা করোনা ভাইরে ঢিলা দিয়া মারব কইলাম।  চৌদ্দ দিনের আগে গ্রামের কাকপক্ষীরেও মুখ দেখাইবি না।

দুপুরের আগে বাবার ফোন আসে,  ভাত-পানি নিয়ে উম্মি স্কুলের দরজার কাছে পর্যন্ত যাবে, মেয়েকে দূর থেকে দেখেই যেন বিদায় দেয়।

উমর দরজায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। উম্মির মুখ গামছায় বাঁধা, মেয়ের মুখখানা ভালো করে দেখতেও পায় না উমর। হাতের খাবারের ভাণ্ড আর পানির জগ নিয়ে পা টিপে এগিয়ে আসে। পেছন থেকে হুকুমদাতা দাদার নির্দেশে স্কুলের দরজা থেকেও বেশ দূরে সব নামিয়ে রাখে।

উমর গলা বাড়িয়ে কথা বলে, উম্মি সোনা, তোমার মায়ে আইল না যে!

উম্মি জবাব দেয়, এইটা তো আমার স্কুল। মায় কি এই স্কুলে পড়ে? কেমনে আসপে?

ঠিক আছে, তুমি আর একটু কাছে আসো। তোমার জন্যে কী আনছি, দেখবা না?

মেয়ে থমকে দাঁড়ায়, বলে, না। তুমি করোনা আনছো।

না মা করোনা না। অনেক ভালো জিনিস আনছি, ঠিক আছে তোমার মায়রে কইও, সবাই ঘুমায় গেলে আমি রাইতে ঘরে গিয়া দিয়া আসপো ।

মেয়ে কী বোঝে কে জানে, ভাতপানি  রেখেই পেছন ফিরে দাদার কাছে ছুটতে থাকে।

গায়ে সামান্য জ্বর নিয়ে উমর টানা তিনদিন ও রাত একা স্কুল ঘরেই বন্দি থেকে কাটিয়ে দেয়। অষুধ খেয়েও জ্বরটা ঘাম দিয়ে না ছাড়ায় ভয় হয়, সত্যই কি অবশেষে করোনাক্রান্ত হয়েছে সে? আক্রান্ত না হলে রক্তসম্পর্কের স্বজন ও গ্রামবাসী সবাই তাকে কুত্তা-বেড়ালের মতো দূর দূর করে কেন?  রাতে স্কুলঘরে জ্বলজ্বলে চোখের একটা বেড়াল দেখে এত ভয় পেয়েছিল উমর, শেষরাতে শ্বাসকষ্টও অনুভব করেছে যেন। সত্যি বেড়াল না অন্য কিছু ছিল ওটা? নির্জন স্কুলঘরে মরে পড়ে থাকলে তার দাফনকাফন করার জন্যও হয়তো কেউ এগিয়ে আসবে না। তারচেয়েও বড় কষ্ট বুকে আছড়ায়, প্রায় ছয়মাস পর নানা দুঃখ-দুর্ভোগের পর বাড়িতে পৌঁছেও বউয়ের মুখ না দেখেই মরে যাওয়া।

সঙ্গরোধক বিচ্ছিন্নবাসের পঞ্চম রাতে স্কুলঘর থেকে চোরের মতো বের হয় উমর। কন্যার কাছে খবর শোনার পর আছিয়া হয়তো রাত জেগে স্বামীর অপেক্ষা করে। গ্রামবাসী সবাই ঘুমিয়ে গেছে, তারপরেও পথে হঠাৎ কারো চোখে পড়লে বউয়ের সঙ্গে দেখা করার জরুরি কারণটা বললে নিশ্চয় দোষ ধরবে না কেউ। পথে কোনো বাধা পায় না উমর। করোনার ভয়ে মধ্যরাতে পেসাব পায়খানা করতেও বুঝি ঘর থেকে বেরয় না কেউ।

উমর  চোরের মতো নিজেদের বাড়িতে ঢুকে সরাসরি নিজের ঘরটার কাছে এগিয়ে যায়। ঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে প্রথমে মেয়ের নাম ধরে ডাকে, তারপর  চাপা গলায় বউকে ডেকে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়।

আছিয়া, আছি, ঘুমাইছস! আমি, আমি আইছি, জরুরি কথা আছে, উঠ। দরজা খুলি দে, দেখ কী আনছি।

নিস্তব্ধ বাড়িতে হঠাৎ ডাকাত-পড়া আতঙ্ক নিয়ে আছিয়া চিৎকার করে, ও বাজান, বাড়িতে করোনা আইছে! করোনায় ডাকে আমারে!

আছিয়ার চিৎকারে বাপের ঘরে ও পুলিশ বড়ভাইয়ের পাকা ঘরেও সাড়া জাগে। পড়শি চাচাতো ভাই চেঁচিয়ে উমরের বউয়ের চিৎকারের কারণ জানতে চায়। আর উমর তখন বিপদ বুঝে বউয়ের জন্য আনা জিনিসপত্রের পলিথিন ব্যাগটি, নিজহাতে লাগানো হাড়িভাঙা আমগাছটির ডালে ঝুলিয়ে রেখে আবার চোরের মতো ছুটে পালাতে থাকে।

স্কুলঘরে ফেরার পর রাতেই উমরের ফোন বাজায় অচেনা নাম্বার। কলদাতা গুরুগম্ভীর কণ্ঠে কোয়ারেন্টাইনের নিয়ম ভেঙে রাতে বাড়িতে হানা দেয়ার কারণ জানতে চায়। উমর কান্নার গলায় বলে, অসুখবিসুখ হইলে এইরকম একলা মানুষ বাস করতে পারে ভাই? তাছাড়া আমার করোনা হয় নাই, এমনি একটু একটু জ্বর। রহস্যময় কণ্ঠ উপদেশ দেয়, শোন, তোরে একটা ভালা বুদ্ধি দেই। সব কাম বন্ধ রাইখা সরকার করোনার দায়িত্ব লইছে। আমাদের উপজেলা হাসপাতালেও করোনা টেস্টের ব্যবস্থা হইছে। তুই ওইখানে গিয়া টেস্ট করা আগে, করোনা হইলেও ওরা চিকিৎসা দিব। চৌদ্দদিন পর ভালো হইযা বাড়িতে ঢুকিস।

ফোনটা মেম্বার-পুলিশ যেই করুক, কথাটা মনে ধরে। মনে হয় এভাবে অন্ধকার স্কুলঘরে একা পড়ে থাকলে সামান্য জ্বরেই স্বজনদের অবহেলা ও একাকিত্বের জ্বালায় সে নির্ঘাত মরে যাবে। ফোনে শোনা সরকারি হাসপাতালে যাওয়াটার উপদেশটিকে দৈববাণী বলে মনে হয় তার।  ঢাকার অনেক হাসপাতালে এখন শুধু করোনা চিকিৎসা হয়। কমলাপুর মুগদা হাসপাতালে এক রুগীকে রিকশায় পৌঁছে দিয়েছিল উমর। নিজের এলাকার উপজেলা হাসপাতালটাও তার চেনা। রিকশা-ভ্যান না পাক, পায়ে হেঁটেও যেতে পারবে। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে, রাতেই রওয়ানা দেয় উমর। যথাশীঘ্র সম্ভব, সরকারি হাসপাতালে এবং সরকারি দায়িত্বে নিজেকে আত্মসমর্পণ করাটাই তার বাঁচার একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়ায়।

৮.

ঘোড়াঘাট উপজেলা হাসপাতালের বারান্দায় করোনার উপসর্গ নিয়ে উমরের মৃত পড়ে থাকার খবরটি একাধিক সংবাদমাধ্যমে বেরিয়েছে। যেহেতু বিশ্বময় টিভি ও খবরের কাগজগুলি করোনার খবরকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়, প্রতিদিন করোনায় আক্রান্ত, মৃত এবং সুস্থতার পরিসংখ্যান ঘটা করে প্রকাশ করে। বাংলাদেশে সরকারি হিসাবের বাইরেও এবং সরকারি  করোনা পরীক্ষার ধার না ধেরেই প্রতিদিন করোনা-উপসর্গ নিয়ে যারা মরছে, তাদের অবস্থান ও মোট সংখ্যাটা অন্তত বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম প্রকাশ করে থাকে। উমরের মৃত্যু যেহেতু ঘোড়াঘাট উপজেলা সরকারি হাসপাতালের বারান্দায় হয়েছে, স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিক ও থানাপুলিশের তৎপরতায় ঢাকা থেকে আগত অসুস্থ রিকশাচালক উমরের নাম-ঠিকানাও উদ্ধার করা হয়েছে। উমরের ডেড ফোনটি চার্জ দিয়ে তার পরিচয় উদ্ধার ছাড়াও তার পিতার সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে পুলিশ। কিন্তু উমরের লাশ নিতে রাজি হয়নি তার স্বজনরা। অগত্যা উমরের দাফনের দায় পুলিশকেই নিতে হয়েছে। আর অবহলের দায় এড়ানোর জন্য মৃত উমরের করোনা পরীক্ষার জন্য তার শরীরের নমুনা সংগ্রাহ করেছে হাসপাতাল কতৃপক্ষ। উমরের ট্রাজিক মৃত্যুর বিবরণসহ একটি অনলাইন সংবাদপত্রে হাসপাতালের বারান্দয় মুখোশপরা মৃত উমরের ছবিও বেরিয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর আগে উমর যে স্বপ্ন-ভালবাসার উপহার তার ঘরের পিছে হাড়িভাঙা আমগাছের ডালে ঝুলিয়ে এসেছিল, সেই বিষয়ে কোনো তথ্য ছিল না কোনো রিপোর্টেই। স্ত্রীকন্যার জন্য আনা স্বপ্ন-ভালোবাসার উপহার যথাস্থানে পৌঁছানোর মরিয়া চেষ্টার পরিণতি নিঃসন্দেহে জেনে যেতে পারেনি উমরও। কারণ তার মৃত্যুর আগেই চার্জ ফুরিয়ে আসায় ডেড হয়ে গিয়েছিল নতুন কেনা ফোনটিও।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়